ঘুম ভাঙলে সবার আগে চোখ যায় সিলিং ফ্যানের দিকে। এক মুহূর্তে সারাদিন কিভাবে, কী দিয়ে কি করব একটা প্ল্যান গুছায় ফেলি। একেকটা দিন পালকের মতো মসৃণ মনেহয়। অবশ্য আমার বেশিরভাগ দিন হয় পাহাড়ের মতো ওজন। ঠিক পাহাড় না। পাহাড় অনড় অটল। আমার কাঁধে চাপে বেতাল। গলা চেপে ধরে। মনেহয় আর পারব না, পারছিনা।
আজ চোখ খুলে প্রথম যেই কথাটা মনে পড়লো তা হলো একটা সিগারেট কেনার টাকাও নাই আমার কাছে।
আম্মু ফোন করতে নিষেধ করে দিছে তাকে। “মাস শেষে একাউন্টে টাকা চলে যাবে। কিন্তু নো ফোন। পারলে নিজে কিছু করে দেখাও। স্বাধীনতা একশোর উপর দিয়ে ভোগ করতেছ…. ”
এমন কথা গুলোই বলেছিল। এমন আম্মু মনেহয় দুনিয়ায় একটাই। যে নিজের মেয়েকে উষ্কে দেয়। কিসের সে উষ্কানি তা বুঝতে সমস্যা হয় না। তবুও আম্মু তো আম্মুই। আব্বুর মত ঝেড়ে ফেলে দেয়নি।
আমি দেখতে নাকি আব্বুর মতো। যদিও আম্মুর মতো হলে বেশি খুশি হতাম। আম্মুর সৌন্দর্য দেখে আমারই ঈর্ষা হয়। আম্মুর গড়ন অনেকটা দেবীর মতো। দূর্গা বা সরস্বতীর মতো না। মন্দিরের গায়ে যেসব দেবী খোদাই করা থাকে তাদের মতো। স্টিল নাউ পদ্মিনীর রূপ-লাবণ্যে আকৃষ্ট করে রেখেছে সে ছেলে বুড়ো সবাইকে।
আমি তেমন না। গায়ের রঙ এক সময় ভালো ছিলো। এর মধ্যে একদিন মলে আম্মুর সাথে দেখা হলো, চিনতেই পারলো না আমাকে কয়েক সেকেন্ড। খুব ধমকালো। এতো কালো, রোগা, বিশ্রী হয়ে গেছি তাই।
‘এতো নেশা করছিস কেন? নিজের যত্ন ভুলে গেছিস সব?’
এটা ঠিক ছোটো বেলায় মায়ের মতো রূপসী হবার জন্য খুব এটা সেটা করতাম ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে।
অবশ্য আমার বন্ধুরা ইনান্না ডাকে। মেসোপোটেমিয়ার রাণী, যুদ্ধ আর যৌনতার জন্য বিখ্যাত।
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালাম। সিগারেট না হলে ফুসফুস ভিজবে না। নিশ্বাসে কষ্ট বাড়তে থাকবে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম অনুভব করি।
নাকে নতুন পিয়ারসিং করাইছি মনে থাকে না। এমনিই এলার্জি আছে নাক সুড়সুড় করে। ঘষা দিতেই রক্ত এসে পড়লো। বাতাসে একটা গালি দিলাম। ইচ্ছা মতো গলা ফাটিয়ে। এইটা হোস্টেলের রুম না যে ফিসফিস করে বলতে হবে সব। । নিজের ভাড়া করা ফ্ল্যাট। ভাড়া অবশ্য নামকাওয়াস্তে।
এলাকা একটু নিরিবিলি আশেপাশে কোন বাড়িঘর নাই। শান্তিতে থাকার মতন পরিবেশ চারদিকে। পাঁচ মাস ধরে ফ্ল্যাটে আছি। ফ্ল্যাট বলা যায় না যদিও। নিচ তলায় গোডাউন। কিসের গোডাউন এখনো জানিনা। দোতলায় একটা ঘর, রান্নাঘর আর বারান্দা। পুরা ছাদটাই আমার বারান্দা। রাত্রে যেদিন দলবল আসে না খুব নিরিবিলি চারপাশ ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যায়, খুব ভালো লাগে মানুষ ছাড়া জীবন।
জীবনে মানুষ দেখতে দেখতে এখন মনে হয় যত কম মানুষ দেখি ততই শান্তি। তবে অত শান্তিও নাই আমার জীবনে।
প্রায়ই সন্ধ্যার পর দলবল নিয়া বারান্দা কাম ছাদে গাজার আসর বসে। পড়াশোনা গোল্লায় গেছে এখানে আসার পর। থার্ড সেমিস্টারে ব্রেক নিতে হইলো। এতো গাজা খেলে কার পড়ালেখা হয়? গাজার সাপ্লাইয়ার এসপির পোলা মুন্নাফ।সোর্স আছে ওর।
প্রতিদিনই আসরে নতুন কেউ না জুটে আইসা। এরিখ দেয় মজমার খাওয়াদাওয়ার টাকা। এই দেড়তলা বাড়িটা এরিখের বাবার। ভাড়া তিন মাসের দিছি। দুই মাস বাকি পড়ছে। কিন্তু তাও হাতের টাকার শেষ হইয়া যায়।
আগে আব্বু টাকা দিতো, আম্মু টাকা দিতো। হোস্টেলে থাকতাম যখন। দুইজনে জেদাজেদি কইরা মধ্যে মধ্যে পাঁচ দশ হাজার টাকা বেশিও দিত।
এখন আর সেই সোনার দিন নাই। এখন হইলো ফকিরা দিন। মাস গেলে বাসা ভাড়া দেই, দেনা শোধ করি তারপর ফকির।
রাত্রে ভয় করবে তোর, বলে এরিখ প্রথম রাতেই আমার সাথে থাকতে চাইলো। আমার ভয় ডর খুব কম। বললাম, ‘কেন ভয় করবে? না ভয় করবে না। তুই যা। ‘
এরিখ দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে বলছিল, ”সব সময় এমন ফোঁসফোঁস করস ক্যান। একটু নরম হইলে তোর কোন খানে কইমা যায়? ‘
তারপর টানা এক সপ্তাহ এইখানে আমার সাথেই থাকলো। অন্য কেউ থাকতে চাইলে ধমকায়। এমন কী গ্রুপের কোনো মেয়েকেও থাকতে দেবে না। বিপদে এক রাত থাকতে চাইলেও না।
এরিখের সাথে আমার পরিচয় এক বছর আগে একটা গাজার আসরে।
ফাঁকে একদিন জয়ন্ত গোপনে আমাকে বললো ওর কোন কাজিন বিদেশে থাকে বিশাল ফার্নিশড ফ্লাট খালি পইড়া আছে। এইখানে কোনো ফার্নিচার নাই, ফ্রিজ নাই, এসি নাই তার চেয়ে ওই বাসায় গেলে ভালো থাকতে পারব।
থাপ্পড় একটা দিতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু দেই নাই। হাতের গুটি বিনষ্ট করতে নাই। বাসা ছাড়ছিলাম পর বহুত কিছু শিখছি জীবনে। চোখের সামনে পিছনে সকল মানুষ গুটি। সবাইকে হাতে রাখতে হয়।
নিজের বাসা ছাড়ার ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু কীভাবে ওখানে থাকা যায় বুঝতে ছিলাম না। জ্ঞান হবার পর আম্মু আব্বুর বিশ্রী ঝগড়া মাইরপিট দেখতে হইতো। বিকালে খেলতে গেলে পাশের বাড়ির আন্টিরা ডাইকা নিয়া বলতো লিলি তোমাকে আইস্ক্রিম খাওয়াবো, পুতুল খেলতে দেবো বাসায় আসো। বাসায় নিয়া খাইতে দিয়া জিজ্ঞাসা করতে থাকতো রোজ রোজ আব্বু আম্মু কী নিয়া এতো ঝগড়াঝাটি করে? ছোটো ছিলাম নিজেও সব বুঝতাম না। বলতাম,
আম্মু হাতাকাটা ব্লাউজ পরে অফিসে যায় তাই আব্বু বকে।
আর মারামারি কখন হয়?
যখন আম্মু বলে কাজের মেয়ে লাইজুকে আব্বু অনেক পছন্দ করে।
আন্টি তখন আরো আইস্ক্রিম দিয়া বলতো, দুইজনই মারামারি করে? বলতাম, হ্যাঁ আব্বু আম্মুকে মারে আম্মুও আব্বুকে…
এরপর এলাকা ছাড়লাম আমরা। কিন্তু লাইজুকে ছাড়ানো গেলো না। আমার সামনে এসএসসি পরীক্ষা আব্বু আম্মু আলাদা হয়ে গেলো। আমি আম্মুর সাথেই থাকতাম। আব্বু অবশ্য জিজ্ঞেস করছিল, লিলি তুমি কি আমার সাথে থাকবা নাকি তোমার আম্মুর সাথে? আম্মু খুব্ বাজে কথা বইলা আব্বুকে বিদায় করছিলো। আমার একটু মন খারাপ লাগতো আব্বুর জন্য। আলাদা হবার পর আম্মুর চাকরিতে প্রমোশন হলো। খুবই সুখী আম্মু বোঝা যেতো।
কিন্তু তখনও প্রায়ই ফোনে ঝগড়া করতো আব্বু আম্মু। একটা সংসার গড়া যেমন কঠিন ভাঙা আরো কঠিন!
সম্ভবত কিছু সম্পত্তি আব্বু আম্মুর নামে করছিলো। ঘুষের টাকার সম্পদ সব নিজের নামে করা যায় না। তাই নিয়ে ঝগড়া। বাসায় লোক পাঠিয়ে গ্যাঞ্জাম করা এইসব অশান্তি লাইগাই ছিলো।
আবার বাসা বদল করলাম মা-মেয়ে। এতো গ্যাঞ্জামের মধ্যেও এসএসসিতে গোল্ডেন এ পাইয়া গেলাম। আম্মুকে বললাম হোস্টেলে দিয়ে দাও আমাকে। আম্মুও মনেমনে তা-ই চাচ্ছিল।
কলেজে উঠেই সিগারেট ধরা। মেয়েদের সাথে মিশতে পারতাম না। সবাইকে কেমন ন্যাকাচোদা মনে হতো। মেয়েরাও আমার সাথে মিশতো না।
মনেমনে বলতাম না মিশলি আমার কী হইলো। আসলে হিংসা করত তারা। আমার মতো বন্ধুদের সাথে হোন্ডায় চড়ে বেড়ানোর সুযোগ ওদের ছিলো না। কলেজে থাকতে হোন্ডা চালানো শেখা হয়ে গেলো আমার। টাকার কোনো অভাব নাই। বন্ধুরও অভাব নাই।
ঘুম ভাঙলে একটা সিগারেট আমার লাগবেই। কী যে করি। দিশাহারা লাগতেছে। এরিখ কখন আসবে কে জানে। হারামজাদা জানে আমার হাতে টাকা নাই। কিন্তু কোনো টাকা দেয় না। আমি নাকি টাকা উড়াই। ধার হিসাবে চাইলে আগে দিতো। এখন তাও দেয় না। গতকাল আসার কথা ছিলো খাবার নিয়া। রাতে কিছুই খাই নাই।
কিন্তু নিকোটিনের অভাব আমার মাথাটা খালি করে দিলো। বোঁবোঁ করতেছে।
আইডিয়া! নিচে দারোয়ান চাচার কাছে একটা সিগারেট নেয়া যায়। বিছনা থেকে নাইমা স্যান্ডো গেঞ্জির উপর একটা টি শার্ট পরলাম। নিচে ট্রাউজার। স্কার্ফও নিলাম। চাচাটার চোখ খারাপ না। মনও ভালো। আমার আব্বুও কোনোদিন এতো সুন্দর কইরা আমাকে মা ডাকতো না। স্যান্ডেল একটা পাইলাম আরেকটা খুঁইজাই পাইলাম না কোথাও।
খালি পায়েই নামলাম। শরীর তখন কাঁপতেছে। রেলিঙ শক্ত হাতে ধইরা নামতে নামতে চোখে পানি আসলো।
আব্বু সেই কাজের মেয়ে লাইজুকে বিয়া করে ফেলছে। চাকরিটা গেছে। কিন্তু কী জানি সাপ্লাই বিজনেস করে টাকা পয়সা আরো বাড়ছে শুনছি। দারোয়ান চাচার দাড়ির চেয়েও বিশাল লম্বা দাড়ি এখন আব্বুর। পাঞ্জাবি পায়জামা পরে। আমাকে পথে পাইয়া একদিন বলছিলো, বাসায় আসতে পারো কিন্তু লাইজুকে তোমার আম্মু বলতে হবে।
এমন মাথা গরম হলো, চিৎকার করে বললাম, একটা মাগীরে জীবনেও আম্মু বলব না।
আব্বু দাঁত কিড়মিড় করে বলছিল, তাহলে আমার দিক থেকে তোমার সাথে আর কোনো সম্পর্ক নাই।
তারপর থেকে টাকাও দেয়া বন্ধ।
এইচএসসিতে এ প্লাস ছিলো। রেজাল্ট যেন কেমনে কেমনে ভালো হইয়া যায়। নিজেও জানি না। তখন অবশ্য হোস্টেলেই থাকতাম। প্রায়ই আম্মুর কাছে হোস্টেল সুপার নালিশ করতো, আপনার মেয়ে খুবই বেয়ারা। এই মেয়ে হোস্টেলের পরিবেশ নষ্ট করতেছে। শেষ পর্যন্ত ওখান থেকে আমাকে বাইর কইরা দিলো। প্রাইভেট ইউনিতে হাফ স্কলারশিপে এডমিশন নিছি।
একটা ছাত্রর বাসায় গিয়ে ওর মায়ের কাছে অভিনয় করে কাইন্দা পড়লাম। উনি থাকতে দিতে রাজী হইলেন। তবে দুই দিনের বেশি না।
তখন দুইটা টিউশানিও করতাম। টুকটাক ফ্রিল্যান্সিং কাজ যোগাড় কইরা দিতো আম্মুর বয়ফ্রেন্ড। টাকার অভাব হয়নাই তখনও।
কিন্তু বাসায় আম্মু উঠতে দেয়নাই আর। বয়ফ্রেন্ড অবশ্য বলছিলো মেয়েটা কোথায় কোথায় ঘুরবে। থাকুক আমাদের সাথে সমস্যা কী?
আম্মু আমাকে আড়ালে নিয়া বললো, ‘হইছো তো একটা আগুন। যেখানে যাবা সব জ্বালায়া দিবা। তার চেয়ে নিজেরে সামলাইতে শেখো। নিজের দায়িত্ব নিজে নাও। টাকা প্রয়োজনে আরো বাড়ায়া দেই।’
আম্মুর আচরণে আমার অবশ্য অত কষ্ট হয়নাই। এক ছাদের নিচে মা মেয়েকে খাওয়ার সুযোগ পাক সেই বয়ফ্রেন্ড নামক সংসারী আধবুড়োটা আমিও চাইনাই। কতো ইয়াং পোলাপান লাইন দিয়া আছে।
নিচে নাইমা দারোয়ান চাচাকে পাইলাম না। ফোন দিলাম চাচা আপনে কই?
চাচা আমতা আমতা করল। তারপর বলে, মা তুমি ওই ঘর ছাইড়া এখনই অন্য কোথাও চইলা যাও।
আমি তাজ্জব, কেন চাচা কী ঘটনা?
আবার আমতা আমতা করে চাচা।
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, কী হইছে বলেন আমাকে।
বলল, এরিখের আব্বারে পুলিশে ধরছে, এরিখ পলাইছে।
আমার মাথা আকাশ ভাইঙ্গা পড়ার অবস্থা। এইজন্য এরিখের ফোন বন্ধ। পরশু আসে নাই, কালকেও না।
চাচাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পাইলাম না। চাচা ফোন সুইচড অফ কইরা দিছে। ঝিম খেয়ে দাঁড়ায়া আছি।
ফোনের মেসেজ এলার্টে ঝিম ধরা কাটলো। বিকাশে অজ্ঞাত কেউ দশ হাজার টাকা দিছে।
আরেকটা মেসেজ, পরে সুবিধা মতো আরো পাঠাবো।
টাকা আসার সাথে সাথে ঝিম ধরাটা কাইটা গেলো। এখুনি ক্যাশ করাইতে হবে। এইখান থেকে তাড়াতাড়ি সরতে না পারলে কখন পুলিশি হাঙ্গামায় জড়ায় পড়তে হবে কে জানে। কিন্তু যাব কোথায়। সিঁড়ি দিয়া উঠতে উঠতে তাই চিন্তা করতেছি