৩
ভাদ্র মাসের গরমে দারোগা বাবু নাস্তানাবুঁদ।
বিশাল দেহী দারোগা বাবুর কলসির মতো ভুঁড়িটি দ্রুত গতিতে ওঠা-নামা করছে। ওজনের ভারে হাতলঅলা চৌধুরীমার্কা চেয়ারের পেছনের পায়া উঠোনের বেলে-দোআঁশ মাটি ভেদ করে ডেবে গেছে।
দুই কনস্টেবল জব্বার আলী ওরফে যদু ও মোমিনুল ইসলাম মধু তাদের স্যারকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। একজন বাতাস করছে—তো আর একজন দেড় লিটারের বোতল থেকে ঠাণ্ডা কোক গ্লাসে ঢালছে।
গ্লাস উপচে কোকের ফেনা পড়ে যেতে থাকলে দারোগা বাবু কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আহ! আস্তে ঢাল।’—তারপর কোকের গ্লাসে চুমুক দিয়ে গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ঘটনাটা কীভাবে ঘটল?’
বেদনার্ত ও উৎসুক গ্রামবাসীরা এতক্ষণ দারোগা বাবুকে ঘিরে ছিল। কিন্তু তাঁর প্রশ্নটি শুনে কেউ মুখ খোলার সাহস পেল না।
‘আপনি বলেন’,—গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, দেখতে কালো, মুখে এলোমেলো দাড়ি, আর কড়া হলদে দাঁতের এক গ্রামবাসীর দিকে তাকিয়ে দারোগা বাবু বললেন, ‘কী জানেন, বলেন তো শুনি?’
স্যান্ডো গেঞ্জিঅলা কাঁচুমাঁচু করতে করতে বলল, ‘ছার আমি এ ব্যাপারে কিছুই না। শুধু জানি, বশিরুল্লাহ খুন হয়েছে।’
‘সত্যিই জানেন না?’
‘না।’—স্যান্ডে গেঞ্জিঅলা পিছিয়ে গেল।
দারোগা বাবু কোকের গ্লাসে চুমুক দিয়ে আর একজন গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনি কি কিছু জানেন?’
‘জি না ছার। আমিও শুধু এইটুকু জানি—বশিরুল্লাহ খুন হয়েছে।’
দারোগা বাবু তৃতীয় ব্যক্তির কাছেও একই উত্তর পেলেন। ফলে তিনি বুঝে গেলেন, কেউ ঝেড়ে কেশে মুখ খুলবে না। তাই পিচ্ছিল কফ জড়ানো ফ্যাসফ্যাসে স্বরে তিনি হেসে উঠলেন। বললেন, ‘কেউ কিচ্ছু জানে না। যদু-মধু তোরা কিছু জানিস রে?’
যদু বলল, ‘আমিও কিছু জানি না স্যার।’
কিন্তু মধু বলল, ‘স্যার, এখানে উপস্থিত একজনকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি সব জানেন।’
‘কে সে?’
কেরামত আলীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে কনস্টেবল মধু বলল, ‘এই— ইনি!’
দারোগা বাবু কেরামত আলীর দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকালেন। শাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা একহারা লম্বা লোকটি। ক্লিন শেভ করা। ঠোঁটের উপর চিকন গোঁফের রেখা এমনভাবে রাখা হয়েছে যেন সে সদ্য গোঁফ ওঠা কৈশোর পেরোনো যুবক। খুব সহজেই গ্রামের মানষজন থেকে তাকে আলাদা করা যায়। কিন্তু সে গ্রামবাসীদের থেকেও বেশি কাঁপছে, ভয়ে। রীতিমতো তার পা দুটি থিরথির করে কেঁপে চলেছে। ঢোলা পাজামার কারণে পা-কাঁপুনির পুরোটা যদিও বোঝা যাচ্ছে না।
দারোগা বাবু বললেন, ‘আসেন ভাই, সামনে আসেন।’
কেরামত আলী ভয়ে ভয়ে দারোগা বাবুর সামনে এল। কুঁজো হয়ে দুই হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেক করার জন্য।
কেরামত আলী দুই হাত বাড়িয়ে দিলেও দারোগা বাবু এক হাত দিলেন। তাতে অস্বাভাবিক এক হ্যান্ডশেক অনুষ্ঠিত হল।
দারোগা বাবু বললেন, ‘কেমন আছেন?’
কেরামত আলী যেন তার কথাটি শুনতে পেল না তাই সম্বিত ফিরে পাওয়ার মতো করে বলল, ‘জি?’
দারোগা বাবু আবার বললেন, ‘বলছি—আপনি কেমন আছেন?’
কেরামত আলী বলল, ‘জি আমি খোদার অশেষ কৃপায় এক প্রকার আছি। আপনি ভালো আছেন তো স্যার?’
দারোগা বাবু কেরামত আলীকে হয়তো আজিব চিড়িয়া ভাবলেন। বক্র-মিষ্টি হাসি হেসে বললেন, ‘আমিও খোদার অশেষ কৃপায় এক প্রকার আছি।’
‘ম্যাডাম সাহেবা কেমন আছেন?’
‘তিনিও ভালো আছেন।’
‘আর আপনার বাচ্চকাচ্চা—বাবুসোনারা?’
‘ওরাও ভালো আছে।’
‘সদা-সর্বদা দোয়া করি—তারা যেন ভালো থাকেন। নিরাপদে থাকেন।’
দারোগা বাবু বললেন, ‘আমিন! তা আপনার নাম কী ভাই?’
‘আমার নাম কেরামত আলী। এ্যাসিসটেন্ট ক্লার্ক, মৎস্য বিপণন বিভাগ, কাওরান বাজার, ঢাকা।’
দারোগা বাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘আপনি ঢাকায় থাকেন?’
‘জি জি। আমি আর আমার প্রাণপ্রিয় সহধর্মীনি মালেকা বিবি মিলেমিশে একই বাসায় ভাড়া থাকি। বাড়ি নং ২৪২/এ, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, কাঁঠালবাগান, ধানমন্ডি।’
দারোগা বাবু বিপুল উৎসাহে বললেন, ‘বাহ! আপনারা একই বাসায় থাকেন! কী চমৎকার! তা আপনাদের বাসাটা নিশ্চয় খুব সুন্দর?’
‘দুই রুমের বাসা স্যার। দখিনমুখী। কিন্তু সামনেই লাগোয়া বাড়ি থাকায় আলো-বাতাস খুব একটা ঢুকতে পারে না। তাই শতভাগ সুন্দর—এ কথাটা বলা যায় না।’
‘তো আলো-বাতাস আছে—এ-রকম একটা বাসায় উঠলেই পারেন।’
‘তা হয়তো পারি স্যার—কিন্তু ভাড়ায় কুলোতে পারব না।’
‘হুম..সেটা একটা ব্যাপার।’—বলে দারোগা বাবু আজিব-চিড়িয়ার দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
কেরামত আলী বলল, ‘স্যার, এভাবে আমার দিকে তাকাবেন না। আমার ভয় লাগে।’
‘কেন, ভয় লাগে কেন?’
‘দারোগা-পুলিস দেখে ভয় পাওয়া আমার ছোটবেলার অভ্যাস স্যার।’
‘ধুর মিঞা। এটা কোনো কথা বললেন? আজকালকার যুগে কেউ কি পুলিস দেখে ভয় পায়?’
‘স্যার, আমি পাই স্যার।’
‘কী কারণে ভয় পান?’
‘মৃত্যু স্যার, মৃত্যুই হল—ভয়ের কারণ।’
‘এটা তো খুবই আজিব কথা বললেন। পুলিসরা কি মানুষ মেরে ফেলে?’
‘না না স্যার আমি তা বলি নি।’
‘তাহলে?’
‘মানে হল—আপনাদের কাছে অস্ত্র থাকে—যেমন আপনার কোমরে একটি কালো পিস্তল রয়েছে—চাইলেই ওটা দিয়ে মানুষ মেরে ফেলা যায়।’
‘কিন্তু আমরা কি তা করি? আমরা চাইলেই তো কাউকে গুলি করতে পারি না। আইন আমাদেরকে সেই অধিকার দেয় নি।’
‘তা বটে তবে সবসময় কি আপনারা আইন মেনে চলতে পারেন? ধরা যাক, এখন আপনি আমার উপর রেগে গেলেন আর টাশ টাশ করে দুটো গুলি করে দিলেন। আমি কি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব? পটাং করে পড়ে গিয়ে পটল তুলব না?’
দারোগা বাবু গলাখাঁকারিমূলক একটা কাশি দিয়ে বললেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি বোকামানুষ কিন্তু আপনার সাথে কথার বলে মনে হল—যতটা বোকা ভেবেছিলাম আপনি ততটা বোকা নন।’
কেরামত আলী লাজুক হাসি হেসে বলল, ‘না স্যার! আপনার প্রথম ভাবনাটাই ঠিক আছে হে হে হে! আমার স্ত্রীও আমাকে তাই বলে।’
‘মানে—বোকা বলে?’
‘বোকার হদ্দ বলে।’
দারোগা বাবু হো হো করে হেসে উঠলেন। সিগারেটে আগুন সংযোগ করে বললেন, ‘তো মৃত্যুর খবর পেয়ে বুঝি আপনি ঢাকা থেকে ছুটে এসেছেন?’
‘না স্যার। আমি এসেছি বশিরুল্লাহর বিবাহ খেতে। মৃত্যুর খবর পেলাম তো এখানে এসে—এই তো একটু আগে।’
‘ওহহো! আপনার দাওয়াত খাওয়াটা হল না।’
‘জি স্যার। দাওয়াত খাব বলে তিন দিনের ছুটি নিয়েছি। বৃহস্পতি-শুক্র-শনি। কিন্তু আগে খেয়াল ছিল না—ছুটির নেওয়ার পর খেয়াল হয়েছে—শুক্র-শনি এমনিতেই ছুটির দিন।’
‘আহা—কী ভুলটাই না হয়েছে!’
‘তারপরও আফসোস করছি না কারণ—ভুল তো ভুলই—তাই না স্যার?’
‘অবশ্যই। কিন্তু আপনার উয়াইফ কোথায়? তিনি আসেন নি?’
‘না স্যার, আসে নি। আসবে কীভাবে? পায়ে বাতের ব্যথা যে!’
‘এ আবার কী বলছেন!’
‘জি স্যার। প্রতিদিন পা টিপে না দিলে তার ঘুম আসে না।’
‘আহারে!’
‘দোয়া করবেন স্যার।’
‘তো বশিরুল্লাহটা কে?’
কেরামত আলীর আগেই গ্রামবাসীদের কেউ একজন চট করে উত্তর দিল, ‘এই মুর্দাই হল—বশিরুল্লাহ।’
দারোগা বাবু কোকের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তা সে কেমনে খুন হল—এ ব্যাপারে কিছু কি জানেন?’
একটু আগে চট করে উত্তর দেওয়া গ্রামবাসীটি দারোগা বাবুর এই প্রশ্নে এক দুপা করে পিছিয়ে গেল। উত্তর দিল কেরামত আলী, ‘না স্যার। আমি এইমাত্র এসে পৌঁছলাম। আগামিকাল শুক্রবার বাদ জুম্মা বশিরুল্লাহর বিয়ের বরযাত্রীর সাথে আমার সওয়ার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই আমার খালাত ভাইটা খুন হয়ে গেল।’
কথার মাঝখানে কনস্টেবল যদু দারোগা বাবুর কানে কানে বলল, ‘স্যার ইনাকে সন্দেহের তালিকায় রাখব কি?’
দারোগা বাবু আর একবার কেরামত আলীকে জরিপ করে বললেন, ‘নাহ। দরকার নেই বোধ হয়।’
এর মধ্যে হোমড়াচোমড়া ভঙ্গিমায় শুকনা দেহের মেম্বর আজগর আলী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল, ‘সবাই সরে যান। দারোগা স্যারের সাথে আমার কিছু কথা আছে—প্রাইভেট।’—তারপর দারোগা বাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের পরিচয় দিল।
গ্রামবাসী অলসভঙ্গিতে সরে যেতে লাগল—যেতে যেতে ফিরে তাকাল কেউ কেউ। তবে সবাই চলে গেলেও কেরামত আলী গেল না।
মেম্বর সাহেব একটা কৃত্রিম কাশি মেরে বলল, ‘স্যার, মুর্দা কি দাফন করা যাবে?’
দারোগা বাবু শেষ হয়ে যাওয়া কোকের গ্লাস কনস্টেবল মধুর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘না মেম্বর সাহেব! আপনি কি মুর্দা দাফন করে আমার চাকরি খেতে চান?’
মেম্বর সাহেব হাসি-সমেত আর একটা কৃত্রিম কাশি দিয়ে বলল, ‘কী যে বলেন স্যার। আজরাঈলেরও কি সাধ্যি আছে—আপনার গতরে টোকা দেওয়ার?’
গ্লাসে চুমুক দিয়ে কোক ভরা ফোলা-ফাঁপা গালে দারোগা বাবু রোদ-ঝলমল ফুটন্ত হাসি হাসলেন। তাঁর চোখ দুটো নদী চরের পরিস্কার বালুর মতো চিকচিক করে উঠল। তিনি মুখের কোক পেটে চালান করে একটা প্রমাণ সাইজ ঢেঁকুর তুলে বললেন, ‘না ভাই। আমরা আল্লাহর নাখারাজি কথা থেকে বিরত থাকি। একদিন সবাইকে মরতে হবে। এই দুনিয়াদারি যেমন আছে সেভাবেই পড়ে থাকবে কিন্তু আমরা সবাই চলে যাব।’
এ ধরনের কথা সর্বসমাজেই সমাদৃত। ফলে দারোগা বাবুও বাহবা পেলেন।
কেরামত আলী মনে মনে ভাবল, বাহ! কী পরহেজগার দারোগা বাবু! দারোগার প্রতি তার তাজিম দিগুন বেড়ে গেল।
মেম্বর বলল, ‘তো এখন ডিশমিশের উপায় কী স্যার?’
দারোগা বাবু বললেন, ‘উপায় একটাই—আর তা হল—খুনীকে খুঁজে বের করা।’
‘কেউ তো দেখে নাই। কোনো সাক্ষীসাবোদও নাই। খুনীকে কেমনে খুঁজে বের করবেন স্যার?’
দারোগা বাবু তার স্বভাবসুলভ পুলিস জাতির চিরচেনা হাসি হেসে বললেন, ‘পুলিস পারে না এমন কিছু আছে নাকি? এভরি থিং ইজ পসিবল।’
দারোগা বাবুর কথাটা কেরামত আলীর খুব ভালোলাগল। দারোগার প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথাটা বাড়ন্ত লাউ লতার মতো নূয়ে পড়ল।
মেম্বর একবার কেরামত আলীর দিকে আর একবার যদু-মদুর দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ‘আমি কি আপনার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে পারি স্যার?’
‘নিশ্চয় নিশ্চয়’,—বলে দারোগা বাবু কেরামত আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি একটু ওদিক থেকে ঘুরে আসুন। পরে আবার আপনার সাথে কথা বলব।’
কেরামত আলী বাধ্য বালকের মতো টু শব্দটি না করে চলে গেল।
মেম্বর বলল, ‘ঘটনা—গতকাল সন্ধ্যার। আর কিছুক্ষণ পর মুর্দার শরীর থেকে দুর্গন্ধ বেরুতে শুরু করবে। তখন এখানে আপনারা বসে থাকতে পারবেন না। তো এই অবস্থায় একটা ফায়সালা করা যায় না স্যার?’
কনস্টেবল মধু দারোগা বাবুর কানে কানে বলল, ‘ইনাকে কি সন্দেহের খাতায় রাখা যায় স্যার?’
দারোগা বাবুও মধুর কানে কানে বললেন, ‘কিন্তু সে তো মাল সাধছে। মাল ধরব নাকি সন্দেহ করব?’
মধু বলল, ‘এখানেই তো সমস্যা স্যার। খুনের বিচার না চেয়ে মাল সাধছে—এটা কি সন্দেহের ব্যাপার নয়?’
দারোগা বাবু বললেন, ‘ইটস আ ভ্যালিড পয়েন্ট।’
মধু বলল, ‘এ্যারেস্ট করব স্যার?’
দারোগা বাবু বললেন, ‘আগেই না। আর একটু দেখি।’
মধু বলল, ‘ওকে স্যার।’
দারোগা-কনস্টেবলের কানাকানি-ফিসফিসানি শেষ হলে দারোগা বাবু সিগারেট ধরালেন।
মেম্বর বলল, ‘স্যার আমাকে ভুল বুঝবেন না। মুর্দার মাতা চাইছেন না তার সন্তানের লাশ কাটাছেঁড়া করা হোক। তাই আমি তার হয়ে আপনার প্রতি বিশেষ আর্জি জানিয়েছি। যদি সম্ভব হয় ফায়সালা করেন—নয়তো আপনাদের নিয়ম অনুযায়ী যা করার তাই করেন।’
কেরামত আলীর কাঁধে ভর দিয়ে দারোগা বাবুর কাছে এল বশিরুল্লাহর বৃদ্ধা মাতা কইতরি বেগম। এসেই পাগলিনীর মতো বাংলার চিরায়ত সুরে তাৎক্ষণিক স্বরচিত পদে আহাজারি শুরু করল:
‘কাটলে কলিজার ধন—
মায়ের মনে ব্যথা পাবে—
সইতে পারব না গো—দারোগা বাবু—
ওগো দারোগা বাবু॥’
ক্রন্দন-নৃত্য শেষ করে কইতরি বেগম মূর্ছা যায় যায় অবস্থায় দারোগা বাবুর পা জড়িয়ে ধরল।
‘আরে আরে কী করছেন!’—দারোগা বাবু সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন এবং বৃদ্ধা মাতাকে টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগলেন।
এই ফাঁকে দারোগা বাবুর ভারে ডেবে যাওয়া চৌধুরীমার্কা চেয়ারখানা স্থানান্তর করে দিল কনস্টেবল যদু।
মেম্বর ও কেরামত আলীর সহায়তায় বৃদ্ধা মাতাকে টেনে তোলা সম্ভব হল।
কইতরি বেগম আবার তার ক্রন্দন-নৃত্য শুরু করল:
‘বুকের ধন পাখির মতো ফুড়–ৎ করে উড়ে গেছে—
বলতে পারেন—কোথায় পাব তারে গো দারোগা বাবু—
বলেন—কোথায় পাব তারে॥’
দারোগা বাবু বললেন, ‘আপনি শান্ত হোন। আমার কথা শোনেন।’
‘শান্ত আমি হতে পারব না গো দারোগা বাবু—
শান্ত হওয়ার কোনো উপায় নাই।
বুকের মানিক যার উড়ে গেছে
কেমনে সে শান্ত হবে ওগো দারোগা বাবু॥’
দারোগা বাবু বললেন, ‘আচ্ছ ঠিক আছে। আমি দেখছি কী করা যায়। হল তো?’
কইতরি বেগম কিশোরি-বালিকার মতো খিলখিল করে হেসে উঠল, ‘আপনি বহুত ভালো ওগো দারোগা বাবু—আপনি বহুত ভালো।’
কেরামত আলী বলল, ‘পাগলামি কোরো না খালা। দারোগা বাবুর কথা শোনো।’
কইতরি বেগম প্রচণ্ড রেগে গেল। কেরামত আলীর গালে ঠোক্না মেরে বলল, ‘তুই কীভাবে মায়ের মন বুঝবি? তোর কি সন্তান আছে? তুই তো আটকুঁড়ে। সন্তান হারানোর বেদনা তুই কেমন করে বুঝবি রে—কেরামত?’—আবার শুরু হল ক্রন্দন,—‘তোরা কেউ মায়ের বেদনা বুঝতে পারবি না, ওরে আমার প্রাণের ভাগিনা—কেরামত, তোরা কেউ আমার বেদনা বুঝতে পারবি না।’
কেরামত বলল, ‘ঠিক আছে খালা। তোমার কথাই ঠিক।’
‘ওরে আমার ভাগি না রে—
তুই যদি আরো আগে আসতি রে ভাগিনা—
আমার কলিজার ধন খুন হইত না!’
কেরামত আলী তার খালার শাড়ির আঁচল ঠিক করে দিয়ে বলল, ‘কেমন করে আসি খালা? তুমি তো জানো—আমার অফিস আছে। তাছাড়া তোমাদের বউমার বাতের ব্যথা।’
এবার কইতরি বেগম নৃত্য-ক্রন্দনের আছর কাটিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল—যেন তার কিছুই হয় নি—সবকিছু ঠিকঠাক আছে—‘আরে রাখ তোর বাঞ্জা বউয়ের কথা। ঐ বউ বিদায় কর। আমি তোকে আবার বিয়ে করাব। দেখবি—বছর যেতে না যেতেই তোর ঘরে চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর একটি ছাওয়াল জন্ম নিবে!’
‘ঠিক আছে খালা, তাই হবে। এখন ঘরে চল।’
কইতরি বেগম আর কোনো কথা বলল না। যেন সে কেরামত আলীর কথা মেনে নিয়েছে।
কেরামত আলী তাকে ধরে ভেতর বাড়ি নিয়ে গেল।