একজন ভূগোলবিদ কিংবা চিত্রকর যেকোনো সময় বেছে নিতে পারে ফেরিওয়ালার জীবন৷ কিন্তু একজন অধ্যাপক? অধ্যাপকের যেন কোথাও যাবার নেই। অধ্যাপকের চোখে যেন একঝাঁক অন্ধকার মেধা। একটু ছোঁয়া দিলেই যেন মেধাগুলো জ্বালে লাল নীল প্রভূত দীপাবলী।
দীপাবলীর মোহ থেকে অধ্যাপক আটকে যায়। বের হতে পারে না কিছুতেই। সেই মোহই তাঁকে আটকে রাখে স্যাঁতস্যাঁতে ৬০০ স্কয়ার ফিটের ভাড়া বাড়িতে।
ভাত আছে মাছ নাই মাছ আছে লবণ নাই। স্পষ্ট অভাবের জাতাকলে কেটে যায় সংসার নামের এক আধুনিক যন্ত্রণা।
স্ত্রীর চোখ রাঙানি দেখেও না দেখার ভানে চশমাটা চোখ থেকে নাকের কাছে এনে বাংলা একাডেমির বাংলা অভিধানে চোখ রেখে দেখে যান রাগের সমার্থক শব্দ। অভাবের সমার্থক শব্দ। আর ভাবতে থাকেন ঝগড়া বানানে ঝ কেন? জ য কেন নয়? আবার ভাবতে থাকেন ব্যাকরণ্ণিক বিষয় আমার না। থাকুক বানান যেমন আছে।
বড় মেয়েটা ক্লাস এইটে পড়ে। সে বোঝে বাবার ক্রাইসিস তাই তার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করে না। ঝালমুড়ি ফুচকা ভালো লাগে না।
কিন্তু ছোট মেয়ে! যার কিনা বয়স সবে ৫। যা দেখে সবকিছু ভালো লাগে। না খেলেও মাখাতে ইচ্ছে করে। তাকে তো ফ্রিজে লবণ চিনি দিয়ে পানি জমিয়ে আইসক্রিমের বিকল্প বুঝানো যায় না।
অধ্যাপক মাঝেমধ্যেই দম আটকে নিশব্দের সবচেয়ে জোরে কান্নাটা কাঁদেন। সেই কান্না কাউকে স্পর্শ করে না। মানে সবার অগোচরে কাঁদেন৷ ভাবেন এতএত ছাত্রছাত্রী কেন পড়াশোনা করতে আসে? এরা এত এত শিক্ষিত হয়ে যাবেটা কোথায়! এদের যাওয়ার জায়গা কোথায়? কেন সবাইকে অনার্স মাস্টার্স করতে হবে! এমন বিলাসিতা এরা পেলো কোথায়! কারও কি ইচ্ছে হয় না পাখি হবার। কিংবা কিছুই না হবার। নাকি সবাই বেছে নিতে চায় আমার মতো মাস্টারি তথা কেরানির জীবন।
রাগে মাথা গরম হতে থাকে। মাথা গরম হওয়া এই গল্পের অধ্যাপকের নিদ্রা কুসুম। রাগ ওঠলেই তাঁর ঘুম চলে আসে। বিছানা বালিশের প্রয়োজন পড়ে না।
অধ্যাপক শুয়ে আছে শ্বশুড়বাড়ির দেওয়া একমাত্র উপহার সেগুন খাটের ওপরে।
অধ্যাপক বক হয়ে গেলেন। ডানা মেলে ওড়তে থাকলেন শরতের সাদা মেঘ ওড়া আকাশে। টুপ করে বসলেন পুকুরের নিঃস্বঙ্গ এক বাঁশের খুঁটিতে।
পুকুরের স্বচ্ছজলে ভেসে যাচ্ছে পুটিমাছ। পুটি মাছের প্রতি তাঁর কোনো লোভ নেই। তিনি বরং তাকিয়ে দেখছেন ঝাঁকবেঁধে ছুটে চলা পুটি মাছের দল। বাতাসে নদীর ঢেউয়ের মতো পুকুরের পানির ধাক্কাকে উপেক্ষা করে পুটিমাছের সাঁতরে বেড়ানোর যে ছন্দ তা দেখে বক অধ্যাপকের হলো মানুষ হবার শখ। শুধু মানুষ না কবি মানুষ।
কবি মানুষ হয়ে তিনি লিখতে চাচ্ছেন একটা পুটি মাছ কাব্য।
বক, মানুষও হয়ে ওঠে তৎক্ষনাৎ। মানুষ হওয়ার পর দেখা যায় তার হাতে বড়শি। বড়শিতে গাঁথা মাছ শিকারের লোভনীয় খাদ্য।
তিনি ভুলে যায় বক জন্মের কাব্যিকতার কথা।
তাঁর শুধু মনে হতে থাকে পুটি মাছের ভাজির সাথে শুকনা মরিচের কম্বিনেশন। সাথে খিদে পেটের গরম ভাতের কথা।
বড়শিতে টপাটপ ওঠতে থাকে একের পর এক করে অগণিত পুটি, সরপুটি।
রান্নাঘরে বউয়ের সাথে মাছ শিকারি অধ্যাপক পেঁয়াজ ছিলতে ছিলতে গল্প করেন, ‘বুঝলা আঁখির মা, আজগে ছিলো মাছে গো বিয়া। সব মাছ এক অইছে বিয়ার অনুষ্ঠান করতে। এই যে দেখতাসো না পুটি মাছের কানের কাছে কেমন সোনালি লাল ভাব। এইগুলা হইলো গিয়া বিয়ার সাজ। আমি তো হাসতে হাসতে মরি। মাছেগো আবার বিয়া! আমি যেই না টুপ ফালাই ওমনি কামড়ে ধরে। ভাবছে বিয়ার ভোজ। হাহাহা!’
বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে খেতে বসে যেই কড়া ভাজা মাছটা মুখে দিবে ওমনি ঘুম ভেঙে যায় অধ্যাপকের৷
ঘামে ভিজে গেছে অধ্যাপকের গা। কারেন্ট চলে গেছে নাকি ফ্যান নষ্ট হয়ে গেছে বুঝার আগেই ওদিকে রান্নাঘর থেকে স্ত্রীর চিৎকার ভেসে আসছে,’ সারাদিন খালি ঘুম আর শুইয়া বইসা থাকা! ওদিকে যে ঘরে পেয়াজ নাই, লবণ নাই। সেই খবর কি আছে! মাইনশের সংসার করি শুধু সম্মানের ভয়ে। নইলে এখনো বাপের বাড়িতে চলে গেলে বাকি জীবন শুইয়া বইসা খাইতে পারব।’
অধ্যাপক চুপচাপ বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাটতে থাকে দোকানের দিকে। চোখেমুখে এক টক লজ্জা। দোকানে বাকি ৩ হাজার টাকা, আবার নতুন করে বাকি চাইবে কীভাবে ভাবতে ভাবতে আর চশমা মুছতে মুছতে হেঁটে যাচ্ছেন পৃথিবীর পথ, অধ্যাপক।