পরিবর্তনের স্বর চেনাতেন আবুবর

শুক্রবার স্কুল বন্ধ। বারান্দায় বসে খবরের কাগজ দেখতে দেখতে চা খাচ্ছিলেন আবুবর সাহেব।চায়ে চুমুক দিয়ে উঠানের পাশেই আমগাছের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন,  নিজের হাতে লাগানো গাছটায় মুকুল ধরে ম-ম করছে। তারই ওপরে বেঁধেছে মাকড়সার বাসা।
আবুবর সাহেব কাছে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন, কান পেতে শুনলেন, ফিসফাস করে আমের মুকুলে মাকড়সারা আলাপ করছে নিজেদের ভেতর।
মাকড়সার ভাষা বোঝার ক্ষমতা তাঁর নাই, তবু বেশ মজা করে দেখতে থাকলেন তিনি। স্ত্রী বড় মাকড়সাটি আটটি পা জোড়ায় জোড়ায় রাখল,এতে মনে হলো চারটি পা। আর তার পায়ের লোম একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। আর সেখানে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে জ্বলজ্বল করে উঠল। ফলে উজ্জ্বল রঙের পায়ের লোমকে ফুল মনে করে মৌমাছি একটা ছুটে এলো আর আটকা পড়ল।খাদ্য শিকারের চমৎকার কৌশল এটা। কিন্তু এটা পোর্শিয়া মাকড়সা না। পোর্শিয়া হলে হেডস্যার হতো। মনে মনেই হেসে ফেললেন তিনি। হেডস্যারকে তিনি ছোটো বড়ো যাই হোক একটা পোর্শিয়া মাকড়সা মনে করেন।

হাতে চা নিয়ে বিলকিস বেগম এলেন।
– কী ব্যাপার, খুব খুশি মনে হচ্ছে! কী দেখছ মনোযোগ দিয়ে?
– না, কিছু না। আমের মুকুল দেখছি।
– হুম, মুকুল তো অনেক ধরে, আম তো সেভাবে ধরে না।
– হ্যাঁ, কৃষিবিদের সাথে আলাপ করব ভাবছি।
মাকড়সারা তাদের কথার শব্দ পেয়ে সরে গেল। আবুবর সাহেব স্ত্রীর সাথে গল্প করলেন কিছুক্ষণ। এরপর তিনি বালতি ভরে পানি এনে গাছে গাছে সেচ দিতে থাকলেন।

দুজন ছাত্র এলো এ সময়। তাদের দিকে না তাকিয়েই আবুবর সাহেব জানতে চাইলেন, কে বাবারা?
– স্যার, আমি আনিস, সাথে মিন্টু আর ফজলু।
– ও, তোমরা? ক্লাস নাইন। ফার্স্ট বয়। ল্যাবে প্র্যাকটিস করবে?
– জি স্যার। আরো কয়েকজন আসবে।
– আচ্ছা যাও, ল্যাব খুলে দিচ্ছি।

স্কুলের ল্যাবরেটরি বন্ধ হলে বাড়িতেই নিজস্ব একটা ল্যাবরেটরি বানিয়েছেন আবুবর সাহেব। কারণ কিছুদিন ধরেই স্কুল ল্যাব থেকে সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছিল আপনা থেকে। দপ্তরি আর প্রধান শিক্ষককে বলেও প্রতিকার মেলেনি। এমনিতেই ছোট হয়ে গিয়েছিল ঘরটা। পাশেই নামাজ পড়ার ঘর করা হয়েছে। পেশাবখানা তার পাশে লাগা। প্রধান শিক্ষক বলেছেন, উত্তরের দিকে বড় করে একটা ল্যাব তৈরি করা হবে ভবিষ্যতে। আবুবর সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন, এই ল্যাব আর হবে না। তাই তিনি বাড়িতেই একটা ল্যাব তৈরি করেছেন। এমনকি ছোট শালি তনুকেও টিসি দিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন শ্বশুরবাড়ির এলাকায়।

ল্যাব খুলে দেবেন, কিন্তু আবুবর সাহেব ল্যাবের চাবি খুঁজে পাচ্ছেন না। চাবিটা শোয়ার ঘরের আলমারিতেই ছিল। সাধারণত তিনি খুব সতর্কতার সাথে লেবেলে নাম লিখে লিখে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখেন। আজকে না পাওয়ার কারণ, ল্যাবের চাবি বিলকিস বেগমের হাতে। গতকাল তিনি লুকিয়ে রেখেছেন। রেখেছেন এই কারণে যে, মানুষটা কী সব কেমিক্যাল আর ল্যাবের যন্ত্রপাতি কিনতে কিনতে সংসারটা ফতুর করে দিচ্ছেন। আজকে তিনি চাবি নিতে এলে সরাসরি বললেন, টাকা এনেছে ওরা? আগে জিজ্ঞাস করেন টাকা এনেছে কি না। টাকা না দিলে আজ ল্যাবে ঢুকতে দিবেন না।
– ছি ছি বিলকিস বেগম, কী কথা বলছ? তারা টাকা আনবে কেন?
– এই যে জিনিসপাতি কিনছেন, টাকা আসমান থেকে আসছে? কাঁটাকম্পাস থেকে দুরবিন, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি না কী সব, কোথা থেকে আসে টাকা? ওদের কাছ থেকে নিতে পারেন না?
– আরে ওরা বিজ্ঞান চর্চা করবে, এর জন্য টাকা নেব?এমনিতেই বিজ্ঞানবিমুখ হইছে ছেলেরা।
– পাগল হইছেন? কে কোন বিমুখ হইছে তা তো আপনার দেখার দরকার নাই! কোন দুনিয়ায় বাস করেন? ওদের টাকা দিয়াই দেখেন সব মাস্টার বাড়ি-গাড়ি করেছে। আর আপনি বাপের জমি বেচে ওদের মানুষ করে ফকির হন।
– বিলকিস বেগম! বড় বড় চোখ করে আবুবর সাহেব বললেন।
চোখ লাল হয়ে উঠছে তাঁর। অপমান তিনি সহ্য করতে পারেন না, বিশেষ করে ছাত্রের সামনে। এতে শরীরের বিকৃতি ঘটা শুরু করে। এমন বড় বড় লাল চোখ বিলকিস বেগম ভয় করেন। তিনি চাবিটা বের করে দিতে দিতে বললেন, খালি সম্মানবোধটাই আছে।
– চুপ করবে বিলকিস বেগম!
বিলকিস বেগম চুপ হয়ে রান্নাঘরে গেলেন। সেখানেই গজগজ করতে থাকলেন, সব মাস্টারই বাড়িতে গোয়ালঘর বানিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ায়, বাড়ি-গাড়ি করে, আর উনি এক পয়সাও নিবেন না। হাতেম তাঈ হইছেন। বিজ্ঞান শিক্ষক হয়া কামাই করতে পারেন নাÑএইটা কেমন কথা? বিলকিস বেগম দেখলেন, আবুবর সাহেব ল্যাবের দরজা খুলে দিয়ে বাথরুমে গেছেন। এই সুযোগে তিনি ল্যাবের দরজায় দাঁড়িয়ে ছাত্রদের বললেন,
– এই ছেলেরা, টাকা না দিলে তোরা এখানে আসবি না। ল্যাবের জিনিসপাতির খরচ আছে না? এসব কোথা থেকে আসে বুঝিস না তোরা? আমাকে তোরা টাকা দিবি এর পর থেকে। ঠিক আছে?
– ঠিক আছে ম্যাম।
– স্যার যেন না জানে। না হলে কইলাম আর ঢুকতে দিব না।
– ঠিক আছে ম্যাম।
কথাটা বলে দ্রুত সরে পড়লেন বিলকিস বেগম। তিনি বুঝতে পেরেছেন, সংসারটা ধরে রাখতে এই জেদি মানুষটার সাথে কৌশলে চলতে হবে। অথচ জেদ তোলা যাবে না। বিব্রত বোধ করেন এমন কাজও করা যাবে না। সম্মানবোধে লাগে তাঁর। শিক্ষক মানুষ তো, আছে শুধু এইটাই। সম্মানবোধ। কেউ দিক না দিক, নিজে নিজে ভাবেন সমাজের সম্মানিত তিনি। সেই অহংবোধে বকবক করেন। নিজেকে পণ্ডিত পণ্ডিত ভাবেন। যেন তাঁর জ্ঞানের তলে মাথা নত করে কুর্নিশ করেন। আর ভাবেন সবাই তাঁকে ‘জি স্যার জি স্যার’ বলবে। এমন না হলে শরীর বিকৃত হওয়া শুরু করে। আজব মানুষ। সেই মানুষটা যেভাবে সুখী থাকে সেভাবেই চলতে হবে বুদ্ধি করে। টাকার হালটাও ধরতে হবে, আবার তাঁর ছাত্রদেরও ভাগানো যাবে না।
তবে মানুষটা ইদানীং ছাত্র-ছাত্রীদেরই বেশি সময় দিচ্ছেন। এ কারণে বিলকিস বেগম বিরক্ত বোধ করলেও মেনে নিয়েছেন। ওদের নিয়েই মানুষটা আলাদা জগৎ বানিয়ে ফেলে মজায় থাকেন, আনন্দে থাকেন। এ কারণে তিনি ঘাঁটান না এটা মেনে নিয়ে যে, মানুষ তো সুস্থ থাকার জন্য অনেক কিছুই করে, উনার ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে মহৎ চিকিৎসা।
বিলকিস বেগম রান্নাঘরে সরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই উঁকি মেরে দেখলেন ছাত্ররা পেটের কথা বলে দিয়ে গোলমাল বাধাচ্ছে কি না। দেখলেন, আবুবর সাহেব ফিরে এসে ছাত্রদের নিয়ে গবেষণায় মগ্ন হয়ে আছেন। খুব মনোযোগী হয়ে দেখছে ছেলেরা।

আলোময় করে সাজানো হয়েছে আবুবর সাহেবের ল্যাবটা। আকাশ থেকে আলো ফেলা হয়েছে তিন নম্বর তাকে। সেন্টারে বসানো তাকটা পুরোটাই আয়নায় গড়া। সেই আয়নায় আকাশের আলো প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে গেছে ঘরময়। ফলে দিনের বেলা পিঁপড়েদের আনাগোনা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা যায়। সেই আলোর ভেতরে আবুবর সাহেব চারপাশে আট-দশজন ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে মন ভরে বিজ্ঞানের পাঠ দিচ্ছেন।
বিজ্ঞানী বানাতে চান তিনি ওদের। অন্তত বিজ্ঞানের ছোঁয়া দিতে চান। নিরেট পাথরে বিজ্ঞানের টোকা লাগলে যে ফুল ফুটতে পারে এমন তাত্ত্বিক কথাও তিনি বলেন। বলেন যে, প্রতিটি বস্তুর একটা নিজস্ব ভাষা আছে, বুঝছ বাবারা। নিজস্ব স্বর। লোহার স্বর আর সোনার স্বর যেমন এক নয়, তোমাদেরও কিন্তু আলাদা স্বর আছে। বস্তুর সাথে তোমাদের মনের স্বর একবার টায় টায় ধরতে পারলে দেখবে ফুল ফুটছে। যেমন নিউটন আপেলের স্বর ধরতে পেরেছিলেন, ফুল ফুটিয়ে দিয়েছেন। তিনি তো মনে করতে পারতেন, আহা, কী চমৎকার সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ হয়ে আপেল এসেছে! খুব মজা করে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে পারতেন। সেটা তিনি করেন নাই। আপেলের কান্না তিনি শুনতে পেরেছিলেন, নিচে পড়ছি কেন, বাঁচাও। তিনি আপেলটা হাতে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। আপেল আবার জিজ্ঞেস করল, নিচে পড়ছি কেন হ্যাঁ? তিনি চিন্তায় ডুবে গেলেন। এই হলো বিজ্ঞান। বস্তুর কথা বুঝতে পারা। বস্তুর স্বর তোমার চিন্তার স্বরে প্রশ্ন তুলে তুলে গবেষণা চালানো। এ কারণে বস্তুকে ভালোভাবে চিনতে হবে। কী বলো বাবারা?
– জি স্যার।
– কিন্তু স্যার, ঘটনাটা? কার ইশারায় ঘটল?
– এইটাই হলো ম্যাজিক। আল্লাহ সেই ম্যাজিকটা খেলে দিয়েছেন। আমরা টাসকি মেরে দেখছি ম্যাজিকটা। কিন্তু বিজ্ঞান দেখবে ভেতরের ব্যাপারটা। যেটার কথা বস্তুর ভেতর দিয়ে সৃষ্টিকর্তা শোনাতে চান। যেমন দেখো ম্যাজিক যেভাবে ঘটে। বলেই তিনি এবার এসিড আর ক্ষারের লীলাখেলা দেখিয়ে লিটমাস পেপারের রং পরিবর্তনের স্বর চেনাতে শুরু করলেন।

————— ——————— —— —– ————–
শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ

৯. আবুবর- ঘোড়া পাছায় হাঁটছেন
৮.  আবুবর- কোনোকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত