আফসান চাচা করোনায় মারা গেলেন

১.
করোনার ঘনঘোর দুঃসময়ে আফসান চাচা একদিন সত্যি সত্যিই আমার বাসার সামনের গেটে হাজির হলেন। সেদিন সকাল বেলা আমি তখনও ঘুমাচ্ছিলাম। তাকে দেখে আমি সামান্য অবাক হলাম। কিন্তু সেটা তাকে বুঝতে না দিয়ে স্বাগত জানালাম। তাকে ড্রয়িং রুমে বসতে বললাম। তিনি বসলেন। আমি কিছুক্ষণ পর খোলাজালি পিঠা আর কাচকি মাছ তার সামনে নিয়ে দিলাম।

– খান
– আপনিও খান
– আচ্ছা, অবশ্যই
– পথে আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো
– নাহ, খুব চমৎকার ভাবে চলে
এলাম। সায়েদাবাদ থেকে ফেনীতে একটা বাসে। ফেনী থেকে আরেকটা বাসে মীরসরাই।
– আচ্ছা, বেশ
– আপনার পড়াশোনার কি অবস্থা?
– এই তো চলছে।
আফসান চাচা বললেন, বুঝলেন, আমার একটা স্বপ্ন আছে এলাকায় একটা পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা।
– খুব চমৎার স্বপ্ন।
– দেখেন , আমি আমার জীবনে অনেক গুলো বই কিনেছি। ধরেন রবীন্দ্র, নজরুলের পুরো সমগ্র আছে। আরো অনেক লেখকের বই আমার সংগ্রহে আছে। সেগুলো আমি দান করে দিতে চাই। কিন্তু দান করতে হলে তো একটা সিস্টেমের মধ্য দিয়ে করতে হবে। সেটা হচ্ছে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে।
– পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা যাবে, তবে এলাকার মানুষের সহযোগিতা, সমর্থন দরকার।
– আমি সালেহ আহমদকে বলেছিলাম, পাঠাগার স্থাপনের কথা, কিন্তু সে জানালো এখন কেউ বই পড়ে না। আর এখানে নাকি আরো বই পড়ে না। সে-ও তেমন আগ্রহ দেখালো না।
– কথাটা সত্য নয়। একটা পাঠাগার করলে অল্প সংখ্যক লোক হলেও আসবে। তাদের দেখাদেখি তরুণ কিশোররাও পড়ার আগ্রহ পাবে।
– হ্যাঁ, শুরুটা তো কাউকে না কাউকে দিয়ে করতে হবে।
– তোমার পরিচিত সাংবাদিক আছে না, তাদেরকেও রাখতে হবে উদ্যোগটার সাথে। আর যেদিন পাঠাগারটারটা উদ্বোধন করা হবে সেদিন তাদের সামনে কিছু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
– আচ্ছা, অবশ্যই বলবেন।
– করোনার এই সময়ে আমি চলে আসলাম তোমাদের বাসায়! কিছু মনে করো নি তো!
– নাহ মনে করার কিছু নাই। আপনি তো আমাদের পুরনো লোক।
– আমি কিন্তু মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করি আর ভিড়ের মধ্যে তেমন যাই না। ভিড় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি।

আফসান চাচা কয়েকটা বিয়ে করেছেন এটা আমি জানতাম। কিন্তু তিনি ঠিক কয়টা বিয়ে করেছেন তা আমি নিশ্চিত নই। এই ব্যাপারে তার সাথে আমার আলাপ করা দরকার মনে করছি। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আমিই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা, চাচা, আপনি কয়টা বিয়ে করেছেন, যদি বলতেন?
– তিনটা
– তিনটা?
– হ্যাঁ
– এখন কোন বউয়ের সাথে আছেন?
– দ্বিতীয় বউয়ের সাথে।
– আপনি কি নিজেকে সুখী মনে করেন?
– সুখ ব্যাপারটা আল্লাহর দান। তবুও আমার মনে হয় আমি সুখে আছি।
– আপনার এতগুলো বিয়ে করার পেছনে কি কোনো যৌক্তিকতা ছিল?
– যৌক্তিক অযৌক্তিক সেদিকে যাবো না। যখন যে জায়গায় ছিলাম সেখানে থাকার সুবিধার্থে বিয়ে করেছি। বিয়ে না করলে তখন আমার সমস্যা হয়ে যেত।
– সেটা আপনার ব্যাপার।
– তোমরা তো আমার বাইরেরটা দেখলা, আমার জীবনে যে অনেক বড় বড় ট্র্যাজেডি আছে সেটা তো জানো না। আমার জীবনী লিখতে চাইলে কয়েকশত পৃষ্ঠা লেখা যাবে। আমার জীবনটা সুখে দুঃখে ভরা। কখনো সুখে ছিলাম। কখনো দুঃখে ছিলাম। যখন যেখানে ছিলাম বউ বাচ্চা নিয়ে ভালোভাবে থাকতে চেয়েছি। অনেকে আমর উপর রাগ করে আমি নাকি প্রথম বউকে তেমন দেখাশোনা করিনি। আসলে দেখো, ওই বিয়েটা আমার একদম কম বয়সে হয়েছিল।
আমি তখনও ছোট, বয়স ধরো ১৬ বা ১৭ হবে এরকম। আমার বাবা বললেন, তোকে এই মেয়েটার সাথে বিয়ে দিয়ে দেই। আমি তখন অতশত বুঝতাম না। না বুঝেই বিয়েটা করে ফেলেছি।
– তোফায়েল ভাই রা ওই ঘরের সন্তান!
– হুমম
– ওদেরকে আপনি ঠিক মতো দেখাশোনা করেছেন বলে তো মনে হয় না।
– সেটা হয়তো করতে পারিনি।
– এরপর দ্বিতীয় বিয়েটা কোথায় করলেন?
– ওইটা ঢাকায়
– কীভাবে?
– ঢাকায় তখন আমি একটা বাড়িতে লজিং থাকতাম। ৭৭ সালে। সে সূত্রে সে বাড়ির একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। পরে পরিণয়। এখন এইটার সাথেই স্থায়ীভাবে আছি।
– আর তৃতীয় বিয়েটা করলেন কোথায়?
– এটা খুলনায়।
– আপনার কি তৃতীয় বিয়েটাও করার দরকার ছিলো?

আফসান চাচা চুপ থাকলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন-
– আমি তখন খুলনায় একটা বেসরকারী কোম্পানীতে চাকরি করতাম। একলা থাকতাম, একলা খেতাম। কখনো নিজে রেঁধে, কখনো হোটেলে। এজন্য চিন্তা করলাম একটা বিয়ে করি। তারপর পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিলাম। অনেক পাত্রী আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল।
– আপনি দ্বিতীয় বউকে তো খুলনায় নিয়ে যেতে পারতেন। তৃতীয় বিয়েটা না করলেও পারতেন।
– করেছি আর কি, মনের সুখ।
– নাহ, এটা আপনি ঠিক করেননি হয়তো বা।
– ঐ সংসারে আপনার সন্তান কয়টা?
– মেয়ে একটা
– আপনি তিন বিয়ে করেছেন। ছেলেমেয়ে মোট কয়টা?
– মোটা পাঁচ জন। প্রথম ঘরে দুই জন, দ্বিতীয় ঘরে দুই জন, তৃতীয় ঘরে একজন।
– সব বউয়ের সাথে কি আপনার এখন যোগাযোগ আছে?
– না, প্রথম আর শেষটার সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টার সাথে আছে।

ডিভোর্স কেন হল, সেটা আফসান চাচাকে জিজ্ঞাসা করলাম না। তবুও তিনি নিজের থেকে বললেন,
– প্রথম টার সাথে আমার তখন থেকেই হয়নি। আমাকে জোর করে বিয়ে করিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমি সে বিয়েতে রাজিও ছিলাম না। আর শেষ টার সাথে আমার মতের মিল হচ্ছিল না। আমি দেখেছি, খুলনার মেয়েটার সাথে আরেক লোকের পরকীয়া আছে। পরে তাকে এই জন্য ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছি।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকলাম। আফসান চাচা লোকটার সম্পর্কে যতই জানছি ততই অবাক হচ্ছি। আমি বলব না লোকটার চরিত্র খারাপ। হয়তো বিভিন্ন কারণে তিনটা বিয়ে করতে হয়েছে উনাকে। তার মধ্যে দুই বউয়ের সাথেই এখন আর সম্পর্ক নাই।

– আমি কিন্তু প্রথম বউয়ের সাথে তেমন সম্পর্ক না রাখলেও ঐ ঘরের ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য খুব চেষ্টা করেছি। বড় ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালাম। আরিফকে অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। গ্রাম থেকে শহরে এনে রেখেও কাজ হয়নি। ওটা ইন্টারপাশ করে আর পড়েনি। আমি ওকে কিছু টাকা দিয়েছিলাম ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য। ওই টাকা দিয়ে সে টিভি আর ভিসিআর কিনে এনেছে । এরপর থেকে ওর সাথে আমি আর যোগাযোগ রাখিনি।
– আপনি মেজো বউয়ের সন্তানদের বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন মনে হয়।
– না, আমি সব সন্তানকেই গুরুত্ব দিয়েছি। যারা আমার কথার অবাধ্য হয়েছে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আমি তো টাকা পয়সা খরচ করেছি ওদের পেছনে, তা না হলে আমি কি করব!
– আর শেষ ঘরে একটা মেয়ে? বিয়েটা মনে হয় লেইটে করেছেন
– হুমম। ডিভোর্স হওয়ার পর কোর্টের রায় অনুসারে আমি তাকে মাসে ৯ হাজার টাকা করে দিই। মেয়েটা তার মায়ের সাথে থাকে। মেয়ের সাথে যোগাযোগ আছে।
এরপর আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে আছি। খোলাজালি পিঠা আর কাচকি মাছ দিয়ে আমরা সকালের নাস্তা করলাম। এখন চা দেয়া হল আহসাস চাচাকে।

চা খাওয়ার পর আমরা ছাদে উঠলাম। লেবু, পেঁপে, কমলা, মরিচ, আম গাছ লাগিয়েছে আমার ছোট ভাই। কয়েকটা লেবু থেকে কেটে দিলাম আফসান চাচাকে। তিনি ধন্যবাদ দিলেন।
– আমি তো লাগাইনি, লাগিয়েছে আমার ছোট ভাই।
– নিন একটা পেঁপে। নিয়ে চাচিকে দিবেন, খুশি হবে।
– তোমাদের এখানে আসব যে তাকে জানিয়েছি।
– পরের বার আসলে চাচিকে সহ নিয়ে আসবেন।
– আমার ইচ্ছে ছিলো, শেষ বয়সে এলাকায় চলে আসব। ঢাকা শহরে আর ভালো লাগে না। গ্রামীণ পরিবেশে থাকতে পারলে ভালো হত। মুক্ত বাতাস, মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পারলে ভালো হত। ঢাকার ধূলাবালি খেয়ে ফুসফুসে সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। পরে ডাক্তার দেখিয়েছি। এখনো ওষুধপত্র খাচ্ছি।
– চলে আসেন গ্রামে।
– আসতে তো ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমার জীবনটা এমন হয়ে গেছে যে, চাইলেও এখন ঢাকা ছেড়ে আসা সম্ভব নয়।
– হুমম জীব খুব জটিল।
– আর আমি এখনো কারো উপর নির্ভরশীল না। সেজন্য আমি ৭০ বছর বয়সেও নিজেকে চাকরিতে নিয়োজিত রেখেছি। তোফায়েল, আরিফ কোনো ছেলের সাথেই এখন আর যোগাযোগ নেই। দ্বিতীয় ঘরের যে ছেলেটা আছে সে-ও দীর্ঘদিন বেকার ছিলো। আমি বুড়ো বয়সে তাকে চাকরি করে খাইয়েছি। আমি নিজেকে সব সময় আত্মনির্ভরশীল দাবি করি।

আমি মনে মনে ভাবলাম, লোকটা দাম্পত্য জীবনে এতগুলো বিয়ে করল। সুখী হতো পারেনি। হয়তো দ্বিতীয় বউয়ের কাছে সুখে থাকলেও থাকতে পারে।

