নীল পাখি উড়ে গেলো, একটু পরেই আরেকটা লাল পাখি উড়ে এসে বসলো সেই গাছেই । পাশের গাছ বসে আছে দুটো হলুদ পাখি পাশাপাশি । কি বৈচিত্র্য আর রঙের সমাহার প্রকৃতির বুকে! পেছনে ফিরে গোল বাগানটার দিকে তাকালেই একসাথে রঙধনুর সবগুলো রং দেখে ফেলা যায় ফুলে ফুলে । অথচ এই সব পাখি আর ফুলের নাম আপন আলম জানে না, জানার ইচ্ছে আর সুযোগ কোনটাই হয়নি বোধহয় কোনদিন! কেবল বয়ে গেছে সময়ের স্রোতে রোজ রোজ এক টানা সুর, একই সুর আর সুরের পরতে পরতে লহরি হয়ে। যেমন বয়ে চলে সামনের নদী – কোত্থেকে আসে জানে না , কোথায় যায় জানে না, শুধু চেনে এই পার্কের এই একখানি বেঞ্চের সামনে যতদূর দেখা যায় ততটুকু নদী, নদীর নামও জানে না অথচ কম করে হলেও পঁয়ত্রিশ বছর হয়ে গেছে সে এই ছোট্ট শহরে এসেছিলো। তারপর বয়ে গেছে নদীর জল, বয়ে গেছে সে সময়ের ডাকে নিজেও। মাথার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে চেনা জানা স্মৃতিই হারিয়ে যাচ্ছে আর যে নদীর নাম কোনদিনই জানা হয়নি তার নাম কি করে মনে আসবে !
একটু একটু মনে পরে অনেক আগে মাঝে মাঝে এই জায়গাটিতে উইকএন্ডের সামান্য অবসরে আসতো । সাথে এমিলি থাকত । একটা পুরানো রঙ চটা কাঠের বেঞ্চ ছিলো মনে পরে তার। কাঠের গায়ে কি রং ছিলো মনে পড়ে না, এখন অনেকগুলো বেঞ্চ, চকচকে পলিশ করা কাঠ…
এমিলির কথা মনে পরে তার। সেই কবে এই শহরে আসার পর ধীরে ধীরে দোকানটা কিনেছিলো তারপর একদিন জন্মভূমিতে ফিরে গিয়েছিলো, বাবার এর বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করে ফিরে এসেছিলো একা, খাবার দোকানটা জমপেশ চলতে শুরু করেছিলো, নিজে ততদিনে শেফ হবার কোর্স করে ফেলেছে, এমিলিকে কমাস পরেই দেশ থেকে নিয়ে এল, তখনও এমিলি তার অচেনা, এইখানে এই নদীর পারেই তাদের প্রেম তারপর আবেগ…
মনে পড়ছে বাবা আর মার মুখ , মনে পড়ছে কতদিন কত কাল যেন জন্মভূমিতে যাওয়া হয়নি, তারপরই মনে পরে বাবা মা দুজনেই বেচে নেই – স্পষ্ট সে বিয়োগের স্মৃতি , আর কে কে মরে গেছে মনে পড়ছে না, এমিলির কথা মনে পড়ছে কেবল ।
সে নিজে কখনই স্বদালাপি ছিলো না, অন্যকে খুশি করার মত কোন কথা ছিলো না, অথচ দেশেতো কত বন্ধু ছিলো, তারা কল দিতো, অথচ বারবারই সে থাকতো ব্যস্ত আর ব্যস্ত, অনেক কাজ, ধীরে ধরে কেউ আর তাকে মনে করার কোন কারণই ছিলো না … তারপর আরও পরে যখন ফেসবুক নামক সেই অদ্ভুত কাছাকাছি নিয়ে আসা প্রযুক্তির অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটলো, সেই সব চেনা মুখ সব সামনে চলে এল। এমিলি বলতো, ‘তুমি কখনই শিখলে না কাকে কি বললে খুশি হয়-তবুও ভালো যে মুখে আর অন্তরে তোমার এক -এই টাই আমাকে আটকে রেখেছে তোমার সাথে , হয়তো এইটাই একদিন কারণ হয়ে যাবে তোমাকে ছেড়ে যাবার’ …
হঠাৎ তার মনে পড়ে শুধু তাকেই না এই শহর ছেড়েই চলে গেছে এমিলি, কেনো গেলো? তার আত্মকেন্দ্রিক স্বভাব আর ভালো লাগছিলো না কি? মনে পড়ছেনা আর তার সেসব কিছু …
কত পুরাতন কথা মনে পড়ে অথচ নতুন কথা মাথায় হারিয়ে যাচ্ছে। দোকানে যেতে হবে? আজ কি বার?
তারপরই আপনের মনে পড়লো দোকান তো ৬ মাস হলো বেঁচে দিয়েছে – এই শরীরে আর ভুলে যাওয়া রোগ নিয়ে দোকান চালানো যাচ্ছিলো না, তারোপর কোভিড নামক এক কালো ছায়া এল, কোভিডের আগে আগে এমিলি চলে গেলো আনন্দের কাছে … আনন্দের কাছেই তো যাবে , তাতে তো কোন দোষ নেই , আনন্দতো আমাদেরই ছেলে, কোথায় জানি থাকে ? কোন শহরে ?…
কত কিছুই তো মনে পড়ে যাচ্ছে – একটা সবুজ দেহ লালা মাথা কাকাতুয়া নিচু ডালটাকে দোল খেলো…
আহা! মনে পড়ে জন্মভূমির পতাকাটা ঐ রঙের। মনে পড়ে কতগুলো মুখ, এই পাখিটার নামও সে জানে না, নাকি ভুলে গেছে, মনে পরে এক এক মুখের শৈশবের রূপ সাথে পরিণত বয়সের ছবি, ফেসবুকের প্রোফাইল; একটা গ্রুপ খুলেছিলো সেই বন্ধু ক’জন, একই পাড়ায় থাকতো তারা ছোটকালে- তারা কয়জন মনে আসছে না। মেসেঞ্জার গ্রুপে ওরা কত কথা লিখতো আর আপন শুধু লাইকের বুড়ো আঙ্গুল প্রদর্শন বা বরজোড় দু একটা শব্দ লিখতো। গ্রুপ ভিডিওগুলোতেও তেমন যুক্ত হবার সময় হতো না।
বেঞ্চ ছেড়ে সে উঠলো দোকানের দিকে যেতে হবে তার, কিন্তু দোকান তো বেঁচে দিয়েছে – মনে পড়ছে, এমিলি ছাড়া দোকান একা চালাতেই পারলো না, অফুরন্ত সময় এখন , অঢেল অবসর। এমিলি আর দেশের বন্ধুগুলো সবাই শুধু ভেবেছে তার কোন কথা নেই , শুধু কাজ আর কাজ, অথচ সে এখন কথা বলতে চায়, সবার কথা জানতে চায় … পকেটে মানিব্যাগটা হাত নিয়ে একাট ছোট ফোন ডায়েরী দেখতে পেলো , কয়েকটা ফোন নম্বর সেখানে ।
প্রথম নম্বরটা মোবাইলে টিপে টিপে দেখলো সেটা সেভ করা আছে কান্ট্রি কোড সহ। কল দিলো। অনেক দিন পর যেন মাতৃভাষা শুনলো কন্ঠে – ‘এই নম্বরটি এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছে না।’
পরের নম্বরটিও তাই … একে একে পাঁচটা নম্বর, সবগুলো মোবাইলে সেভ করা, শুধু শেষেরটা বেজে গেলো একটানা অনেকক্ষণ, কেউ ধরলো না । হয়তো সবাই নম্বর পরিবর্তন করে ফেলেছে, ফেসবুকে গ্রুপটাতে ঢুকে বেশ করে বকে দেবে ভাবলো সবাইকে …
ডায়েরীর শেষ পাতায় চলে গেলো -‘আনিস ভাই’ খুব পরিচিত লাগছে কিন্তু তার মনে পড়ছেনা – কে?
মোবাইলে নম্বরটি টিপতেই সেখানে নামটা উঠলো … আনিস ভাই…
কল দেবে কি? কিন্তু কি বলবে , কি সম্বোধন হবে?
তারচেয়ে এমিলির নম্বরটা খুঁজতে লাগলো মোবাইলে, এইতো দু’দুটো নম্বর …
একটা হোয়াইট মেয়ে ছুটে আসছে আলমের দিকে , মোবাইল থেকে মুখ সরিয়ে সে দিকে তাকলো । দূরের জিনিস একটুও বুঝতে পারে না সে আজকাল। চোখদুটো কুঁচকে চেনার চেষ্টা করলো মেয়েটার চেহারা। আরও কাছে আসতেই শুনল তার নাম ধরে ডাকছে , ‘মি আলাম , মি আলাম’।
কে মেয়েটা? তারপর চিনতে পারলো, ঐ তো তাকে ওষুধ দিয়েছিলো সকালে, কিন্তু ওষুধ কি সে খেয়েছিলো মনে পড়ছে না।
মেয়েটা কাছে চলে এল, বলল , ‘ওহ! ইউ আর হেয়ার এন্ড আই এম লুকিং ফর ইউ ইচ এন্ড এভরি কর্ণার ইন দ্যা হাউস, লেটস গো, উই হেভ টু রেডি ফর এয়ারপোর্ট, আই থিংক ইউ হেভ এটলিস্ট নট ফরগেট আওয়ার ফ্লাইট, উই উইল গো টু মি আনান্দস হাউস ।
‘ নো, আই উইল নট গো দেয়ার, এমিলি উইল বি দেয়ার উইথ হিম, নো নো, এমিলি সুড কাম হেয়ার ফার্স্ট।’
‘ ওহ মি আলাম, ইউ আর গ্রাজুয়েলি ফরগেটিং এভরেথিং, ইউর ব্রাদার মি আনিস ওয়াজ সেভেন ইয়ারস ওল্ডার দ্যান ইউ বাট হোয়েন হি কেমড হেয়ার টু ইয়ারস এগো হি কুড রিমেম্বার হিজ চাইল্ড হুড এভরিথিং হেপেনড উইথ ইউ…’
‘ আনিস, মাই ব্রাদার ! ইয়েস ইয়েস তাইতো … আনিস ভাইয়াতো মরে গেছ…’
ততক্ষণে ঘরে এস গেছে দু’জন । সোজা মেয়েটা তার হাত ধরে বেড রুমে নিয়ে গেলো । খাটের উপরে একটা স্যুটকেস প্রায় গোছানো, পাশের দেয়ালে রঙিন কাগজে বড় বড় করে লেখা-
বাবা তোমার ডিমেনসিয়া শুরু হয়েছে। তুমি সব ভুলে যাচ্ছো। তোমার শৈশবের বন্ধুদের পাঁচজনের কেউই বেঁচে নেই আর। তিনজন আরও আগেই মারা গেছেন। গত একবছরে বাকী দুজন কোভিডে মারা গেছেন মা’র মতই। আনিস আংকেলও আর নেই ।
তুমি রোজ রোজ এই সাতজনকে ফোন দাও। তাই এখানে লিখে রাখলাম।
আনন্দ
তোমার একমাত্র ছেলে
ডোন্ট ফরগেট মি বাবা।