ডিটেক্টিভ কে কে (কেরামত আলীর কেরামতি)—৫


দখিনমুখী দোচালা ঘর। টিনের চালে লতানো চালকুমড়ো গাছের ছড়াছড়ি। অসংখ্য হলুদ ফুলে ছেয়ে আছে চালা। নিচে ডালিম গাছের ছায়াঘেরা শান্ত জানালার শিক ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে হীরা। একটা চড়ুই বারবার ডালিম গাছের ডালে উড়ে এসে বসছে। হীরা তাকে উড়িয়ে দিচ্ছে। বসতে দিচ্ছে না।
হঠাৎ পুলিস দেখতে পেয়ে সে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ‘এই যে আমি—এই যে—এইদিকে আসেন স্যার!’
পুলিস দেখে কিশোর ছেলেটির এত আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কারণ বুঝতে পারল না কেউ।
দারোগা বাবু, আজগর আলী মেম্বর এবং কেরামত আলী বিস্ময়ে থেমে পড়লেন। যাকে খুনী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে সে নিজেই পুলিসকে ডাকছে—বিস্ময়ের কারণ—এটাই।
সবাই হীরার কাছে যেতেই হীরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার বাবা আমাকে আটকে রেখেছে।’
দারোগা বাবু বললেন, ‘কেন, তোমাকে আটকে রেখেছে কেন?’
‘আমি যাতে বশির ভাইকে দেখতে যেতে না পারি সে জন্য আমাকে আটকে রাখা হয়েছে।’—হীরা বলল।
‘কিন্তু কেন?’—দারোগা বাবু জানতে চাইলেন।
‘আমি জানি না স্যার। আপনি কি একবার আমার বাবার সাথে কথা বলবেন?’
‘অবশ্যই বলব। তোমার বাবা কোথায়?’
‘আপনারা ভেতর বাড়ির আসেন। বাবাকে পাবেন।’

ভেতর বাড়ি পর্যন্ত যেতে হল না। তার আগেই লিয়াকত মোল্লা পুলিসের সাথে দেখা করতে এল।
আজগর মেম্বর লিয়াকত মোল্লাকে দেখিয়ে বলল,—‘স্যার, ইনি হীরার বাবা।’
সহাস্যে সালাম দিল লিয়াকত মোল্লা, ‘স্যার আসসালামালাইকম।’
দারোগা বাবু বললেন, ‘কী ব্যাপার? আপনি ছেলেটাকে ঘরবন্দি করে রেখেছেন কেন?’
লিয়াকত মোল্লা ভয়ে কাঁচুমাঁচু করতে করতে বলল, ‘জটিল কাহিনি স্যার!’
দারোগা বাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘জটিল কাহিনি মানে কী?’
‘আর বলবেন না স্যার। বশিরুল্লাহর খুনের খবর শোনার পর থেকে সে পাগলের মতো আচরণ করছে। বলছে, সে তার বন্ধুর খুনের বদলা নেবে। এই বলে হাতের কাছে দা-বটি যা পাচ্ছে তাই নিয়ে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তাই আমি ভয়ে পেয়ে আটকে রেখেছি।’
দারোগা বাবু বললেন, ‘সে কি খুনীকে চেনে?’
‘না, খুনীকে চিনবে কী করে?’
‘তাহলে দা-বটি নিয়ে খুনের বদলা নিতে কার কাছে যেতে চায়?’
‘স্যার আমি দরজা খুলে দিচ্ছি। আপনারা কথা বলেন।’

আজগর আলী মেম্বর ভেতরে গেল না। বলল, ‘স্যার আপনারা কথা বলেন, আমি বাইরে আছি।’
ভেতরে গেলেন দারোগা বাবু ও কেরামত আলী।

হীরা বলল, ‘স্যার আপনার পিস্তলটা দেন তো!’
দারোগা বাবু বললেন, ‘তুমি পিস্তল দিয়ে কী করবে?’
‘গুলি করব।’
‘কাকে গুলি করবে?’
‘কাকে আবার! আপনি দেখছি কিচ্ছু জানেন না? গুলি করব—খুনীকে।’—বলে দারোগা বাবুর কোমরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করল।
‘না না। তুমি গুলি করতে পারবে না।’
‘কেন পারব না?’
‘কারণ—তুমি গুলি করা শেখো ানি।’
‘আপনি আমাকে শিখিয়ে দিবেন। তারপর গুলি করব। ঠাশ ঠাশ করে গুলি করব।’
‘তুমি ছোট। ছোটদের গুলি করা নিষেধ।’
‘কে বলল নিষেধ? আপনি কি ইউটিউব দেখেন না? ইউটিউবে ছোটরাও গুলি করে।’
‘ইউটিউবে যেগুলো দেখ সেগুলো খেলনা পিস্তল। আর এটা হল—আসল পিস্তল।’
‘আমি আসল পিস্তল দিয়েই গুলি করব।’
‘কাকে গুলি করবে?’
‘বললাম তো—খুনীকে গুলি করব?’
‘খুনী কে? তুমি তাকে চেনো?’
‘না। আমি তো তাকে দেখি নাই।’
‘যাকে দেখ নাই তবে তাকে গুলি করবে কীভাবে?’
‘আগে খুঁজে বের করব তারপর গুলি করব।’
দারোগা বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার বাবা সঠিক কাজটিই করেছেন। আমি হলেও তাই করতাম।’
হীরা বলল, ‘আপনি দেখছি আমার বাবার চেয়েও কঠিন মানুষ।’
দারোগা বাবু হো হো করে হেসে ফেললেন। কিন্তু কিছু বললেন না।
কেরামত আলী বলল, ‘গত চার পাঁচ দিনের মধ্যে বশিরুল্লাহর সাথে কাউকে কথা বলতে দেখেছ?’
‘অবশ্যই দেখেছি।’
‘তারা কারা?’
‘চিনি না তো।’
‘কোথায় কথা বলতে দেখেছ?’
‘চান্দুর দোকানে।’
কেরামত আলী এই পর্যন্ত এসে থেমে পড়ল। খুনী ধরা পড়ে গেছে—এমন একটা ভঙ্গিতে গোল গোল চোখে দারোগা বাবুর দিকে তাকাল।
কিন্তু দারোগা বাবু কেরামত আলীর হুট করে এ-রকম থেমে পড়া বা গোল গোল চোখে তাকানোর কোনো মানে বুঝলেন না। পাত্তাও দিলেন না।
কেরামত আলী বলল, ‘স্যার, এরাই তারা?’
দারোগা বাবু তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, ‘কারাই তারা?’
‘এই যে হীরা বলল, চান্দুর দোকানে অপরিচিত মানুষদের সাথে বশিরুল্লাহকে কথা বলতে দেখা গেছে! অপরিচিত ঐ লোকেরাই হয়তো খুনী।’
‘আপনি কি নিশ্চিত?’
‘হীরার কথা শুনে তো তেমনটাই মনে হচ্ছে স্যার।’
তারমানে এখন চান্দুর জবানবন্দি নিতে হবে—আপনি কি এমনটা ইঙ্গিত করছেন?’
‘একদম ঠিক বলেছেন স্যার। আমি সেটাই বলছি।’
‘স্যরিÑ আমি দুঃখিত। কারণ—আই হ্যাভ টু গো। আমি সাধারণত এতক্ষণ বাইরে থাকি না। খুনের কেস বলে রইলাম। তবে হ্যাঁ, আপনি চাইলে চান্দুর সাথে কথা বলতে পারেন। কথা বলে যদি কোনো ক্লু পান আমাকে জানাবেন। এই যে আমার কার্ড।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
‘আপনি হীরার সাথে কথা বলেন। আমি যাই।’
দারোগা বাবু কেরামত আলীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
কেরামত আলী দারোগা বাবুর সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল, ‘আমি ফোন দিলে আপনি ধরবেন তো স্যার?’
‘ধরব না কেন, ধরব। না ধরলে আপনার পরিচয় দিয়ে টেক্সট করবেন।’
‘অশেষ ধন্যবাদ স্যার।’

দারোগা বাবু চলে যাওয়ার পর কেরামত আলী বাইরের দিকে তাকাল।
আজগর আলী মেম্বর মেহগনি গাছতলে দাঁড়িয়ে ছিল। দারোগা বাবু তার কাছে যেতেই মেম্বর তার পিছু নিল।
কেরামত আলী ভাবল, মেম্বর সাহেব কি এখন পুলিসকে ঘুষ দিয়ে তদন্তের কাজ বন্ধ কর দেবে? আবার এটাও ভাবল, মেম্বর তাকে টাকা দিতে চায় কেন? কইতরি বেগম বলেছে বলে? না-হয় কইতরি বেগম বলেছে, তাই বলে সে টাকা দিতে এত আগ্রহী কেন? এখানে তার স্বার্থ কী? সে কি তবে এই খুনের সাথে জড়িত?
বশিরুল্লাহর খুনের সাথে মেম্বরের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে চিন্তা করতে গিয়ে কেরামত আলীর মাথায় প্যাচ লেগে গেল। তবে সে এই চিন্তায় বেশি দূর এগোতে পারল না।

এর মধ্যে হীরা বলল, ‘আপনাকে তো চিনলাম না!’
কেরামত আলী বলল, ‘না চেনারই কথা।’
‘পরিচয় দেন। আপনার নাম কী?’
‘আমার নাম কেরামত আলী। এ্যাসিসট্যান্ট ক্লার্ক, মৎস্য বিপণন বিভাগ, কাওরান বাজার, ঢাকা।’
‘মৎস্য মানে কী?’
‘মৎস্য মানে মাছ।’
‘তার মানে আপনি মাছ ধরেন?’
‘না। মাছ ধরে জেলেরা?’
‘আপনি কী করেন?’
‘আমি হিসাব রাখি।’
‘মাছ ধরার হিসাব রাখেন?’
‘না। মাছ বিক্রি করার হিসাব রাখি।’
‘তারমানে আপনি মাছ বেচেন?’
‘তা বলতে পারো।’
‘এ জন্যই তো বলি—এত মাছের গন্ধ কেন? পঁচা মাছের গন্ধ! উয়াক থু!’
‘না না না তুমি যা ভাবছ ব্যাপার সেরকম নয়। মাছ বিক্রি করার আলাদা লোক আছে। আর তাছাড়া মাছের গোডাউন থেকে আমার অফিস অনেক দূরে। সেখান থেকে আমার গায়ে মাছের গন্ধ আসা সম্ভব নয়।’
‘কিন্তু আমি কিসের গন্ধ পাচ্ছি?’
‘আতরের গন্ধ পেতে পারো। আমি আতর দিয়েছি। বিদেশি আতর।’
‘সত্যিই বিদেশি?’
‘হ্যাঁ। মেইড ইন মরক্কো।’
‘কই দেখি তো—জিনিসটা?’
‘সাথে নেই। লাগেজে রেখে এসেছি।’
হীরা কেরামত আলীর পাঞ্জাবির কোণাটা শুঁকে বলল, ‘তারমানে এটা পচা মাছের গন্ধ না?’
‘অবশ্যই না।’
‘ঠিক আছে। আপনার কথাই মানলাম।’
কেরামত আলী গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘যারা বশিরুল্লাহর কাছে আসত তারা কারা?’
‘বশির ভাইয়ের আত্মীয়।’
‘কেমন আত্মীয়?’
‘ভালো আত্মীয়।’
‘ভালো আত্মীয় মানে কী?’
‘ফকরু ঘটকরে চেনেন?’
‘না।’
‘ফকরু ঘটক আসত।’
‘আর?’
‘আর আসত পাত্রীর খালাত ভাই।’
‘খালাত ভাই! খালাত ভাই আসত কেন?’
‘বশিরভাইয়ের সাথে দেখা করতে।’
‘খালাত ভাইয়ের নাম কী?’
‘মজনু।’!
কেরামত আলী ভাবল, দুয়ে দুয়ে চার মিলে যাচ্ছে। চিকনা চামেলি—মানে পুতুলের সাথে তবে কি মজনুর প্রেমের সম্পর্ক ছিল? অস্বাভাবিক নয়। থাকতে পারে।
কেরামত আলী বলল, ‘তা মজনু কী বলত?’
‘বেশি কিছু বলত না। খালি খাইত। মাগত পাইত আর খাইত।’
‘কী খাইত?’
‘বিস্কুট, চানাচুর, কলা, চা আর সিগারেট।’
‘শুধু খেত? কথা বলত না?’
‘বলত।’
‘কী বলত?
‘বলত—তার খালাত বোন খুব নরম স্বভাবের। তাকে যেন বশির ভাই আদর-যতœ করে রাখে। তাকে দিয়ে যেন বেশি কাজ-কর্ম না করায়।’
‘আর কী বলত?’
‘আরো অনেক কথা বলত। সব তো মনে নাই।’
‘মজনুর পকেটে কখনো কি পিস্তল বা কিরিচ দেখেছ?’
‘কিরিচ কী?’
‘কিরিচ মানে—চাকু।’
‘আরে নাহ! সে তো খারাপ লোক না। ভালো ছেলে।’
‘তাই?’
‘হ্যাঁ।’
‘ফকরু ঘটক কেমন লোক?’
‘ভালো তবে—চিটার। কিছুটা বাটপারও।’
‘তারমানে কে চিটার আর কে বাটপার তুমি সেটা বুঝতে পার?’
‘অবশ্যই। আমি সব বুঝতে পারি।’
‘আমাকে দেখে তোমার কেমন লোক মনে হয়—বল তো শুনি?’
‘আপনি একজন হাবা লোক। দুনিয়ার হাবা।’
কিশোর বালকের কাছ থেকে নিজের সম্পর্কে এ-রকম সাটিফিকেট পেয়ে কেরামত আলী থতমত খেয়ে গেল। স্টেশনের চাঅলার সাথে হীরার পাওয়া যাচ্ছে। চাঅলা তাকে বলেছে—ভোদাই, আর হীরা বলছে—হাবা। হাতের কাছে ডিকশনারি থাকলে দুটো শব্দের আলাদা আলাদা অর্থ বের করে দেখে নেওয়া যেত। তবে তার ধারণা—দুটো শব্দের অর্থ হয়তো একই হবে। মানে—বোকা।
যাক। আদতে সে বোকাই। এটা পুরনো কথা। এ নিয়ে চিন্তা করে লাভ কি। বরং বশিরুল্লাহ কীভাবে খুন হল—সেটা নিয়ে ভাবা ভালো।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত