১.
সোলাইমান মিয়া পড়লো মহাবিপদে। তার আয় রোজগারের কোন উপায় নাই। আবার এদিকে তার ইস্তিরির গর্ভ হইসে। দুশ্চিন্তায় সে অস্থির।
সেই সময় গ্রামের এক ধনী ব্যক্তি ঠিক করলো যাকাত দিবে। সারা গ্রামের মানুষের ভীড়ের মধ্যে লাইন ধরে শাড়ি লুংগি দেওয়া যাকাত না।কয়েকজন গরিব মানুষকেই তারা যাকাত দিবে বইলা ঠিক করলো,,এর মধ্যে সোলাইমান মিয়া একজন।
যাকাত দিবে ভালো কথা। কিন্তু তার জন্য একেবারে সাংবাদিকের মত প্রশ্ন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। যাকাতের টাকা দিয়া সোলাইমান মিয়া কী করতে চায়? রিক্সা কিনবে নাকি গরু কিনবে নাকি সেলাই মেশিন? সোলাইমান মিয়া ঠিক করলো একটা চায়ের দোকান দিলেই ভালো হবে। সে চায়ের দোকান করে দেবার জন্য বললো। সেই ধনী লোকও তাকে একটা চায়ের দোকান করে দিলো।
এদিকে সোলাইমান মিয়ার ইস্তিরি কন্যা সন্তান প্রসব করলো। কি যে সুন্দর সেই কন্যা! সোলাইমান মিয়া তাই তার মেয়ের নাম রাখলো বিউটি। মেয়ের জন্মের পর তার অবস্থাও ধীরে ধীরে ফিরতে লাগলো। সে ভাবলো মেয়ের গুণেই তার এত উন্নতি। এমনকি একদিন রাতে সে স্বপ্নেও দেখল, তার মেয়ে বিউটি খাট স্পর্শ করতেছে আর সেই খাট ধীরে ধীরে ফুলে ফুলে ভইরা যাইতেছে। স্বপ্ন দেইখা তার ঘুম আচমকা ভাইঙিয়া যায়। সে তার ইস্তিরিরে ডাক দেয়। তারপর নিজের আজব স্বপ্নের কথা বলে। তার ইস্তিরি কাঁচা ঘুম ভাঙ্গায় বিরক্ত হয়। হাই তুলতে তুলতে বলে, “এইগুলা কী বলেন আগর বাগর আপনি? এইগুলা কি হয় নাকি? ঘুমান তো! বেশি চিন্তা করতে করতে আপনার মাথাডাই গেছে। ”
সোলাইমান মিয়ার ইস্তিরি ঘুমাইয়া পড়ে। কিন্তু সোলাইমানের ঘুম আসে না। তার খালি মনে হয়, স্বপ্নের একটা অর্থ নিশ্চয়ই আছে।
বিউটির জন্মের পরের দুই বছরের মধ্যে সোলাইমান মিয়ার সংসারে সচ্ছলতা আসে। তার দুই ভাই-ও তার থেইকা সাহায্য নিয়া একইভাবে ব্যবসা শুরু করে এবং লাভবান হইতে থাকে। তিনভাই মিলামিশ্যা থাকে। ছোট দুই ভাইয়েরাও বিবাহ করে। তাহাদের ঘরেও পরপর দুই বছরে দুই কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। তাহারা সোলাইমান মিয়ার মত সন্তানের নাম অত ইংরেজিতে রাখে না। তারা নাম রাখে আরবিতে। একজনের নাম ফাতেমা আরেকজনের নাম রাবেয়া। বিউটি, ফাতেমা ও রাবেয়া, তাহারা সকলেই একত্রে বড় হইতে থাকে।
বিউটি তিন বোনের মধ্যে বড়। সে-ই তাদের দেখেশুনে রাখে। পড়া বুঝাইয়া দেয়। বিউটির নিজের রেজাল্টও বরাবরই খুব ভালো। পড়ালেখা শেষে ঘুমের আগে সে ছোট দুই বোনকে সে গল্প শুনায়। রূপকথার গল্প। সেই যে এক সওদাগর ছিলো,,তার ছিলো তিন কন্যা। একদিন সওদাগর দূরে বাণিজ্য করতে যায়, কন্যাদের জন্য কী আনবে জিজ্ঞেস করে তাই। অন্য কন্যারা অনেক দামী দামী জিনিস উপহার চাইলেও,,ছোট কন্যা চাইলো একটা গোলাপ ফুল। আর সেই ফুল আনতে গিয়ে সওদাগরের সাথে পরিচয় হয় এক ভয়ংকর মানুষের সাথে। সেই মানুষ ঠিক মানুষ না,,আধা মানুষ আধা জন্তু। সে শর্ত দেয়,,ছোট কন্যাকে তার হাতে তুলে দিতে হবে। সেই গল্পের শেষে দেখা যায়, ছোট কন্যার স্পর্শে একদিন সেই আধা মানুষ আধা জন্তু সুদর্শন এক রাজপুত্রে পরিনত হয়। ডাইনি বুড়ির অভিশাপে এতদিন সে এই রকম আধা মানুষ আধা জন্তু হয়ে ছিলো। ছোট কন্যার স্পর্শে সেই অভিশাপ কাটলো।
ফাতেমা আর রাবেয়া অবাক হয়ে গল্প শোনে। জানতে চায়, ছুটু কইন্যা আধা মানুষ আধা জন্তুটারে ধরলো আর সে রাজপুত্র হইয়া গেলো? কেমনে হইলো?
ওদের ছেলেমানুষী প্রশ্ন শুইনা বিউটি হাসে, বলে, ছুটু কন্যা তো অনেক সুন্দর ছিলো। তার মনটাও ছিলো সুন্দর। আর ঐ জন্তুর মত মানুষটারে ভালোও বাসতো। তাই তার ভালোবাসার সৌন্দর্যে ঐ জন্তুটা ভালো হইয়া যায়।
ফাতেমা আর রাবেয়ার প্রশ্ন তাও শেষ হয় না।
রাবেয়া জানতে চায়, আপা, ছুটু কন্যা কত সুন্দর ছিলো?
ফাতেমা জবাব দেয়, আমাগো বিউটি আপার মত সুন্দর ছিলো।
বিউটি হাসে, বলে, আমার মত না, তোদের মত সুন্দর ছিলো।
ছোট্ট রাবেয়া আবার প্রশ্ন করে, আপা, আমরা কি জন্তুর মত মানুষকে ধরলে সে সুন্দর হইয়া যাইবো?
বিউটি আদরের বকা দেয়, তোগোরে গল্প শুনাইলেও মুশকিল। খালি আজাইরা বাজাইরা প্রশ্ন।
রাবেয়া বলে, আমার মনে হয়, আমরা জন্তুর মত কোন মানুষকে ধরলে সে সত্যিই সুন্দর হইয়া যাইবো। আমরা সবাই-ই তো সুন্দর, তাই না?
ফাতেমা বলে, কিন্তু বিউটি আপা বেশি সুন্দর।
বিউটি এবার কপট রাগ দেখায়, বকা দেয়, হইসে হইসে, আর বেশি কথা কইতে হইবো না। ঘুমা অখন।
২.
বিউটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইসে। সে ঢাকায় পড়তে আসতে চায়।
বিউটির এই ঢাকায় আইসা পড়ার ব্যাপারে ফাতেমার বাবার মত ছিলো না। মাইয়া মানুষের অত পইড়া কী লাভ। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পইড়াই বা কী হইবো? সে নিজের মেয়ে ফাতেমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করাইছে। ফাতেমাকে সে কখনো শহরে পড়তে দিবে না। সোলাইমান মিয়ার মত ভুল যেন রাবেয়ার বাবাও না করে এইটা সে বারবার বুঝাইয়া বলে। রাবেয়ার বয়স কম। এখনো সে ঘরেই থাকে। বাইরে যত কম বাইর হওয়া যায় ততই ভালো। দরকার নাই বিউটির মত অত ভালো রেজাল্ট করার।
ফাতেমা, রাবেয়া, বাবা, মা, গ্রাম… সব কিছু পেছনে ফেলে বিউটি শেষ পর্যন্ত শহরে চলে আসে। অচেনা এক শহর। তার মন খারাপ হয়, কিন্তু তাতে এই শহরের কারো কিছু যায় আসে না।
বিউটি তো শহরে আইসাই পড়সে। যতই মন খারাপ হোক, এইখানেই তার পড়তে হইবো। মনকে বুঝায় সে। একদিন ক্লাস শেষে সে বান্ধবীর বাসায় যাইতে থাকে। সামনে পরীক্ষা, তাই দুইজনে একসাথে পড়বো, এই উদ্দেশ্য। যাইতে পথে সূর্য ডুইবা যায়। এইটা শহর, গেরামদেশ না। এইখানে সূর্য ডুবলেও আসলে ডুবে না। শহর জাইগা থাকে,,সারা দিন রাত। বিউটি তাই ভয় পায় না। কিন্তু হঠাৎ কে যেন তার মুখ চাইপা ধইরা ঝোপের ভিতরে টাইনা নিয়া যায়। বিউটি দেখে লোকটা একটা জন্তুর মত। সামনের দুইটা দাঁত নাই আর পাশের ছেদন দন্ত দুইটা হিংস্র জন্তুর মত বড়। জন্তুটার মুখ থেইকা লালা ঝরতেছে। জিব্বা লকলক করতেছে। চোখগুলাও ভয়ংকর। জন্তুটা বিউটিরে ধর্ষণ করে। বিউটির সৌন্দর্য বা মন বুঝার ক্ষমতা এই জন্তুর নাই। বিউটি চিৎকার করে। কেউ তার কথা শুনে না। তার সংস্পর্শে আইস্যা কোন জন্তু সুন্দর মানুষে রূপান্তরিত হয় না। উল্টা বিউটি মইরা যায়।
বিউটি মইরা যায়। জন্তুটা হো হো কইরা হাসে।
যেদিন বিউটির কপালে এই দূর্দশা ঘটে সেইদিনই, ফাতেমা তার মাদ্রাসায় আরেক জন্তুর থাবার মুখে পড়ে। ফাতেমাও রক্ষা পায় না। রক্ষা পায় না ঘরে ঘুমন্ত ছোট্ট রাবেয়াও। আরেক জন্তু তাকেও ঘরের ভেতরে একা দেখে আক্রমণ করে।
ফাতেমা বা রাবেয়াদের সংস্পর্শে আইস্যাও জন্তুগুলা মানুষ হয় না।
জন্তু জন্তু-ই থাকে। আর তারা হো হো কইরা হাসতে থাকে।
তাদের হাতে ধর্ষিত হয়, খুন হইতে থাকে পৃথিবীর যত সৌন্দর্য, মায়া, মমতা ও ভালোবাসা। সূর্য ডুবতে থাকে আর পৃথিবী অন্ধকার হইতে থাকে। অন্ধকার পৃথিবীতে বিচরণ করতে থাকে শুধু জন্তুরা। তারা দেখতে আধা জন্তু আধা মানুষ।
১২ জানুয়ারি, ২০২০