স্পর্শিয়া আজ স্কুলে যাবে না। কাল ডিনার করতে করতে বাবা বললেন,
– আগামী দু’দিন স্কুলে যাবার দরকার নেই। আমি তাবাসসুম মিসকে জানিয়ে দেবো।
যোগী সোসাইটির শিশুরা স্কুল ফাঁকি দেয় না। ঝড় হোক, ঝঞ্ঝা হোক, হরতাল হোক, বৃষ্টি বা প্লাবন হোক স্কুল খোলা থাকলে অভিভাবকরা পৌছে দেবেনই। স্কুলের প্রতি শিশু এবং অভিভাবকদের দায়বদ্ধতা এতটাই গাঢ় যে, বিকেলে কেয়ামত হবে জানলেও সকালে শিশুদের স্কুলে পৌছে দিয়ে হেডমিস্ট্রেসকে অনুরোধ করবে, “ম্যাম, আজ দুটো ক্লাশ বেশী করাবেন, প্লিজ। কেয়ামতের পর ক’দিন পড়াশোনা বন্ধ থাকবে কে জানে!”
স্কুলে যেতে না পারায় স্পর্শিয়ার মন খারাপ হওয়া উচিত কিন্তু হচ্ছেনা। ওর মন বিষন্নতায় ভরে আছে। মা অফিসে যাবার আগে ওর মাথায় হাত বুলালেন, মা’র কণ্ঠে উছলে ওঠা আদর,
– স্পর্শি, লক্ষ্মী মা আমার, তুমি এখন সিক্সথ গ্রেডে পড়ো। মানে ক্লাস সিক্স, প্রব্লেম ফিক্সড। তুমি বড় হয়ে গেছো মা, তাই না!
– হুম।
– এই তো আমার লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি ওই বিষয়টা খুব ভালো করে ভাবো। তুমি যা বলবে তা’ই হবে।
স্পর্শিয়া হাসি মুখে মাথা দোলায়। মা দু’গালে চুমো খান, বাবা ওকে কোলে তুলে নিয়ে নাকে নাক ঘষে আদর করেন। দু’জনে একসাথে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়।
পাঁচতলার ১৪শ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে স্পর্শিয়ার একা থাকার অভ্যাস আছে। প্রতিদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে একাই থাকতে হয়। গ্যারেজ থেকে হর্নের শব্দ আসতেই স্পর্শিয়া এক দৌড়ে বারান্দায় যায়, ওদের পার্ল হোয়াইট রঙের গাড়িটা সদর গেট দিয়ে রাস্তায় বের হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। বাবা আর মা সদর দরজার সামনে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে হাত বের করে ‘বাই.. বাই’ জানায়, ও হাত নেড়ে জবাব দেয়।
বাবা এবং মা দুই অফিসে চাকরী করেন। একসাথে অফিসে গেলেও মা ফিরেন বিকেল সাড়ে পাঁচটায়, বাবা রাত ৮টায়। স্পর্শিয়া জানে আজ বাবাও মা’র মত দ্রুত ফিরবেন। সন্ধ্যায় নাশতা করতে করতে তার সিদ্ধান্ত শুনবেন। এরপর সবাই মিলে বাইরে কোথাও ডিনার করতে যাওয়া হবে। তাই সময় নষ্ট না করে ও ভাবতে শুরু করে। কিন্তু বহু ভেবেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, ছোট্ট মাথায় সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
ঘটনার শুরু চার দিন আগে। ওইদিন ছিলো সাপ্তাহিক ছুটি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাবা আর মা ফিসফিস করে অনেক আলাপ করলেন। লাঞ্চ করতে বসে মা বললেন,
– স্পর্শিয়া, তোমাকে একটা কথা বলছি, খুব মন দিয়ে শোনো।
– বলো, মামনি।
– তুমি আমাকে ভালোবাসো?
– হুমমম।
– তুমি বাবাকে ভালোবাসো?
– হুমমম।
মা এক পলক বাবার দিকে তাকালেন, বাবা বললেন,
– বাবা আর মা’ও তোমাকে অন্নেক অন্নেক ভালোবাসে। কিন্তু একটা সমস্যা তৈরী হয়েছে..
– কি সমস্যা, বাবা?
– বাবা আর মা’র এডজাস্ট হচ্ছে না।
এডজাস্ট না হওয়ার কথাটা স্পর্শিয়ার কাছে নতুন নয়, বন্ধু অর্কের কাছে শুনেছিলো ওর বাবা-মা’রও এডজাস্ট হচ্ছে না। ওরা সারাটাদিন ফিসফিসিয়ে ঝগড়া করে, মাঝে মাঝে অর্ককে মার দেয়। পরে যদিও খুব আদর করে। অর্কের বর্ণনায় এডজাস্ট না হওয়াটা স্পর্শিয়া বুঝতে পারে না, তবু অর্কের প্রতি ওর খুব মায়া হয়। স্পর্শিয়ার বাবা-মা তো অর্কের বাবা-মা’র মত করেন না, তাই ‘এডজাস্ট হচ্ছে না’ শুনে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে,
– এডজাস্ট না হওয়া কি? এডজাস্ট না হলে কি হয়?
বাবা-মা’র চেহারায় সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্য বিস্ময় ঢেউ তুলে মিলিয়ে যায়, মা হাসিমুখে বলেন,
– ধরো, এমন হয় না, তোমার খুব প্রিয় বন্ধুর সাথে তোমার আর মিলছে না। দু’জনের বন্ধুত্বটা আছে, কিন্তু তুমি আর তার অভাব মিস করছো না, তাকে ভালোও লাগছে না। কি এমন হয় না!
– হুম।
– এটাই হলো এডজাস্ট না হওয়া। বড়দের এডজাস্ট না হওয়া আরও জটিল, বড় হলে বুঝবে।
– হুম। বড়দের এডজাস্ট না হলে কি করে?
বাবা বললেন,
– বড়দের এডজাস্ট না হলে একসাথে থাকতে পারে না। তাই এখন থেকে বাবা আর মা আলাদা থাকবে।
স্পর্শিয়া বিভ্রান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,
– ওহ! আমিও কি আলাদা থাকবো! একা ফ্ল্যাটে?
স্পর্শিয়ার প্রশ্নে মা মিষ্টি হেসে বললেন,
– না। একা ফ্ল্যাটে থাকার বয়স তোমার হয়নি। তুমি ভেবে বলো মামনির সাথে থাকবে না বাবার সাথে থাকবে।
– এখনই বলতে হবে?
– না, খুব ভালো করে ভেবে বলতে হবে। তুমি কার সাথে থাকতে চাও।
ওইদিনের কথোপকথনের পর স্পর্শিয়ার ইচ্ছে করছিলো দাদুর কাছে চলে যায়, দাদুর কাছে থাকে। কিন্তু গত বছর যখন পরীক্ষা চলছিলো, দাদু আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। দাদুকে সি-অফ করতে বাবা গ্রামে গিয়েছিলেন, পরীক্ষা থাকায় ওকে নিয়ে যায়নি। ও দাদুকে ‘হ্যাপি জার্নি, গুডবাই’ বলে বিদায় দিতে পারেনি।
কার কাছে থাকবে তা স্পর্শিয়া ভাবছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বাবাকে তার ভালো লাগে, মামনিকে ভালো লাগে আর এই ফ্ল্যাটটাও ভালো লাগে। কাউকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। ও বুঝতে পারছে শেষ পর্যন্ত একজনকেই বেছে নিতে হবে। ওর আর ভাবতে ভালো লাগেনা, ড্রইং রুমে বসে রিমোটে চেপে স্মার্ট টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ঘুরে বেড়ায়।
বাবা আর মা একসাথেই বাসায় ফিরেন। স্পর্শিয়ার সিদ্ধান্ত শোনার জন্য তাড়াহুড়ো করেন না। আফটার নুন স্ন্যাক খেতে বসে এই প্রসঙ্গটাই এড়িয়ে যান। রাতে সোসাইটির মালিকানাধীন অভিজাত রেস্তরা ‘যোগীয়ান ডাইন’এ ডিনার করতে করতে বাবা প্রশ্ন করেন,
– কি ভাবলে মামণি?
– আমি তোমার সাথে থাকবো।
মা জানতে চাইলেন,
– তুমি বাবার সাথে থাকবে!
– হুম! তোমার সাথেও থাকবো।
বাবার কণ্ঠে চাপা বিরক্তি,
– সেটা তো সম্ভব নয়, মামনি। বাবা বা মা’র মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে, অন্যজনের সাথে ছুটির দিনগুলোতে থাকবে, সময় কাটাবে। দু’জনের সাথে তো আর একসাথে থাকা যাবেনা, দু’জনের যে এডজাস্ট হচ্ছে না।
স্পর্শিয়ার দৃঢ় উত্তর,
– যাবে।
– কিভাবে?
– ম্যাজিক দিয়ে, আর ওই ম্যাজিকটা আমি জানিইইইই।
মা’র কণ্ঠে রাগ,
– ম্যাজিক বলে কিছু নেই, ম্যাজিক হলো ফাঁকিবাজী।
– মামণি, ম্যাজিক আছে। ম্যাজিক হলো টেকনিক। অর্ককেও শিখিয়ে দিবো, তোমাদেরও শিখিয়ে দিবো।
বাবা আর মা কথা বাড়ান না। স্পর্শিয়ার কথা শুনে ভাবেন আগামীকালের দিনটা যাক, এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু ওখানে তো যোগী সোসাইটিতে বসবাসের যোগ্য করে গড়ে তোলা হবে না। তাই বাবা বা মা- একজনকেই বেছে নিতে হবে ওর।
ম্যাজিক দেখবেন এমনটা আশা করেনি বাবা-মা, কিন্তু পরদিন স্পর্শিয়ার ম্যাজিকে পুরো যোগী সোসাইটি দুলে উঠলো। স্পর্শিয়ার টেবিলে পাওয়া গেলো চিঠি, “বাবা ও মামনি, এই যে দেখো ম্যাজিক, আমি তোমাদের দু’জনের সাথেই আছি আবার কোথাও নেই শুধু আল্লাহর কাছে আছি।” ছোট্ট ডেডবডিটা পাওয়া গেলো বাথটাবে ডুবন্ত, শ্যাম্পুর বোতলের পাশে বাবার স্লিপিং পিলের অনেকগুলো খালি মোড়ক। ম্যাজিকের সম্মোহন কাটতে বাবা-মা’র চোখ অশ্রুতে ভরে এলো।
স্পর্শিয়ার ম্যাজিকের সংবাদ বাতাসে মিশে যোগী সোসাইটির কোনায় কোনায় প্রতিধ্বনি তুললো, সেও ক্ষণিকের জন্য। শুধু যোগি সোসাইটির হর্তাকর্তারা আতঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন তুললেন, “সেক্যুলার যোগী সোসাইটির এক শিশুর মাথায় আল্লাহ’র কাছে যাওয়ার জঙ্গীবাদ ঢুকালো কে?” স্পর্শিয়ার মৃত্যুশোকের কান্না ভুলে হর্তাকর্তাদের অনুভূত জঙ্গীবাদের আতঙ্ককে ঘরে ঘরে পৌছে দিলো হাওয়া।
একদিনেই বাবা-মা ছাড়া অন্য সবার মন থেকে মুছে গেলো স্পর্শিয়া; যেনো স্পর্শিয়া যোগী সোসাইটির কেউ নয়, স্পর্শিয়া নামে যোগী সোসাইটিতে কেউ ছিলো না।