রাক্ষুসী

আমাদের গল্পের শুকতারার জন্ম হয়েছিলো মিষ্টি এক সুবহে সাদিকে। আকাশে তখনও শুকতারাটা হাল্কা আলো ছড়াচ্ছিলো। শুকতারার বাবা মেয়ের নাম ঐ তারার নামেই রাখলেন। সেই শুকতারা দেখতে দেখতে ডাংগর হয়ে উঠে। গরিব ঘরের শ্যাম বর্ণের একহারা গড়নের শান্ত মেয়েটা সবার নজরে পড়ছিলো। পাড়া প্রতিবেশিরা কানাকানি করে, শুকতারার বাপ কেমন? মেয়ের বিয়ে দেয় না। মেয়ের দিকে কোনদিন না জ্বীনের বদনজর পড়ে যায়।

তারপর একদিন সত্যিই শুকতারার দিকে জ্বীনের নজর পড়ে। এটা প্রথম টের পায় গ্রামের ভাদাইম্যা ছেলে সুলাইমান।সুলাইমান এক নিশুতি রাতে পা টিপে টিপে দাঁড়িয়েছিলো শুকতারার জানালার পাশে। অমাবস্যার সেই রাতে শুকতারা মাথার সব চুল এলিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখছিলো। হঠাৎ সে আয়নার ভেতর দিয়ে সুলাইমানের শয়তানি হাসিটাও দেখে ফেলে। আর আয়নাটা রেখে পাশের ঘর থেকে জলদি বটিটা নিয়ে এসে এলোচুলে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। শুকতারার এমন কোমলে কঠিনে মেশানো রূপ দেখে ভয় পেয়ে সুলাইমান দৌড়ে পালায়। পরে গ্রামের মধ্যে সুলাইমান ঢিঁঢিঁ ফেলে দেয়, শুকতারা মানুষ নয়, একটা রাক্ষুসী। জ্বীন ভর করেছে শুকতারার উপরে, সে নিজে দেখেছে।শুকতারা বটি হাতে রাতের বেলা কিভাবে জংগলের ভিতর দিয়ে একা একা হেঁটে গিয়েছিলো, সেইসব বানানো গল্প চায়ের দোকানে বসে বসে সে সব বর্ণনা করে। কিন্তু সুলাইমান নিজে যে শুকতারার জানালার পাশে গিয়ে রাতের বেলা উঁকিঝুঁকি মারতো, সেই কথা অবশ্য বলে না।

কথা রটে যেতে বেশি সময় লাগে না। গ্রামের সবাই জেনে যায় শুকতারা রাক্ষুসী। রূপ ছড়িয়ে শুকতারা ডাংগর হতে থাকে, কিন্তু কেউ তাকে বিয়ে করে না। শুকতারার গরিব বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার সাগরে একদিন যেন এক আশার জাহাজ নোংগর ফেলে। গ্রামে পালাগানের আসর বসে। দূর দূরান্ত থেকে গাতকেরা গান শোনাতে আসে এখানে। গাতক সুজনউদ্দিনও এই গ্রামে এসেছে গান গাইতে। সে শুকতারার বাবা-মাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়, সে শুকতারাকে বিয়ে করতে চায়। শুকতারার বাবা-মা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পান।

সুজনউদ্দিন মানুষ খুব ভাল। বিশাল দেহী,শান্ত-শিষ্ট মানুষ, টু-টাং করে দোতারায় সুর তোলে। সে ভাল গান গায়, মাথায় তেল দিয়ে সিঁথি করে চুল আঁচড়ায়, পান খায়। তাকে দেখে সুখী সুখী মনে হয়। কিন্তু তার বউগুলো কেন জানি বেশিদিন বাঁচে না। কেউ জানে না, কেন। এর আগে তিনটা বিয়ে করেছিল সুজনউদ্দিন। কিন্তু একজনও বাঁচে নি। শুকতারার বাবা-মা এসব নিয়ে মাথা ঘামালেন না। দ্রুত মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলেন।

শুকতারার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের রাতে সে লাল শাড়ি পরে বসে থাকে খাটের উপরে। গ্রাম্য বালিকারা কিছু ফুল ছড়িয়ে রেখে গেছে বিছানার উপরে। সুজনউদ্দিন ঘরে এসে শুকতারার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। শুকতারার মনে হয় তার হাতে, পিঠে, কোমড়ে কেউ শক্ত হাতে ক্রমাগত খামচি দিচ্ছে। আঘাতে আঘাতে শুকতারা নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু কিছু বলে না। আস্তে আস্তে সে তাকায় সুজনউদ্দিনের চোখের দিকে।শুকতারা করূণার হাসি হাসে। আর সুজনউদ্দিন আশ্চর্যজনকভাবে ছোট হতে থাকে। ছোট হতে হতে সে একটা পিঁপড়ার সমান হয়ে যায়। শুকতারা পিঁপড়ার সমান সুজনউদ্দিনকে তার হাতের তালুতে নিয়ে হাহাহা করে হাসতে থাকে। পিঁপড়া সুজনদ্দিন ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে শুকতারার দিকে। শুকতারার খুব মজা লাগে সুজনউদ্দিনের এই অসহায় রূপ। ‘’কেমন লাগে গো এখন তোমার? তুমি এহন একটা পিঁপড়ার সমান। আমার কোন ক্ষতিই করতে পারবা না।একটা পিঁপড়া কি খুব বেশি ক্ষতি করতে পারে, কও?‘’

রাত পেরিয়ে ভোর হয়। নতুন বউ দেখতে এসে গ্রাম্য নারীরা দেখে সুজনউদ্দিনের বিশালদেহটা নিথর হয়ে পড়ে আছে খাটের উপরে। ছেলের মৃতদেহ দেখে সুজনউদ্দিনের মা চিৎকার করে উঠেন, ‘’হারামজাদি, রাক্ষুসি, বিয়ার রাইতেই আমার পোলারে তুই খাইলি!’’ শুকতারা কোন কথা বলে না।তার চোখ আশচর্য রকমভাবে শান্ত। গ্রাম্য নারীদের একজন তাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়, ‘’খালাম্মা, দেহেন, দেহেন, এই মাইয়ার চোউখের ভিত্রে আগুন জ্বলে। এই মাইয়া তো মানুষ না, পেত্নী। ওরে আল্লা গো।‘’

সুজনউদ্দিনের দাফন কাফন হয়ে গেলেও শুকতারার মুক্তি নেই। তার শাশুড়ি, দেবর, ননদ আর গ্রাম্য ওঝারা সবাই মিলে ঝাড়ুপেটা করে। শুকতারা চুপচাপ পড়ে পড়ে ঝাড়ুর বাড়ি তার পিঠ পেতে নেয়। কাঁদে না, একটা আওয়াজও করে না। ওঝা বলে, ‘’এ বড় শক্ত জ্বীন। দেখছেন, হাজার মারলেও কেমন ব্যথা-বেদনা পায় না!’’

খবর পৌঁচ্ছে যায় সুলাইমানের কানেও। সে তার বন্ধুদের সাথে গাছের নিচে তাস পেটাতে পেটালে বলে, আরে! আমি তো আগেই কইছিলাম, ঐ মাইয়া রাক্ষুসী।‘’

নভেম্বর, ২০১৫

(প্রচ্ছদের ছবিটি জয়া আহসান অভিনীত ”তারপরেও আঙ্গুরলতা নন্দকে ভালোবাসে” নাটকের একটি দৃশ্য থেকে নেয়া)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত