চৌদ্দ বছর ধরে অদিতির সাথে আমার কোনও যোগাযোগ ও দেখা সাক্ষাৎ নেই। চৌদ্দ বছর পর ম্যাসেঞ্জারে অদিতির এই প্রথম একটি ম্যাসেজ পেলাম। অদিতি লিখেছে — ” জানি, তুমি আমায় দেখতে আসবে না। তবুও বলছি। একবার এসে দেখে যেও আমাকে। শরীর একদম ভালো নেই। হাসপাতাল আর বাড়ি, বাড়ি আর হাসপাতাল — এই করেই দিন চলে যাচ্ছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তোমাকে এই ম্যাসেজটি লিখছি। কেন জানি – তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একবার এসে দেখে যেও। কেবিন নং ১২, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।
অদিতির সাথে আমার একটি চির অভিমান ছিল।
কেন ওর প্রতি আমার অভিমান তা অদিতি জানেও না। ওকে বলিও নি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কোনোদিন আর অদিতির সাথে দেখা করব না। দেখা করিও নি এত বছর।
এই চৌদ্দ বছর অদিতি হয়ত আমাকে নিয়ে অনেক রকম ভুল বুঝে থেকেছে। হয়ত ভেবেছে আমি ওকে ভুলে গেছি। হয়ত ভেবেছে, বিয়ে করেছি তাই স্ত্রী সন্তান নিয়ে দূরে চলে এসেছি। হয়ত ভেবেছে – আমি ওর একজন নিষ্ঠুর বন্ধুই কেবল ছিলাম।
আসলেই অদিতির সাথে নিষ্ঠুরতা আমি করেছি। এই অদিতিকে নিয়ে আমি একসময় ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছি। রিকশার হুডি ফেলে রোদ্রকরোজ্জ্বল আলোর নিচ দিয়ে পথ চলেছি। রেস্টুরেন্টে বসে কত খেয়েছি। নাটক পাড়ায় নাটক দেখেছি। সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখেছি।
আমাদের প্রিয় ছিল নদী। ঢাকার আশেপাশে সবগুলো নদীর কূলে আমরা বেড়াতে গিয়েছি। নৌকায় ভেসেছি নদী বক্ষে। নদীর উদ্ভ্রান্ত শীতল বাতাসে ওর খোলা চুল এলমেল হয়ে উড়ে এসে আমার মুখ ঢেকে দিত। ওর চুলের ফাঁক দিয়ে দেখেছি নীল আকাশ। আমরা জলের দিগন্ত ছুঁতে নদীর স্রোতে ভেসে গিয়েছি। আমরা ডানামেলা গাংচিল হয়ে শূন্যে উড়ে বেড়িয়েছি। আমরা তুলোর মতো মেঘে মেঘে ভেসে ভেসে মিশে গেছি।
অদিতির সাথে পথ চলতে চলতে অনেক সময় পথ হারিয়ে ফেলতাম। ভুল পথে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম অনেক দূর! চিনতাম না কোথায় আমরা এলাম। এইরকম কত পথ হারিয়েছি পথের উপরে। প্রায়ই মনে হতো আমরা কোনও অরণ্যে চলে এসেছি। ময়ুরের পেখম পড়ে আছে বনপথে। বনবীথির ঘন ছায়াতল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আরও বন নিবিড়ে। কতরকম ফুলের গন্ধ নিতাম। কত পাতা ঝরার মর্মর শব্দ শুনতাম দুজন কান পেতে। শালবনে বর্ষার দ্বিপ্রহরে এক ময়ূরকে পেখম মেলে নাচতে দেখেছিলাম। নাচতে নাচতে তার পেখম খুলে পড়েছিল। ময়ূরী তা দেখছিল কেবল। ময়ুরের কষ্ট দেখে ময়ুরী নিষ্ঠুর থাকতে পারেনি। তার কাছে যেয়ে কানে কানে ময়ুরী কী কথা বলেছিল, বুঝতে পারিনি তা। হয়ত মিলনের কথা বলেছিল।
একবার একটি ছোট্ট খোলা কাঠের লঞ্চে করে পদ্মা পারি দিয়ে ভাগ্যকূল গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য – ওখানে নদীর ঘাটে হোটেলে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাব। লঞ্চটি যখন মাঝ দরিয়ায় তখন আমরা খোলা ছাদের রেলিঙের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। চারদিকে থৈথৈ জল। কোথা থেকে ঝলকে ঝলকে পুণ্যময় হাওয়া এসে অদিতির কুসুম কোমল চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল। উড়ছিল ওর শাড়ির আঁচলও। ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ গানের সুরের মতো মনে হচ্ছিল। হঠাৎ দেখি – অদিতি শীতে কাঁপছে। ওর কপাল ছুঁয়ে দেখি, শরীরে বেশ জ্বর। অদিতি বলছিল — ‘আামাকে একটু জড়িয়ে ধরো।’ ওর শাড়ির আঁচল দিয়েই ওকে ভালো করে ঢেকে আমার বাহুডোরে জড়িয়ে রাখি। জ্বরের ঘোরে অদিতি বলছিল — পদ্মার অতল জলে আমাকে নিয়ে যাও। আমি মরব এই জলধীতে।’
আমাদের আর ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া হয়নি সেদিন । ভাগ্যকূলে নেমে আর একটি লঞ্চে করে ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম।
আর একটি ঘটনার কথা বলছি! ঘটনাটি স্বপ্ন না বাস্তব তা এখনও ভ্রান্ত হয়ে আছে আমার জীবনে। হয়ত স্বপ্ন দেখেছিলাম, নয়ত বাস্তবটাই স্বপ্নের মতো মনে হয়েছে।
কালিগঙ্গার তীরে একটা ভাঙা রথঘর। চৈত্রের তপ্ত দুপুরে নদীর কূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি আর অদিতি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমরা রথঘরটিতে গিয়ে বিশ্রাম নেই। বাইরে তখন তপ্ত রোদ ঝনঝন করছে। কোথাও কেউ নেই। একটা পরিত্যক্ত বেঞ্চের উপর দুজন বসি। সামনে নদী বয়ে চলেছে। জল শান্ত। চিকচিক করছে সূর্যের রশ্মি পড়ে। পাশে জঙ্গল থেকে একটি গিরগিটি জলে গিয়ে ঝাপ দিল। জল আলোড়িত হলো।
অদিতি বলছিল — ‘আমার ঘুম পাচ্ছে।’ আমি বলি —
— এখানে কোথায় ঘুমাবে?
— এই ভাঙা বেঞ্চের উপরে।
— এটা একটা ঘুমানোর জায়গা হলো?
— তুমি বেঞ্চের একপাশে বসো, আমি তোমার উরুতে মাথা রেখে ঘুমাব।
— আচ্ছা, শোও। ঘুমাও।
অদিতি আমার উরুর উপর মাথা রেখে শুইল ঠিকই কিন্তু ঘুমাল না সে। ও বললো – ঘুম আসছে না।
— ঘুম আসছে না কেন?
— তোমার শরীরের গন্ধে ঘুম আসছে না।
অদিতি আমার একটি হাত টেনে নিয়ে ওর বুকের উপরে রাখে। আমি অদিতির চোখ দেখি। এই চোখে এই কোন্ মায়া চাহনি! আমিও চেয়ে থাকি !
অদিতি বলছিল – আমার বুকের উপর কান পাতো। শোনো, কেমন নিঃশ্বাস তৈরি হচ্ছে ওখানে। কেমন সেই শব্দ! আমি সত্যি কান পাতলাম। চোখ মুখ ঠোঁট ললাট সবই স্পর্শ হলো…
কী এক ঘোরের মুহূর্ত! যখন ঘোর কাটে তখন অদূরে চেয়ে দেখি — কালিগঙ্গার জল থরথর করে কাঁপছে। হঠাৎ বসন্ত বাতাস হুহু করে বয়ে এসে লাগল আমাদের গায়ে। কবে কে কোন্ কবি লিখেছিল —
‘ অবশেষে, কোনও এক মধ্যাহ্নে
বাঁশঝাড়ের ধারে যদি কেউ ললাট স্পর্শ করে
ধীরে, অতি ধীরে – তাকে দিও আমার বিরহ.. ‘
****
কে এই অদিতি? কিছুই বললাম না ওর কথা।
এই মেয়েটি ঢাকায় এসেছিল মধুমতি নদীর তীরের সুদূর নড়াইল থেকে। অদিতি আমার সহপাঠী ছিল। সহপাঠী থেকে বন্ধু। অদিতিই প্রথম বলেছিল কথা। কোরিডোরে দাঁড়িয়ে একদিন বলেছিল আমাকে–
” তোমার নামটি খুব সুন্দর! “অমিত!” আমার নামের সাথে তোমার নাম মিল আছে। আমি অদিতি। কিন্তু আমি লাবণ্য নই।’
তারপর থেকে অদিতি আমার বন্ধু হলো। ভাবতাম ভালোই হলো। লাবণ্য না হলেও লাবণ্যের মতো চেহারা ওর। চোখ দুটো উদ্বেলিত করত আমাকে। এ্যাথলেট দেহবল্লরী! সুচিত্রা সেনের মতো মায়া করে যখন তাকাতো আমার দিকে, তখন আমার বুক কেঁপে উঠত। মনে একটা আকাঙ্খা তৈরি করে রেখেছিলাম — আহা! এই মেয়ে আমার বউ হলে ভালোই হবে।
কিন্তু ও যে বিবাহিত ছিল তা জানতাম না। জেনেছি পরে। ওর স্বামী ট্রেনিংএর জন্য দেশের বাইরে ছিল দীর্ঘ দিন। অদিতি থাকত হোস্টেলে। ওর একাকীত্বের সময়ে আমি ওর পাশে বন্ধু হয়ে থাকি।
অদিতির স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে এলে অদিতি হোস্টেল ছেড়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছে ভজহরি লেনে একটি বাসা ভাড়া নেয়। একদিন অদিতি বাসার ঠিকানা দিয়ে বলেছিল – ‘বাসায় এসো’। যেন রবি ঠাকুরের ঐ গানের কথার মতো আহবান — ‘দুঃখসুখের দোলে এসো, প্রাণের হিল্লোলে এসো।’
কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছিল না। যাইওনি অনেক দিন। অদিতি অনুযোগ করে প্রায়ই বলত– ‘তুমি আর এলে না। ‘
আমি বলেছিলাম — ‘ যা হারিয়ে যায় তা আগলে রইব কত আর? ‘
কী মনে করে, একদিন সন্ধ্যায় হোস্টেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই অদিতির বাসায়। দোতালায় ওরা থাকে। আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠি। বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ভিতর থেকে অদিতি ও অদিতির স্বামীর খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। একটু পর শুনতে পেলাম অদিতি গান গাইছে — ‘ আমরা – মলয় বাতাসে ভেসে যাবো শুধু কুসুমের মধু করিব পান;
ঘুমোবো কেতকী সুবাস শয়নে চাঁদের কিরণে করিব স্নান।’
এই গানটি আমাকে একদিন অদিতি গেয়ে শোনায়েছিল বুড়িগঙ্গার পাড়ে। আমি আর ভিতরে ঢুকলাম না। কেন জানি মনটা খুব খারাপ লাগছিল। সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসি। পথে নেমে পথের উপর হাটঁতে থাকি। পা চলছিল না। কেমন যেন থেমে থেমে যাচ্ছিল!
মনের গভীরে মর্মরিত ব্যথা অনুভব করছিলাম আর ভাবছিলাম — এই পৃথিবীতে অনেক সত্যই মিথ্যা। অনেক বস্তু আছে যা একান্তই নিজের মনে হয় , কিন্তু সেইসব বস্তু আমার নয়। সেই সব বস্তু যতই প্রিয় হোক না, তা নিজের অধিকারে রাখা ঠিক নয়।
পরিশিষ্ট —
তারপর আমার লেখাপড়ার জীবন শেষ হয়। বিয়ে করি। ঘরে একজন মায়াবতী আসে। আনন্দ বেদনার সংসার করতে থাকি। অদিতির সাথে মাঝে মাঝে কথা হতো, দেখাও হতো। পরে আস্তে আস্তে ওকে দূরে সরে রাখলাম। দূর থেকে শুধু বন্ধুটাই সে রইল। আর সব ঢেকে থাকল গোপন দীর্ঘশ্বাসের নীরব শব্দহীনতার মধ্যে..।
অদিতির ম্যাসেজটি দেখে ইচ্ছে হলো – দেখে আসব ওকে। এতদিন শুধু শুধু অভিমান করে থেকেছিলাম ওর উপর। দেখা করে ওর কাছে যেয়ে ক্ষমা চেয়ে নেব। কিন্তু পোড়ামুখী সে সুযোগ আমাকে দেয়নি। ব্যস্ততার কারণে হাসপাতালে যেতে ক’টা দিন দেরি করে ফেলেছিলাম। পরে জানতে পারি — অদিতি পরপারে চলে গেছে।
- ***