বিজ্ঞান গবেষণার সাথে কুকুর লড়াইয়ের যৌক্তিক কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়, কিন্তু আবুবর সাহেব সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। স্বর পরিবর্তনের গবেষণা শুরু করলেই তিনি দেখেছেন, কুকুরেরা কোথা থেকে যেন ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে এসে লড়াই বাঁধে। শুধু লড়াই নয়, তাদের আগ্রাসী আক্রমণে আর ভয়ঙ্কর গর্জনে আবুবর সাহেবের স্বর পরিবর্তনের চিন্তা অঙ্কুরেই মারা যায়।
এমনিতেই জেদি হলেও বেশ ভিতু প্রকৃতির মানুষ আবুবর সাহেব। কুকুরের এমন মাতাল উন্মাদনা আর হুঙ্কার গর্জনের সাথে তাঁর স্বর বা স্বর পরিবর্তনের গবেষণা স্বরব হতে পারে না। বরং চুপসে গিয়ে তিনি ল্যাব থেকে বেরিয়ে ভুঁড়িওলা হেডস্যারের পেছনে জড়োসড়ো দাঁড়ান।
হেডস্যার ছুটাছুটি করে লড়াই থামানোর চেষ্টা করলে আবুবর সাহেব অফিস রুমে ঢুকে দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখেন, মাতোয়ারা কুকুরগুলো গোটা স্কুলমাঠ তুলকালাম যুদ্ধে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া করে তাদের নাকমুখে কামড়ে শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে।
একসময় ল্যাবরেটরির ওপর আছড়ে পড়ে তারা হাঁপাতে হাঁপাতে পরস্পরের দিকে আক্রমণাত্বক দৃষ্টি রেখে ঘেউ ঘেউ করতে করতে থেমে যায়। তারপরেই স্যাররা এবং ছেলেমেয়েরা সবাই স্কুলঘর থেকে বেরিয়ে আসে মারার জন্য। কিন্তু তারা মারতে পারে না। কারণ কুকুরগুলোর মালিক তখন সামনে এসে দাঁড়ায়। মালিক পেয়ে কুকুরগুলোর সাহস আরো বেড়ে যায়। আরো জোড়ে চিৎকার করে তারা। কিন্তু কুকুরের মালিক হাত ইশারায় একসময় থামায় তাদের। এরপর তাদের ডেকে নিয়ে যায় বাড়ির দিকে।
আবুবর সাহেব এবার সাহস করে অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। এসে দেখেন, দুইজন নেতার পেছনে ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে ফিরে যাচ্ছে তাদের পোষমানা কুকুর।
স্কুলমাঠের চারদিকে চারজন রাজনৈতিক নেতার বাড়ি। তাঁরা সবাই কুকুর পোষেন। তাঁদের পোষমানা মোটা-তাগড়া কুকুরগুলোর সাথে আবুবর সাহেবের স্বর পরিবর্তনের গবেষণার কী এমন সম্পর্ক আছে প্রথমদিকে বুঝতে না পারলেও পরে তিনি তিলে তিলে বুঝতে পেরেছেন, তাঁর স্বর পরিবর্তনের ফিসফাস শব্দগুলো নেতাদের কুকুরগুলো পছন্দ করে না, শুধু কুকুর নয়, কুকুরের মালিকদেরও পছন্দ হয় না। একারণে কুকুরগুলো তাদের সূক্ষ্ণ শ্রবণশক্তিতে আবুবর সাহেবের স্বরগবেষণা ধরে ফেলে। মালিকের দিকে তাকায় তারা আর অপেক্ষা করে। মালিকের ইশারামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা শুরু করে লড়াই।
ব্যাপারটা হেডস্যার আর স্কুল কমিটিকে জানান আবুবর সাহেব। প্রথমদিকে কিছুটা গুরুত্ব দিলেও তারা কোনো এক কারণে চুপটি মেরে থাকেন। এর পর থেকেই আবুবর সাহেব কাউকে কিছু বলেন না। তাঁর এই না বলতে পারার ব্যথা নিরবতার ভেতর অব্যক্ত যন্ত্রণার দহন হয়ে গুমোট বেঁধে থাকে, তাঁর মগজে স্বরব কষ্ট তোলপাড় করে কণ্ঠহারা বোবার মতো ছটফটায় যেন। এই ফটফটানি নিয়ে তিনি ভাষাহীন হয়ে সারাক্ষণ মাথায় একটা ঝিমঝিম ভার নিয়ে একলা হাঁটেন।
এই ঝিমধরা অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে স্কুল যাওয়াআসার পথেই আজ তিনি লড়াইয়ের সামনে পড়েছেন। তিনি দেখেন, স্কুলের ছেলেমেয়েরা কুকুরের মতো মারামারি করছে।
– এই এই বাবারা, থামো থামো থামো! কী করছ নিজেদের ভেতর, থামো তোমরা।
– স্যার, ঐ শয়তানটা আমাকে বাম নেতার কুকুর বলেছে।
– তুই কেনো আমাকে ডান নেতার কুকুর বললি?
– এই থামো! আবুবর সাহেব থামতে বললেন।
– স্যার গতকাল সে আমাকে পূব নেতার কুকুর কইছিল।
– তুই আগে বলেছিস পশ্চিম নেতার কুকুর।
আবুবর সাহেবের তালগোল বেঁধে যায়। হায় আল্লাহ, কুকুরগুলোর লড়াই কীভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে চলে এসেছে। তিনি সবাইকে চুপ থাকতে বলেন।
– তোমরা নেতার কুকুরগুলোর মতো নিজেদের মধ্যে মারামারি করছ। কেনো করছো বোকার দল?
– আমাকে কুকুর বলেছে স্যার। তাও আবার পশ্চিম নেতার কুকুর।
– সৌভাগ্য তোর, বেহেস্তে যেতে পারবি। তোকে তো বাম নেতার কুকুর বলে নাই, শালা নাস্তিক! একজন খেঁকিয়ে ওঠে।
– কী ভয়ঙ্কর! এই কী সব বলছ তোমরা? ছি, থামো তোমরা।
আবুবর সাহেব থামানোর চেষ্টা করলেন। তারা আবার শুরু করে মারামারি। আবুবর সাহেব বুঝতে পারলেন, খুব ভয়ানক হয়ে গেছে ছেলেমেয়েদের মন-মানসিকতা। এভাবে এদের থামানো যাবে না। তিনি পেছনে সরে আসেন।
স্কুল সীমানার দেয়াল লাগোয়া চায়ের হোটেল। দেয়ালের ইট কেটে দোকানের সাথে দরজা বানানো। সেই কাটাদরজা দিয়েই আবুবর সাহেব হোটেলে ঢোকেন। সেখানে দেখেন এক টেবিলে বসে অট্টহাসি দিয়ে খোশগল্পে মেতে চা খাচ্ছেন চার নেতা। তিনি তাঁদের বললেন, থামান ছেলেদের। কী জঘন্য মারামারি করছে দেখেন।
তাঁরা হাত ধরে আবুবর সাহেবকে পাশেই বসালেন। চায়ের অর্ডার দিলেন আবুবর সাহেবের জন্য।
– আরে মশাই, চুপ করে ওদের তামাশা দেখেন। বলেই তাঁরা গল্পে মেতে উঠলেন।
– আহা, তামাশা নয়, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ওরা।
– আহা বোকা মাস্টার! অধিকার কী জিনিস তারা শিখুক। এরপর দেখবেন এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
– কী করে এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যায়?
– আপনি চুপ থাকলেই সব ঠিক হয়ে যায়! বলেই তাঁরা হাসতে লাগলেন।
আবুবর সাহেব চা খেলেন না। যে কাটামুখ দিয়ে হোটেলে ঢুকেছিলেন, সেই মুখ দিয়েই বেরিয়ে এলেন তিনি। দেখলেন, কুকুর কামড়াকামড়ি থেমে গেছে তাদের।
ব্যাপারটা কি তাহলে এমনিতেই ঠিক হয়ে গেল? খটকা লাগল আবুবর সাহেবের। না, এমনিতেই এইসব ঠিক হয়ে যায় না।
আবুবর সাহেব মাথা নিচু করে অফিসের দিকে যেতে যেতে ভাবতে লাগলেন। আরো একটি নতুন ধরনের গবেষণা করবেন তিনি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, যার নাম দিবেন “কুকুর ও স্বর পরিবর্তনের গবেষণা”। যে গবেষণায় দেখাবেন বিজ্ঞান গবেষণার স্বর কুকুরের ঘেউঘেউ চিৎকারে কিভাবে হারিয়ে যেতে থাকে।
————— ——————— —— —– ————–
শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ
৯. পরিবর্তনের স্বর চেনাতেন আবুবর-১
৮. সোনাইর বিয়ে পাখির সাথে
৮. হিরোর গন্ধ সমাচারে আবুবর-১