চিরতরে মুক্তির প্রার্থনায়

ষাটোর্ধ্ব পরিমল বসুর ফিনফিনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী, গালের ঝুলে পড়া চামড়ায় নতুন যৌবনপ্রাপ্ত যুবকের মতো ক্লিন সেইভ করার পরও থেকে যাওয়া বেশ কতগুলো সাদা দাঁড়ি, নাকের নিচে গাঢ় ধবধবে গোঁফ আর ছানিপড়া ফ্যাকাশে অথচ ঘোলাটে লাল হয়ে থাকা চোখে কালো ফ্রেমের চশমা দেখে তার সেকেন্ড ক্লাস অফিসার জামাই কিংবা তার পরিবারের সদস্যগণ কি ভাববে সেটা পরের বিষয়; বিকেলে বাজারে গিয়ে নিজের সাধ্যমতো কিংবা বায়না রেখে বিয়ের সরঞ্জামাদি কিনতে পারবে কিনা সেই ভাবনায় অধীর হতে থাকবে পরিমল বসু। তার আগে ধুতি আর গামছা নিয়েই পুকুরপাড়ে স্নানের আয়োজন করতে থাকবে। সেখানে প্রতিটি ডুবের সাথে তার মনও বারবার ডুববে আর ভাসবে ছোট শিশুকে দোলনায় দোল খাওয়ানোর মতো। কাল তার কালোরঙা মেয়ে ঠিকমতো সেজে বিয়ের পিড়িতে বসলে অতঃপর হঠাৎ কোনো কারণে আবার বরপক্ষের মত বদলাতে পারে কিনা একথাও ভাবতে থাকবে পরিমল বসু আর সেই ভাবনার সাথেই তার পেঁকে যাওয়া গোঁফের ডগা যেন আরো পাঁক খেতে থাকবে। এবং তারপর পাকাপাকির বিষয়টা, সেটা গোঁফের-ই হোক অথবা বিয়ের, গোঁফের হলে তেল লাগবে কিনা আর বিয়ের হলে দেনমোহর নিবে কিনা তা বরের বাবার সাথে আজ রাতেই একলহমা আলোচনা করে নিতে হবে; যেহেতু ফল পেতে গেলে পরিচর্যা আবশ্যক! স্নান শেষ হলে নিজের ফর্সা গায়ে ঝাঁঝালো সর্ষের তেল মাখতে মাখতে কিভাবে একমাত্র আদরের মেয়েটা এমন কালো হলো যে ভালো বর পেতে এতো বেগ পেতে হলো ভাবতে থাকবে আর তার মতো তার স্ত্রীর রঙও যে ফর্সা, এই কথাটি মনে পড়ে যেতে আরো উত্তেজিত হতে থাকবে বুড়ো পরিমল। তখন হাটের দিকে যেতে থাকলে ভবিতব্য জামাইয়ের সাথে দেখা হলে সে এই হাটে কেন জানতে চাইবে আর তার অমঙ্গলকামী হিংসুক গ্রামবাসীগণ তার অথবা তার মেয়ের নামে নতুন জামাইয়ের কাছে কোনো কুৎসা রটাচ্ছে কিনা ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠবে। জামাই হাসিখুশি ভাবেই কথা বললে অবস্থা স্বাভাবিক আছে ভেবে কুঁচকে যাওয়া কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম শীতল স্বস্তিতে শুকোতে থাকবে।

বিকেলের দিকে হবু বেয়াই এর সাথে কথা বলতে গেলে বারেকের দোকানের বাহারি পান নিয়ে যাবে যাতে পানের রসের মতো বেয়াইর মনটাও রসে স্থিত, ধীর হয়ে যায়। তখন দেনমোহরের কথাটা পাড়লে খুব বেশি চাইতে বেয়াইর আত্মসম্মানে বাঁধবে এবং অল্প আয়োজনেই যাতে অনুষ্ঠানটা শেষ করা যায় সে বিষয়েও কথা বললে বেয়াই সম্ভবত হ্যাঁ-সূচক বাক্যই ব্যবহার করবেন বলে আশাবাদী পরিমল। সন্ধ্যা হয়ে গেলে রাতের খাবারটা তারা না খাইয়ে ছাড়বেন না এবং জামাই তার হবু শ্বশুরকে খুশি করার জন্য নিজের হাতে ভাত-তরকারি তাকে উঠিয়ে দেবে। খাওয়া শেষ হলে সৌজন্যতা বজায় রাখতে রাতটা থেকে যেতে বললেও বিয়ের ব্যাপারে বিস্তর কাজ আছে এবং বহু মাহাজনকে বসিয়ে রেখে এখানে এসেছে বলে বেয়াইর গুরুত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রসন্ন মনে বেয়াই এবং জামাই তাকে বিদায় জানাবে। একটু বেশি করে হলে জামাই অর্ধেক পথ পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিয়ে যাবে। সে আসতে না করলেও বাহানা এবং যত্নের ব্যাপার যে তার মেয়ে, এই ভাবনায় অধীর হয়ে উঠবে বৃদ্ধ পরিমলের মন।

কালকের দিনটা ভালোয় ভালোয় কাটলেই তার কালো মেয়েটারও ভালো হবে, হবে মঙ্গল এবং লোকের নানারকম বিব্রতকর অপমানজনক কথা বলা বন্ধ হবে। শুধু লক্ষ্য রাখতে হবে কারো বাজে কথায় অথবা অন্য কোনো কারণে জামাইয়ের মত হঠাৎ যেন পাল্টে না যায়। এদিকে তার কালো রঙের কৃষ্ণকলিও মনের গোপন কালো সেøটে সুদর্শন বরটির ছবি আঁকছে কিনা পরখ করতে চাইলে খানিকটা মুচকি হেসে, সামনের দুটো দাঁত দিয়ে তর্জনী কামড়িয়ে আবার দরজার আড়ালে লুকোলে ঘটনা যে সত্য আবিষ্কার করে এবং বিবাহপরবর্তী তাদের জীবন যে সুখী হবে নিশ্চিত ভেবে চিন্তামুক্ত হবে বৃদ্ধ পরিমল। বৌ’কে মেয়ের যত্ন নিতে বললে আর ভালো ভালো খাওয়াতে বললে বৌ এতো সুখের ভাবনায় চ্ছেদ ঘটিয়ে অভাবের করুণ চেতনার কথা মনে করিয়ে দিলে পরিমলের মন কিছুটা থেমে গেলেও ধার দেনা পাবার মতো বহু লোক আছে, ভেবে মনকে সান্ত্বনা দেবে সে। কিন্তু কাল বিয়ে এবং মেয়েকে ভালোমতো খাওয়ানোর জের ধরে বিয়ের অন্যান্য খরচও যে জোগাড়ে বাকি তা ভেবে আরো অস্থির হয়ে উঠবে তার মন। পরদিন কিছু ব্যবস্থা করা যাবে ভেবে শুয়ে পড়লে চিন্তা আরো জেঁকে বসবে মাথায়। কোনো উপায় অবশেষ না থাকলে ভিটেটা বন্ধক দিতে হবে এবং তার বিনিময়ে হলেও মেয়ের বিয়ে দিতে হবে ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়বে পরিমল বসু।

হঠাৎ বুটের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে পরিমল, তার বোকা স্ত্রী এবং সদ্য যৌবনপ্রাপ্তা কালোরঙা কৃষ্ণকলি কি করবে ভেবে উঠতে পারবেনা। অথচ তাদের চাঁটাইয়ে ঘেরা একটি ঘরের পাটাতনে ভাগ করা দুটো রুমের সম্মুখ দরজায় ক্রমাগত হাতের ধাক্কা, বুটের লাথি পড়তে থাকলে একসময় তা ভেঙে গিয়ে গুড়িয়ে পড়বে আর রাগান্বিত ক্যাপ্টেন ও তার সহসেনারা বৃদ্ধ ও তার স্ত্রীকে অনবরত লাথাতে থাকবে। পরিমল বসুর আলগা হয়ে আসা ধুতি আরেকটা পাছায় পড়া লাথির চোটে খুলে গেলে ক্যাপ্টেনের সহসেনা সিপাহীরা বহু সাধনার পরে যেন একটা মুরগা পেয়েছে ভাব করে খলবলিয়ে হাসবে। পাটাতনের ওপাশে থাকা মেয়ে যাতে মধ্যদরজা খুলে এদিকে না আসে প্রার্থনা করতে করতে পাটাতনের দিকে পরিমলের স্ত্রী তাকালে তখনই চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বিরক্ত মুখে সুন্দর গড়ন, ছিপছিপে চেহারার কালোরঙা তাদের আদরের রাণী বের হয়ে আসবে। অতঃপর তার ওপরেও চলবে করুণ অত্যাচার। তিনজনকে অনেকক্ষণ প্রহারের পর তাদের দেহশক্তি এবং এদের সহ্যশক্তি নিস্তেজ হয়ে এলে ক্যাপ্টেন খাটের ওপর বুট তুলে বসবে আর পরিমলের মেয়েকে একগ্লাস পানি আনতে পাঠাবে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে তারপর পানি নিয়ে আসার পর পানি খেতে খেতে ক্যাপ্টেন তার মেয়েকে শকুনের মতো খুটে খুটে দেখবে এবং অবশেষে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে ছেড়ে দিয়ে সহসেনাদের ‘ইস লাড়কি কো গাড়ি মে তোলো’ বললে বৃদ্ধ পরিমল দারুণ ক্ষোভে ফেটে পড়বে। কিছু খোঁজার পর খাটের নিচে মোটা একটা খড়ি পেয়ে সেটা দিয়ে ক্যাপ্টেনকে পেছন থেকে মারতে চাইলে সিপাহীদের একজন দেখে ফেলবে এবং ক্যাপ্টেন ভীষণ রেগে গিয়ে ‘মুঝকো মারেগা তু? মুঝকো?’ বলতে বলতে সেই খড়ি দিয়ে পরিমলের রোগা শরীরের প্রতিটি হাড় ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলবে। তাই দেখে মেয়ে অনেক জোরাজোরির পরও নিজেকে তাদের কাছ থেকে ছুটাতে না পেরে কান্নায় ফেটে পড়বে আর তার স্ত্রী ক্রমাগত আহাজারি করেই যাবে। আধমরা অবস্থায় নিজের মেয়েকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখবে পরিমল ও তার স্ত্রী।

পরেরদিন বরযাত্রীরা এসে নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া বাড়ি দেখে আশেপাশে জড় হওয়া গ্রামবাসীদের কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে তারা কেউ বলবে, ‘কি আর হবি? শালা তো নিজের পেটটাই চালাবার পারেনা। পেটের দায়ে বিক্রি করি দিছে নিজের বেটিক মিলিটারির কাছত।’ কেউ আবার বলবে, ‘বেটার কাছত তো মুই এলাও পাঁচশ টাকা পাও। টাকা শোধ করার মুরদ নাই আর বেটিক আইছে বিয়া দিবা।’ এসব কথা শোনে এবং মেয়ে না থাকায় বিয়েটা যে আর হচ্ছেনা বুঝতে পেরে হবু বেয়াইকে গালি দিয়ে তার গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেরত আসবে ছেলের বাপ আর বহু সাধনার পর একটা প্রস্তাব পাকাপোক্ত হয়ে অবশেষে তাও ছুটে গেলে পরিমলের স্ত্রীর আহাজারি আরও বাড়তে থাকবে। বৃদ্ধ পরিমল আধবোজা চোখে অচেতন হয়ে শরীরের ব্যথার সাথে মনের ব্যথাটাও প্রচন্ডভাবে অনুভব করবে আর হিংসুক গ্রামবাসী নাক সিঁটিয়ে সেখান থেকে চলে যাবে। তখন মোখলেস ঘটক পান চিবোতে চিবোতে বিয়ে না হলেও নিজের পাওনাটা পাওয়ার আশায় বসে থেকে কয়েকঘন্টা পরেও বৃদ্ধের কোনো সাড়া না পেয়ে নিজের মনেই গজগজ করতে করতে বলবে, ‘পকেটত নাই টাকা আর শালা বুড়া বেটি বিহাবা আইছে।’ মনে মনে অভিশাপ দিতে দিতে মোখলেস ঘটক বিদায় নিলে, তার মেয়ের যাতে আর বিয়েই না হয় এমন প্রার্থনাই যেন সে করছে এমনটা মৃদু আঁচ করতে পারবে বৃদ্ধ পরিমল। কিন্তু মেয়ে থাকলেই না বিয়ে হবে! পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে থাকবে হয়তো, অথবা দেশেরি কোথাও থাকতে পারে, ভাবতে থাকবে পরিমল। নিয়ে গেলে সেখানে ক্যাপ্টেন তাকে নিজের চাকরানী বানিয়ে ইচ্ছেমতো অত্যাচার করবে এবং তার বাবাভক্ত মেয়েটা কখনোই আর তার বুকে ফিরে আসবেনা ভেবে অনড় শরীরে শুয়ে থেকে আকাশপানে তাকিয়ে থাকলে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা করে তুলবে।

তবুও প্রত্যাশার কাছে হার মানবে সমস্ত আশঙ্কা, সন্দেহ কিংবা নিদারুণ সত্য। বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা ভগবানের কাছে নিত্যই প্রার্থনা করবে কালো সেই ফুটফুটে মেয়েটির জন্য। দাওয়ায় বসে জাঁতাকলে সুপোরি কাটতে কাটতে বৃদ্ধা প্রতি মিনিটে বাড়িতে ঢোকার খোলা রাস্তায় চোখ রাখবে মেয়ের আসার প্রত্যাশায়। সেই অমনোযোগীতায় সুপোরির জায়গায় নিজের বাম হাতের জ্যেষ্ঠ আঙুলটি দিয়ে দিলে ধারালো জাঁতাকল তার ক্ষয় হতে থাকা দুর্বল আঙুলের হাড় মট করে কেটে দুফাঁক করে দেবে আর সেই যন্ত্রণায় আকাশপাতাল কাঁপিয়ে তুলতে থাকবে। মূর্ছা যেতে থাকা স্ত্রীর দুফাক হয়ে যাওয়া আঙুল ময়লা ন্যাকড়া দিয়ে চেপে ধরবে বৃদ্ধ পরিমল। গ্রাম্য কবিরাজকে খবর দিলে সে আসতে চাইবেনা টাকা পরিশোধের আগে। উপায়ন্তর না দেখে দ্রুত দূর্বাঘাস ছিড়ে মুখে চিবিয়ে আর মাকড়সার জাল পানিতে ভিজিয়ে, একটু মুখের থুতু দিয়ে অর্ধেক আঙুলে শক্ত করে চেপে ধরবে পরিমল। ঘণ্টাখানেক পর রক্ত পড়া বন্ধ হলে শরীরের অর্ধেক রক্ত হারিয়ে ফেলা বৃদ্ধা নেতিয়ে পড়বে আর পরিমল দিকভ্রান্তের মতো এদিক-সেদিক পায়চারি করতে করতে কিছুই আর ভেবে বের করতে পারবেনা।

দুদিন পর অর্ধেক আঙুল হারানো বৃদ্ধা কিছুটা সুস্থ হলে মেয়ের চিন্তা আবার তাদের প্রত্যাশিত মনে জেগে উঠবে। এই বুঝি হঠাৎ ‘বাপজান’ বলে মেয়েটা এসে বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরবে! কিন্তু ঘরে বসে থাকলেই যে মেয়ের খোঁজ পাওয়া যাবেনা, বৃদ্ধা এমন ইঙ্গিত দিলে পরিমল মেয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়বে কিছু না খেয়েই। বাসায় ফেলে আসা অসুস্থ স্ত্রীর জন্য চিন্তা হলেও মেয়েকে খুজে পাওয়ার প্রবল ইচ্ছা সেই চিন্তাকে প্রশমিত করবে। একবার আবার ভাববে যে এদেশে না পেলে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে ক্যাপ্টেনের পায়ে পড়ে ভিক্ষে চেয়ে মেয়েকে নিয়ে আসবে। তারপর আবার পঁচিশ পার হওয়া তরুণ কালো মেয়েটির বিয়ের চেষ্টা করে যাবে। পথিমধ্যে হবু বেয়াইয়ের সাথে দেখা হলে দেখেইনি এমন ভাব করে পাশ কেটে যাওয়া ছাড়া কিছু করার থাকবেনা পরিমলের। গ্রামে-গঞ্জে, পাশের গ্রামে, তার পরের গ্রামে, তারও পরের গ্রামে, এমনকি শহরে এসেও, বিভিন্ন মানুষদের জিজ্ঞেস করেও তারা মেয়ের সন্ধান দিতে না পারলে হতাশায় ভেঙে পড়বে পরিমল। ব্যর্থতার কাছে পরাজিত হয়ে ফিরে আসতে থাকলে তিন গ্রাম পেরিয়ে নদীর কাছের বালুচরে এসে রাত হয়ে গেলে তখন আর বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করবেনা তার। শুকনো পাটকাঠির মতো রোগা পা দুটোও আর সাড়া না দিলে ঠান্ডা বালুর ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙলে একটা ভেসে আসা লাশ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। সেটা কার লাশ তা আবিষ্কার করার তাড়নায় উঠে গিয়ে লাশের খুব কাছাকাছি যেতেই বৃদ্ধের ছোট হৃদপিণ্ডে বড় অসহ্য একটা ধাক্কা লাগবে। লাশটা যে তার মেয়েরই বুঝতে পেরে স্বল্পভাষী পরিমল পুরোপুরি নির্বাক হয়ে পড়বে। রোদ ফুটতে থাকলে সেই রোদের উজ্জ্বল তীক্ষè ঝিলিক তার কালোরঙা মেয়ের চেহারাটা সোনালি আভায় রাঙিয়ে তুলবে।

নিজের হালকা, ভঙ্গুর পিঠটাকে সম্বল করে কয়েকদিন আগে মরে যাওয়া মেয়ের পঁচতে থাকা উৎকট দুর্গন্ধময় লাশটা বয়ে নিয়ে আসতে থাকলে গ্রামের লোকেরা দারুণ ঘৃণায় নাক ঢাকবে আর পরিমলের সাথে বিষয়টা ভালো হয়নি এমন মত প্রকাশ করে লোক দেখানো আফসোস করতে থাকবে। মরা লাশ দেখতে পুরো গ্রামবাসীর হিড়িক লেগে যাবে তাদের ছোট বাড়িতে আর শরীরের জায়গায় জায়গায় পঁচে সাদা হয়ে যাওয়া কালো মেয়েটির লাশ দেখে একেকজন বমিতে ভাসিয়ে ফেলবে সমস্ত উঠোন। বৃদ্ধা তার মেয়েকে দেখতে চাইবেনা এবং মেয়ের পুরনো একটা সাদা-কালো ছবি বুকে চেপে ধরে বিলাপ করতে থাকবে। সান্ত্বনা দেওয়ার মানুষের অভাব হবেনা। বিয়ে বাড়ি হলে যতগুলো না মানুষ আসতো আনন্দ করতে, তার চেয়েও বেশি মানুষ এসে ভিড় জমাবে সহানুভূতি দিতে। বৃদ্ধ পরিমল আর তার অর্ধাঙ্গিনী নীরব হয়ে তাদের সহানুভূতির পাত্র হতে থাকবে। ‘আহারে বেচারি’ আফসোস করে দেখতে আসবে তার হবু বেয়াইও। তবে হবু ও বেয়াই কোনোটাই আর সেদিনের পর থেকে বিশেষণ হিসেবে থাকবেনা। লাশটাকে দ্রুত পোড়ানো দরকার এবং সেই মুহূর্তে কাঠের টাকাটাও যোগানে অসমর্থ্য পরিমলকে করুণার পাত্র করে গ্রামবাসী টাকা দিয়ে তাকে সাহায্য করতে চাইলে সে না করে দেবে এবং তার একমাত্র মেয়ের সৎকার সে নিজেই করবে প্রতিজ্ঞা করে অর্থসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ঠিক তখনই একটা বুদ্ধি মাথায় এলে সেটা কানে কানে বৃদ্ধাকে বললে বৃদ্ধা একবাক্যেই বৃদ্ধের কথায় রাজি হবে। তাদের দুজনেরই মুখে এমন হাসির আভা দেখা দেবে যেন অতিসত্বর তারা একটি বন্দী শিকল থেকে মুক্ত হতে যাচ্ছে।

দেনমোহর বাকি রেখে বিয়ে দিতে চাওয়া মেয়েটির এমন দশায় তার দেনমোহরের বদলে সৎকারের কাঠের টাকা জোগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়া বৃদ্ধ পরিমলকে দেখে আফসোস হতে থাকবে কুদ্দুস বেপারীর। সেই অর্থটা সে নিজেই দিতে চাইলে বৃদ্ধ কড়া না-বোধক ইঙ্গিত জুড়ে দিয়ে বলবে অন্যের অর্থে সে তার মেয়ের সৎকার করবেনা। তার ভিটেবাড়িটা কিনে নিতে কুদ্দুস বেপারীকে বললে সে সেটা বন্ধক নিতে পারে, কিন্তু বিক্রি কেন? এমন প্রশ্ন করলে বৃদ্ধ জোর দিয়ে বলবে ভিটে না বিক্রি করে সে মেয়ের সৎকার করবেনা। ওদিকে লাশের পঁচা গন্ধ গ্রামের পুরো আকাশ-বাতাস ছেঁয়ে ফেললে গ্রামবাসীও কুদ্দুস বেপারীকে অনুরোধ করবে পরিমলের ভিটেটা কিনে নেয়ার জন্য। অবশেষে নগদ টাকা দিয়ে একঘরের সামনে ছোট উঠানসহ পুরো জায়গাটা কিনে নিলে পরিমল সেই টাকা দিয়ে শবদাহের আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। বহু কষ্টের পর, গ্রামবাসীদের নাক কুঁচকে থেকেও কিঞ্চিৎ সাহায্যের পর অবশেষে পরিমলের কালো মেয়েটার চিতা দাউদাউ করে জ্বলবে আর সেই প্রশান্তি নিয়ে বৃদ্ধ পরিমল ও তার স্ত্রী দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসবে।

জীবনে একটাই মাত্র আকাক্সক্ষা থাকার পরও সেটা না হওয়ায় হতাশ দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক গভীর রাতে পুরো গ্রামবাসীকে বিন্দুমাত্র বুঝতে না দিয়ে, তাদের ছোট চোখের হাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে মেয়ের লাশ খুজে পাওয়া সেই নদীর তীরে চলে যাবে। পরিমল একটু বড় হয়ে ওঠা খোঁচা-খোঁচা দাড়ি চুলকিয়ে জীবনে তার প্রাপ্তি ও ব্যর্থতা রোমন্থন করতে থাকবে আর বৃদ্ধা তার কেটে যাওয়া জ্যেষ্ঠ আঙুলটার দিকে তাকিয়ে মেয়ের কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়বে। কালো ফ্রেমের চশমা খুলে পরিমল বয়ে যাওয়া স্রোতধারায় ছুড়ে মারবে। চোখে গুমোট অন্ধকার দেখতে থাকলে ঝাপসা চোখে স্ত্রীর বাড়িয়ে দেয়া দুহাত রশির শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেলবে। তারপর নিজের চেষ্টায়, কিছুটা স্ত্রীর সহযোগিতায় নিজের দুহাতও হ্যান্ডকাপ পরা কয়েদির মতো শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেলবে। রাত তখন গভীর থেকে আরো গভীরতরো হতে থাকবে। আধভাঙা চাঁদের মলিন জোছনার আলো নদীর তীরে জেগে ওঠা চিকন বালুচরে এসে পড়লে আলোয় তা চিকচিক করতে থাকবে আর আবছা আলোয় সেই বালুচরে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা দেখতে পাবে তাদের আদরের কালোরঙা মেয়েটির প্রিয় মুখ। সে যেন তাদের ডাকছে, বহুদূর থেকে ভেসে আসা সেই ধ্বনি শুনতে পাবে দুজনে। একটু বাদেই একটা বড় স্রোত আসতে দেখলে দুজনই ঝাঁপিয়ে পড়বে তাতে। তারপর পানি খেতে খেতে, দম হারাতে হারাতে একসময় লক্ষ্মী মেয়েটির কাছে চলে যাবে। দেখা মিলবে তখন জীবনের পূর্ণতার; চিরতরে মুক্তির সাধ মিটবে। বাসা বাঁধবে তারা সুখে-দুখে, হাসি-কান্নায়, অনাবিল আনন্দধারায়।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত