গ্রীষ্মের পড়ন্ত দুপুরে আন্তঃনগর ট্রেনের এসি কামরায় উঠতে পেরে মনসুর আলির বেশ লাগে। গার্ডরা সাধারণত এই কক্ষে যাত্রী ব্যতীত কাউকে প্রবেশ করতে দেয় না। এখানে হকার-ভিক্ষুকের আনাগোনা নিয়ন্ত্রিত। তবুও ফাঁকফোকরে অনাহূত কেউ ঢুকে যায়। মনসুর সেই সুযোগটিই নিয়েছেন। কামরাটি অন্য কামরার মতো নয়। কেউ দাঁড়ানো নেই। দু’একটি আসনও ফাঁকা আছে। মনসুর যাত্রী নন, হকারও নন। তার কাছে বিক্রি করার মতো কিছু নেই। চিপস-বিস্কুট, ছোটোদের বর্ণপরিচয়, ধর্মীয় বই কিংবা মসজিদ নির্মাণের সাহায্যের রশিদ বই কোনোটিই তার কাছে নেই। তার হাতে একটি পুরাতন দোতারা। তিনি গান করেন। সাধারণত শীতকাল হচ্ছে গানের আসরের জন্য ভালো মৌসুম। বড়ো শিল্পীদের আসরে তারও ডাক পড়ে। তবে মাঝ বয়সি মনসুর আলি তত বড়ো শিল্পী নন। কোনো বড়ো শিল্পীর অনুপস্থিতিতে তিনি হয়ত দায়িত্ব নেন। নাহলে গানের আসরে বড়ো শিল্পীদের গানের আগে তাকে গাইতে হয়। তবে বাউল গান গেয়েই তার জীবন চলে। ছয় সদস্যের পরিবার তার ওপর ভর করে আছে। শীত অতিক্রান্ত। এই সময় গানের ডাক আসে কম। মাজারে, উরসে, কোনো কোনো মেলায় গানের আসর হয়। তবে এসবে এখন আর সংসার চলে না।
বাধ্য হয়েই ট্রেনে আসা। ট্রেনে গান গাইতে তার গায়কসত্তায় বাধে। এখানে অনেক ধরনের মানুষ থাকে। একেকজনের একেক রুচি। তার ওপর কারো ইচ্ছে হলে স্মার্টফোনে গান শুনে নেয়। একজন লোকগায়কের গানের জন্য কেই-বা অপেক্ষা করে থাকে। এখানে সম্মানীও পাওয়া যায় যৎসামান্য। তবে ভেবে এইটুকু সান্ত¡না পান যে, গান শুনিয়ে কারো কাছ থেকে চেয়ে টাকা-পয়সা নেন না। কেউ খুশি হয়ে যা দেয়। উপযাচক হয়ে গান শোনাতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তার ইচ্ছের ওপর জীবন চলে না। চার সন্তানের সবাই ছোটো। বড়ো ছেলেটি মাঝেমধ্যে বাবার সাথে গানের আসরে যায়। একটুআধটু গাইতে শিখেছে। ডুপকি বাজাতে পারে। বাবার সাথে গায়। কখনো দোহারের কাজ করে। গান একটু সমৃদ্ধ হয়, শ্রোতারা পছন্দ করে। আজ ছেলেটি তার সাথে ট্রেনে এসেছে প্রথমবারের মতো।
এসির ঠান্ডা হাওয়ায় মনসুর আলির আরামবোধ হবার সাথে সাথে ক্ষুধার অনুভূতিটা জানান দেয়, দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। সান্ত¡নার কথা হলো মনতলা স্টেশন বেশি দূরের পথ নয়। আধাঘণ্টায় পৌঁছা যাবে।
২.
মনসুর আলি এসির কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকান। বিভিন্ন পরিবেশে গান গেয়ে তার এই প্রতীতী জন্মায় যে, যস্মিন দেশে যদাচার। লোকাল ট্রেন হলে হয়ত কোনো এক কোণে দাঁড়িয়ে মনসুর তার মতো করে গান শুরু করে দিতেন। এমনিতে ট্রেনে গান করার সময় একটু জড়তা কাজ করে। হঠাৎ গান শুরু করা যায় না। মানুষের ভিড় থাকে, ট্রেনের শব্দ- সব ছাপিয়ে কণ্ঠ আর যন্ত্রের মিল ঘটানো কঠিন। তবে জীবন তার চেয়েও কঠিন। কঠিন কাজটিই মানুষকে করতে হয়। এসি রুমের পরিবেশটা তার পছন্দ হয়। এখানে সাধারণত যাদের টাকাপয়সা আছে তারা বসেন, সমাজ তাদের ভদ্রলোক বলে। মনসুর যাত্রীদের চোখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছেন। কেউ যদি প্রশ্রয়ের চোখে তাকায়, এই হল আশা। এমন সময় রেলের পুলিশ এসে জোরে ধমক লাগায়- ‘এই গানঅলা, আবার এখানে আইছো, যাও।’ মনসুর অপ্রস্তুত হন– কোথায় যাবেন, যাওয়ার জায়গা থাকলে কেউ এখানে আসে? ছেলে বিলাল ভয় পায়। মনসুর প্রায় চলেই যাচ্ছিলেন, এমন সময় একজন তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি গান করেন?’ মনসুর যেন এই কথাটিরই অপেক্ষায় ছিলেন। এ তো প্রশ্ন নয়, আহ্বান; যেন অনুরোধ! দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে মনসুর জবাব দেন, ‘জি সাব’!
