মুহাম্মদ সা.বাস্তবতার আলোকবর্তিকা।
অন্ধকার জগত
১.চৌদিক ছেয়ে আছে অমাবস্যার নিকষ-কালো গাঢ় অন্ধকার। সময়ের বাঁকে বাঁকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে যাচ্ছে অন্ধকারের সেই আস্তর। নিশীথ রাত। চন্দ্রিমার রোশনাই ফুরিয়ে গেলো। নেই কৌমুদী। তারকারাজি আর ঝরাচ্ছে না তার মরীচি। আজ জোনাকিও নেই। নেই তার অস্ফুট ঝিলিক। আলোর কোনো প্রদীপ নেই, দ্যুতির কোনো পিদিম নেই। নেই কোনো বিদ্যুতের ঝলক, বিজলীর চমক।
শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। ঘুম নেই, নিদ্রা নেই। নীরন্তর, অষ্টপ্রহর লেগে আছে যুদ্ধ, লেগে আছে বিগ্রহ। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ছুটে গেলো। ভাই-বোন মা-পিতা ছুটে এলো। বাঁধলো যুদ্ধ। শুরু হলো সংহার-সংঘাত, মারামারি-হাতাহাতি। বয়ে উঠলো বিষাদ-বিথার জলো হাওয়া। চমকে উঠলো অশান্তির কিরণমালা। অমাত্যদের দৌরাত্ম্যে ভুগছে আপামর-জনতা। বড়দের কাছে মানুষ হারাচ্ছে বাকস্বাধীনতা। নেই মানবতা, নেই কোনো হৃদ্যতা।
চন্দ্রক-সুরুজ বাকি নেই, ইট-পাথর বাকি নেই। গাছপালা, তৃণলতা কিচ্ছু বাকি নেই। মানুষ এ-সবের শুরু করলো আরাধনা, পূজা-অর্চনা। দিকিদিকি চলছে পৌত্তলিকতার কুপ্রচার, মূর্তিপূজার জয়জয়কার। লাত-উজ্জা-হুবল-মানাতের জয়গান ভাসছে ইথার-পাথারে। তিন শতাধিক1 পাথুরে-মূর্তির জয়শান উড়ছে এখানে-ওখানে সবখানে। ছোট ছোট মূর্তি বানিয়ে মানুষ রেখে দিলো নিজ নিভৃত-কক্ষে, সেঁটে দিলো দেয়াল-প্রাকারে। এগুলোকে ডাকে তাদের বিপদ-কালে, মসিবতে পড়লে।
আলোর আভাস
২.কালের এক সৌভগ-কন্দরে, এক গৌরবোজ্জ্বল সময়-ক্ষণে। ওহাব-তনয়া আমেনা2 আর মুত্তালিব-পুত্র আব্দুল্লাহ। নব-জীবনের স্বপ্ন দেখলো। যুগল-জীবনের জাল বুনলো। দাম্পত্য জীবনে পদার্পণ করলো। উদ্বাহ-বন্ধনে মিলিত হলো। কিয়ৎ কাল পর। আমেনা অন্তঃসত্ত্বা। সন্তান-সম্ভবা। খোদায়ী কারিশমা। আমেনার নেই কোনো জঠর-যাতনা, নেই উদর-বেদনা। অমনিতে হয়ে গেলো3 এক আদুরে খোকা।
সংবাদ শুনে দৌড়ে এলো আব্দুল মুত্তলিব। সযত্নে ক্রোড়ে তুলে নিলো সদ্য-শিশুকে। অমায়িক চাহনিতে চেয়ে দেখলো আপনা পৌত্রকে। তার বিধুমুখের মৃদু হাসি দেখে দাদা হতচকিয়ে উঠলো। তার আগমনে আনন্দে বুক ভরে উঠলো। মন খুশি হলো, দিল খুশি হলো। পুলকিত হলো, রোমাঞ্চিত হলো। মুহাম্মাদ4 করে দাদা তার নাম রাখলো।
উৎসবমুখর সৃষ্টি
৩.মুহাম্মাদের আগমনে আজ চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ ঝলমল করছে, গগনে গগনে ফেরেশ্তারা ছুটাছুটি করছে, তোরণে তোরণে বাঁশি বাজছে, নীহারিকা-লোকে, তারায় তারায়, অণু-পরমাণুতে কাঁপন ধরছে। কুল-মাখলুক আজ উচ্ছ্বসিত, উল্লসিত, বিস্মিত, শিহরিত। জলে-স্থলে, লতায়-পাতায়, তৃণে-গুল্মে, ফুলে-ফলে আজ অভূতপূর্ব জানাজানি, কানাকানি। বলছে–’খুশ আমদেদ ইয়া রাসূলাল্লাহ’।5
বঞ্চিত মাতৃছায়া
৪.আমেনা আর ছুয়াইবা বুক খুলে দিলো। হালিমা দূর-দিগন্ত থেকে পড়িমরি হাজির হলো। শিশু মুহাম্মদকে দুগ্ধ-পান করালো6। মুহাম্মদ এখন বড় হলো। শিশুত্বের আবরণ খুলতে গেলো। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস। মা আমেনা বিদায় নিলো7। মুহাম্মদ চির-এতিম হলো। ফের গেলো দাদার ছত্রছায়ায়। তবে এ-ছায়াও বেশিকাল টিকেনি। স্থায়ী হয়নি। ফানুসের মতন উড়ে গেলো। মুহাম্মদ একলা-অনাথ রয়ে গেলো।
নিঃসঙ্গতার সাথী
৫.অনন্তর আবু তালিবের নীড়ে পাড়ি জমালো নিঃস্ব মুহাম্মদ। চাচার বানিজ্য-বিহারে সিরিয়া গেলো। বুহাইরার আগাম বাণীতে স্তম্ভিত হলো8। আরো বোদ্ধা হলো, সমঝদার হলো। ফিজার যুদ্ধে এগিয়ে এলো। সমাজ-ব্যবস্থা তীক্ষ্ণ-নজরে অবলোকন করলো। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বৈরাচারের আভাস খোঁজে পেলো। মাজলুমের পাশে দাড়ালো। নির্যাতন-নিধনের নিমিত্তে হিলফুল ফুজুলে যোগ দিলো9।
পঁচিশে পদ মাড়ালো মুহম্মদ। তখন যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ে তার যশ-খ্যাতি, নাম-স্তুতি। তার মন্ত্র-মুগ্ধ টানে মোহিত হলো সতী-সাধ্যি খাদিজা। শয়নে-স্বপনে কাছে পাওয়ার উদগ্র-স্পৃহা জন্মিলো খাদিজার হৃদয়-অন্তপুরে। খদিজা প্রস্তাব পাঠালো মুহম্মদের সমীপে। মুহম্মদ রাজি হলো খুশি-মনে, স্ফূর্ত-দিলে। আবু তালিব এলো। আপন মনে খুতবা পড়লো। পূর্ণ কাজ বিহিত করলো। মুহাম্মদ আর খাদিজা বিবাহ-পরিণয়ে মিলিত হলো10।
সমাজ সংস্কার
৬.জীবন-পরিধি বাড়তে লাগলো। বয়স পঁয়ত্রিশে গিয়ে ঠেকলো। সটান মূক-মৌন দন্ডায়মান পবিত্র কা’বা জীর্ণ-শীর্ণকায়ে রূপ নিলো। সংস্কারের প্রয়োজন বোধ হলো। সবাই এগিয়ে এলো। কৃষ্ণ-প্রস্তর স্থাপন-কালে দ্বিমত দেখা গেলো। মুহম্মদ এর পরিপক্ব সমাধান দিলো। আরব খুশি হলো। কোরেশ আনন্দিত হলো। সবাই অকপটে মুহম্মদকে ‘আল-আমীন’ বলে স্বীকৃতি দিলো11।
ঐশী বাণীর অপেক্ষা
৭.বয়স চল্লিশে পাড়লো। খোদার নৈকট্য লাভে মুহাম্মাদ উন্মাদ হয়ে উঠলো। নিজন, একলা ও মুক্ত-মনে হেরাগুহায় আনাগোণা শুরু করলো। একদিন গেলো, দু’দিন গেলো। বহু দিন পর আল্লাহর ইচ্ছে হলো। শাশ্বত সত্যের ঐশী-বাণীর প্রত্যাদেশ হলো। খোদায়ী-ওহীর গোড়াপত্তন হলো। ‘ইকরা’ ধ্বনি বেজে উঠলো। মুহাম্মদ আজ নবী হলো12। সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম।
আড়ালে-আবড়ালে উম্মী নবী দিতে লাগলেন দীনের দাওয়াত, শুরু করলেন ইসলামের প্রচার। খাদিজা এলেন। আবু বকর এলেন। জায়েদ-আলী-উছমান ছুটে এলেন। হাতে হাত রাখলেন। ইসলামের শান্ত-হীম-শীতল সরোবর-নীরে অবগাহন করলেন। কালিমা তাইয়িবা মুখে আওড়ালেন। স্বতঃস্ফূর্তে দীন কবুল করলেন। রাদিয়াল্লাহু আনহুম।
প্রকাশ্য আহ্বান
৯.”এবার প্রকাশ্য সভায় সত্যের উদাত্ত আহ্বানের সময় এসে গেলো। মুহাম্মদ সাঃ ছাফা পর্বতের পাদদেশে ডাক দিলেন। কোরেশদের সকল শাখার চল্লিশজন নির্বাচিত লোকের সমাবেশে অত্যন্ত আবেগ ও দরদপূর্ণ ভাষায় ঈমানের দাওয়াত দিলেন। মূর্তিপূজা ত্যাগ করে তাওহিদ ও রিসালাতে বিশ্বাস করার আবেদন জানালেন”।
এতে কোরেশ কুপিত হলো, খড্গহস্ত হলো। আবু তালিবকে বললো– “আপনার ভাতিজা নবুয়তের দাবীদার হয়েছে এবং পূর্বপুরুষের ধর্ম ও উপাস্যের নিন্দা শুরু করেছে। এমনকি আমাদের বুদ্ধি ও প্রজ্ঞাকে উপহাস করেছে। এ স্পর্ধা অসহ্য। আপনার খাতিরে এতদিন সহ্য করেছি। কিন্তু আর নয়। তাকে নিরস্ত করুন, অন্যথায় আমরা এমন ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো যা আপনার জন্য হবে অপ্রীতিকর”13।
বীরত্বের রুপরেখা
১০.নবীজি বীর-বিক্রমে এগিয়ে যান। সাহাবারা সঙ্গে থাকেন। কিন্তু জুলুমের আড়ৎ মুহুর্মুহ শাখা ব্যাদান করতে লাগলো। আম্মার-ইয়াসির-সুমাইয়া বাদ গেলেন না। বিলাল-উছমান-খাব্বাবের রক্ষা হলো না। তখন অবস্থা বুঝে দয়ালু নবী প্রাণোৎসর্গী সাহাবা কিরামকে ইথিওপিয়ায় প্রস্থান করতে হুকুম দেন। সাহাবারা তাই করেন। দলে-উপদলে ও বিভিন্ন দলে সেখানে গমন করেন।
একশ’ একজনের নববী কাফেলাটি নজ্জাশী আসমাহার উদার-পরশে আশ্রয় নেন। কোরেশ নেতারা দৌড়ে যায়। আগত মুসলিম দলটি নিয়ে মিথ্যে প্রোপাগাণ্ডা চালায়। দুর্ধর্ষ জাফর অগ্রসর হন। চিত্তহারী ভাষায় বক্তব্য দেন। তার চিত্তাকর্ষী বক্তব্যে পূর্ব-দিগন্তের তেতিয়ে উঠা নবারুণের আলোকরশ্মি থেকেও বেশি উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠে ইসলামের সত্যতা ও বাস্তবতা, স্বকীয়তা ও অন্যায়-বিমুখতা14।
খোদায়ী মদদ
১২.কোরেশ থমকে যায়নি। রীতিমতো চলতে লাগলো জুলুম। আবু তালিবকে তারা বললো নবীজিকে সঁপিয়ে দিতে। এতে আবু তালিব রাজি হয়নি। ফলতঃ তারা বনি হাশিম আর মুত্তলিবকে বয়কট করলো। না পারত-পক্ষে নবীজি নিজ গোত্র নিয়ে আবু তালিব-গিরিতে বাস বানালেন। অভাব-অনটনে ও অনশনে তিনটি বছর গুজরে গেলো। বয়কট-নামায় চিড় ধরলো। খোদায়ী মদদ হলো। বয়কট মুলতবি ঘোষণা হলো15।
জীবন-চাকা বক্রে গেলো। সুখের নীলম আকাশে এক থোকা বিষাদ-ভরা মেঘ এসে গর্জে উঠলো। বিচ্ছেদের কালো ছায়া ঘিরে বসলো। শান্তনার হাতছানি আজ চির-খতম হলো। খাদিজার প্রাণপাখি উড়াল দিলো। আরও কিছুদিন গেলো। রবের হুকুম হলো। আবু তালিবও পরপারে পাড়ি জমালো16। নবীজি চিন্তিত হলেন, উদ্বিগ্ন হলেন। উৎকন্ঠার এই বছরে তিনি মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন।
তায়েফ সফর
১৪.নবীজি এ-চৈন্তিক ঘোর কেটে উঠলেন। নববী-মিশন চরিতার্থ করতে অনুকূল পরিবেশ ঢুঁডতে লাগলেন, উপযোগী একটি সমাজ খোঁজতে লাগলেন। তাই পালক-পুত্র জায়েদ সমেত তায়েফ গেলেন। বুক-ভর্তি আশা নিয়ে তায়েফ-বাসীকে দাওয়াত দিলেন। তাওহিদের কথা শুনালেন। কিন্তু তায়েফ বাসী অবাধ্যতা করলো। নবীজির পশ্চাতে দামাল-পুলাপানকে লেলিয়ে দিলো। কটূক্তি করলো। তীর্যক মন্তব্য করলো। কুরুচিপূর্ণ ও অযাচিত বাক্য ছুড়লো। এতে নবীজি বেশ বেগ পেলেন। মর্মাহত হলেন, ব্যথিত হলেন17।
মেরাজ গমন
১৫.এভাবে শনৈঃশনৈঃ নবুওয়তের এক যুগ কেটে গেলো। ঠিক তখনই আল্লাহ তাআলা নবীজিকে অলৌকিক এক নেয়ামত দিলেন। মসজিদে হারাম থেকে আকসা নিয়ে গেলেন। সেখানে নবী-রসূলের সমাবেশ হলো। নবীজি সকলের ইমামতি করলেন। সেখান থেকে বুরাক যুগে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় এভাবে সপ্ত আকাশ হয়ে সিদরাতুল মুনতাহা অবধি সশরীরে পৌঁছে যান। জিবরীল থমকে দাড়ান। নবীজি আগে বেড়ে আল্লাহর সামনে নত-শিরে ঝুঁকে পড়েন এবং খোদার তসবীহ করেন।
নবীজি ফিরতি-কালে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সওগাত পেলেন। নরক-স্বর্গ পরিভ্রমণ করলেন। ভোরে ভোরে সেখান হতে ফিরে এলেন। সাৎসকালে মিরাজের এ-তেলেসমাতি কাহিনী লোকমুখে চাউর হয়ে পড়ে। লোকজন চিত্তির, আক্কেলগুডুম! কি করে সম্ভব এটি! কিছু লোক হেঁসে উঠলো। কিছু লোক দম্ভ-ভরে অস্বীকার করলো। কিন্তু,,আবু বকর এসে এর সত্যায়ন করলেন। নবীজি খুশি হয়ে আবু বকরকে সিদ্দীক বলে ভূষিত করলেন18।
আশ্রয়ের আশ্বাস
১৬.নবুওয়তের দশম বছর। মক্কা আর নয়, ইসলাম প্রচারের লক্ষে নবীজি নতুন একটি জনপদের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। শত্রুভাবাপন্ন কোরেশদের অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ। অপরদিকে ইথিওপিয়া গমন-কারী সাহাবারা ফেরার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। সব মিলিয়ে নতুন একটি আবাস-ভুমির প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়। যেটা হবে ইসলামের আশ্রয়-কেন্দ্র। যেখানে থাকবেনা কোনো অরাজকতা, পরাধীনতা। যেখানে সাহাবারা খোঁজে পাবেন স্বকীয়তা, স্বাধীনতা।
মেলায় মেলায়, হাটে-বাটে সব জায়গায় ঘোরে বেড়ালেন। উকাজ মেলায়ও গেলেন। সুশোভিত তশতরিতে সাজিয়ে ইসলামকে উপস্থিত করলেন একে একে বহুজনের কাছে। কিন্তু কেউ সায় দেয়নি, আশ্রয় দেয়নি। পরে হজের মৌসুম যখন এলো। রাতগভীরে ছুটে গেলেন আগত লোক-জনের ধারে ধারে। পরিশেষে ইয়াছরিব থেকে আসা ছয়জন যুবকের সাথে আলাপ হয়। তাদের ললাট থেকে সতত ঠিকরে পড়ছিলো ঈমানী-মুক্তার উজ্জ্বল চমক। তারা নবীজির হাতে ঈমান আনেন। আশ্রয়ের আশ্বাস দেন।
সে ছয়জন ইয়াছরিব ফিরলেন। গোপনে দাওয়াত চালিয়ে গেলেন। আওস-খজরজে তৌহিদী বাণী ছড়িয়ে দিলেন। ঘরে ঘরে ইসলামী চারাগাছ রোপে দিয়ে অবস্থা অনুকূলে নিয়ে এলেন। তো পরবর্তী হজের মৌসুমে তারা বারো জন হয়ে নবীজির সন্নিধানে হাজির হলেন। খুটিনাটি আলাপ-আলোচনার পর তারা নবীজির হস্তযুগলে হাত রেখে বাইয়াত19 গ্রহণ করেন।
সহযোগীদের তিতিক্ষা
১৭.কুরআন ও ইসলামের প্রচার লক্ষে নবীজি মুসআব আর ইবনে উম্মে মাকতুমকে ইয়াছরিব পাঠান। তাদের ত্যাগ-তীতিক্ষা ও দাওয়াতের সুদূরপ্রসারী ফল হিশেবে ইয়াছরিবে বয়ে উঠে ইসলামের এক অভিনব তরঙ্গ-মালা। ফলতঃ হজের সময় এলে তিয়াত্তর জনের একটি দল যাত্রা করে। সবাই নবীজির সান্নিধ্যে এসে বাইয়াত20নেন এবং হিজরতের জন্য আগ্রহ পেশ করেন।
নবীজি আদেশ দিলেন হিজরত করতে, মাতৃভূমি ছাড়তে। সহজ-সরল মাটির মানুষগুলো আস্তে আস্তে পাথেয় জোগাড় করতে লাগলেন। নীরবে গোপনে অল্পে অল্পে আপন ভিটা ছাড়তে লাগলেন। সহস্র-স্মৃতি বিজড়িত বাস্তুভূমি ত্যাগ করতে লাগলেন। মহার্গ মুল্যবান স্থাবর-অস্থাবর সম্পদগুলো রেখে, মায়া-ভরা সুরম্য সুদৃশ্য ঘর-বাড়ি ছেড়ে রাত্র-দিনে একে একে যাত্রা শুরু করলেন ইয়াছরিব পথে।
নতুন ষড়যন্ত্র
১৮.সবাই চলে গেলেন। বাকি আছে হাতেগুনা কয়েক জন। অবস্থা-দ্রষ্টে কোরেশরা রীতিমতো ভিরমি খেয়ে উঠলো। নতুন করে ষড়যন্ত্র ফাঁদলো তারা। সবাই গেলো তো কি। মুহাম্মাদের কিন্তু রক্ষা নেই। তারা হত্যার সিদ্ধান্ত নিলো। পক্ষান্তরে নবীজি খোদায়ী হুকুমের প্রতীক্ষায় রইলেন। আবু বকর উদ্দিষ্ট সময়ের প্রহর গুনছেন।
