বনবেশ্যা
এই কাহিনীটি শুনেছিলাম একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছ থেকে। অফিসের কাজে সেবার গিয়েছিলাম রামুতে। আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল রাবার বিভাগের একটি ডাকবাংলোতে। কী সুন্দর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই রামু। যে দিকে তাকাই শুধুই — রাবার বাগান, মেহগনি, জারুল আর সেগুন গাছের সারি।
প্রথম দিনের কথা। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দূরে কোথাও থেকে জন কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছিল । বাংলোর কেয়ারটেকার ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করি — এটি কিসের শব্দ শোনা যায়? ও বলে, ‘একটু দূরেই বৌদ্ধ বনবিহার। ওখানে আজ বিশেষ প্রার্থনা হচ্ছে। ছোট একটি মেলাও বসেছে। জন মুখরতার এই শব্দ আসছে ওখান থেকেই। ” আমি বলি — আমাকে তুমি ওখানে নিয়ে চলো ।’
আমি ওর সাথে চলে যাই ঐ বৌদ্ধ বিহারে। ঢুকতেই দেখি — মন্দির প্রাঙ্গণে পাইন গাছের নিচে চল্লিশোর্ধ্ব একজন ভিক্ষু বসে আছে। পরনে কমলা রঙের ধূতি কাপড়। দেখতে অনেকটা সন্ন্যাসীদের মতো। সন্ন্যাসীর মতো কাউকে দেখলে, আমি কেমন যেন বিচলিত হয়ে যাই । কেন জানি মূহূর্তে দেখা এই লোকটিও আমার নজর কেড়ে নেয়।
বিহারের ভিতরে প্রবেশ করে দেখি মহামতি বুদ্ধের পিতলের মূর্তি। মূর্তির চারপাশে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ বসে প্রার্থনা করছে। আমিও ওদের সাথে বসে মঙ্গল প্রার্থনায় অংশ নেই। প্রার্থনা শেষে উপসানালয় থেকে বের হওয়ার সময় ঐ ভিক্ষুকে আবারও দেখতে পাই। আমার খুব কৌতুহল হয় ওর সাথে কথা বলবার।
ওর নাম ছিল হংসধ্বজ সেরিং। বান্দরবানের থানচি থেকে সে এসেছিল। সীমান্তবর্তী মদক পাহাড়ের গহীন অরণ্যে রেমাক্রীতে ওদের বাড়ি। উপত্যকার বুক চিরে বয়ে আসা শঙ্খ নদীর পাড়ে ওর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ ছিল হংসধ্বজ। কিয়াং এর পাশে এক টিনের ছাউনিতে হংসধ্বজ থাকত। তারুণ্য উদ্ভাসিত জীবন আমার তখন। পথ চলতে চলতে অদ্ভুত এই ধরণের মানুষদের সাথে পরিচয় হলে কেন জানি আমিও মিশে যাই তাদের জীবনের সাথে।
একদিন সন্ধ্যায় হংসের ওখানে গিয়ে দেখি, সে একাকী বসে আছে। ঘরের ভিতর অন্ধকার। আমাকে দেখে সে একটি কেরোসিনের শিখা ধরায়। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে পকেট থেকে সে দুটো চুরুট বের করে বলে — ‘এটি বার্মিজ ভেষজ চুরুট। তুমি একটি খাও। খুব ভালো লাগবে। তোমার যদি কোনো দুঃখ থাকে, তুমি সব ভুলে যাবে।’ আমি বললাম — ‘ আমার তো কোনো দুঃখ নেই। ‘ হংস আবার বলে — ‘তুমি যদি সুখীও হও তারপরও তোমার ভাল লাগবে, তোমাকে আরও বেশি সুখী মনে হবে ।’
দুজন দুটো চুরুট ধরাই। দুজনই টানছিলাম সুখ আনন্দে। নিজেকে তখন সত্যিই সুখের অধিক সুখী মানুষ মনে হচ্ছিল। আলো অাঁধারে দেখছিলাম হংসধ্বজকে। ওকে দেখে মনে হলো — ও কোনো দুঃখ ভুলেনি। রুমটি কেমন যেন ধূয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। বৌদ্ধ মন্দিরে আজ কোনো কোলাহল নেই । বাইরে বনতলায় নীরবতা নামছে আকাশ ভেঙে। আমি হংসধ্বজকে বলি — তুমি কী তোমার দুঃখ ভুলে যেতে পেরেছো?
হংস : না।
আমি : কী এমন দুঃখ তোমার? আমাকে বলো না!
হংস : চলো বাইরে যাই। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
বনতলে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটি পুকুর ঘাটে গিয়ে বসি। সেই সন্ধ্যা রাতে অনেক কথাই শুনেছিলাম হংসধ্বজের কাছ থেকে। আমার কাছে মনে হয়েছিল, কিছু কথা বলেছিল সে স্বাভাবিক ভাবে। কিছু বলেছিল উন্মাতালের মতো। হংসধ্বজের মুখ থেকেই ওর কথাগুলো শোনা যাক।
আমাদের রোমাক্রীতে শঙ্খ নদীর তীরে পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার আছে। বংশানুক্রমে সেই বিহারের ভিক্ষু হতে হলো আমাকে। এর আগে ছিল আমার বাবা, তার আগে আমার দাদা। আমাকে এই বৌদ্ধ বিহারের দায়ভার নিতে হবে জেনে আমি প্রথম থেকেই বৈরাগ্য জীবন বেছে নিয়েছিলাম। বিবাহ কিংবা সংসার ধর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করি নাই।
এক প্রবারণা পূর্ণিমা দিনে বিহারে আসে এক বৃদ্ধা। তার সাথে ছিল বিশ বাইশ বছরের এক তরুণী। এর আগে এদের কোনও সময় কিয়াং এ প্রার্থনা করতে দেখিনি। পরিচয় পেয়েছিলাম, তারা সীমান্তের ওপারে ব্রহ্মদেশের বাসিন্দা। বৃদ্ধা সমর্পণ ভঙ্গিতে বিনীত করে বলে, বাবা, তুমি আমার এই মেয়েকে মঙ্গলের পথে ফিরে নিয়ে এসো।
তরুণীর নাম জিনা অংপ্রু। উপত্যকার এক ভাসমান বনবেশ্যা। মেয়েটি এত সুন্দরী ছিল যে, সে নাকি তার খদ্দরের বাইরেও প্রতিদিন ধর্ষিত হত। সীমান্তের ওপার থেকে ওর বৃদ্ধা মা নিরুপায় হয়ে তাই এই রেমাক্রীতে ওকে নিয়ে চলে আসে। এখানে এক পরিচিতের কাছে আশ্রয় নেয়। আমি বৃদ্ধাকে বলি, তুমি ওকে সাথে করে কয়েকদিন এই মন্দিরে নিয়ে আসবে।
মেয়েটি প্রায় তিনমাস প্রতিদিন মন্দিরে এসেছিল। আমি তাকে বুদ্ধের অমোঘ বাণীগুলো শোনাতাম প্রতিদিন। মেয়েটি যেন সুস্থ জীবনে ফিরে আসে, তার জন্য তাকে বোঝাতাম আমার যত চিন্তা চেতনা দিয়ে। ওকে বলতাম, আমার সংসার নেই। কিন্তু আমি ভালবাসি এই বৌদ্ধ বিহার। দীক্ষা নিয়েছি ধর্মের। বুদ্ধের অমিয় বাণী আমার আত্মাকে দিয়েছে শান্তি। তুমি সুন্দর জীবনে ফিরে আস। কাউকে বিয়ে কর। ঘরকে ভালবাস। সংসার পাতো। সন্তান নাও। ওকে বুঝিয়ে বলতাম — মানুষের কামনা-বাসনা সবই দুঃখের মূল। ঐসবের মাঝে যে সুখ আসে তা দুঃখ মিশ্রিত এবং অস্থায়ী। অবিমিশ্র সুখ বলে কিছু নেই। নিবার্ণ লাভে এই দুঃখের অবসান ঘটে। কামনা-বাসনার নিস্তারের মাঝে পূর্ণ শান্তি অর্জিত হয়।
মেয়েটি আশ্চর্যজনক ভাবে তার জীবনধারা বদলিয়ে ফেলে। মোহ কাটিয়ে নির্বাণ লাভ করে বুদ্ধের অহিংস বাণীতে। সে ধর্মের প্রতি আসক্ত হয়ে ওঠে। এবং রোমাক্রীর এই বৌদ্ধ বিহারের সেবিকা হয়ে যায়। নদীতীরে বনভূমির এই বিহারের জন্য মেয়েটি প্রতিদিন ঘটে করে জল আনত নদী থেকে। আমি নির্মোহ ভাবে অবলোকন করতাম তার চলাফেরা, তার প্রতিদিনের জীবন পট।
একদিন বসন্তের আবেশ হিল্লোলে অরণ্যের বাতাস স্পন্দিত হচ্ছিল। পলাশ ও কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম উচ্ছ্বাসে আকুল হয়েছিল অন্তরীক্ষ। কুসুমার্দ্র সুবাসে সুরভিত হয়ে উঠেছিল বনভূমি। কোকিলের কূজনে কুহরিত হচ্ছিল দশদিক। যেন ভ্রমর এসে বসেছে প্রসূনের বক্ষে। প্রকৃতির নিয়মে বিমুগ্ধ হরিণ-হরিণীর মতো কী এক আবেগে আমরা আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে যাই।
ঋতু বসন্তের কোন্ আচম্বিত বাসনায় জিনা অংপ্রু তার বক্ষের উত্তরীয় উন্মুক্ত করে দিল। স্তনপট্টের উপর দিয়ে কুচকুম্ভের স্পষ্ট আভাস দেখা দিল। আমি উদাত্ত জিনাকে দেখছিলাম মুগ্ধ চোখে। কিন্তু সহসা একটা দমকা বাতাস এসে সব এলমেল করে দিল। চকিতে সরে গিয়ে সে অরণ্যের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
তাকে সেদিন আর খুঁজে পাওয়া গেল না। পরেরদিন জিনা অংপ্রুর মৃতদেহ গ্রামের লোক খুঁজে পেল শঙ্খ নদীর তীরে বনঝোপের ভিতর থেকে। তার সমগ্র শরীর বিষ নাগিনের ছোবলে ক্ষত বিক্ষত ছিল।
—————————————–
ডিসক্লেইমার :
এই গল্পের দুটো প্যারা আমি সন্মাত্রানন্দ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছি।