“বুঝলে, দিনে দুটো খেতাম, আজ থেকে একেবারেই ছেড়ে দিলাম” বলে বাবা ম্যাচটা মা’র হাতে ফিরিয়ে দিলেন। মা বহুবার বাবাকে সিগারেট ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছেন, বাবা ছাড়েন নাই। তবে বাবা শোভনের সামনে সিগারেট খায় না। বাবার শার্টে গন্ধ লেগে থাকে। কড়া গন্ধটা শোভনেরও ভালো লাগে না। বাবা আর সিগারেট খাবে না- এমন সিদ্ধান্তে মা’র খুশি হবার কথা। কিন্তু মা’র চেহারা মলিন হয়ে এলো। মা’র চোখ দু’টো ছলছল করছে। নাকের ডগায় লালচে আভা। মন খুব বেশী খারাপ হলে মা’র নাকের ডগা এমন লাল হয়ে ওঠে। বাবার সিদ্ধান্তে মা’র কষ্ট পাওয়ার কারণটা শোভন ধরতে পারে না। এবার জন্মদিনে গ্রাম থেকে দাদু ফোন করে বলেছেন, “দাদাভাই, তুমি আট বছরে পড়লে! মাশাল্লাহ। তুমি তো বড় হয়ে গেছো।” তবু শোভন বড়দের ব্যপারগুলো বুঝতে পারে না।
মা মুখ মুছার ছলে শাড়ির আঁচল দিয়ে ভিজে আসা চোখ আর নাকের ডগা মুছেন, কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন “চা খাবে! একটু চা কইরা দেই!” চা বাবার খুব পছন্দ। বাবা মগভর্তি চা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে বা বিছানায় হেলান দিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দেয়, বই বা পত্রিকা পড়ে, কোনো কোনো রাতে চায়ের মগ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে, বাড়ির সামনের রাস্তাটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে আর আয়েশ করে চা খায়- শোভনের দেখতে খুব ভালো লাগে। শোভনের খুব চা খেতে ইচ্ছে করতো, মা দিতেন না। এখন দেন। যে সকালগুলোতে ঘরে ডিম থাকে না, শোভন নাস্তায় চায়ে পরোটা ভিজিয়ে খায়। শোভনের এখন বাবার সাথে চা খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ওকে বিস্মিত করে বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন, “না, না। এখন কষ্ট করে চা বানাতে হবে না। ভাবছি কাল থেকে সকাল ছাড়া চা খাওয়াটাও বন্ধ করে দিবো, কি বলো!” মা কিছুই বললেন না। বিছানায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনের চেষ্টা করলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন।
বাবা সত্যিই চা খাওয়া ছেড়ে দিবেন- বড়দের কখন যে কি হয় শোভন বুঝতে পারে না। দু’বছর আগে করোনা ভাইরাস এলো– অফিস বন্ধ, স্কুল বন্ধ। বাবা অনেকদিন অফিসে যাননি। ঘরবন্দী বাবা সারারাত ঘুমোতে পারতেন না। চিন্তা করতেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। তবে শোভনের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। ও বুঝতো বাবা অভিনয় করছে। কারণ বাবার মিথ্যে হাসিতে চেহারার চিন্তারেখাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতো। তখন কি সব হিসেব নিকেষ করে বাবা দিনে পাঁচটা সিগারেট থেকে কমদামী দু’টা সিগেরেটে নেমে এসেছিলেন। মা’ও অনেক চিন্তা করতেন। কিন্তু বাবাকে স্বাভাবিক স্বরে বুঝাতেন, “এতো চিন্তা কইরো না তো। চিন্তার চাপে তোমার কিছু হয়া গেলে আমাদের কি অবস্থা হইবো সেইটা ভাইবো! টেনশন কইরা লাভ নাই, দেইখো সব ঠিক হয়া যাইবো।” বাবা শুধুই হাসতেন। আকুল কান্নার মত করুণ সে হাসি! বিষাদমাখা স্বরে মা’কে বলতেন, “হুম, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের যা যাচ্ছে তা এক্কেবারেই যাচ্ছে। তিল তিল করে গড়ে তোলা সঞ্চয়, তোমার গহনা, শোভনের ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে রাখা ফিক্সড ডিপোজিট- সব.. সব।”
করোনার পর বাবার অফিস খুললো। শোভন ভেবেছিলো সব আগের মত হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই আগের মত হলো না। বাবা আর মা’ও আগের মত হতে পারলেন না। চেষ্টাও করলেন না। শোভনের বিশ্বাস- ও আগের মতই আছে। আবার মনে সন্দেহও জাগে- সবার মত বদলে গেছে। একরাতে আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন, “আর পারছি না। বাড়িটা বদল করতে হবে।” বাড়ি বদলের কথা শুনে শোভনের মন খারাপ হলো। দুই বেড রুমের এই ফ্ল্যাটে শোভনের নিজের একটা রুম আছে। মা খুব সুন্দর করে রুমটা সাজিয়ে দিয়েছেন। রুমের একপাশের দেয়ালে মিকি মাউজ আর মিনি মাউজ হাসছে। বিছানার পাশের দেয়াল আর পুরো সিলিং জুড়ে বাবা ছোট-বড় অনেকগুলো তারা লাগিয়ে দিয়েছেন। তারাগুলো অন্ধকারে মিটমিট করে জ্বলে। রাতে ঘুম ভাঙলে শোভনের মনে হয় ও খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে। রুমের পাশে গ্রিলঘেরা ছোট বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাশের ফ্ল্যাটের রুমনের সাথে কথা হয়। শোভনের মনে পড়ে, রুমনরা গত মাসে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। শোভনদের ফ্ল্যাটে ঢুকার দরজা থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত লম্বা জায়গাটার মাঝখানে মা পর্দা টানিয়ে ড্রইং আর ডাইনিং রুম বানিয়েছেন । এই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে যাওয়ার কি প্রয়োজন শোভন বুঝতে পারে না।
পরের মাসেই বাড়ি ছাড়া হলো। বাড়ি ছাড়ার আগের দিন বাবা সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল আর শোভনের খাটটা বিক্রি করে দিলেন। নতুন ফ্ল্যাটের জন্য নতুন সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল ও বিছানা কেনা হবে ভেবে শোভন খুশি হয়েছিল। কিন্তু নতুন ফ্ল্যাটে এসে ওর ছোট বুকটা গভীর বিষাদে ডুবে ছিল। এই ফ্ল্যাটে একটা মাত্র বেড রুম। রান্নাঘরের সাথে সামান্য খোলা জায়গায় মা শোভনের পড়ার টেবিলটা গুছিয়ে দিয়েছেন। এই ফ্ল্যাটে শোভনের নিজের রুম নেই- ওর খুব কষ্ট হয়। আবার বাবা-মা’র মাঝখানে ঘুমোতে পারে বলে আনন্দও হয়। স্কুলে যেতে ও আসতে প্রতিদিন সাত তলায় উঠা-নামা করতে হয়। লিফট নেই, ছোট পায়ে অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে উঠা-নামা করতে কষ্ট হয়। বাবা-মা’র রুমের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকখানি আকাশ আর গলি থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত যাওয়া পথটা স্পষ্ট দেখা যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে বা রাস্তায় তাকালেই শোভনের মন ভালো হয়ে যায়।
বাড়ি বদলের সাথে আরও অনেক কিছুই বদল গেল। আগের ফ্ল্যাটে থাকতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে শোভনকে নিয়ে বাবা আর মা বেড়াতে যেতেন। মাঝে মাঝে ফাস্টফুডের দোকানে বসে শোভনকে বার্গার বা ক্রিস্পি চিকেন ফ্রাই খাওয়াতেন। মা ফুচকা খেতেন। বাবা শুধু চা খেতেন। এখন এক একটা শুক্রবারে বাবা বলেন, “চল বাবাই, একটু ঘুরে আসি।” পার্কের পাশে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে বাবা প্রশ্ন করেন, “বাবাই, তুই কি খাবি- ঝালমুড়ি, ফুচকা, বার্গার না চিকেনফ্রাই!” শোভনের বার্গার বা চিকেনফ্রাই খেতে ইচ্ছে করে। বড়দের অনেক কিছু বুঝতে না পারলেও বাবা কোন উত্তরে স্বস্তিবোধ করবেন তা বুঝতে পারে। শোভন বলে, “ঝালমুড়ি খাবো। কাঁচামরিচ ছাড়া ঝালমুড়ি।” যেদিন বেতন হয়, শোভনের জন্য বাবা বার্গার বা ক্রিস্পি চিকেন ফ্রাই বা পোলাও আনবেনই আনবেন। পোলাও শোভনের খুব প্রিয়, নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর ঈদের দিন ছাড়া মা একদিনও পোলাও রান্না করেনি।
মানুষ শিক্ষাশ্রয়ী প্রাণী। শিক্ষাকে আশ্রয় করে মানুষ বেঁচে থাকে। শিক্ষাই মানুষকে শেখায় মানিয়ে নেওয়া এবং মেনে নেওয়া এক নয়। বেঁচে থাকার অনিবার্য ধাওয়ায় অসহনীয় বাস্তবতার সাথে মানুষ মানিয়ে নেয়। না মেনেও মেনে নিতে বাধ্য হয়, অভ্যস্ত হয়। মানিয়ে নিয়ে এবং মেনে নিয়ে বা না মেনে শোভনদের পরিবার অনাবৃত দুঃসময় অতিক্রম করছিলো। নতুন করে শোভনের বাবা একবেলা ছাড়া চা খেতে চাইছে না, চা ও সিগারেটহীনতার সাথে মানিয়ে নিতে চাইছে– শোভনের মা’র মন শঙ্কায় ভরে উঠে। কাঁপাকাঁপা স্বরে জানতে চান, “তুমি আর সিগারেট খাইবা না, এইটা ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু সবকিছু ছাড়তে ছাড়তে চা’ও একবেলা ছাড়া খাইবা না, এইটা কেমন কথা! কি এমন ঘটছে সেইটা বলবা?”
মা’র প্রশ্ন শুনে শোভনের বাবা বালিশে হেলান দেন। লোডশেডিং চলছে, ফ্যাকাশে চার্জার বাতির আলোয় দেওয়ালে পড়া বাবার ছায়াটাকে আরও ফ্যাকাশে লাগছে। শোভনের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলেন, “তুমি শোনো নাই, কারা যেনো আমাদের দিকে দুর্ভিক্ষ ছুড়ে দিচ্ছে।”
মা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন না, স্বাভাবিক স্বরেই বলেন, “দুর্ভিক্ষের আর বাকী আছে কি! জিনিসপত্রের যে দাম, প্রতিটা দানা হিসেব কইরা মুখে তুলতে হইতাছে। মাসে দু’শ চল্লিশ টাকা বাঁচানোর জন্য তুমি সিগারেট ছাইড়া দিবা- ভালো কথা। কও তো আসন্ন দুর্ভিক্ষে বাড়ি ভাড়া, ইলেক্ট্রিসিটি, গ্যাস ও পানির বিল শোধের পর কি আমাদের ডাল-ভাত আর আলুভর্তাটাও ছাইড়া দিতে হইবো!”
শোভনের মনে পড়লো মা ডিম, ব্রয়লার মুরগির মাংস বা চাষের পাঙ্গাস মাছ রান্না করলেও প্রায় দুপুরেই আলুভর্তা, তরকারির ঝোল আর ডাল দিয়ে ভাত খান। বাবা আরও আগে, করোনার সময় থেকে “ভাল্লাগে না” বলে ব্রয়লার মুরগি ও চাষের পাঙ্গাস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। শোভন বুঝতে পারে “ভাল্লাগে না’ নয়, বাবা-মা সংসারের হিসেব মিলাতেই এসব খাবার মুখে তুলেন না, ভাতও কম খান। মা’র প্রশ্নের উত্তরে বাবা বলেন, ” কি জানি! ডাল-ভাত আর আলুভর্তাও ছাড়তে হতে পারে। হাওয়া খেয়ে বাঁচা যেতে পারে। এ শহরের দূষিত বাতাস এখনও বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে উঠেনি। যাও একটু চা করো, আগামীকাল থেকে একবেলা চা করলেই হবে।”
মা মোম জ্বালিয়ে নিয়ে রান্না ঘরে যায়। কৌতূহলী শোভন প্রশ্ন করে, “বাবা, দুর্ভিক্ষ হলে কি মানুষ মরে যায়? আমরা বাঁঁচবো তো!” বাবা শান্তস্বরে বলেন, “দুর্ভিক্ষে ধনীলোকরা মরে না রে বাবাই। গরীবরা বাঁচে না। আমরা যারা মরার মত বেঁচে আছি আর মরলে একেবারে বেঁচে যাই, ইঁদুর মারার কলে টোপের মত ঝুলি, তারা দুর্ভিক্ষে বাঁচবো কি মরবো – এ বড় জটিল প্রশ্ন। তবে বাঁচি বা মরি গোর আজাব বাড়বে, বাড়তেইথাকবে। এসব কথার মানে বড় হলে বুঝবি। রাত হচ্ছে, এখন ঘুমো বাবাই।”
বাবার কথার অর্থ শোভন বুঝে না। তবু ওর মন খারাপ হয়। মনে মনে ভাবে বেঁচে থাকলে দুর্ভিক্ষের পর ওদের কি আরও ছোট আরও উঁচু কোনো লিফটবিহীন ফ্ল্যাটে চলে যেতে হবে যেখানে ওর পড়ার টেবিল রাখার জায়গাটুকুও হবে না, প্রতিদিন পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উঁচুতে উঠতে হবে পরদিন ফের নেমে যাওয়ার জন্য। শোভন চোখ বন্ধ করে ঘুমোতে চেষ্টা করে, ঘুম আসে না।