অথৈ জলে ভাসি
তখন ছিল ভরা বর্ষাকাল । খাল, বিল, নদী, মাঠ, ঘাট সব জলে ভেসে গেছে। মা’র হাতের কড়া করে লেখা একটি পত্র পেলাম। আমাকে বাড়ি যেতে হবে। কি জন্য বাড়ি যেতে হবে পত্রে তার কোনো উল্লেখ নাই। শুধু বলেছে ‘পত্র পাওয়া মাত্র চলিয়া আসিবে। কোনো রূপ দেরি করিবে না।’
আমি নতুন চাকুরি নিয়েছি। তারপরেও মায়ের ডাক , যেতেই হবে। চাকুরি চলে গেলেও যেতে হবে, চাকুরি থাকলেও যেতে হবে। তবে এরূপ কোনো কিছু হয় নাই। কর্তৃপক্ষ আমাকে পাঁচ দিনের ছুটি দিয়েছে।
আমি ভূয়াপুর থেকেই দেখতে পাই রাস্তার দু’পাশে বানের জলে থৈথৈ করছে। ভরা যমুনার উপর দিয়ে লঞ্চে যেতে যেতে যখন সিরাজগঞ্জ শহরে পৌঁছি তখন বিকাল হয়ে যায়। শহরের বাহিরগোলা থেকে কাটাখালী নদীর উপর দিয়ে নৌকায় আমাদের বাড়ি যাওয়া যেত। আমি ছইওয়ালা একটি ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করি। অথৈ জলের উপর দিয়ে ডিঙ্গিটি ভাসতে ভাসতে যখন বাড়িতে পৌঁছে তখন সন্ধ্যা গত হয়ে যায়।
রাতে মা যখন আমাকে খাবার খাওয়াচ্ছিল — তখন তিনি বললেন- ‘ ইউনুস ঘটক একটি পাত্রীর সন্ধান দিয়াছে। বংশ মর্যাদা নাকি ভালো। শুনিয়াছি মেয়ে খুবই রূপবতী। কালকে তোমাকে নিয়া সেই মেয়ে দেখিতে যাইব। আমি মনস্থির করিয়া রাখিয়াছি, মেয়ে যদি পছন্দ হয়, তবে এই মেয়ের সাথেই তোমার বিবাহের কথা পাকাপাকি করিয়া আসিব।’
আমি বিদ্যাসাগরের মতো মাথা নেড়ে মাকে আমার সম্মতি জানিয়ে দিলাম।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম — মা’কে তো সম্মতি জানিয়েই দিলাম। মেয়ে দেখতে না জানি কেমন হয়, সেই কথাই ভাবছিলাম। যদি পছন্দ না হয়, যদি দেখতে অসুন্দর হয়, তখন তো মার উপর দিয়ে কথা বলতে পারব না। মা যাই পছন্দ করবে তাই আমাকে বিবাহ করতে হবে। জীবনে বড়ো আশা করেছিলাম — আমার বউয়ের চোখ হবে বনলতা সেনের মতো স্নিগ্ধময়, কুচবরণ কন্যার মেঘবরণ কেশের মতো কালো লম্বা চুল হবে, অনঙ্গ বউয়ের মতো লাবণ্যময় মুখ হবে, চাঁপাডাঙ্গা বউয়ের মতো লক্ষ্মী হবে, আর আনোয়ারা উপন্যাসের নায়িকার মতো সতি সাধবী হবে। এই সব কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে যাই।
পরের দিন একটি পানসি নৌকা এসে ঘাটে ভেঁড়ে। নিকট পরিজনদের মধ্যে একটি সাজ সাজ রব উঠল। আমার বিয়ের কন্যা দেখতে যাবে। সবাই সুন্দর সুন্দর কাপড় পরিধান করল। মা, বড়ো বোন, ভাবীসহ আট দশ জন হবে। যেহেতু এটা শুধুই কন্যা দেখা তাই আমাকে কেবল পায়জামা আর পাঞ্জাবী পরতে হলো। আমরা সবাই গিয়ে নৌকায় উঠি, তারপর নৌকা ছেড়ে দেয়।
নৌকাটি কখনো মাঠের জলের উপর দিয়ে, কখনো খাল দিয়ে, কখনো নদীপথ দিয়ে পৌঁছে যায় ব্রহ্মগাছা গ্রামে। এই গ্রামের পাশ দিয়ে যমুনার একটি শাখা নদী বয়ে গেছে। যার নাম ইছামতী নদী। ভরা বর্ষার মৌসুমে নদীটি খরস্রোতা থাকে। দুপুরের ঠিক পরপরেই আমাদের নৌকাটি শেখ বাড়ির ঘাটে পৌঁছে যায়। বাড়ির অন্দরমহলে তখন উৎসবের আমেজ। আমাদের বসার ব্যবস্থা বাড়ির খাস মহলেই করা হয়েছে।
একসময় খাওয়া পর্ব শেষ হয়। এবার কন্যা দেখানোর পালা।
আমরা ঘরের মধ্যে বসে আছি। জরী করা লাল রংয়ের জর্জেট শাড়ি পরে ঘোমটা টেনে একটি মেয়েকে আমাদের সামনে আনা হলো। কেউ একজন তার ঘোমটা খুলে দিল। উন্মোচন হলো মেয়ের মুখখানি। কেউ দেখছে চুল, কেউ দেখছে নাক, কেউ দেখছে ভ্রূ। কেউ দেখছে চোখ, কেউ দেখছে ওর উচ্চতা- কেউ দেখছে মেয়ে কেমন করে হাঁটে। দেখছে গায়ের রং কেমন, দেখছে হাসিতে গালে টোল পড়ে কী না, দেখছে মুক্তার মতো দাঁত কী না। আমিও দেখলাম মেয়েটিকে।
ওর নাম শোভা।
শোভা দেখতে বেশ সুন্দরী, হাসিতে মুক্তা ঝরে, ডাগর ডাগর চোখ, নির্মল ওর মুখশ্রী। কিন্তু আমার চেতনার রংএর সাথে ওর রং মিলল না। আমি যাকে এতদিন খুঁজেছি, এই পৃথিবীর পথে পথে– এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়। আমার চোখ বিনম্র হলো। কোনো কথা বলছিলাম না। আমি মাঝে মাঝে দেখছিলাম- শোভার পাশে বসে থাকা ওর ছোট বোন প্রভাকে। আমার চেতনার রংএর সাথে এই মেয়ের রং মিলে গেছে। এ যে দেখছি সেই মেয়ে— যাকে আমি এতদিন এই পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে, গ্রামে, গঞ্জে, শহরে ও জনারণ্যে খুঁজে বেড়েয়েছি।
আজ আর কোনো মতামত মেয়ে পক্ষকে জানানো হলো না। সন্ধ্যা রাতের মধ্যেই আমাদের নৌকা বাড়ির ঘাটে এসে পৌঁছল। আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। ভাবী এসে টিপ্পনী মারল– ‘হায় আল্লাহ, দেখতে না দেখতে ধ্যান শুরু হয়েছে।’ আমি কিছুই বললাম না। রাতে যখন খেতে বসেছি মা তখন বলল- ‘কন্যা আমার ভারি পছন্দ হইয়াছে। আমি এই মেয়েকে আমার বউমা করিয়া ঘরে তুলিয়া আনিব।’
আমার মন খারাপ দেখে মা প্রশ্ন করে — ‘তোমার কি কন্যাকে দেখিয়া পছন্দ হয় নাই ?’
তখন আমার খাবার খাওয়া শেষ হয়েছে। হাত ধুতে ধুতে বললাম — ‘তোমরা যে মেয়েকে পছন্দ করেছ, তাকে আমার পছন্দ হয় নাই। পছন্দ হয়েছে প্রভাকে।’
এই বলে আমি আমার ঘরের ভিতর চলে আসি।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম সেই ত্বন্নী তরুণী প্রভার কথা–
কি চঞ্চলা তোমার চোখ, বাঁকা চোখে চেয়ে তুমি কাকে দেখেছিলে মেয়ে ?
তোমার চোখেই বনলতা সেনকে আমি দেখলাম
আমার সারা জনমের চেয়ে থাকা তোমার চোখেই স্থির হয়ে গেল, এত অথৈ জল ভেঙ্গে আমি যেয়ে তোমাকেই দেখলাম —
এই মেয়ে তো আমার জন্ম জন্মান্তরের,
ছায়া শীতল ইছামতী নদীর তীরে জলবতী মায়াবতী এই মেয়ে আমার জন্যই জন্মেছে।
আবার মনটা এই ভেবে বিষণ্ণ হল শোভা’র জন্য । ওতো কোনো অন্যায় করে নাই। আমি রাজি হলেই শোভা’ও আমার বউ হতে পারে। ওতো স্বপ্ন দেখতে পারে এই রকম করে —
‘এ কোন্ ধ্রুবতারার ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আমার আকাশে তুমি আবির্ভূত হলে
তুমি কি দেখতে পাচ্ছ অনেক তারার পাশে একটি নিষ্প্রভ স্বাতি জ্বলে আছে
তুমি অরুন্ধতিকে কেন খুঁজে বেড়াও–
এত অথৈ জলে নৌকা ভাসিয়ে তুমি আমাকেই দেখতে এলে,
তুমি আছ আমার চোখে, আমার চোখের তারায়-
তুমি দেখেছ ইছামতী নদীতে এখন কত জল,
এই জলে ভেসে ভেসে এক রাজপুত্রের বাড়ি আমার যেতে ইচ্ছা করে।’
একবার মনে হলো, মাকে বলে দেই– শোভাকেই আমার পছন্দ হয়েছে। ওর সাথেই আমার বিবাহের ব্যবস্থা করো। কিন্তু তা আর হলো না। পরের দিন সারাদিন বাল্য বন্ধুদের সাথে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। আমাদের বাড়ির সাথে ঐ একই নদী বহমান, সেই নদীর তীরে আনন্দেই সারাদিন ঘুরলাম ফিরলাম। তাই মাকে আর কোনো কথা বলা হলো না। মনে করলাম– মা যা করে, আমি তাই করব।
রাতে খেতে বসেছি। মা তখন বললেন- ‘আমি আজকে ইউনুস ঘটককে শেখ বাড়ি পাঠিয়াছিলাম। প্রভার সাথেই তোমার বিবাহের তারিখ পাকাপাকি করিয়া আসিয়াছে। আমি বেশি দেরী করিব না। আগামী পরশু দিনই বিবাহের তারিখ ধার্য্য করা হইয়াছে।’
বিয়ের দিন সকালবেলা লাহিড়ী মোহনপুর এলাকা থেকে বড় বড় দু’টি দক্ষিণা পানসি নৌকা বাড়ির ঘাটে এসে ভেঁড়ে। নৌকা দুটিকে রঙ্গিন কাগজ দিয়ে সাজানো হলো। সানাই আর ব্যান্ড পার্টি আনা হলো। শহর থেকে কলের গানও নিয়ে এসেছে। ফেরদৌসি রহমানের একটি গান বাজছে। ‘ওকি বন্ধু কাজল ভ্রমারারে,
কোন্ দিন আসিবেন বন্ধু কইয়া যাও, কইয়া যাওরে।’
বিয়ের দিন আকাশে ঝিকিমিকি রোদ উঠল। আমাকে শেরওয়ানী ও টুপি পরানো হলো। নৌকায় গিয়ে উঠলাম। দখিণ দিক থেকে বাতাস বয়ে আসছে শান্ত বেগে। নৌকায় বাদাম টানানো হলো। মাঝি মাল্লারা গান ধরল। সানাই বাজছে। কলের গান বাজাচ্ছে। ব্যান্ড পার্টির ঢোলের শব্দে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল।
শেখ বাড়িতে বিকালের আগেই বর যাত্রীরা গিয়ে পৌঁছে। এখানেও সানাই বাজছে। চারিদিকে হাসি রাশি রাশি, চারিদিকে উৎসবের আনন্দ। কাজী এসে বিবাহ পড়ালেন। সন্ধ্যার সময় আমাকে নিয়ে প্রভার পাশে বসানো হলো। বাড়ির বৌঝিরা আনন্দ করছে। আয়নাতে প্রভার মুখ দেখানো হলো।
এই সেই মুখ যাকে আমি হাজার বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, তাকেই আজ পেয়ে গেলাম এই ইছামতী নদীর তীরে।
রাতেই নতুন বউকে নিয়ে বাড়িতে ফিরি। ধান দূর্বা সোনা পানি ছিটিয়ে নববধুকে বরণ করে ঘরে তোলা হলো। রাত ততোক্ষণে অনেক হয়ে গেছে। সানাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কলের গান আর বাজছে না। ঢাকের বাড়িও থেমে গেছে। ভাবী কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন- ‘নাও, এখন থেকে আমার কোমড়ের বাঁকের উপর তোমার আর তাকাতে হবে না। আমার তুলতুলে গালও তোমার আর টিপতে হবে না। এবার দরজাটা বন্ধ করে দাও।’
সকালবেলা পাখির ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তার আগে আযানের সুরও ধ্বনিত হয়েছে। প্রভারও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বাড়ির ঘাটে লোকজনের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। সবাই বলাবলি করছে কোথা থেকে এক মেয়ের লাশ এসে ঘাটে ঠেকে আছে। আমি এবং প্রভা ঘাটের দিকে এগিয়ে যাই। লাশটি তখন ঘাটের উপর মাটিতে শুয়ে রাখা হয়েছে। আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে প্রভা চিৎকার করে “বুবু” বলে লাশটিকে জড়িয়ে ধরে।
এরপরে পঁচিশ বছর চলে গিয়েছে। আমার জীবনটাকে পুরাপুরি সুখী করতে পারি নাই। একটা অপরাধবোধ প্রতিনিয়ত দহন করে। যদি কখনো বাড়িতে যাই, যদি তখন ভরা বর্ষার দিন থাকে, যদি সারা নদীর বুকে জুড়ে অথৈ জল থাকে, যদি তখন পূর্ণিমার তিথি হয়– ইছামতীর নদীর কুলুকুলু জলের শব্দে তখন শোভার কান্নার ধবনি শুনতে পাই।
( সমাপ্ত )
~ কোয়েল তালুকদার