পথ জানা নেই | ছোটগল্প
আমি ফারজানা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্সে পড়ি। আজ আমি ভার্সিটি থেকে আসার সময় একটি ডায়েরি কিনে এনছি। ডায়েরিতে আমি আমার ছোটবেলার বড়বেলার কিছু ঘটনা লিখব বলে মনস্থির করেছি। কি লেখা যায়! আমার জীবন তো অনেক ঘটনাবহুল। এই মুহূর্তে ছোটবেলার কিছু স্মৃুতি মনে পড়ছে। হু পেয়েছি। তবে তাহলে এই বিষয়টা দিয়েই শুরু করা যাক।
আমি তখন ক্লাস টু তে পড়ি। আব্বু তখন আমার জন্য মনসুর নামে গ্রামের একটা লোককে পড়াতে আনেন। মনসুর নাকি ভালো ছাত্র ছিল সেসময়। বিএ পাশ করেছে। এদিকে আব্বু বেশিরভাগ সময় ব্যবসার জন্য বাইরে থাকত। এই সুযোগটা মনসুর খুব ভালোভাবে নেয়। আর আমার আম্মুর চরিত্রও খুব বেশি ভালো ছিল না। আমি তখন নারী পুরুষের সম্পর্ক, প্রেম ভালোবাসা এসব বুঝতাম না। তবে তখন আমরা স্কুলে বর বউ খেলা খেলতাম। আমি একবার মনের মত সাজে বউ সেজেছিলাম। সেবার মনের মত সাজে ফার্স্ট হয়েছিলাম। তো মনসুরকে মামা ডাকার জন্য বলেছিল আমার আম্মু। তাই আমি মামা ডাকতাম। আব্বু তো বাইরে থাকত, যখন মনসুর মামা আমাকে পড়াত তখন আমার আম্মু আমার পাশে এসে বসে থাকত। আম্মু না থাকলে আমার বুকে কখনও কখনও হাত রাখত মনসুর মামা। আমার এটা তখন একদমই ভালো লাগত না। আমি আম্মুকে বলেছিলামও। আম্মুু তখন বলেছিল, আরে এটা তোকে আদর করছে। তুই বুঝিস না কেন! কখনও কখনও আমাকে পড়া দিয়ে ভেতরের রুমে গিয়ে আম্মুর সাথে গল্প করত। কখনো কখনো মনসুর মামা এবং আম্মু শুয়েও থাকত । আম্মুর সাথে বসে গল্প করা অবস্থায় আমি একবার মনসুর মামার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মামা আমাকে পড়াটা বাতলে দেন। মনসুর মামা এবং আম্মু আমাকে ধমক দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন। ভেতরের রুম থেকে আম্মু একদিন ফিসফিস করে বলেছিল, শফিক কিছুই করতে পারবে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার শিশুমনে তখন এই ধারণা হয়েছিল যে, ভালোবাসি এই কথাটা তো শুধু আমার আব্বুকেই বলতে পারে আম্মু। এভাবে অনেক দিন চলছিল। একদিন হঠাৎ আব্বু এসে দেখে ফেলে ব্যাপারটা। আব্বু তো রেগে মেগে আগুন। তিনি কিছুতেই আর মনসুর মামাকে আমাকে পড়ানোর জন্য রাখবেন না। আব্বু মনসুর মামাকে বললেন, তোমার আর পড়ানোর দরকার নাই। তিনি দুই মাসের টাকা এডভান্স দিয়ে বিদায় হয়ে যেতে বললেন। মনসুর মামা আব্বুর এই কথাগুলো মেনে নিতে পারল না। তিনি প্রতিক্রিয়া দেখালেন। তিনি বললেন, আপনার মেয়েকে না পড়ালেও আমি এখানে আসব। এখানে আমার অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। আব্বু বললেন, এখানে কিসের অধিকার তোর ? আমার বউয়ের সাথে ইটিশ পিটিশ বন্ধ কর। তোকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম। তুই আর আমার বাড়ীতে আসবি না। কিন্তু মনসুর মামার ভাবভঙ্গি এমন যেন আব্বুর কোনো ওয়ার্নিংকে পাত্তাই দিলো না।
আব্বু সেদিন বাড়িতেই ছিল। সেদিন ব্যবসার কাজে বাইরে যায়নি। মনসুর মামাও সেদিন বাড়িতে আসল। আব্বু মনসুর মামাকে দেখে তো রেগে মেগে আগুন। আব্বু খুব কঠোর গলায় জিজ্ঞাসা করে, এই তোকে না নিষেধ করেছি; এই বাড়ীতে না আসার জন্য। তারপরও তুই কেন এসেছিস? মনসুর মামা বলল, আমি না আসলে কে আসবে! মনসুর মামাও আব্বুকে তুই করে কথা বলে। তিনি বললেন, তোর বউকে জিজ্ঞাসা কর না! আমি কেন আসি। আব্বু তাকালো আম্মুর মুখের দিকে। জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার, তুমি কি ওকে আসতে বলেছ? আম্মু ভয় না পেয়ে বলল, আসতে বলেছি, ওকে আমি পছন্দ করি।
আব্বু বলে, কি বলিস খানকি বেটি?
আম্মু বলে, এই গালি দিবি না একদম।
আব্বু আম্মুর ঝগড়াঝাটি খুব চরমে লেগে গেল। একপর্যায়ে আম্মু বলে, আমি ওকে বিয়ে করেছি। কি করতে পারবি দেখা।
আব্বু যেন অবাক হল। তারপর বলল, কি তুই বিয়ে করেছিস মনসুরকে?
আম্মু বলল, তো কি হয়েছে?
এই কথা শুনে আব্বু রেগে মেগে আগুন। অন্যদিকে মনসুর খুব শান্ত নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি যেন আব্বু আম্মুর তামাশা দেখছেন।
আমরা পরে জানতে পেরেছি মনসুর মামা আমাকে পড়ানোর তিন মাসের মাথায় আম্মুকে বিয়ে করেছেন।
আব্বু আম্মরু ঝগড়াঝাটি দেখে আশেপাশের লোকজন সবাই ভিড় করে আমাদের বাড়ির উঠানে। সবাই তামাশা দেখছিল। কেউ কেউ এসব ঘটনা দেখে নিজেরা নিজেরা মজা নিচ্ছিল। আমি ছোট ছিলাম তারপরও এসব বুঝতে পেরেছিলাম।
ঝগড়াঝাটির এক পর্যায়ে মনসুর মামা আব্বুকে কিলঘুষি মারতে থাকে। কিন্তু কেউ সেদিন আব্বুর পক্ষে কথা বলতে বা আব¦ুকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। মারতে মারতে আব্বুর গায়ে থেকে রক্ত বের হয় প্রচুর। তিন দিন পর আব্বু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে মারা যান। আর আমাকে এতিম করে যান। আব্বু মারা যাওয়ার পর পুরো গ্রামজুড়ে কয়েকদিন পর্যন্ত লোকজন এই বিষয়ে আলোচনা করেছিল। আমি তখন আমার মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
আঠারো বছর আগে আমি এই ভয়ংকর ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আব্বু মারা যাওয়ার পর আম্মু মনসুর মামার সাথে থাকতে শুরু করল। আব্বু বাড়ীটা আম্মুর নামেই লিখে দিয়েছিল। সেজন্য কেউ কিছু করতে পারেনি। এরপর আমি বড় চাচার বাসায় থাকতে শুরু করি। বড় চাচা তখন কুমিল্লায় একটা এনজিওতে চাকরি করতেন। আমাকে কুমিল্লার লাকসামে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেখানেই পড়াশোনা করেছি। পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করি। চাচার বাসায় থাকার সময় চাচী প্রায়ই এটা সেটা নিয়ে আমাকে খোঁটা দিত। কটাক্ষ করে কথা বলত। সেগুলো মাঝে মাঝে আমাকে কষ্ট দিত। তবুও আমি চাচা চাচীর কাছে কৃতজ্ঞ যে, তাদের বাসায় আমি আশ্রয় পেয়েছি। তারা আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন। চাচী এক সময় আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাচার সহযোগিতা আর আমার পড়াশোনার প্রতি অসম্ভব দৃঢ়তা আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। আমি এখন বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ফরেন ক্যাডার হওয়া আমার স্বপ্ন।
এক সময় আমার মনে হয়েছিল সুইসাইড করে ফেলি। কিন্ত ভাবলাম, সুইসাইড করে কি হবে! আল্লাহর কাছে গুনাহগার বান্দা হিসেবে বিবেচিত হব। কষ্টগুলো চাপা রেখে বড় হয়েছি।
আমার মা আমাকে ছোটবেলায় কাছে রাখলো না। তবে তিনি যে আব্বুর সাথে প্রতারণা করেছিলেন সে শাস্তি আল্লাহ তাকে দিয়ে দিয়েছে। শুনেছি, মনসুর মামার সাথে আম্মুর বিয়ের দুই বছরের মাথায়ই মনসুর মামা আরেকটা বিয়ে করে নেয়। আর আম্মাুকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। আব্বু মারা যাওয়ার পর আম্মু ওই বাড়ীর মালিক হয়ে যায়। এরপর মনসুর মামা আম্মুর সাথে প্রতারণা করে আম্মুর বাড়িটা নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেয় এবং আম্মুকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। মনসুর মামা এখন আমার জন্মদাতা বাপের বাড়ীতেই থাকেন।
ওই যে চলে আসলাম আঠারো বছর আগে, আর তো ফিরে যাইনি ওই বাড়িতে। মায়ের সাথেও আর যোগাযোগ হয়নি। আমি যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম, চাচা চাচীও দেখা সাক্ষাৎ করতে বলেছিল আম্মুর সাথে কিন্তুু আম্মুই তখন আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর আমার আম্মুু এখন মানুষের বাড়ীতে কাজ করে।
আজ এই পর্যন্তই। বাকিটুকু অন্য সময় লিখব।
আমি ভাবি আমার মতো দুর্ভাগা এই পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছে।