শেষের গান শূন্য আকাশ

 

আজকের দিনটা শুরুই হয়েছিল ভীষন বিচ্ছিরিভাবে! একেকটা দিন এমন আসে। সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি, নাশতা না খেয়ে তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে বের হয়ে আসা, রাস্তায় গাড়ি না পেয়ে রোদে দাঁড়িয়ে থাকা এবং অতঃপর দেরি করে অফিসে আসা। মিটিং ছিল সকাল এগারোটায়। সাপ্তাহিক এই মিটিংটা সাধারনত আধা ঘন্টা বা বড়ো জোর এক ঘন্টায় শেষ হয়। আজ মিটিং শেষ হতে প্রায় দেড়টা বেজে গেল। বের হয়ে হাতের কাজ শেষ করে ফ্রেস হয়ে কেবল লাঞ্চ নিয়ে বসতে যাবে মিথিলা। ঠিক তখনই টেবিলের ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল। খুব গুরুত্বপূর্ণ কল না ধরে নিয়েই রিসিভার তোলে মিথিলা। পিএবিএক্স থেকে জানালো, আপনার একজন গেস্ট আছেন। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন। মিটিংয়ে ছিলেন বলে বসিয়ে রেখেছি।
এখন আমি লাঞ্চ করব! আরও কিছুক্ষণ বসতে বলো! বলেই মিথিলা জানতে চান, নাম কি?
নাম বললেন অর্ণব।
অর্ণব! অর্ণব এসেছে! এখন এই সময়! না বলে! কেন! মুখে বললেন, পাঠিয়ে দাও!
অর্ণব এলো। কাউকে কিছু জিঞ্জেস না করেই সরাসরি ওর টেবিলের দিকেই এগিয়ে এলো। পরনে জিন্স, সাদায় নীল ছোট বুটি দেওয়া ফুলশার্ট। হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো। ছেলেটা লম্বাও বেশ। হালকা পাতলা গড়ন। মাতা ভর্তি অবিন্যস্ত চুল কপালের এক পাশ ঢেকে দিয়েছে। দুপুর রোদ পেরিয়ে এসেছে বলেই হয়তো ফর্সা মুখে এখনও লালচে আভা। টেবিলের অপর দিকে দাঁড়াতেই মিথিলা হেসে বলল, বসো!
আমি বসতে আসিনি!
তাহলে?
আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনি তো লাঞ্চ করেননি। আমিও না। বাইরে কোথাও খাব। চলুন!
এভাবে বুঝি যাওয়া যায়!
যাবেন না? তাহলে আমি যাই! বলেই উঠতে যাচ্ছিল অর্ণব। মিথিলা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বসো! আমাকে মাত্র দশ মিনিট সময় দাও। আমি সব গুছিয়ে কাউকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আসছি!
ওকে! আপনি কাজ করুন আর আমি আপনাকে দেখি! অনেক দিন আপনাকে মনের চোখ দিয়ে দেখেছি। আপনি কেমন করে হাসেন, কথা বলেন, অভিমান করেন, হাঁটেন- চলেন সবটাই আমি মনে মনে বানিয়ে নিয়েছি। আজ একটু মিলিয়ে নেই। ও হ্যাঁ, আপনার হাসি সুন্দর। হাসলে আপনাকে সেক্সি লাগে!
মারব এক থাপ্পড়!
আপনার সময় কিন্তু এক মিনিট প্রায় শেষ!

বাইরে তখনও প্রচণ্ড খরতাপ। রোদের প্রখরতায় চোখ মেলে তাকানো যায় না। সানগ্লাস পরতে পরতে রিক্সায় উঠে হুড তুলে দিতে বলল মিথিলাই। রিক্সার হুড তুলে দেওয়ায় ওরা দুজন খুব কাছাকাছি চলে এলো। এ যেন শুধু বসে থাকা নয়; পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকা। পাশ ফিরে তাকালে এক জনের নিঃশ্বাস আরেক জনের গায়ে এসে লাগছে। মিথিলা আফটারসেভ লোশনের হালকা গন্ধও পেল। কিন্তু কেন জানি মিথিলার কোনও রকম অস্বস্তি হলো না। ছেলেটার সঙ্গে ওর পরিচয় বছরখানেক ধরে। তবে আজই প্রথম দেখা। পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে। প্রথম দিকে মিথিলা ওকে পাত্তা দিতে চায়নি একদমই। ওর বয়স এবং ব্যক্তিত্বে যা স্বাভাবিক। কিন্তু কী জানি কী আছে ছেলেটার কথাতে। না শুনে পারা যায় না! ওদের কথা হয় মূলত ইনবক্সেই। সেই প্রথম দিকে অর্ণব একবার লিখল, আপনার চেহারার মধ্যে দুঃখী দুঃখী একটা ভাব আছে! পড়ে প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো মিথিলার। চেনা নেই জানা নেই এক জনের চেহারা বিশ্লেষণে নেমেছে। ইচ্ছে করছিল প্রচণ্ড এক চড় কষিয়ে দিতে ওর গালে। কিন্তু পরের ম্যাসেজটা পড়ে এত ভালো লাগল! লেখা ছিল, ‘দুঃখী মেয়ের খুব গভীরে লুকানো সুখের গল্প আছে। নিশ্চয়ই আছে! গোপন ভ্রমর, রাজকুমার আর পাতালপুরীর কেচ্ছা আছে। নিশ্চয়ই আছে। শূন্যতা আছে তোর। তাই তুই এত বেশি সুন্দর!’ শুরু হলো ওদের কথার পিঠে কথা সাজানোর খেলা। একদিন মিথিলা ইউটিউব এ গান শুনছিল। অর্ণব নক করল, কী করছেন?
গান শুনছি। বলেই গানটা অর্ণবকে শেয়ার করে দিলো। ‘পিপাসা নাহি মিটিল’ রবি ঠাকুরের গান।
শুনে অর্ণব লিখল, খুব ভালো। ব্যাপক আবেদন আছে গানটায়।
আজকালকার ছেলেদের শব্দের ব্যবহার দেখে গা শিউরে ওঠে! মিথিলা লেখে, রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে ব্যাপক শব্দটা ঠিক যায় না!
সরি! আমি আমাকে শুধরে নেব।
আরও একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনে হলো, না থাক! এটা বড়দের কথা।
আমি ছোট!
নয়তো কী! আমার চেয়ে কম করে হলেও পাঁচ- ছয় বছরের ছোট।
তাতে কী! সাধনায় নামলে কেউ আর ছোট থাকে না। সব কিছুর স্বাদ জানে সে! বেদনার বিষপুষ্প থেকে মধু আহরন করতে সবাই পারে কি!
তুমি পারো?
আমি পারি! যা কেউ পারে না তা আমি পারি! এভাবেই এগিয়ে গেছে সময়। আলাপ গড়িয়েছে বন্ধুত্বে। অন লাইনে না পেলে কথা হয়েছে ফোনে। কিন্তু ফোনে খুব কম কথাই হয় ওদের। আসলে ফোন ভীষণ কেজো হয়েছে আজকাল। ফোন রিসিভ করলেই কাজের কথা। এটা কেন, ওটা কেন, এটা চাই, ওটা চাই! পিসিতে বসলে তাই মাঝে মাঝে সেলফোনটা মিউট করে রাখে মিথিলা। সবার সঙ্গেই কেবল কাজের কথা, স্বার্থের কথা। শুধু অর্ণবের সঙ্গেই বোধ হয় ও মনের কথা বলে। যে কথায় কোনও স্বার্থ উদ্ধারের তাড়না নেই। বরং আনন্দ আছে! অর্নবের সব চেয়ে বড় গুনই এটা, ও যতক্ষণ কথা বলবে সব ভুলে সে কথা শুনে যেতে হয়। আসলে কাজের কথা মনেই থাকে না!
কী হলো? কী ভাবছেন অতো? জানতে চায় অর্ণব।
কিছু না! আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি বলো তো?
শাহবাগের দিকে যাই? ওখানে নানা রকম ভর্তা, ভাজি আর ডাল দিয়ে ভাত খাব।
কিন্তু ওখানে বড্ড ভিড় আর হট্রগোল। আমার অতো ভিড় ভালো লাগে না। তারচেয়ে কোনও চাইনিজ রেস্তোরাঁয় বসি চলো। আমি জানি তোমার চাইনিজ ফুড ভালো লাগে না। আমারও লাগে না। কিন্তু ওখানে লোকের ভিড় কম। আলোর বাড়াবাড়িও নেই। বসতে একটু স্বস্তিবোধ করি।
আচ্ছা চলুন! আপনার যেখানে ভালো লাগে আজ সেখানেই বসি।
ধানমন্ডির একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে কোনার একটা ছোট টেবিলে ওরা মুখোমুখি বসল। মিথিলা জানতে চাইল, কী খাবে অর্ণব?
আপাতত আপনাকে চুমু খাব। তারপর আপনি যা অর্ডার করবেন, সোনামুখ করে তাই খাব।
আচ্ছা তোমার মুখে যা আসে তাই বলো! তোমার ভয় করে না?
ভয়? আপনাকে? ধুর! মিথ্যে বলব না, আপনাকে দেখার আগে কথা বলতে মাঝে মাঝে একটু অস্বস্তি হতো, ভয়ও করত। কিন্তু দেখার পর থেকে শুধু আদর করতে ইচ্ছে করছে! আপনি দেখতে এতো মিষ্টি!
এই ছেলে! কথবার্তা একটু হিসেব করে বলো! আমি কিন্তু তোমার সিনিয়র!
আসল বয়স হচ্ছে মনের বয়স। আর সেক্ষেত্রে আমি আপনার সমান!
আহা হা! কী আমার সমান! নাও হয়েছে। এবার কথা বন্ধ করে খেয়ে নাও! নইলে মার খাবে।
মারুন না প্লিজ! তবু একটু ছুঁয়ে দিন!
তুমি একটা আস্ত শয়তান! তবে এই শয়তানটাকেই আমার খুব ভালো লাগে!

আজ আর অফিসে ফিরবে না ঠিক করেই মিথিলা বের হয়েছিল। রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে তাই ওরা একটা রিক্সা নিয়ে এলোমেলো ঘুরতে লাগল। রিক্সা ছেড়ে একটা শপিংমলে ঢুকে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে অর্ণবের জন্য একটা নীল রঙের শার্ট কিনল মিথিলা। শুধু কিনেই খান্ত দিল না। নতুন কেনা শার্টটা অর্ণবকে পরিয়ে পুরনোটা প্যাকেট করে নিলো।
তখন সন্ধ্যা নেমেছে। কাছ থেকে না দেখলে মানুষের মুখগুলো চেনা যায় না। ওরা লেকের পাড়ে গিয়ে বসল। ভিড় এড়িয়ে একটু দূরে। ওরা চুপচাপই বসেছিল। গাছের ডালে তখন পাখিদের দিনশেষের কলকাকলি। সব ছাপিয়ে ওদের নিরবতাটাই যেন অনেক বেশি শব্দময় হয়ে উঠেছিল। হঠাৎই অর্ণব মিথিলাকে কাছে টেনে চুমু খেল। ব্যাপারটা এতটাই আচমকা ঘটল যে মিথিলা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না কী ঘটল। কিছক্ষণ আবারও নিরবতা। তারপর মিথিলাই বলল,
অর্ণব, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও? খুব কঠিন কিছু?
আমি চলে যাচ্ছি মিথিলা!
কোথায়?
আপাতত বনবাসে। অজ্ঞাতবাসও বলতে পারেন।
মানে! কেন এমন পাগলামি করছ অর্ণব?
পাগলামি না, প্রয়োজন! এই জীবনটা আমার আর ভালো লাগছে না, মিথিলা। কেবলই মনে হয় এ যেন নিছকই বেঁচে থাকা। আমি জীবনের মানে খুঁজে পেতে চাই! আমি মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থাকতে চাই।
তুমি কি চাকরি ছেড়ে দিয়েছ অর্ণব?
হুম! আজই।
চাকরি করেও কি জীবনের মানে খোঁজা যায় না অর্নব?
না যায় না! চাকরি মানে হচ্ছে অন্যের দাসত্ব করা। একজন শিল্পী কখনও অন্যের দাসত্ব করতে পারে না। আমি প্রকৃতির সন্তান! প্রকৃতির কাছাকাছিই হবে আমার আবাস!
আমায় সঙ্গে নেবে অর্ণব?
আপনি যাবেন! আপনি সঙ্গে থাকলে বেশ হয় কিন্তু। জানেন তো, বৈষ্ণবেরও কিন্তু একজন বৈষ্ণবী থাকে। আসলে সাধন সঙ্গী ছাড়া সাধনা পূর্ণ হয় না! কিন্তু আপনার তো যাওয়া হবে না!
কেন অর্ণব? আমি কি তোমাকে ভালবাসি না!
আমিও আপনাকে খুব ভালবাসি! কিন্তু আপনার যে পিছুটান আছে। আপনার সন্তান আছে। যার সঙ্গে আপনার মায়ার বাঁধন। মায়ার বাঁধন ছেঁড়া যায় না! মায়া জিনিসটা প্রেমের চেয়েও পাওয়ারফুল!
কিন্তু আমার কি মনে হয় জানো অর্ণব, একদিন তুমি আমার কাছে ঠিক ফিরবে! আমার ভালবাসা, আমাকে উপেক্ষা করার মূল্য তোমাকেই দিতে হবে। একদিন আমার ভালবাসার জন্যে তুমি চোখের জল ফেলবে। ফিরতে তোমাকে হবেই অর্ণব!
অর্ণব মিথিলার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, যদি পারো ফিরিয়ে এনো! কিন্তু যে ফিরবে সে কি এই আমি? প্রতিটি ফেরাই তো নতুন জন্ম। আমি না হয় তোমার সঙ্গে নতুন করেই শুরু করব; নতুন জীবনটা! উপেক্ষা নয়; সে জন্মে আমি তোমায় মাথায় করে রাখব!
আমাদের আর কথা হবে না অর্নব?
কথাই কি সব, মিথিলা?
তাহলে আমাদের আর কী বাকি থাকল?
কথার বাইরে যা থাকে! সেটুকুই থাকবে আমাদের।

ফিরতে ফিরতে মিথিলা দেখে চারপাশে যেন কেউ নেই, কিছু নেই। ও আকাশের দিকে তাকায়। আজকের আকাশটা এত বড় আর এত ফাঁকা কেন! ভাবতে ভাবতেই ঘরে ফেরে মিথিলা।

 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত