আগে যা ঘটেছে —
( টিটো আর হীরু রহিতদার আন্দামানের বারাটাং অফিসে ঘুরতে এসে জারোয়াদের গ্রাম লাকড়া লুংটাতে মেডিক্যাল টিমের সঙ্গে গিয়েছে। শেখানে টিটোর ওহামে নামে এক জারোয়া কিশোরের সঙ্গে পরিচিতি হয়েছে টিটোর। ওহামে টিটোকে এতোতাই আপন করে নিয়েছে, যে তাঁর জোনয় বোন থেকে মধু সংগ্রহ করে এনে খাইয়েছে। সেদিন লাকড়া লুংটা গ্রাম থেকে রহিতদার বারাটাং অফিস কোয়াটারে ফিরে আসার পরে শুরু হয়েছে শুরু হয়েছে ভয়ংকর প্রাকৃতিক দূর্যোগ। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিতে টিটোরা বন্দি হয়ে রয়েছে ঘরেই। এরপরে হঠাৎ আবহাওয়া ভালো হওয়ায় ফের টিটো আর হীরু সুযোগ পেয়েছে লাকড়া লুংটা দ্বীপের জারোয়াদের গ্রামে যাওয়ার। এরপর……)
।। ৬ ।।
আজ টিটোর এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো। আজ টিটো জারোয়া দ্বীপ লাকড়া লুংটাতে জারোয়াদের তৈরি কুঁড়েঘর ‘চাড্ডা’য় এসেছে। জারোয়াদের কুঁড়ে ঘরকে চাড্ডা বলে। চাড্ডা আর কিছুই নয়। গাছের ডাল, লতাপাতা, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি জারোয়াদের নিজস্ব ঘরানার কুঁড়ে ঘর। তাঁদের ডেরা। নানা রকম আকৃতির। ছোট, বড়, স্থায়ি, অস্থায়ী। এই ক’দিনের হালফার সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিতে অধিকাংশ চাড্ডা ভেঙ্গে গিয়েছে। টিটোর জারোয়া বন্ধু ওহামে টিটোকে তাঁর নিজস্ব চাড্ডায় নিয়ে এসেছে।
এখানে ওহামের সঙ্গে জঙ্গলের ভিতরে জারোয়াদের চাড্ডায় আসার আগে রহিতদা চাড্ডা সম্পর্কে টিটোকে জানিয়ে দিয়েছিল। অধিকাংশ চাড্ডা জারোয়ারা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তৈরি করে না। কারন হিসাবে রহিতদা বলেছিল, মূলত পশু শিকার, মাছ ধরা, শামুক, গেঁড়ি-গুগলি জোগাড়, ফলমুল গাছের কন্দ বা মধু সংগ্রহের জন্য জারোয়ারা প্রয়োজন মতো চাড্ডা তৈরি করে। জারোয়ারা নিজেদের সুবিধা মতো চাড্ডা বানায়। চাড্ডা তৈরি করতেও বেশি সময় লাগেনা। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জারোয়ারা নিজেদের প্রয়োজন মতো অস্থায়ী চাড্ডা বানিয়ে নিতে পারে।
রহিতদা বলেছিল, “ জানিস তো টিটো, এই লাকড়া লুংটা দ্বীপে অবশ্য কিছু স্থায়ী চাড্ডা রয়েছে। এই জারোয়ারা কিন্তু অস্থায়ী চাড্ডা বানিয়ে সেখানে রাতেই বেশি থাকে। মিডল আন্দামানের এই লাকড়া লুংটা দ্বীপের বরাবর অন্য দ্বীপগুলি, যেমন তানমাদ, থাইডঙ বা বোইয়ার এলাকাতে জারোয়ারা মূলত ঘুরে ফিরে অস্থায়ী চাড্ডা বানিয়ে তাতে থাকে। তবে, এই লাকড়া লুংটা দ্বীপে আমরা আগে ঘুরে দেখেছি, এখানে কিন্তু স্থায়ী চাড্ডার সংখ্যাই বেশি ।”
বারাটাঙ থেকে লাকড়া লুংটা দ্বীপে আসার সময় আজ সমুদ্র ছিল স্বাভাবিক। গত কয়েক দিনের প্রবল ঝড় বৃষ্টির পরে সমুদ্র যে এরকম নিস্তরঙ্গ থাকবে টিটো ভাবতে পারে নি। আজ সকাল থেকেই টিটোর সব কিছুই কেমন যেন ভালো হচ্ছে। প্রথমে বারাটাঙ্গে রহিতদার এই লাকড়া লুংটা জারোয়া দ্বীপে নিয়ে ওঁকে নিয়ে আসার কথা বলা থেকে ভালোর শুরু। আরও ভালো লেগেছে রহিতদাদের মেডিক্যাল টিমের ডুঙ্গিতে আসতে আজ কোন ধকল হয়নি। তারপরেও আরও ভালো লেগেছে, ডুঙ্গি থেকে দ্বীপে নামার আগেই টিটোকে দেখতে পেয়ে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে নেমে গিয়েছিল ওহামে নামের সেই জারোয়া বন্ধু। ডুঙ্গি দ্বীপের কাছাকাছি আসতেই সমুদ্রের জলে নেমে ডুঙ্গি থেকে নামিয়ে ওহামে তাঁর হাত ঘরে জলের মধ্যে থেকে সাবধানে টিটোকে দ্বীপে নিয়ে এসেছে। ওহামের সঙ্গে এদিন ফের দেখা হবে কি না, সেটা নিয়ে নিজের মনেই সংশয় ছিল টিটোর। কিন্তু রহিতদারা যে সেদিন লাকড়া লুংটা দ্বীপ থেকে মেডিক্যাল টিম নিয়ে ফেরার সময় ফের এদিন আসার কথা বলে গিয়েছিল, সেটা জানতো না টিটো।
আজ টিটোর প্রতি সব বিষয়ে কেমন যেন উদার ছিল রহিতদা। বারাটাঙ থেকে ডুঙ্গিতে জারোয়া দ্বীপ লাকড়া লুংটায় আসার পথে ওঁকে কিছু কথা বলেছিল রহিতদা। বলেছিল, “ আসলে কি জানিস তো টিটো, আমি চাইছি, তুই নিজের মতো এই জারোয়াদের সঙ্গে মেলামেশা কর। তুই যে সুযোগ পেয়েছিস, তা তোর বয়সের অন্য কোন ছেলে ভাবতেই পারে না। আরও ভালো হয়েছে, এই দ্বীপের এক জারোয়া ছেলের সঙ্গে তোর বন্ধুত্ব মতন কিছু একটা তৈরি হওয়ায়। জারোয়ারা কিন্তু প্রচন্ড বিশ্বাসী হয়। জারোয়া ছেলেটির যদি তোকে পছন্দ না হতো, তবে আগের দিন কিছুতেই তোর জন্যে নিজেদের সংগ্রহের মধু নিয়ে আসতো না। যাইহোক, আজ যদি তোর সঙ্গে ওঁর আবার দেখা হয়, দেখবি ওই জারোয়া ছেলেটি তোকে আরও বেশি আপন করে নেবে।”
ওহামে যে আগের দিনের কথা মনে রেখে ওঁদের জন্যে প্রতিক্ষা করছিল, সেটা ওহামের সমুদ্রের ধারে এসে ওঁদের জন্য অপেক্ষা করা দেখেই টিটো বুঝতে পেরেছিল।
কিন্তু হীরুদার সঙ্গে আগের দিন যে জারোয়া ছেলেটির ভাব জমেছিল বলে মনে হয়েছিল, তাঁকে কিন্তু দ্বীপে নেমে টিটোর নজরে পড়েনি। টিটো আজ আর ওঁর নিজের সেই বাইনোকুলারটি সঙ্গে করে নিয়ে আসে নি। তার বদলে হাফ প্যান্টের পকেটে করে নিয়ে এসেছে ওঁর মাউথ ওরগানটি।
দ্বীপে পৌঁছে রহিতদারা কিছুক্ষনের মধ্যেই মেডিক্যাল ক্যাম্পের জন্য তাঁবু তৈরি করে নিয়েছে। দেরিতে রোনা দিলেও বেলা আজ খুব বেশি হয়নি, তবে এখনই রোদের তেজ বেশ কড়া। ওহামে টিটো্র হাত ধরে মেডিক্যাল ক্যাম্পের পাশের একটি
গাছের ছায়াতে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। নিজের ব্যাকুলতা জানাতে নানা ভাবে টিটোর সঙ্গে নানা রকমের আচরন করছে ওহামে। ও আজ নিজের কোমড়ে লাল রঙের কাপড়ের টুকড়ো জড়িয়ে রেখেছে। হয়তো এর আগের দিন টিটোকে পোষাক পরে থাকতে দেখেই ওঁর মনে এটা আজ এসেছে। আর আজ ওহামে নিজের মাথায় লাল রঙের কাপড়ের ফেট্টি বেঁধেছে। গলায় পড়েছে সামুদ্রিক ঝিনুক জাতীয় নানা জিনিস দিয়ে তৈরি মালা। ওহামে হেসে হেসে টিটোর সারা শরীরে হাত বোলাতে বোলাতে বলে চলেছে, ‘ মিলোহালে, , , থিতো, , , , মিলোহালে, , , থিতো’।
টিটো এর আগের দিনই শুনেছিল, মিলোহালে কথার মানে হচ্ছে ‘বন্ধু’। আর প্রনবেশদা সেদিন জারোয়া ভাষায় ওহামের সঙ্গে ওঁর নিজের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় টিটোর নাম জানিয়ে ছিলেন। টিটোকে ওহামে ডাকছে “থিতো” নামে। আগের দিনের মতো আজও রহিতদারা মেডিক্যাল টিম নিয়ে আসার সময় নারকোল, কলার কাঁদি, মুড়ির প্যাকেট, নিয়ে এসেছে। অন্যান্য জারোয়ারা সমুদ্রের জলের মধ্যে নেমে এসব নেওয়ার জন্য ঝাঁপাঝাঁপি করলেও ওহামে কিন্তু আজ সেদিকে কোন আগ্রহ দেখায় নি। সে প্রথম থেকেই ব্যস্ত রয়েছে টিটোকে নিয়ে। এদিকে ধিরে ধিরে বেশ কয়েকজন জারোয়া ফের ভিড় জমিয়েছে মেডিক্যাল ক্যাম্পে। প্রনবেশদা ওঁদেরকে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিচ্ছেন।
টিটোর হঠাৎ চোখ গেল আকাশের দিকে। দূরে জঙ্গলের মধ্যে থেকে ধোঁয়া ঊঠতে দেখা যাচ্ছে। রহিতদার মেডিক্যাল টিমের মধ্যের একজন স্টাফ এদিকে আসছিলেন। টিটোর নজর লক্ষ্য করে হেসে হিন্দিতে বললেন, “ আমরা যে আজ আবার মেডিক্যাল টিম নিয়ে দ্বীপে এসেছি, সেখবর এখানে উপস্থিত জারোয়ারা দ্বীপের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্য জারোয়াদের কাছে পাঠাচ্ছে। যদি কোন জারোয়ার চিকিৎসার কোন প্রয়োজন থাকে, তবে এই ধোঁয়ার সংকেত দেখে এখানে এসে হাজির হবে। একটু পরেই দেখবে, জারোয়াদের ভিড় মেডিক্যাল ক্যাম্পে উপচে পড়ছে। ”
টিটো হঠাৎ খেয়াল করলো, তাঁর ধারেপাশে ওহামে নেই। একটু ভালো করে তাকিয়েই দেখতে পেল, ওহামে পাশের জঙ্গলের ভিতর থেকে ছুটে আসছে। ওঁর হাতে ধরা কি যেন একটা জিনিস।
ওহামে টিটোর কাছে এসে ওঁর গলায় ঝিনুকের তৈরি একটি মালা পড়িয়ে দিল। ওহামের ডান হাত টিটো নিজের হাতে নিয়ে হ্যান্ডসেকের মতন করলো। রহিতদা ঠিক কথাই বলেছিল। আজ টিটোকে হয়তো নিজেদের পদ্ধতিতে বিশেষ সন্মান জানাচ্ছে ওহামে। টিটো এবার নিজের গলার সেই মালার দিকে নজর দিল। দেখলো ঝিনুক, শঙ্খ এসব দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই মালাটি। আর সুতো হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে এক ধরনের বিশেষ গাছের আঁশ জাতীয় জিনিষকে। টিটোকে মালা পড়িয়ে ওহামে ডিগবাজি দিয়ে পা শুন্যে তুলে হাতের সাহায্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এ যেন এক ধরনের আনন্দের বহিপ্রকাশ ! ওহামের এই ধরনের কান্ড দেখে টিটো নিজেও হো হো করে হেসে উঠলো। কারন পা দুটো শুন্যে তুলে হাতের সাহায্যে হাঁটার কারনে ওহামের কোমরে জড়ানো লাল রঙের কাপড়ের টুকড়োটি উলটে গিয়েছে। ফলে ওহামে যে উলঙ্গ হয়ে গিয়েছে, সেটার কোন বোধই নেই ওহামের।
টিটো লক্ষ্য করলো, হীরুদা আজ অন্য একজন জারোয়া যুবকের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওই জারোয়া যুবকটি হেসে হেসে হীরুদাকে কি যেন বলছে। কিন্তু টিটোর মনে হলো হীরুদা জারোয়া ভাষা ঠিক বুঝতে পারছে না। কারন, হীরুদার মুখ দেখেই বিষয়টা আন্দাজ করা যাচ্ছে। কেমন বোকার মতো হাসছে হীরুদা। এদিকে ওহামের উচ্ছাস দেখে রহিতদা মেডিক্যাল ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এগিয়ে এসেছে টিটোদের কাছেই। রহিতদা কাছে এলে ওহামে জারোয়া ভাষায় কি যেন বললো। রহিতদা ওহামের কথা শুনে হেসে মাথা নেড়ে সন্মতি জানিয়ে টিটোর দিকে ফিরে বললো, “ও তোকে ওঁর বাড়ি, মানে ওঁর চাড্ডায় নিয়ে যেতে চাইছে। তুই ইচ্ছে করলে যেতে পারিস। আমি ওঁকে বলে দিচ্ছি, তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে। কথাটা তুইও মাথায় রাখিস। আর মনে রাখিস, কলকাতা ফিরে গিয়ে বাড়িতে এসব কথা জানাবি না। তাহলে মাসি কিন্তু আমাকে পেটাবে।” এরপরে ওহামেকে রহিতদা জারোয়া ভাষায় সব বুঝিয়ে দিল। ওহামে হেসে মাথা নেড়ে সন্মতি জানালো।
রহিতদার সন্মতি পেয়ে ওহামে টিটোর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো জঙ্গলের দিকে। টিটো বুঝতে পেরে ওহামের সঙ্গে রওনা দিল। ওহামে জঙ্গলের ভিতরে পা-এ চলা পথ ধরে আগে আগে চলেছে। তাঁর পিছনে হাঁটছে টিটো। কলকাতা থেকে আন্দামান আসার সময় নিজের বুট জুতো নিয়ে এসেছিল টিটো। আজও সে ওই বুট জুতো মোজা ছাড়াই পড়ে এসেছে। এই জঙ্গলে সেই বুট জুতো এখন খুবই কাজে দিচ্ছে। ওহামের হাঁটার ভঙ্গিতে একটা দারুন একটা বিশ্বাসের ভাব ফুটে উঠেছে , তাঁর প্রতিটা পদপক্ষেপে।
গত কয়েক দিনের ঝড় বৃষ্টিতে পা এর নীচের গাছের খসে পড়া পাতা ভিজে পিছল হয়ে রয়েছে। পা পিছলে যেতে পারে ভেবে টিটো খুব সাবধানে হাঁটছিল। ওহামে কিন্তু খালি পা এই লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেছে। যেন টিটোকে ওঁর ডেরায় নিয়ে যেতে পেরে ও খুব গর্বিত।
দুপুর না হলেও বেলা বেশ হয়েছে। টিটো প্রথম দিন থেকেই ঘড়ি হাতে দ্বীপে আসেনি। সেকারনে ঘড়ি দেখে সময় আন্দাজ করতে পারছে না। এদিকে যে সূর্য দেখে সময় আন্দাজ করবে, তার কোন উপায় নেই। ওহামের সঙ্গে সে বেশ গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে ফেলেছে। এ এক ভয়ংকর জঙ্গল। কাঁটা বেতের ঝোপ, যে পথ দিয়ে তাঁরা হাটছে সেখানে লতাপাতা, গাছ-গাছড়া রয়েছে। সেগুলো সরিয়ে পথ করে দিচ্ছে টিটোর নতুন ‘মিলোহালে’ ওহামে। মানে বন্ধু ওহামে। গত কয়েক দিন বৃষ্টি হওয়ায় ছোটছোট নালা দিয়ে জল নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। জলের তেজ বেশ ভালোই। টিটো বুঝতে পারলো, গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে এখানকার উঁচু জায়গার জল এখন নালাগুলি দিয়ে নীচের দিকে যাচ্ছে। টিটো দু-একবার খেয়াল করেছে, কাঁটা বেতের ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে বিষাক্ত সব সাপ। মাকড়সার তো কোন অভাব নেই। আর থিকথিক করছে নানা আকারের জোঁক। গোটা জঙ্গলটাতেই স্যাঁতস্যাঁতে বুনো গন্ধ ভর্তি। টিটো দু-একবার মাথা তুলে উপরে আকাশ দেখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বড় বড় গাছের ঝোপের কারনে আকাশ দেখা যাচ্ছেনা। সূর্যের আলোও পরিস্কারভাবে এখানে ঢুকছেনা। অনেক উঁচুতে গাছের জমাট ঘন পাতায় এমন জড়াজড়ি হয়ে রয়েছে, যে সূর্যের আলো মাটি পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারছে না।
হঠাৎ এক জয়গাতে দাঁড়িয়ে পড়লো ওহামে। যে এলাকা দিয়ে তাঁরা চলছিল, তার পাশেই একটি গাছের লতানো পাতা কিছু ছিঁড়ে নিয়ে নিজের হাতে ঘষে রসের মতো তৈরি করলো ওহামে। এবার টিটোর শরীরের যেসব এলাকা জামা প্যান্টের কাপড়ের বাইরে ছিল, সেখানে সেই রস তেলের মতো করে ঘষে লাগিয়ে দিল। টিটো আন্দাজ করতে পারলো, আগের দিন যেমন মাটির প্রলেপ শরীরে দিয়েছিল, সেরকমই কোন প্রাকৃতিক ওষুধ ওহামে লাগিয়ে দিল, হয়তো এই প্রাকৃতিক লতানো গাছের রস এই জঙ্গলের পোকামাকড়, মাকড়সা, জোঁক থেকে টিটোকে রক্ষা করবে। ওহামে নিজের শরীরেও ওই পাতার রস লাগিয়ে নিল। এখন হয়তো আর তাঁদের কোন পোকা মাকড় কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
রহিতদা বারন না করায় আর টিটোর নিজেরও কৌতুহল থাকায় সে ওহামের কথায় রাজি হয়ে ওঁর ডেরা বা চাড্ডায় আসতে রাজি হয়েছিল। এখন ঘন জঙ্গলের অচেনা পরিবেশে এসে টিটোর মনে হচ্ছে, ওহামের দেওয়া প্রস্তাবে তখন রাজি না হলেই ভালো করতো। গভীর জঙ্গলের ভয়াবহ অবস্থায় টিটো যখন অজানা আতঙ্কে বিরক্ত, ঠিক তখনই ওহামে তাঁকে সঙ্গে করে গভীর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ফাঁকা জায়গাতে এসে দাঁড়ালো।
টিটো দেখলো বেশ কিছুটা এলাকাতে বড় বড় গাছ নেই। মাথার উপর পরিস্কার আকাশ দেখা যাচ্ছে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ডাল লতাপাতা দিয়ে তৈরি কয়েকটা কুঁড়ে ঘর। টিটো বুঝতে পারলো, এটাই ওহামের ডেরা। ওহামের চাড্ডা। একটা চাড্ডার বাইরে এক প্রাপ্ত বয়স্ক জারোয়া মহিলা নজরে এলো টিটোর। মহিলার শরীরের উর্দ্ধাঙ্গে কোন কাপড় বা পোষাক নেই। শুধু কোমড়ের নীচে গাছের ছাল বেঁধে রেখেছে। সেটাই পোষাকের কাজ করছে। এদিকে মহিলার গলা, মাথায় রয়েছে সাদা ফুলের তৈরি মালা। তাঁর কোলে রয়েছে এক জারোয়া শিশু। মহিলা এক মনে একটা নারকেল খাচ্ছে।
।। ৭ ।।
কয়েকটি গাছের শুকনো ডাল দিয়ে শুকনো পাতা দিয়ে ছাদ দেওয়া ডেরাটি ছোট। আর সেটাই যে ওহামের ডেরা, সেটা ওহামের আচরনেই বুঝতে পারছিল টিটো। শুকনো পাতা দিয়েই দেওয়ালের মতো তৈরি করা হয়েছে। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি নীচু মতো জায়গাটা যে চাড্ডার ভিতরে ওহামের শোবার জায়গা, সেটা টিটো আন্দাজ করতে পেরেছে। এরকম বাঁশের কঞ্চির শুয়ে রাত কাটানোর কথা টিটো ভাবতেই পারেনা। ওঁদের কলকাতার বাড়িতে টিটো যে বিছানায় রাতে ঘুমোয়, সেটা বেশ গদিওয়ালা। ওহামের এই বিছানায় রাতে ঘুমানোর জন্য গাছের একটি গুড়ি মাথার বালিশের আকারে চাক করে কাটা। জামা কাপড় না পরে প্রায় উলঙ্গ মহিলা যেভাবে প্রকাশ্যে বসে রয়েছে, শুকনো পাতার ঝুপড়ি দিয়ে মাথা গোঁজার জায়গা – এদের আচরন দেখে টিটোর মনে হলো, বহু প্রাচীন সময়ে যেন টাইম মেশিনে চেপে আদিম যুগে ফিরে গিয়েছে। টিটোকে চাড্ডার ভিতরে নিয়ে গিয়ে ওহামে যা বললো, এই প্রথম টিটো সেই কথার মানে বুঝতে পারলো। টিটোকে অবাক করে দিয়ে ওহামে ওঁর কঞ্চির তৈরি শোওয়ার জায়গা দেখিয়ে বললো, ‘থিতো …বৈঠো…থিতো… বৈঠো…।”
‘বৈঠো’ মানে হিন্দি ভাষাতে টিটোকে সেখানে বসার কথা বলছে ওহামে। ওহামে হিন্দি ভাষা জানে বা বলতে পারে, সেটা টিটোর ধারনাই ছিলনা ! সেদিন প্রণবেশদা কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, জারোয়া সিভিলিয়ানদের সঙ্গে এখন মিশতে শুরু করায় কয়েকজন জারোয়া কিছু হিন্দি শব্দ রপ্ত করে নিয়েছে। কিন্তু আগে একবার বেশ কিছুক্ষন সময় টিটো ওহামের সঙ্গে কাটিয়েছে। একবারের জন্যেও ওহামের মুখে কোন হিন্দি শব্দ শোনেনি। ওহামের চাড্ডার ভিতরে স্যাঁতস্যাতে জংলি দুর্গন্ধ নাকে লাগছিল টিটোর। কিন্তু ওহামের আপ্যায়ন সে ফেলতে পারলো না। কোন মতনে বাঁশের কঞ্চির বিছানায় বসলো টিটো। এবার টিটোর মনে পড়লো, তাঁর পকেটে রাখা মাউথ অরগানের কথা। মুখে কিছু না বলে পকেট থেকে বের করে আনলো মাউথ অরগান। ওহামেকে এখনও সে মাউথ অরগানটি দেখায়নি।
জারোয়াদের স্বাভাবিক কৌতুহলেই মাউথ অরগান হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো ওহামে। আগের দিন টিটোর বাইনোকুলার হাতে নিয়ে দেখে, পরে বুঝতে পেরেছিল, ওটা চোখে লাগালের দূরের জিনিষ কাছে দেখা যায়। মাউথ অরগানটিকেও সেরকম ভেবে চোখে লাগানোর চেষ্টা করে নিরাস হলো। টিটো হেসে ওহামের হাত থেকে মাউথ অরগান নিজের কাছে নিয়ে মুখে ধরে হিন্দি গানের ধুন বাজালো।
মাউথ অরগানের অদ্ভুত শব্দ শুনে ওহামে তো অবাক ! ও নিজে এবার টিটোর হাত থেকে মাউথ অরগান নিয়ে মুখে ধরে চেষ্টা করলেও কোন শব্দ সেটা থেকে বের করতে পারছিল না। আজ বারাটাং থেকে এই জারোয়া দ্বীপ লাকড়া লুংটাতে আসার সময় নিজের মাউথ অরগান পকেটে নিয়ে ভেবেছিল, আজ ফের যদি ওহামের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, ওঁকে আগের দিনের মতোই বন্ধু হিসাবে চিনে ভালো ব্যবহার করে, তবে টিটো মাউথ অরগানটা ওহামেকে গিফট হিসাবে দিয়ে যাবে। কিন্তু টিটোর সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ওহামে আজ শুধু ভালো ব্যবহারই করেনি, নিজের বাড়ি, নিজের চাড্ডায় টিটোকে নিয়ে এসেছে। ওহামে মাউথ অরগানটা বাজাতে পারছে না দেখেও, টিটো উপহার দেওয়ার সিধান্ত থেকে পিছালো না।
কিন্তু ওহামে ঠিকভাবে মাউথ অরগান মুখে চেপে শব্দ বের করতে পারছিল না। ওহামেকে মাউথ অরগানের ব্যবহার শেখানোর চেষ্টা করতে গিয়ে টিটো পড়লো মহা সংকটে। জারোয়ারা ঠিকভাবে মুখ পরিস্কার করে কি না, সেটা টিটোর জানা নেই। তবে ওদের দাঁত সাদা ঝকঝকে পরিস্কার হলেও ওহামের একবার মুখে লাগানো মাউথ অরগানে দ্বিতীয়বার মুখ লাগাতে টিটোর ঘেন্না হচ্ছিল। টিটো বারবার মাউথ অরগানে কিভাবে মুখ থেকে হাওয়া ঠেলতে হবে অভিনয় করে দেখালো। ওহামে ঠিক মতো মুখের ভিতরের হাওয়া মাউথ অরগানের ভিতরে ঠেলতে পারছেনা। অনেকক্ষনের চেষ্টায় শেষে ওহামে মাউথ অরগান থেকে শব্দ বের করতে পারলো। টিটো নিজের দু’হাত দিয়ে মাউথ অরগানটিকে ওহামের মুখেই চেপে আগু পিছু করে বিভিন্ন শব্দ বের করার পদ্ধতি দেখিয়ে দিল। এরপর খুব ভালো না পারলেও ওহামে ওটা দিয়ে কিছু শব্দ বের করলো। ততক্ষনে ওঁর চোখেমুখে বিশ্ময় ফুটে উঠেছে। প্রচণ্ড আনন্দ হলেও মাউথ অরগানটা ওঁর কোন কাজে লাগবে না ভেবে টিটোকে ফেরত দিতে গেল। টিটো সেটা ফের ওহামের হাতে দিয়ে, সেটা যে ওহামের জন্য টিটো এনেছে, সেটা বোঝানোর চেষ্টা করলো। ওয়ামে সেটা যখন বুঝতে পেরেছে, তখন আনন্দে আবার চাড্ডার ভিতরেই পা দুটো শুন্যে তুলে হাঁটতে শুরু করলো।
ওহামের চাড্ডা থেকে মাউথ অরগানের অজানা বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ শুনে বাইরে বসে থাকা মহিলা কোলে বাচ্চা নিয়ে উঠে এসেছে। তাঁকে দেখিয়ে ওহামে টিটোর দিকে ইঙ্গিত করে বলতে থাকলো, ‘মিলোহালে……মিলোহালে……।’ মহিলা এবার টিটোর কাছে এসে জিজ্ঞাসার মতো করে জানতে চাইলো, ‘ আ…… তি……পা ………আ……… তি………পা।’
টিটো যে জারোয়া ভাষা বুঝবে না সেটা আন্দাজ করেই ওহামে বললো, “থিতো……থিতো………।”
এবার টিটো বুঝতে পারলো মহিলা জারোয়া ভাষাতে টিটোর নাম জানতে চেয়েছিল। সেকথাই এভাবে জিজ্ঞাসা করেছিল। এরমধ্যে ওঁরা ওহামের চাড্ডা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। মহিলা কোলে একহাতে বাচ্চাকে সামলে অন্য হাত দিয়ে টিটোর চুল, জামা, গালের চামড়া টেনে টেনে দেখছিল। টিটো মহিলার এই ব্যবহারে অবাক হয়ে গিয়েছে। ওঁর শরীরের কিছু অংশে মহিলার টানাটানির জন্য ব্যাথা লাগলেও মুখে কিছু বললো না। মহিলা টিটোকে ছেড়ে দিয়ে যেখানে বসে নারকেল খাচ্ছিল, সেখানে ফিরে গিয়ে আবার একটা ভাঙা নারকেল হাতে তুলে নিল। সেই ভাঙা অংশ থেকে কিছুটা নারকেল মুখে নিয়ে চিবিয়ে সেই চেবানো অংশ নিজের মুখ দিয়েই শিশুটির মুখে ঢুকিয়ে দিতে থাকলো। শিশুটিও মহিলার মুখের আধ চেবানো নারকেল নিশ্চিন্তে গিলতে লাগলো। টিটো শুনেছিল, বাঘের বাচ্চারা যখন নিজেরা শিকার ধরতে শেখে না, তখন বাঘিনী শিকার করে নিজে সেই শিকারের মাংস খেয়ে শাবকদের সামনে এসে বমি করে দেয়। শাবক বাঘেরা সেই নরম মাংস খায়। তবে এটা কি জারোয়া মা-দের শিশুকে শক্ত নারকেল চিবিয়ে নরম করে খাওয়ানোর পদ্ধতি। অদ্ভুত তো !!!!
মহিলা যে শুধু জারোয়া শিশুটিকেই সেই এঁটো নারকেল খাওয়ালো তাই নয়, ওহামের মুখে মুখ লাগিয়েও কিছুটা নরম চেবানো নারকেল দিয়ে দিল। ওহামের তো আনন্দ যেন আর ধরে না ! দুই হাত তুলে লাফাতে লাগলো। টিটো এবার এঁদের আচরনে বুঝতে পরলো এই মহিলা ওহামের সম্পর্কে মা। এক সন্তানকে খাইয়ে স্নেহের বশবর্তী হয়ে তাঁর অন্য সন্তানকেও আদর করে খাওয়ানোর ঘটনায়। সত্যি, সাধারন সামাজিক মানুষদের মতোই জরোয়াদেরও মহিলাদের সন্তান স্নেহের ধরন একই রকমের।
এবার ওহামে তাঁর মা-কে বলতে লাগলো, “মিলোহালে থিতো…… ইনেঙে সেও ……… ইনেঙ্গে সেও………।”
টিটো অবাক হয়ে দেখলো এবার ওই মহিলা বাচ্চাটিকে কোলে নিয়েই টিটোর কাছে এগিয়ে এসে একহাত দিয়ে টিটোর শরীরের নানা অংশে বোলাতে আরম্ভ করলো। মহিলার মুখে স্নেহের হাসি লেগে রয়েছে। যেন ওই মহিলা টিটোকে বোঝাতে চাইছে, ‘তুমি খুব ভালো মানুষ। ভালো থেকো’।
মহিলা টিটোর দিকে ইঙ্গিত করে ওহামেকে জিজ্ঞাসা করলো, “আমুনুয়া ইলাকোলে?”…… “আমুনুয়া ইলাকোলে”?…………।
মা এর কথা শুনে ওহামে তাড়াতাড়ি টিটোর কাছে এসে একটা হাত ধরে টেনে অন্য দিকে নিয়ে যেতে চাইলো। তবে সেই টানের মধ্যে কোন সাবধান করার লক্ষন ছিল না। যেন অন্য কিছু টিটোকে দেখানোর কথা তাঁর মা ওহামেকে মনে করিয়ে দিয়েছে, এমন ভাব ছিল। টিটোও ওহামেকে কোন বাধা না দিয়ে ওহামের সঙ্গে এগিয়ে গেল। ওহামে টিটোকে নিয়ে এলো চাড্ডার বাইরের এলাকার মধ্যেই অন্য এক দিকে। সেখানে মাটিতে খানিকটা জায়গায় গর্ত মতো করে সেটার উপরে পাথর চাপা দেওয়া হয়েছে। পাথরের উপর হাল্কা করে মাটি বেছানো। অবাক হয়ে টিটো দেখলো, ওহামে প্রথমে সেই ছড়ানো মাটি পরিস্কার করলো। এবার পাথর বেরিয়ে এসেছে। পাথরের টুকড়োগুলো যে কোন গর্তের উপরে চাপা দেওয়া সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দুটো পাথরের টুকড়োর ফাঁকা অংশ দিয়ে অল্প অল্প ধোঁয়া বের হচ্ছে। সেটা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, গর্তের ভিতরে আগুন জ্বলছে। ওহামে এবার পাথরের টুকড়োগুলোকে সরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু পাথরের টুকড়ো গুলোতে হাত দিয়েই আবার সেই হাত মুখের কাছে নিয়ে এসে ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে। তারমানে পাথরের টুকড়ো গুলো ভিতরের আগুনের তাপে গরম রয়েছে। কোন গরম জিনিষ হাত দিয়ে ধরলে ছেঁকা লেগে মানুষ যেমন আচরন করে, ওহামে সেধরনেরই আচরন করছে। টিটো আন্দাজ করলো, ওহামের হাতে আগুনের তাপের আঁচে গরম হয়ে থাকা পাথরগুলোর তাপ লাগছে। তবুও দমছে না তাঁর এই জারোয়া বন্ধুটি। ফের আবার নতুন উদ্যমে গরম পাথরের টুকড়ো সরানোর চেষ্টা করছে। এভাবে ধিরে ধিরে সব ক’টি পাথরের টুকড়োই সরিয়ে ফেললো সে। ওহামের এই চেষ্টা দেখে টিটো আশেপাশের থেকে গাছের ভাঙা ডালের টুকড়ো নিয়ে এসে সেটার সাহায্যে গরম পাথরের টুকড়ো সরিয়ে ওহামেকে সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওহামে টিটোকে হাত নেড়ে সেটা করতে নিষেধ করেছে। বাধ্য হয়ে টিটো মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে ওহামে ঠিক কি করে কৌতুহল নিয়ে সেটাই দেখে যেতে চাইছে।
সব পাথরের টুকড়ো সরানোর পরে টিটোর নজরে এলো পাম গাছের পাতা জাতীয় বড় বড় পাতায় মোড়ানো কিছু জিনিষ সেখানে আগুনের তাপের মধ্যে রয়েছে। একটি মাত্র পাতা দিয়ে মোড়ানো সেই জিনিষগুলো নয়। অনেকগুলো পাতার একই রকম মোড়ক সেখানে রয়েছে। আর সেগুলো সব ক’টাই গরম। কারন মোড়ানো পাতা থেকে ধোঁয়া উঠছিল। একটি মোড়ানো গরম পাতা তাপের কারনে অনেকক্ষনের চেষ্টায় বাইরে বের করতে পেরেছে ওহামে। মুখ দিয়ে ক্রমাগত ফুঁ দিতে দিতে তাপ কিছুটা কমানোর পরে, মোড়ানো পাতার ভাঁজ খুললো ওহামে।
পাতার মোড়ানো অংশের ভিতরে উঁকি দিল। টিটো এবার দেখতে পেল, কিছুটা চামড়া ছাড়ানো কোন জন্তুর মাংস পাতার খোলসের ভিতরে রয়েছে। সেই মাংস আগুনের তাপে সম্ভবত ঝলসে গিয়েছে। টিটোর কাছে জারোয়াদের অনেক জিনিষ এবার পরিস্কার হয়েছে। এই গর্তের ভিতরে নীচে কাঠ, ডালপালা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তার উপরে আবার পাথর ছড়ানো রয়েছে। পাথরের উপরে কাঁচা মাংস পাম জাতীয় গাছের পাতায় মুড়িয়ে রেখে তার উপরে আবার পাথর ছড়ানো ছিল। আর সেই পাথরের উপরে ছড়ানো ছিল হাল্কা করে মাটির আস্তরন। টিটো বুঝতে পারলো, এটাই তাহলে জারোয়াদের মাংস সেদ্ধ বা আগুনে ভাপিয়ে খাওয়ার পদ্ধতি। শুধু সেটাই নয়, ওহামের মা যে ‘আমুনুয়া ইলাকোলে’ বলে জারোয়া ভাষায় ওহামেকে যেকথা বলেছিল, সেটার অর্থ সম্ভবত টিটো মাংস খাবে কি না ! সেই কথাই সম্ভবত জিজ্ঞাসা করতে বলেছিল।
কোন জন্তুর মাংস এভাবে মাটির গর্তের ভিতরে আগুনে ঝলসানো হয়েছে, সেটা জানে না টিটো। কলকাতায় চিকেন বা মটন ছাড়া অন্য কোন জন্তুর মাংস খায়নি সে। ঝলসানো এই মাংস দেখে যে টিটোর দোনোমনা হচ্ছে, সেটা ওঁর আচরনে পরিস্কার হয়ে উঠেছে। আর সেটা বুঝতে পেরেই ওহামে পাশের এক জঙ্গল থেকে নিয়ে এলো ওই পশুটির গায়ের চামড়া। মাংস কেটে ঝলসানোর আগে পশুটির চামড়া ছাড়িয়ে বেশ যত্ন করেই রেখে দিয়েছিল ওঁরা। টিটো দেখলো, ওহামে বেশ প্রমান সাইজের শুয়োরের চামড়া নিয়ে এসে হাতে ঝুলিয়ে টিটোকে দেখাচ্ছে। এবার সেই চামড়া পাশে রেখে পাতায় ঝলসানো শুয়োরের মাংসের কিছু অংশ মুখে তুলে বাকী মাংস থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে নিয়ে চিবিয়ে ফেলে দিল। দু’দিকে মাথা নাড়তে থাকলো ওহামে। যার অর্থ, যেন এই মাংসের ঝলসানোতে সন্তুষ্ট নয় সে। এবার গর্তের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে আরও একটা পাতায় জড়ানো মাংসের টুকড়ো তুলে আনলো ওহামে। সেই মোড়ানো পাতা একই ভাবে খুলে মাংসের এক টুকড়ো মুখে দিয়ে একই ভাবে চিবিয়ে মুখ থেকে মাটিতে ফেলে দিল। ওহামের চোখ মুখের আচরন দেখে টিটোর মনে হলো, ঠিকমতো পরিপাক হয়ে ঝলসানো মাংস খাওয়ার উপযুক্ত হয়নি। টিটোর দিকে একবার তাকিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে ওহামে গর্তের ভিতরে ফের মাংসগুলোকে আগের মতো করে রেখে দিল। আগে যেভাবে পাতায় জড়ানো মাংস গর্তের ভিতরে ছিল, সেভাবে রেখে আবার সেই পাথরগুলোকে চাপা দিয়ে দিল। পাথরের উপরে হাল্কা করে মাটি ছড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। টিটো ওহামের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল ওঁর কীর্তিকলাপ। উঠে দাঁড়িয়ে কোমড়ে দু’হাত দিয়ে ওহামে মাথা তুলে আকাশের দিকে দেখলো। এক আঙ্গুলে আকাশের দিকে দেখিয়ে ফের গর্তের দিকে ইঙ্গিত করে জারোয়া ভাষাতে কি যেন বললো নিজের মনেই।
টিটো আন্দাজ করলো, গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে মাটির ভিতরে আগুনের উপরে রাখা মাংস ঠিকমতো ঝলসায়নি। বৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা কম পেয়ে ঝলসানো শুয়োরের মাংস যে টিটোকে খাওয়াতে পারলো না, সেজন্য আক্ষেপ করছিল ওহামে। জারোয়া ভাষা না জানলেও আকার ইঙ্গিতে সেকথা বুঝতে টিটোর কোন অসুবিধা হয়নি। জঙ্গলের ভিতরে জারোয়া পদ্ধতিতে শুয়োরের ঝলসানো মাংস টিটো কিভাবে গ্রহন করতো, সেটা আর টিটো এখন ভাবতে চায় না। টিটো খুশি হলো ওহামে ওঁকে নিজের চাড্ডায় নিয়ে এসে আথিতেয়তা করানোর প্রবল চেষ্টা দেখে। যদি প্রকৃতি টানা বৃষ্টি দেয়, আর সেই কারনে মাংস ঠিকমতো খাওয়ার উপযুক্ত না হয়, তবে ওহামে কি করতে পারে ! টিটো নিজের মনেই ভাবলো, ওহামে জারোয়া হলেও মানুষ তো ! হোক না বন্য ! শিকার করা শুয়োরের মাংস প্রাকৃতিক উপায়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে খাওয়ার উপযুক্ত করে তোলে ওঁরা ! আসলে ওঁরাও তো প্রকৃতিরই সন্তান !
(চলবে)