যুদ্ধ | ছোটগল্প
১
‘রাশিয়া তো ইউক্রেনে হামলা করে বসল, শাহরিয়ার।’
‘হ্যাঁ। কয়েকদিন ধরে রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে একটা গ্যাঞ্জাম চলতেছে দেখলাম। আসলে ঘটনাটা কি? যুদ্ধটা কেন লাগল বলতো, রুবেল?’
‘এই যে ন্যাটো নিয়ে। রাশিয়া চায় ইউক্রেন যাতে ন্যাটোতে যোগ না দেয়।’
‘ইউক্রেন ন্যাটোতো যোগ দিলে রাশিয়ার সমস্যা কি?’
‘সমস্যা আছে বন্ধু। রাশিয়ার বহুত সমস্যা।’
‘বল তো দেখি, কী সমস্যা?’
‘ধর, ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে চলে আসে তাহলে সেটা রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের উপর হুমকি হবে।
কেমন হুমকি?’
‘তখন ন্যাটোর সামরিক বাহিনী রাশিয়ার কাছাকাছি চলে আসবে। এই জন্যই মূলত রাশিয়া হামলাটা করেছে। আর দেখ, আমেরিকা কিন্তু উসকাইতেছে। আর ইউক্রেনকে বলতেছে, আমরা তোমাদের সাথে আছি।’
‘আামেরিকা সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে বলে তোর মনে হয়?’
‘নাহ। আমার মনে হয় আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না। যদি আমেরিকা যুদ্ধে জড়ায় যায় তাহলে তাহলে বিশ্ববাসী আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ দেখবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাবে।’
‘হ্যাঁ, আমারও তেমন মনে হয়।’
২
রুবেল আজও চা দোকানে বসে আছে। সাথে আছে শাহরিয়ার। রুবেল শাহরিয়ারকে বলছে, দেখ ছেলেটা কি বলছে। ফেসবুকে একটা ভিডিওতে ইউক্রেনে থাকা এক বাংলাদেশী ভিডিও বার্তায় বলছে, ‘আমি ইউক্রেনের খারকিভ শহর থেকে বলছি। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যে সংকট চলছিল তা এখন আরও সিরিয়াস অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। আজ ভোর পাঁচটা থেকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল থেকে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমার বিনীত অনুরোধ খারকাভ এলাকার যেসব বাসিন্দা রয়েছেন তারা সাবধানে থাকবেন। শিক্ষার্থীরা নিরাপদে থাকবেন। সুযোগ পেলে ইউক্রেন থেকে পশ্চিম ইউক্রেনে চলে যাবেন। গতকাল ইউক্রেন সময় রাত ১১ টায় বাংলাদেশ অ্যাম্বাসীর সঙ্গে একটা মিটিং হয়েছে। সবাই যেন সেফ জোনে চলে যায়। কেউ যেন দেরী না করে। আপনারা যারা খারকাভ শহরে আছেন, ওডেসা ও সুমিতে যারা আছেন তারা যেন দ্রত পশ্চিম ইউক্রেনে চলে যায়। আমরা প্রায় দেড় হাজার বাংলাদেশী ইউক্রেনে উদ্বেগ উৎকন্ঠা, অনিশ্চয়তায় দিন রাত পার করছি। ঘুম নেই চোখে মুখে। রাশিয়ার মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছি। অনেকেই ব্যবসা পড়াশোনা ছেড়ে দেশে ফেরার কথা ভাবছে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমরা সবাই যেন নিরাপদ ও সুস্থ থাকি সেই কামনা করবেন। আল্লাহ হাফেজ।
রুবেল ভিডিওটা দেখে বলল, ‘দেখছস, বাংলাদেশিদের কী অবস্থা! রাশিয়ার এই হামলা কত বাংলাদেশির জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে।’
শাহরিয়ার বলে, ‘তুই শুধু বাংলাদেশিদের কথা ভাবতেছস! শোন, সাধারণ জ্ঞানের বইতে পড়েছিলাম ইউক্রেনকে বলা হয় ইউরোপের রুটির ঝুড়ি। পুরো ইউরোপের খাবারের যোগানদাতা ইউক্রেন। শুধু বাংলাদেশ না সারা বিশ্বে মানুষের জন্য খাদ্য সংকট তৈরী কররে এই যুদ্ধ।’
পাশে বসে আছেন হাশেম মাস্টার। বিকালের সময়টাতে মাস্টার সাহেব চা দোকানে আসেন। আড্ডা দেন। চা খান। অনেক জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানী হওয়ায় এলাকার মানুষজন তার কাছে দেশ বিদেশের বিভিন্ন খবর জানতে চায়।। কারণ তিনি ইন্টারনেটে বিভিন্ন বিদেশী পত্রিকা পড়ে থাকেন। তিনি বসে বসে রুবেল আর শাহরিয়ারের কথা শুনছিলেন। তাদের কথা শুনে তিনি বললেন, ‘দেখ, আর্থিক সামর্থ্য ও সামরিক ক্ষমতায় রাশিয়া ইউক্রেন থেকে অনেক বড় সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রতিপক্ষ যখন ন্যাটো তখন তাদের ক্ষমতা ও সামর্থ্যরে ফারাক বিপুল। ফলে নিজের সর্বনাশ না করে এই অসম যুদ্ধ লম্বা সময় ধরে চালিয়ে যাওয়া রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। ইউরোপের এক পত্রিকায় লিখেছে, রাশিয়ার এই অভিযান যদি দুই বছর স্থায়ী হয় তাহলে রাশিয়ার অর্থনীতি ১৪ শতাংশ হ্রাস পাবে। বেকারত্ব বাড়বে। সঞ্চয় মূল্যহীন হয়ে পড়বে। বিদেশী জিনিসপত্র বাজার থেকে উধাও হয়ে যাবে। রাশিয়া মূলত তেল গ্যাস নির্ভর একটি অর্থনীতির দেশ। যুক্তরাষ্ট্র তেল গ্যাস রপ্তানির কথা ভাবছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে রাশিয়ার অর্থনীতি আরও দ্রত হয়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। অন্য কথায় গত বিশ বছরে পুতিন রাশিয়াকে আর্থিক ও সামরিকভাবে যেখানে নিয়ে গেছেন; এই যুদ্ধ তাকে সেখান থেকে তাকে বহুদূরে ছুড়ে ফেলে দিবে। তিনি আবার ১৯৯০ সালে ধ্বংসপ্রাপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের এক নতুন সংস্কারণে পরিণত হবেন। তা সত্তে¡ও যুদ্ধের মযদান থেকে প্রস্থান করা সম্ভব নয়। এটি কেবল ব্যক্তিগত ইগো নয়। পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার মর্যাদার সঙ্গে জড়িতও।
রুবেল জিজ্ঞাসা করে, ‘তাহলে সমাধান কি চাচা?’
মাস্টার সাহেব আবার বলতে শুরু করেন, ‘পেপারে দেখলাম, আমেরকিান পলিসি মেকাররা বলতে শুরু করেছে, পুতিন ক্ষমতা থেকে সরে না গেলে সংকট মিটবে না। আকারে ইঙ্গিতে কেউ কেউ ক্ষমতা দখলের কথা বলতে শুরু করেছে। রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত নিউইয়র্ক টাইমসের কলাম লেখক রস ডাউহাট লিখেছে, পুুুতিন যতই কর্তৃত্ববাদী হোক না কেন, দেশের অর্থনীতি গাড্ডায় পড়ে গেলে তিনি রেহাই পাবেন না। টিকে থাকার জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় সেনা সমর্থনের উপর নয়, আলগার্ক নামে পরিচিত রাশিয়ার ধনকুবেরদের উপর। রাশিয়া যদি একঘরে একটি প্যারিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয় তা এদের কারো পছন্দ হবে না। বিস্মিত হওয়ার কিছুই থাকবে না যদি এদের হাতে শেষ ঘন্টা বেজে ওঠে।’
৩
রুবেল আজও চা দোকানে বসে টিভির খবর দেখে। খবরে দেখায়, ইউক্রেনে বাংলাদেশি ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজ রকেট হামলার শিকার হয়েছে। এতে জাহাজের এক ইঞ্জিনিয়ার নিহত হয়েছে। নিহত ইঞ্জিনিয়ারের নাম হাদিসুর রহমান। তিনি ওই জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার।
রুবেল মনে মনে ভাবতে থাকে, এই যুদ্ধের মধ্যে জাহাজটি ইউক্রেনে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা দেখি না।
টিভিতে নিহত ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুরের ভাইকে দেখানো হয়। হাদিসুরের ভাই বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই আমার বাবা বাকরদ্ধ হয়ে যায়। মা বেঁহুশ। গতকাল সকালেও ভাই আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ভাই সে সময় ফোনে বলেছিলেন, ভাই আমাদের আর ভাঙা ঘরে থাকতে হবে না। বাড়িতে এসে যেভাবেই হোক ঘরের কাজ ধরব। ফোনালাপে ইউক্রেনে বোমা, গুলির শব্দ ও যুদ্ধেও অবস্থা নিয়েও কথা হয়।’ হাদিসুরের ছোট ভাই আরো বলতে থাকে, ‘সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই যাতে আমার ভাইয়ের লাশ দেশে আনা হয়। এক নজর দেখার জন্য হলেও আমার ভাইয়ের লাশটা শুধু দেখতে চাই।’
৪
রুবেল দেখে, টিভিতে জাতিসংঘ মহাসচিব বক্তব্য রাখছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেসে তার বক্তব্যে বলেন, ‘যুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়েছে। প্রভাবটা পড়েছে পদ্ধতিগতভাবে। খাদ্য এবং জ্বালানির ঘাটতি আর অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছেন বিশ্বের অন্তত ১৭০ কোটি মানুষ। যাদের এক তৃতীয়াংশই এখন দারিদ্র্যে দিন কাটাচ্ছেন। এই মুহুর্তে বিশ্বের অন্তত ৩৬ টি দেশ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ, কারণ ওই ৩৬ টি দেশ তাদের গমের গমের চাহিদার অর্ধেকই রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে সরাসরি আমদানী করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘খাদ্য এবং জ্বালানীর সংকট অনেক দরিদ্র দেশকে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা খুবই শংকার কথা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না হলে সংকট ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। পরিস্থিতি এমন হতে পারে যা আমাদের এই বিশ্ব হয়তো সামাল দিতে পারবে না। এখনই কিছু একটা করতে হবে আমাদেরকে।’
রুবেল ভাবে, কিছুদিন পর পর যুদ্ধ লাগে। যুদ্ধ আর ভালো লাগে না। বিশ্বের মানুষ একটু শান্তিতে ঘুমাতে চায়। পরাশক্তি দেশগুলো নিজেদের শক্তি জানান দিতে পৃথিবী ধ্বংসকারী অস্ত্র নিয়ে একে অপরের দিকে ঝাাঁপিয়ে পড়ছে। যার বলি হচ্ছে কোটি কোটি নারী, পুরুষ, এবং শিশু। পৃথিবী মানুষের হোক।