বললাম, আমি ওকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখি। আর সে স্বপ্নগুলো কী যে জীবন্ত থাকে। ঘুম ভাঙার পর বেশ কিছুক্ষণ আমি বুঝতেই পারি না ঘটনাগুলো স্বপ্নে ঘটলো না বাস্তবে।
শুনে সে বলল, হুম।
এবার আমি সবিস্তারে বলতে থাকি, কয়েকদিন আগে আমার খুব জ্বর হলো। কী ভীষণ মাথা ব্যথা ছিল। আমি ঘুমাতে পারতাম না। ডাক্তার কত রকমের ওষুধ দিয়েছিল। তাতে পেইন কিলার আর ঘুমের ওষুধও ছিল। তবু আমার ঘুম হতো না। আমি ছটফট করতাম। শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছি। তখনই ওকে স্বপ্নে দেখলাম।
এবার সে নড়েচড়ে বসল। মনে হলো যেন আমার স্বপ্নের মধ্যে তিনি কোনো গল্প খুঁজছেন। আমি শুরু করলাম।
জানেন, স্বপ্নের মধ্যেও আমার ভীষণ জ্বর। দেখলাম ও আসছে। কিন্তু ও আমার পাশে বসেনি। সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল, তাই না। কিন্তু ও গিয়ে বসল বাবার মানে আমার শ্বশুরের বিছানার পাশে একটা চেয়ারে। আমার ঘর থেকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ওকে। একটা নীলচেক শার্ট ছিল ওর গায়ে। ফুলস্লিভ। হাতে বোতাম লাগিয়ে রেখেছে। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কিন্তু মুখটা খুব গম্ভীর। বাবার সঙ্গে নিচুগলায় কথা বলছিল। তবু আমি সব কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। ওরা আমার শরীর খারাপ নিয়েই কথা বলছিল। বাবা বলছিল, আজ আবার বউমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা দিয়েছে। ওটা করাতে হবে।
শুনে ও বলল, হাসপাতালে নিতে হবে না বাবা। আমি সঙ্গে ডাক্তার নিয়ে এসেছি। মিঠি খুব ভালো ডাক্তার আমাদের ওখানে। মিঠি দেখার পর আপনার বউমা ভালো হয়ে যাবে। আমি মিঠিকে পাঠাচ্ছি আপনার বউমার ঘরে। দেখুক। আমাকে আবার এখনই ফিরতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
শুনে আমার এত অভিমান হলো। আমি এত অসুস্থ। অথচ ও আমাকে ফেলে চলে যাবে! আমি আমার শাশুড়িকে বললাম, মা আপনি ওকে আমাদের সঙ্গে থাকতে বলেন। ও কেন যাবে!
মা বলল, আচ্ছা আমি বলে দেখি। আমার কথা শুনবে কি না তা তো জানি না।
মিঠি আমার রুমে এলো। অল্প বয়সী একটা মেয়ে। চোখ বড়ো বড়ো। চুল কোঁকড়ানো। কিন্তু অনেক লম্বা। হাঁটু ছাড়িয়ে নিচে নেমেছে। কোঁকড়া চুল সাধারণত এত লম্বা হয় না। মেয়েটাকে দেখে আমার কেন জানি খুব বিরক্ত লাগছিল। আর ওর ওপর খুব রাগ হচ্ছিল। আর ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম ঘেমে ভিজে গেছি। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি ভোরের আলো ফুটছে। তখন বুঝতে পারলাম আমি স্বপ্ন দেখছিলাম।
তারপর? তিনি আবার জানতে চান।
এমন স্বপ্ন আমি মাঝে মাঝেই দেখি। একদিন দেখলাম আমি অন্য কোনো দেশে গেছি। রাস্তায় হঠাৎ ওর সঙ্গে দেখা। ও একা ছিল না। সঙ্গে একজন বিদেশি মহিলা আর পাঁচ/ ছয় বছর বয়সী একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা ওরই কোলে। দেখে আমার এত রাগ হচ্ছিল। এদিকে আমাকে আর আমার বাচ্চাকে একা ফেলে গেছে। আমি কত কষ্ট করছি বাচ্চাটাকে বড়ো করতে। আর সে অন্য একজনের বাচ্চা কোলে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি ওকে বললাম, আমার সঙ্গে বাসায় চলো। ও জবাব দিলো, আমার খুব খারাপ একটা রোগ হয়েছিল। ডাক্তার সবার থেকে দূরে থাকতে বলছিল। তাই আমি তোমাদের ফেলে চলে গিয়েছিলাম। সে সময় এই মহিলাই আমার পাশে ছিল। আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। এখন তাকে আমি ছাড়তে পারব না।
শুনে আমার এত কান্না পাচ্ছিল! কাঁদতে কাঁদতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। একটা অদ্ভূত ব্যাপার কি জানেন? আমার শরীর যখন খারাপ থাকে আমি তখনই ওকে স্বপ্নে দেখি। কেন বলুন তো?
তিনি জবাব দিলেন, স্বপ্নতো মানুষ অবচেতনে যা ভাবে, যা সে পেতে চায়, বেশিরভাগ সময় তাই দেখে। অসুস্থ হলে আপনি আপনার মৃত স্বামীকে খুব মিস করেন। তাই তাকে স্বপ্নে দেখেন।
কিন্তু স্বপ্নে ও অমন কেন? বাস্তবে তো অমন ছিল না। আমাদের কখনো ঝগড়া হতো না। আমি কোনো কারনে রাগ করলেও ও হাসিমুখে সেটা সামলে নিতো। আমাকে একা রেখে একদিনের জন্যও কোথাও যায়নি। এমনকি বিয়ের পর বন্ধুদের সঙ্গেও আড্ডা দেওয়া বাদ দিয়েছিল। আমিই একদিন বলেছিলাম, সব সময় আঠার মতো গায়ে গায়ে লেগে থাকো কেন? বন্ধুদের কাছে যেতে পারো না? তোমার কি কোনো বন্ধু নেই?
শুনে ও বলেছিল, আমার জন্য তুমি সবাইকে ছেড়ে আসছ। আমি তোমার জন্য আমার বন্ধুদের ছাড়তে পারব না? তোমার সঙ্গে থাকতেই আমার বেশি ভালো লাগে।
আচ্ছা, সেই মানুষটা স্বপ্নে কেন বার বার আমাকে ছেড়ে চলে যায়!
এর কারণ আপনি নিজেই। তার মানে স্বপ্নের ঘটনাগুলো অবচেতন মনে আপনি নিজেই সাজান। আপনি জানেন, সে যেখানে গেছে সেখান থেকে আর ফেরা যায় না। আবার না ফেরার কিছু যৌক্তিক কারণও তো চাই। সেই কারণগুলোও আপনার মস্তিষ্কই তৈরি করে।
আচ্ছা ধরে নিলাম আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু আমার ওপর ওর এত অভিমান কেন? কী করেছি আমি?
আমার এ প্রশ্ন শুনে তিনি চুপ করে রইলেন। জবাব দিচ্ছেন না বলে আমি একটু অধৈর্য হলাম। আকুতির স্বরে বললাম, বলুন না, ও কেন আমার ওপর রাগ করেছে! আমারই তো ওর ওপর রাগ করার কথা। সারা জীবন এক সঙ্গে থাকব বলে হাত ধরে মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল!
বললে আপনি শুনে রাগ করতে পারেন। অথবা সত্যিটা স্বীকার নাও করতে পারেন। তাই বলছি না।
আমি বললাম, রাগ করব না। আর সত্যিটা গোপনও করব না। বলুন আপনি।
আচ্ছা আপনার স্বামীর মৃত্যুর পর আপনি কি নতুন কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছেন? দেখুন আমি আগেই বলে নিচ্ছি, সেটা কিন্তু অপরাধ না। বরং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি সেটাকে অপরাধ বলে মনে করছেন। আপনি ভাবছেন এতে আপনার স্বামীর প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। তাকে ঠকানো হচ্ছে। সে কারণেই সে আপনার ওপর অভিমান করেছে। আপনার সঙ্গে কথা বলছে না, আপনার পাশে বসছে না। আপনার সঙ্গে ফিরেও আসছে না। কিন্তু এ সব ভাবনাই আপনার মনগড়া। যিনি বেঁচে নেই তিনি তো বিচারের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তাকে তো ঠকানোর কিছু নেই! বরং এভাবে ভাবুন না, যদি আমাদের আত্মা অবিনশ্বর হয়ে থাকে তাহলে তো আপনি ভালো থাকলে তার খুশি হওয়ার কথা। যেহেতু সে আপনাকে খুব ভালোবাসতেন। আর আমাকে সত্য- মিথ্যা কিছুই বলতে হবে না আপনার। বোঝাপড়াটা আপনি নিজের সঙ্গে করুণ। আমার তো মনে হয় আপনাকে ফেলে অসময়ে চলে গেছে বলে আপনার মনেও খানিকটা অভিমান জমে আছে। কিন্তু মৃত্যুর ওপর তো আমাদের কারো হাত নেই।