কয়েকটা লেবু, ২ টা পেঁপে প্যাকেট করে দিলাম উনাকে। তিনি খুশি হলেন। বিদায় জানালাম।
বললাম, আবার আসবেন।
– নিশ্চয়ই। কথা হবে

২.
আজ রমজান মাসের প্রথম দিন। পহেলা বৈশাখও আজ। দুটো দিনই একদিনে পড়ে গেছে। বিকেল বেলা বাইরে থেকে দুটো তরমুজ বাসায় নিয়ে এলাম ৩০ টাকা দরে। অনেক কম বলা যায়। বাসায় এনে আম্মুকে দেখালে আম্মু বলে, আছে তো আরো দুটো ফ্রিজে কেনার দরকার কি ছিলো!
– থাক না, রেখে দিব ফ্রিজে, কালকে পরশুও খেতে পারব।
– কাঁচা মনে হয়। দেখে নিছিস তো?
– কাটলে বোঝা যাবে।

করোনার কারণে সরকার লক ডাউন দিয়েছে আজ থেকে ৭ দিন। চারদিকে করোনা রোগী মারা যাচ্ছে। আজও ৯৬ জন মারা গেছে।
– আব্বু, করোনা মনে হয় আরো ৩ বছর থাকবে।
– ৫ বছরও থাকতে পারে।
– ওইদিন পেপারে দেখলাম, এক বিশেষজ্ঞ বলল, একটা রোগে সম্পূর্ণ ভ্যাকসিন তৈরী হতে ১০ বছরও লাগে।
– হ্যা, লাগে তো।
– তাহলে কি হবে, এই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষজন চাকরি হারাচ্ছে। না খেয়ে মরছে। এভাবে আর কত দিন।
– খুবই উদ্বেগের ব্যাপার।।
– অলরেডি দেড়টা বছর চলে গেল করোনায় আর কতদিন থাকবে কে জানে!

রাতে শুয়ে পড়লাম। আর স্বপ্ন দেখলাম, এলাকার কয়েকটা পরিবারে করোনা রোগীতে কয়েকজন লোক মারা গেছে। ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল।
এখনো পর্যন্ত আমাদের এলাকায় করোনা রোগী মারা যায়নি, শনাক্তও হয়নি। এটা একটা ভালো খবর। কিন্তু স্বপ্নটা দেখে আঁতকে উঠলাম।

আজও লকডাউন। সকালে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ফোন এসেছে বইয়ের পার্সেল নেয়ার জন্য। এক সপ্তাহ আগে একটা অনলাইন বুকশপে কিছু বইয়ের অর্ডার করেছি। এখন বিকেল ৩ টা বাজে। অর্ডারগুলো নেয়ার জন্য আমি বের হলাম বাসা হলাম। রাস্তায় তেমন গাড়ি নেই। দুচারটা রিকশা চলছে। মহাসড়কে ট্রাক কাভার্ডভ্যান সহ পণ্যবাহী গাড়িগুলো চলছে। পথে এক পরিচিত রিকশাওয়ালার সাথে দেখা।
তাকে বললাম, এই লকডাউনে যাত্রী কেমন পান?
সে জানালো, ‘ প্যাসিঞ্জার তেমন নাই ভাই, আতিক্কা দুই ইকজ্ঞা প্যাসিঞ্জার হাই। আর পুলিশ মাঝে মধ্যে দৌড়ানি দেয়।
– ও তাই
– তাছাড়া, সিএনজি দেখলে সিএনজিতেই উডে, রিকশায় তেমন উডে না। তাই কম আছে এক্কানা।

মহাসড়কে সিএনজি চলাচল নিষিদ্ধ করে দিয়েছে সরকার তবুও এই লকডাউনে কিছুকিছু সিএনজি চালছে। তাই দেখে এক সিএনজিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ কি অবস্থা আপনাদের? অনুমতি আছে নাকি চালানোর?
– আরে না, একজনের থেইকা দেইখ্যা আরেকজন চালার। কোনো অনুমতি নাই।
– ও বুঝলাম।
বাজারে লোকজন অনেক কম দেখা যাচ্ছে। অন্যদিন যেখানে এই রাস্তায় হাঁটা যায় না। আজ অনেক কম সে তুলনায়। অনেকের মুখেই মাস্ক দেখা গেছে, আবার অনেকের মুখেই মাস্ক দেখা যায় না। আজ ১০১ জনের মৃত্যু।

অাসরের নামাজ পড়তে গেলাম। মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তায় ডাব বিক্রি করছে এক তরুণ। একজন জিজ্ঞাসা করছে, কিরে, ডাবের দাম কত রে?
– এক জোড়া ১৪০ টাকা করে ভাইজান। আমি সেখানে থাকা জসিম ভাইকে বললাম, ‘নেন না এক জোড়া।’

তিনি কিছুক্ষণ দেখে বললেন, এই করোনায় এত দাম দিয়ে কে খাবে!

ইফতারির কাছাকাছি টাইম হয়ে গেল। আব্বু আজ পায়ে সামান্য ব্যথা পেয়েছেন। অন্যদিন তিনি ইফতার সাজাতে হেল্প করেন। আজ ব্যথার কারণে করছেন ন।ইফাতারিতে আমরা চিড়া, দই, কলা, খেজুর ইত্যাদি মিশিয়ে খাই। আম্মু ভাত খায়। ভাজা পোড়া খাবার কয়েক বছর যাবত খাই না। তবে, রাতে শোয়ার আগে আমি চনা মুরি খাই ভাতের বদলে রমজানে। এটা ভালো লাগে। চিড়াটা আব্বুই সাধারণত রেডি করে থাকেন।

সারাদিন অনলাইনে ঢুকিনি। ইফতারের পর ঢুকলাম। চিত্রনায়ক কবরী মারা গেল করোনায়। অনেকেই পোস্ট দিচ্ছে। এরপর আরো একটা মৃত্যুর খবর একই দিনে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক তারেক শামসুর রহমান মারা গেল। একটা শীর্ষস্থানীয় অনলাইন পত্রিকা জানাচ্ছে, তারেক শামসুর রহমানের মৃতদহ তার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ওই ফ্ল্যাটে তিনি একাই থাকতেন। পুলিশ দরজা ভেঙে উনার লাশ উদ্ধার করেছে। খবরটা শুনে খুবই আফসোস করলাম, এত গুণী ব্যক্তি কি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতেন। শুনেছি, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা দেশের বাইরে থাকেন। তার লেখা ‘বিশ্বরাজনীতির ১০০ বছর ‘ বইটা পড়েছি, চমৎকার একটা বই। এদিকে কবরী মারা যাওয়ার পর তাঁর পূর্বে দেয়া সাক্ষাৎকারের একটি অংশ ভাইরাল হয়েছে। তা হলো, ‘জীবনে একজন ভালো বন্ধু পেলাম না, ভালো একজন স্বামী পেলাম না। সন্তানেরাও যে যার মতো। কারো সাথে বসে এক কাপ চা খাবো, মনের কথা খুলে বলব তা-ও পেলাম না

আম্মুকে এই টুকু পড়ে শোনালাম। তিনি খুবই আপ্লুত হয়ে গেলেন। আম্মু বললেন
– আমি ছোটবেলায় অনেক গুলো সিনেমা দেখেছি কবরীর। এত বড় অভিনেত্রী যদি এই কথা বলে আমরা কই যাব।
– হুম
– মানুষ আসলে বিখ্যাত হলেই যে পরিপূর্ণ হবে তা না। নিঃসঙ্গ যে কেউ হতে পারে।
– হুম
– কবরী মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিনেমায় নাম লিখিয়েছিল। রাজ্জাক কবরী জুটি তখন বেশ জনপ্রিয় ছিল। তারা এক সাথে অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছে। কবরীর বিশেষ করে সুজন সখী, দ্বীপ নেভে যাই, সারেং বউ, তিতাস একটি নদীর নাম ছবিগুলো অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল

– হুম
আম্মুর সাথে কথা বলে আমি আমার রুমে চলে গেলাম।

৩.

প্রিয় সুমন,
‘আশা করি ভালো আছ। আমি তেমন ভালো নেই। ৪/৫ দিন ধরে আমার কাশি, গলা ব্যথা ও শ্বাস কষ্ট। খাবার দাবারেরও ঘ্রাণ পাচ্ছি না। আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি আমার করোনা হয়ে গেছে। তবে এখনো টেস্ট করিনি। কাল সকালে টেস্ট করাতে যাব। আমি অনেক কষ্টে এই ম্যাসেজটা পাশের বাসার একজনকে দিয়ে লেখাচ্ছি। শোনো, করোনায় যদি আমি মারা যাই তাহলে তোমাদের সাথে আর দেখা হবে না। আমার জীবনের অনেক কথা শেয়ার করার ইচ্ছে ছিলো তোমার সাথে। আমার ইচ্ছে ছিলো এলাকায় একটা পাঠাগার দিতে, লোকজন বই পড়ে একটু আলোকিত হোক সেটা চেয়েছিলাম। একটা প্রোগ্রাম করে এলাকার চেয়ারম্যানকে নিয়ে উদ্বোধন করার কথাও ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আগে থেকেই ফুসফুসে সমস্যা। আমি মনে হয় এই করোনা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হব। তুমি ঢাকায় এসে আমার বইগুলো নিয়ে যেও। তা দিয়ে একটা পাঠাগার তৈরী করতে পারলে মরেও আমার আত্মা শান্তি পাবে। তোমার চাচীকে আমি সব জানিয়েছি। তার সাথে যোগাযোগ করবা।
বেঁচে গেলে দেখা হবে। ‘

রাত ১০ টা বাজে। আফসান চাচা ম্যাসেঞ্জারে আমাকে এই ম্যাসেজটি পাঠিয়েছেন। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। আমি ছোট্ট করে লিখলাম
‘ আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। আল্লাহর কাছে এই কামনা করি।

৪.

সকাল বেলা ঘুমাচ্ছিলাম তখনও। আম্মু আমাকে জাগালেন।
– তোমাকে একটা কথা বলা দরকার। মন খারাপ করবে না তো!
– না। বলো।
– তোমার আফসান চাচা তো মারা গেছে।
– কি বলো! ইন্নালিল্লাহ।
– হ্যাঁ, অনিক এসে জানালো। অনিক বাইরে থেকে শুনে এসেছে।

আফসান চাচার মৃতদেহ ঢাকায়ই দাফন করা হলো। তার জানাযায়ও যেতে পারলাম না।

সন্ধ্যায় আমি পাড়ার দোকানের সামনে হাঁটাহাঁটি করেছি। এলাকায় আসলে তিনি যে লোকের সাথে আড্ডা দেন তাদের একজনের সাথে দেখা হলো। তাঁকে দেখে বললাম,
– আফসান চাচার মত্যুর খবর নিশ্চয়ই শুনেছেন।
– হু
– উনার সাথে আমার কয়েক দিন আগেই কথা হলো। করোনার সাথে লড়াইয়ে হেরে গেলেন।
– আমার বাসায়ও এসেছিলো। অনেক কথাবার্তা হলো সেদিনই।
– উনার আগে থেকেই ফুসফুসে সমস্যা ছিলো। করোনা শনাক্ত হওয়ার দুই দিনের মধ্যেই চলে গেলেন।
– মানুষের হায়াত। কখন যে চলে যায়।

৫.

আফসান চাচা আমার এলাকারই লোক। থাকেন ঢাকায়। ফেসবুক পোস্টের সূ্ত্র ধরে পরিচয় হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, তোমার দাদার সাথে আমার অনেক সুসম্পর্ক ছিলো। তোমার সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা রাখি, এলাকায় গিয়ে দেখা করব। তিনি আমার বাসায় আসলেন। দেখা করলেন। খোলাজালি পিঠা খেলেন। জীবনের সামান্য কিছু ঘটনাও শেয়ার করলেন। বাকিটা পরে বলবেন, বলেছেন। হঠাৎ একদিন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত