তাকে কেউ চিনতে পারেনি।
গ্রামের রাস্তার একপাশে বসতবাড়ি, অন্যপাশে ফসলের মাঠ। মাঠ চিরে একটি রাস্তা চলে গেছে ছোটো নদীটির দিকে। প্রায় সারাবছরই এর পানি হাঁটুর পরিমাণ থাকে। কেবল বর্ষাকালে কখনো দুইতীর উপচে ওঠে। তীরে প্রচুর গাছপালা ঘন হয়ে আছে। নীরবতাকে এখানে সঙ্গ দেয় পাখির ডাক। ঘুঘুর চঞ্চলতা গাছের সবুজ শাখায় দোলা দিয়ে যায়। নদীর তীরে একপাশে পুরাতন কবরস্থান। মৌনতা এখানের ভাষা। একটু দূরে হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে খিল জমিতে ছেলেরা টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলে, যাদের বয়স হয়ত আট থেকে আটাশ। মাঝেমধ্যে তাদের চিৎকার নদীর তীরের নিস্তব্ধতায় মৃদু ঢেউ তুলে যায়।
আহসান কবির উঁচু রাস্তা থেকে নেমে এলেন মাঠের আইল ধরে। তিনি যেন নেমে যাচ্ছেন সময়ের গভীরে। পথঘাট অনেকটা বদলে গেছে। তাকে চিনবে এমন লোক দেখা যাচ্ছে না। চল্লিশ বছর পর তিনি এলেন এই গ্রামে। কম বয়সীরা তাকে চেনার কথা না। এমনকি আশপাশের গাছপালার কাছেও তিনি অপরিচিত। তাকে মনে রাখবে এমন প্রবীণ গাছ দেখা যাচ্ছে না। বয়স্ক একজন আগন্তুককে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখে এগিয়ে এল ক্রিকেট-খেলা তরুণদের একজন। আহসান কবির তার সাহায্য চাইলেন। তরুণটি দেখতে পেল আগন্তুকের হাতে ফুলের তোড়া, সকল ফুল সাদা। তিনি কবরস্থানে যাবেন। এই গ্রামে কবরে ফুল নিয়ে যাওয়ার মতো কাউকে এখনো দেখেনি তরুণ। ফলে তার মধ্যে কৌতূহল জাগল। কবরস্থানটি মূলত পারিবারিক বলা যায়। আত্মীয়-পরিজনদের বড়ো পরিবারের সদস্যরা প্রায় শত বছর ধরে এখানে শায়িত হয়েছেন। আহসান কবির নির্দিষ্ট একটি কবরের কাছে এগিয়ে গেলেন। নামফলক দেখে প্রাচীন একটি কবরের পাশে গিয়ে বসে পড়লেন। একটু দূরে দাঁড়ানো যুবক বুঝতে পারল না, এই লোকটি কে। তিনি বসে আছেন। একটু কি আবেগাক্রান্ত তিনি? বেরিয়ে এলেন কবরস্থান থেকে। সাথে হাঁটছে যুবক। বিনয়সহ জানতে চাইল, ‘আপনি কি আমাদের আত্মীয় কেউ?’ আহাসান কবির তরুণের দিকে মনোযোগ দিলেন। তার নাম হিমেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে চাকরির চেষ্টা করছে। তার পিতা স্থানীয় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এখন অবসরে আছেন। প্রশ্নের জবাব এককথায় দেয়ার মতো উত্তর তার কাছে নেই। এত বছর পরে আত্মীয়তার দাবি নিয়ে পরিচয় দিয়ে কথা বলা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক দেখায় না। কিন্তু তাকে তো পরিচয়টা দিতে হবে। তিনি নিজের নাম বলে জিজ্ঞেস করলেন, এই নামে কাউকে চিনতে পারে কি না। যুবক আগে কিছুটা আন্দাজ করেছিল। এবার বলল, ‘আপনি আমাদের ফুফা হন।’
বিকেলের আলো কমে আসছে। তরুণ আগন্তুককে নিয়ে বাড়িতে গেল। উঠানের একদিকে বাগান। তার পাশে বসার ব্যবস্থা হল। অনেক কিছু বদলে গেছে। নতুন ঘর উঠেছে। তবে পুরাতন ঘরটি এখনো আছে। টিনের চালের রং গাঢ় খয়েরি হয়ে আছে। তবু টিকে আছে দেখে আগন্তুকের বয়সী চোখ ছলছল করে উঠল। একটি মুখ কি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াবে! বহুবছর আগে ঝরে যাওয়া ফুলের সাথে যেন কথা বলতে এসেছেন আগন্তুক। বয়সী গাছে ঝড়ের ঝাপটার মতো কাতর তিনি। চল্লিশ বছর আগে গত হওয়া একজনের স্বামীর পরিচয় নিয়ে আহসান কবির হাজির হয়েছেন তার শ্বশুর বাড়িতে। লিলির হাসব্যান্ড। তরুণের পিতা তাকে দেখেই চিনতে পারলেন। সময় বদলে দেয় অনেক কিছু, কিন্তু শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পরিচয় একেবারে মুছে ফেলতে পারে না। বয়সী যারা খবর পেলেন, তারা তাকে দেখতে এলেন। উঁচা-লম্বা, সৌম্যদর্শন মানুষটির আগের মতোই লম্বা চুল মাথা ভরে আছে। কেবল সংখ্যা কিছু কমেছে, আর কালো রং সাদায় রূপান্তরিত হয়েছে। বয়স যাদের কম তারা পরিবারের হারিয়ে যাওয়া সময়কে পাঠ করার চেষ্টা করছে। সবার চোখেমুখে আনন্দ। যেন আহসান কবির নয়, এই বাড়ির মেয়ে লিলিই ফিরে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, বিয়ে হয়েছে ক‘মাস হল।
কিন্তু এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন?
২.
চল্লিশ বছর পর গতকাল দেশে এসেছেন আহসান কবির। লিলির মৃত্যুর বছরখানেক পর দেশ ছেড়ে যান। শ্বশুর বাড়ির সাথে যোগাযোগ তার ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অথচ কী দারুণভবেই না যুক্ত ছিলেন তিনি এদের সাথে! লিলি, ভালো নাম আফরিন সুলতানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সমাজবিজ্ঞান বিভাগে তার কয়েক বছরের জুনিয়র। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড করতে গিয়ে পরিচয়। দারুণ গান গাইতো লিলি। দুজনের বাড়িই সিলেট জেলায়। ফলে যোগাযোগ তৈরি হতে সময় লাগেনি। মাস্টার্সের রেজাল্ট হতে না হতেই চাকরি হল তার। একটি ব্যাংকের উচ্চপদের কর্মকর্তা। তারপর একদিন দুজনে সিদ্ধান্ত নিল বিয়ে করবে। বিয়ের প্রস্তাব গেল বাড়িতে। শিক্ষিত ছেলে, ভালো পরিবার–বিয়ে হয়ে গেল। সারা গ্রামের মানুষ দাওয়াত পেল। অনেক ধুমধাম হল বিয়েতে। লিলি রোকেয়া হল ছেড়ে উঠে এল আজিমপুরে তাদের নতুন সংসারে। ছুটির দিনে দুজনে একসাথে নিউমার্কেট যায়। পছন্দের জিনিস যা পায় নিয়ে আসে। ঘরদোর সাজায়। হানিমুনে গেল কক্সবাজার। সিলেটের চাবাগানগুলো ইতোমধ্যে ঘোরা শেষ। পূজার ছুটিতে দেশের বাইরে বেড়াতে যাবে ঠিক হল। এরমধ্যে সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়িতে এল দুজন। একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে আহসান কবির দেখল, তার সকল স্বপ্ন আর আনন্দ নীরব হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। কেন, কী হয়েছে লিলির, কেন এই অকাল ঘুম—কিছুই জানা হল না। কেবল সে সত্যটুকু জানল, একবার কেউ ঘুমিয়ে পড়লে তারে আর জাগানো যায় না। একমাত্র মেয়ের অকাল মৃত্যুতে পরিবারে গভীর শোক অনেকদিন ঘিরে থাকল। একদিন হয়ত বিস্মৃতি এসে কিছুটা দূরেও ঠেলে দেয় লিলিকে। কিন্তু আহসান কবির একেবারে যেন হারিয়ে গেলেন। চাকরি ছেড়ে পাড়ি জমালেন বিলাত। সেখানে টুকটাক চাকরি করেছেন, ছেড়েছেন। দেশের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এবার বহুবছর পর ফিরে এলেন।
৩.