সাদা ফতুয়া আর সাদা লুঙ্গি পরিহিত মনসুর গলায় দোতারাটি ঝুলিয়ে তারে টোকা দিলেন। আজ সাথে আছে তার ছেলে। এ হচ্ছে সংগীতের পরম্পরা। মনসুর গান শিখেছেন তার বাবার কাছে। তিনি গ্রামের হাটে গান গেয়ে ওষুধ বিক্রি করতেন। ধর্মঘর, চৌমুহনী, তেমইন্যা, মনতলা বাজারের এক পাশে কোনো খালি জায়গায় ছোটো বাক্সপেটরা নামিয়ে গান জুড়ে দিতেন। লোকজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে-বসে গান শুনত, গানের ফাঁকে চলত ওষুধ বিক্রি। ওষুধ বলতে গাছের শিকড়-বাকড়, তাবিজ, দাঁতের মাজন, কৃমির ওষুধ ইত্যাদি। কিশোর মনসুর ছিলেন পিতার সহযোগী, বাজাতেন ডুপকি। আজ সে দায়িত্ব এসে পড়েছে ছেলে বিলালে ওপর। তবে মনসুর ওষুধ বিক্রি করেন না। তার জীবন ও জীবিকায় জড়িয়ে আছে গান। বিলাল স্কুলে যায় মাঝে-মধ্যে, বাবার সাথে রোজগারে যেতে হয় বলে পড়াশোনায় নিয়মিত হতে পারে না।
মনসুরের পরিবারই সংগীতের পরিবার। পিতার মৃত্যুর পর মনসুর গান শিখেছেন বাচ্চু বয়াতির নিকট। ওস্তাদ শিল্পী। গানের আসরে মানুষের ঢল নামত। শীতের রাতে ভোর হওয়া পর্যন্ত মানুষ তার গান শোনার জন্য বসে থাকত। বিচ্ছেদ, ছেদা-বিচ্ছেদ, মালজোড়া- শরিয়ত-মারফতের লড়াইয়ে ওস্তাদের জুড়ি মেলা ভার। তার শিষ্য মনসুর। তিনি আজ নেই। তবে তার কন্যা আছে তার গৃহিণী হয়ে। গানে গানেই পরিচয়, সংসার। ওস্তাদ নিজের কন্যাকে প্রিয় শিষ্যের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ওস্তাদের মেয়েকে প্রথম দিকে সম্মান দিয়ে আপনি বলে সম্বোধন করতেন। আজও আপনিতেই রয়ে গেছে। তার স্ত্রীও গান পাগল মানুষ। অভাব-অনটনের সংসারেও গানের মায়া তাদের ছেড়ে যায়নি। তিনি হয়ত প্রয়োজনেই আজ ছেলেকে পিতার সাথে পাঠিয়েছেন।
মনসুর গান ধরলেন। বিচ্ছেদী গান। ‘আরে ও জ্বালা নিভে না রে’। প্রয়োজন সবচেয়ে বড়ো প্রেরণার নাম, মানুষের সেরাটা বের করে আনে। মনসুর দরদ দিয়ে গাইলেন। কণ্ঠে পিপাসা, পেটে ক্ষুধা কিংবা অন্তরে অনন্ত বিরহের এক সত্তার জাগরণের কারণেই হোক মনসুরের চোখ ভিজে আসে। সবুজ মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে চলা ট্রেনের এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় কিছু মানুষের কানে তিনি বিরহের বেদনা পৌঁছে দিতে পেরেছেন বলেই মনে হল। বয়সি শ্রোতা মুগ্ধ হলেন তার দরদি কণ্ঠ এবং নিবেদনে। তার সামনের খালি আসনটিতে তাকে বসতে দিয়ে আরও একটি গান গাওয়ার অনুরোধ করলেন। মনসুর এবার ধরলেন তার নিজের লেখা গান- ‘দেহ গড়লায় যতন কইরা/ মনটা করলায় উদাসী/ বুকের ভেতর বাজে সদায়/ বিরহের বাঁশি।’
ছেলে ডুপকিতে তাল দিচ্ছে ভালোই। ট্রেনের শোঁ-শোঁ শব্দের ভেতরেও মনসুর মুহূর্তটা উপভোগ করছেন, নির্মল এই আনন্দের অনুভূতির জন্যেই সব ছেড়ে দিয়ে সুরের সাধনা বেছে নিয়েছেন। তবে গান শেষ হওয়ার আগেই আবার আসে রেল পুলিশ। সম্ভবত আজ কোনো বড় কর্মকর্তা আছেন ট্রেনে। পুলিশের দুই সদস্য মনসুর এবং তার ছেলেকে জোর করে টেনেহিঁচড়ে দরজার কাছে নিয়ে আসে। হরষপুর স্টেশনে নামিয়ে দেওয়ার আগে অশ্রাব্য ভাষার গালির সাথে হয়ত মনসুরের পিঠে দুঘা লাঠির আঘাতও পড়ে।
আকস্মিক এই ঘটনায় বাপ-ছেলে হতবাক হয়ে যায়। ছেলে চোখ মুছে, ‘দুখ পাইছো আব্বা?’ মনসুর মাথা নাড়েন, ‘নাহ!’ তবে ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। ছেলের কাঁধে হাত রেখে কাছে টানেন। তার দিকে না তাকিয়েই বলেন, ‘তুমার মা’রে কইয়ো না গো আব্বা, কষ্ট পাইবো’।
ছোটো রেলস্টেশনের ফ্ল্যাটফর্মে নীরব কোনো জায়গায় দুজনে অপেক্ষা করে ট্রেনের জন্য, যে ট্রেন তাদের ফেলে যাবে না।