একসময় এই গ্রামে বিদ্যুত ছিল না। সন্ধ্যার পরপরই রাত নেমে আসত। এখন বিদ্যুৎ আছে। তবু চারিদিকের নীরবতা রাতকে ডেকে নিয়ে আসে। খাবারের পর সবাই বসেছে একসাথে। নানাজন নানাকথা জানতে চায়। পাশের বাড়ি থেকে এসেছে খুরশিদ আলী, এই বাড়িতে কাজ করত। তখন তার বয়স কম। তাকে দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে উঠল। ‘কী সুন্দর যে লাগত দুই জনরে। মনে হইত ভাই-বইন।’ প্রতিবেশী কাছম আলীর আফসোস,‘ আমরারে ভুইল্লা গেলাইন?’ ঘরের গৃহিণী জানতে চান, ‘আপনি আর সংসার করেননি?’ এই প্রশ্ন এর আগে তিনি শুনেছেন, জবাব দিয়েছেন। কিন্তু এই বাড়িতে বসে এর জবাব দিতে পারছেন না। কেবল চেয়ে রইলেন। তার মনে হল, লিলি কোথাও আছে। এখনই আসবে। সবার সাথে গল্পে যোগ দেবে।
শেষ যে-বার এখানে এসেছিলেন, এরকমই ভাইবোনরা সবাই মিলে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হল। হারিকেনের আলো ঘিরে বসে থাকা মুখ উজ্জ্বল দেখায়। লিলির মুখ সেই আলোয় কেমন সোনালি হয়ে উঠতো! ক্যাম্পাসের চঞ্চল মেয়েটি বাড়িতে এসে কেমন পরিবারের ছোট মেয়েটি হয়ে যেতো। বউ হওয়ার আনন্দের আড়ষ্টতা তখনো যায়নি। সবার মাঝে কেমন চুপচাপ থাকতো। যেন তার কাজ হল, জীবনের আনন্দ চেয়ে চেয়ে দেখা।
সে রাতের মতো আজও কথায় কথায় রাত বাড়ছে। টিনের চালে গাছ থেকে শিশির ঝরার শব্দ হচ্ছে। দূরে কোথাও নিশুতি পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। লোকজন কমে আসে। লিলির বড়ো ভাই কথা বলছেন কম। তিনিই ছিলেন তখন অভিভাবক। বোনকে অনেক ভালোবাসতেন। পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে দ্বিমত করেননি। লিলিও তাকে বাবার মতো শ্রদ্ধা করত। বয়স যে তাকেও কাবু করেছে, বোঝা যায়। যখন সবার কথা ফুরিয়ে এল, আহসান কবির ধীরে ধীরে স্বগতোক্তির মতো বলতে শুরু করেলেন,‘ এত লম্বা জীবন! একা একা হেঁটে পার করে দিলাম। জীবন থেকে পালাতে পালাতে কখন পার হয়ে গেছি দীর্ঘ পথ। মনে হল, সময় ফুরিয়ে আসছে, এবার থামতে হবে। আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম। লিলিকে আপনারা আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, আমি রাখতে পারিনি। আমার আঙুলের ফাঁক গলে ঝরে গেছে। তবে আমি তাকে ফেলে যাইনি, যেখানে গেছি, বুকে করে নিয়ে গেছি।…আমি একটি ছোট্ট অনুরোধ নিয়ে এসেছি।…লিলির কবরের পাশে আমারে একটু জায়গা দেবেন?’
আহসান কবির থামলেন। নিকটে বসা ছিল হিমেল। তার মনে হল, এই নিঃসঙ্গ মানুষটিকে তার জড়িয়ে ধরা দরকার।