আল্লাহর আদেশ হলো। নবীজিও কোরেশদের দুরভিসন্ধি ঠাওর করতে পেলেন। তাই নিশি-রাতে চলে গেলেন আবু বকরের বাস-ভবনে। তাকে বললেন হিজরতের কথা। আবু বকর আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। বাহনে চড়ে উভয়ে বেরিয়ে গেলেন। আলীকে নবীজি নিজ ঘরে চাদর মুড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে এলেন। যাতে কোরেশ নবীজির অনুপস্থিতি টের না পায়। তো নবীজি আবু বকর সহ চাওর গুহায় চলে গেলেন। আশ্রয় নেন টানা তিন দিন।
ব্যর্থ চেষ্টা
১৯.কোরেশ নবীজিকে আঁতিপাঁতি খোঁজলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো। চাওর গুহা থেকে নবীজি আবু বকর সমেত ইয়াছরিবের পথ ধরেন। গমন-কালে বহুত ঝাক্কা পোহাতে হয় আসোয়ার-দ্বয়কে। কিন্তু খোদার মদদের সামনে সবকিছুু হাওয়ায় লীন হয়ে যায়। ফের ইয়াছরিবের দুর্গম-গীরি বেয়ে, আঁকা-বাঁকা পাথুরে মেঠোপথ হয়ে এক-পা দু’পা করে নবীজি বাড়তে লাগলেন অভীষ্ট লক্ষ-পাণে।
ইয়াছরিবে আগমন
২০.ইয়াছরিবের অলিতে-গলিতে, পরতে-পরতে, প্রতিটি কন্দরে-কন্দরে, ঘরে ঘরে, অনুষ্ঠানে-প্রতিষ্ঠানে, সবখানে ছড়িয়ে পড়ে একটি সংবাদ, একটি খবর। যার জন্য ধ্বংসে পতনোম্মুখ জাতি অবাক চাহনিতে তাকিয়ে আছে। কুসংস্কৃতির গ্যাঁড়াকলে পতিত জাতি যার জন্য অপেক্ষা করছে। জাহিলীর কাল-গহ্বরে পড়ে থাকা জাতি যার জন্য প্রতীক্ষা করছে। আজ সে মানবটি ইয়াছরিব আসছে।
শিশু-কিশোর ছুটে এলো। যুবা’ বুড়া দৌড়ে এলো। লোক-জন বেরিয়ে এলো। নর-নারী যোগ দিলো। এক অবারিত মাঠে জমায়েত হলো, এক মুক্ত-তেপান্তরে একত্রিত হলো। তখনই এদের ওদের, এখান ওখান সর্বত্র শ্রুতিত হলো, শ্রূয়মাণ হলো সেরেফ একই গান, একিই ঐকতান। তালাআল বদরু আলাইনার মন্ত্রমুগ্ধ আযান।
নবীজি ইয়াছরিব এসে গেলেন।,,তাঁর আগমনে আজ ইয়াছরিবের আকাশ-বাতাস নেচে উঠলো, আসমান-জমিন কেঁপে উঠলো। তাঁর পদ-শব্দে সরেজমিন হেঁসে উঠলো, তাঁর কদম-তলে বালি-কণা খুনসুটিতে মেতে উঠলো। তাঁর গমন-সংবাদ দিশিদিশি ধ্বনিত হলো। তাঁর স্বাগত-বাণী দিকিদিকি ঝংকৃত হলো। ইয়াছরিব ধন্য হলো। শহরটি আলোকিত হলো। তাঁর আগমনে ইয়াছরিব মদিনা মুনওয়ারায় পর্যবসিত হলো21।
নতুন জীবনযাত্রা
২১.মদিনায় নবীজি নতুন জীবন শুরু করেন। মদিনাকে ইসলামের জন্য উপযোগী করে তুলেন। সমাজ-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। যদ্দরুন সামান্য সময়ে ইসলামের ব্যাপক উন্নতি হয়। মদিনা ইসলামের একটি যুৎসই রাষ্ট্রে উপনীত হয়। নবীজি মসজিদে নববীতে দীনের তালীম দেন। আনচার-মুহাজির তাঁর সংস্রবে ঈমান-দীপ্ত ও দৃপ্ত হয়ে উঠেন। সব মিলিয়ে মদিনায় শক্তিশালী একটি ইসলামী দলের উন্মেষ হয়।
নবীজি যুগপৎ মদিনার ঘাটিকে সুদৃঢ় করেন এবং পার্শ্বস্থ ইহুদিদের সাথে শান্তি চুক্তি করেন। মাথা চাড়া দিয়ে উঠা ইসলাম বিদ্বেষী মুনাফিকদের সাথে সুনিপুণ ভাবে মনস্তাত্ত্বিক মুকাবিলা করেন। পরে ইহুদিরা চুক্তি ভঙ্গ করলে নবীজি এর কার্যকরী ব্যবস্থা নেন। প্রতিরক্ষার আড়ৎকে মজবুত করেন। মদিনার সামরিক শক্তিকে আরও জোরালো করেন। রসদ সামগ্রীর সুব্যবস্থা করেন। যাতে অন্ন-দৈন্যে ক্ষুৎপিপাসায় কাউকে মরতে না হয়।
এভাবে হিজরতের প্রথম বছর কেটে দ্বিতীয় বছরের আগমন হলো। তড়াক সংবাদ এলো–আবু সুফিয়ান বানিজ্য-কাফেলা নিয়ে মদিনার পাশ ঘেঁষে যাচ্ছে। নবীজি সাহাবাদের নিয়ে পরামর্শ করেন। যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। তড়িৎ তিনশ’ তেরো জন প্রাণোৎসর্গী অকুথোভয় দুর্ধর্ষ বীর-বিক্রমীকে নিয়ে নবীজি বেরেয়ি পড়েন। ফের ঐতিহাসি বদর22 প্রাঙ্গণে ড়েরা গাঁড়েন। যুযুৎসু সাহাবাদেরকে রণাঙ্গনে সাজিয়ে দিয়ে আল্লাহর দরবারে নিবিষ্ট-চিত্তে কায়মনোবাক্যে দেহ-মন উজাড় করে বিজয় প্রার্থনা করেন।
বদর প্রান্তর
২২ .ত্রিগুণ বেশি সৈন্য-সমেত ছুটলো নরাধম আবু জাহল। সাথে আছে ঢের রসদ ও অন্ন সামগ্রী। আজ সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্য হতে যাচ্ছে। হক বাতিলের মধ্যে পরখ হতে যাচ্ছে। আজকের এই লড়াই মুক্তির লড়াই। এই সংঘাত মুক্তির সংঘাত। শুরু হলো যুদ্ধ23। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। খোদায়ী নুসরত এলো। ফেরিস্তাদের শাণিত অসির উৎকট ঝংকারে ময়দান কেঁপে উঠলো। মু’মিনদের পাল্লা ভারী হয়ে উঠলো।
সত্তর জন কোরেশী নরকে গেলো। আবু জাহলের বেঢপ কবন্ধটি আজ নিঃস্ব পড়ে রইলো। চৌদ্দ জন সাহাবা আজ হরিৎ-কেচরে রূপ নিলেন। স্বর্গীয় বৃক্ষ-শাখীতে উড়া-উড়ি করতে লাগলেন। নবীজি খোদার শুকর আদায়ে তন্ময় হয়ে উঠেন। মুমিনরা ইসলামের এ-অভূতপুর্ব বিজয় দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে উঠেন। এই যুদ্ধে মুসলিমরা প্রভূত সম্পদ লাভ করে এবং কাফিরদের মুখাবয়বে পরাজয়ের চুনকালি লাগিয়ে দেয়24।
কোরেশ পরাজয়ের গ্লানি আদৌ সহ্য করতে পারেনি। ক্লীবত্বের পরিচয় দিতে মোটেও প্রস্তুত নয় তারা। ধূমকেতুর ন্যায় ঝলসে উঠলো প্রতিশোধের উষ্ণ-আগুন। তাই তিন হাজার শৌর্যশালী রণনিপুন যুদ্ধবাজকে নিয়ে উহুদ-পাণে ছুটলো কোরেশ-পতিরা। খবর পেয়ে নবীজি সাতশ’ সাহাবার একটি আত্মরক্ষা-মূলক দল গঠন করে সামনে অগ্রসর হন25।
যুদ্ধ শুরু হলো। ঈমানী বলে বলীয়ান হয়ে সাহাবারা লড়তে লাগলেন। ‘আল্লাহু আকবর’ নারা ধ্বনিতে সাহাবারা শত্রু ব্যূহে ঝাঁপিয়ে পড়েন। খানিকের মধ্যে বিজয় মুসলিমদের পদ-চুম্বন করে। কাফিররা লেজগুড়িয়ে পালায়। সাহাবারা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ কুড়িয়ে নিতে মগ্ন হয়ে পড়েন। বদরের মতন উহুদেও বিজয়ী-কেতন মুসলিম-শিবিরে পতপত করে উড়ে।
ঘুরে দাঁড়ানো
২৩.কিন্তু আল্লাহর লীলা-খেলা। পাহাড়ের পাদদেশে ওত পেতে থাকা কাফির দল পুনরায় ফিরে এসে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মুসলিমদের উপর চড়ে বসে। চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে মুসলিম বাহিনীকে। হামযা-মুসআব শহীদ হন। আরও সত্তর জন পান করেন শাহাদাতের অমিয় শিরিন সুধা। নবীজি আহত হন। ক্ষত-বিক্ষত হয় তাঁর পবিত্র দেহ। চালনির মতন ঝাঁজরা হয়ে পড়ে তাঁর শরীর মুবারক। বিবর্ন হয়ে উঠে তাঁর চিকনাই মুখটি26।
নবীজি ঘুরে দাঁড়ান। কোরেশদের পশ্চাদ্ধাবনের মানসে আহত সাহাবাদের উৎসাহ দেন। নবীজির আবেগ-উদ্বেলিত ব্যথাতুর সম্ভাষণে ঈমানী জোয়ারে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন পট্টি-ব্যান্ডেজাবৃত সাহাবারা। নবীজি তাদের ধাওয়া করার অভিলাষে হামরাউল আসাদ গিয়ে থামেন। তিন দিন পর যখন তারা ডর-ভয়ে পালিয়ে যায় তখন নবীজি মদিনার পথ ধরেন। তাদের বুঝিয়ে দিলেন–মুমিনরা কিছুতেই থমকে দাঁড়ায় না, ক্ষণিকের পরাজয়ে মুষড়ে পড়ে না27।
রথ-চক্রের ন্যায় ঘুরে ঘুরে এসে গেলো হিজরতের পঞ্চম বছর। ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের দরুন নবীজি ইহুদিদের দু’টি গোত্র বনি কায়নুকা ও নাজিরকে দেশান্তর করে দেন। ফলে এই ইহুদিগুলো মক্কার কাফিরদের সাথে মিলিত হয়ে দশ হাজারে উপনীত হয়। সাথে যোগ দেয় মদিনার দু’মুখো সর্পগুলো। মদিনা পথে রওনা হবে তারা। এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। মুসলিমরা এতে বিষন্ন হয়ে পড়েন।
খন্দক
২৬.কিন্তু সালমান ফারসী পরিখা খননের পরামর্শ দেন। নবীজি সম্মতি জ্ঞাপন করেন। সাহাবারা তাই করেন। প্রাণান্ত চেষ্টার পর খুঁড়ে পেলেন এক বৃহদাকার পরিখা। কোরেশরা এহেন পরিখার সাথে কিছুতেই পরিচিত ছিলো না। তাই তারা যুদ্ধের হাবভাব নিয়ে এলেও সক্ষম হয়নি। পনেরো দিন অবরোধের পর অকৃতার্থ ফিরে যায়। মুসলিমরা পরোক্ষ ভাবে জয়ী হন।28
হুদাইবিয়া
২৬.একদা নবীজি স্বপ্ন দেখেন মক্কা প্রবেশ করতে, কালো কা’বার তাওয়াফ করতে। প্রত্যুষে সাহাবারা জানতে পারেন এ স্বপ্ন। নিজ দেশ ত্যাগ করেছেন ছয়টি বছর হয়ে গেলো। আত্মীয়দের দেখা নেই, মা বাবার সাক্ষাৎ নেই। কি আত্মত্যাগ! কি বিসর্জন! হঠাৎ ইত্যাকার স্বপ্ন দেখে বুক ছটফট করে উঠবে না এমন কেউ কি আছে! দেশ-প্রেম আর গোত্র-প্রীতি নেই এমন কোনো মানব কি আছে!
নবীজি ঘোষনা দিলেন। প্রত্যেকে আপন মনে প্রস্তুতি নিলেন। ইহরাম বেঁধে বেরিয়ে পড়লেন পনেরোশ’ শ্বেত-শুভ্র পোশাকধারী বীর সেনানী। যুদ্ধের জন্য নয়; উমরা করতে যাচ্ছেন তারা, তারা কৃষ্ণ-কা’বার প্রদক্ষিণ করতে যাচ্ছেন। হুদায়বিয়ায় পৌঁছলে কোরেশ বাগড়া দেয়। কি কষ্ট! কি যাতনা! পরে কোরেশ সন্ধি করে। পরবর্তী বছর উমরা করার চুক্তি করে। এ সন্ধি বা চুক্তির মাঝ দিয়ে ইসলামের সাধিত হয় এক অদৃশ্য বিজয়, মহা-বিজয়29।
বিজয়ের মালা
২৭.এভাবে সপ্ত হিজরী এসে গেলো। খায়বার যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয় হলো। ফাদাক জয় হলো। মুসলিমরা চুক্তি মতে মক্কায় এলো। উমরা করে তিন দিন পর প্রত্যাবর্তন করলো। আস্তে আস্তে অষ্টম হিজরী ঢুকে পড়লো। মুতা হলো। রোমান আর মুসলিমের মাঝে শক্তি পরীক্ষা হলো। দেড়লাখ কাফির বাহিনীকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে তিন হাজার সাহাবা বিজয়-মালা পরিধান করলো30।
কোরেশ-কাফিররা হুদায়বিয়ার চুক্তি ভঙ্গ করে। নবীজি খবর শুনে সাহাবাদের নিয়ে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহন করেন। প্রস্তুতি শেষে দশ হাজার সৈন্য নিয়ে নবীজি বেরিয়ে পড়েন মক্কা-পথে31। খালেদ বিন ওলিদকে আগে বাড়িয়ে বলেন–যারা সংঘাতে জড়াবে তাদেরই কেবল কম্ম সাবাড় করে দেবে। নিজ উদ্যোগে কোথাও জিঘাংসা চালাবে না। নবীজিও মক্কায় প্রবেশ করলেন বিজয়ী বেশে।
স্মৃতির আরশিতে ভাস্বর হয়ে থাকা সে প্রতীক্ষিত শহরটি আজ মুসলিমদের করায়াত্তে এলো। হক এলো, বাতিল বিলুপ্ত হলো। সাহাবারা স্বাধীন মাতৃভূমি ফিরে পেয়ে খুশিতে বাক বাক হয়ে উঠেন। নবীজি আশপাশের মূর্তিগুলো ধূলিসাৎ করে দেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেন। দলে দলে মানুষ আসতে লাগলো। নববী জবানে কালিমা শাহাদাহ পড়তে লাগলো। ইসলাম আজ সফল হলো।
হুনাইন হলো। তায়েফ হলো। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে ইসলামের বিজয় হলো। সময় নবম হিজরীতে পা দিলো। বিশ্বময় দুর্ভিক্ষ ছেয়ে বসলো। এক নাজুক হালত। এক সঙ্গিন অবস্থা। তখনই নবীজি জানতে পারলেন রোমানদের রণপ্রস্তুতির কথা। নবীজি তাৎক্ষণিক যুদ্ধ প্রস্তুতির আদেশ দেন। সাহাবারা জান-মাল-ঐশ্বর্য নিয়ে এগিয়ে আসেন। ত্রিশ হাজার সৈন্য-সাথে নবীজি তাবুক প্রান্তরে উপস্থিত হন এবং রক্তপাত-বিনে বিজয় ছিনিয়ে আনেন32।
আরাফাত
২৮.আজ দশম হিজরীর পঁচিশে জিলকদ। পেয়ারা নবী আজ হজ করতে যাবেন। সাথে আছে লাখ খানিক পারিষদ। এগুতে লাগলেন মক্কা-পাণে। মুখে আওড়াচ্ছেন তলবিয়া ধ্বনি। আরাফার ময়দানে এলেন। নিথর-নিস্তব্ধ জনসমুদ্রে দিলেন এক আবেগ তাড়িত ভাষণ। নবীজির আঁখি-যুগল তখন জলে ছলছল নীরে টলমল করছে। উপস্থিত জনতাও নিজেকে সংবরণ করতে পারেনি; ডুকরে কেঁদে উঠলো। কারণ নবীজির এই হজ বিদায়ী হজ। এই ভাষণ শেষ ভাষণ। নবীজির সাথে আর এই মাঠে হবে না কারো দেখা, হবেনা কোনে কথা। কি কষ্ট!..33
নবীজি সাহাবাদের উদ্দেশ্যে কৌতুহলী সুরে বললেন–হে আমার সাথীরা, আল্লাহ আমাকে নবুওয়ত ও রিসালতের যে আমানত দিয়েছেন তা কি আমি তোমাদের মাঝে শতভাগ পৌঁছাতে পেরেছি? তখন সকলে একবাক্যে বলে উঠলেন– নিশ্চয়, নিশ্চয় পৌঁছিয়েছেন। তখন সাহাবারা বুঝে পেললেন নবীজির জীবন আয়ু ফুরিয়ে গেলো। হজে আর আসতে পারবেন না। মানবতার শিক্ষা আর দিতে পারবেন না। তাই সাহাবাদের অন্তর আনচান করে উঠলো। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। মন দিল ফুঁপিয়ে উঠলো। কি কষ্ট!
পরলোকে গমন
২৯.এভাবে এক দিন দু’দিন করে এসে গেলো হিজরতের একাদশ বছর। নবীজি ভীষণ জ্বরে ভোগছেন। হরেক-কিসিম পরিচর্যার পরও রোগ নিরাময় হচ্ছে না। হবেই বা কেনো! কারণ তিনি তো আজ খোদার দিদারে যাবেন। রবের সাক্ষাতে যাবেন। তাই হলো। তড়িঘড়ি রবি আওয়াল এসে গেলো। সোমবার উপস্থিত হলো। আল্লাহর ডাক এলো। বিদায় বাণী বেজে উঠলো। পাপে ভরা এই নশ্বর মহিবুক থেকে আজ নবীজির পবিত্র সত্তা ডানা মেলে উড়াল দিলো। ইন্না-লিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন34
সবদিক করুণ সুর বেজে উঠলো। শোক-সন্তাপের ছায়া মেললো। হাসিগান থেমে গেলো। মেষশিশুরা তৃণ মুখে দিয়ে হঠাৎ ব্যথার স্বরে কেঁদে উঠলো। উটপাল চলতে চলতে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে মদিনা পথে মুখ তুলে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। পুষ্প-উদ্যান থেকে বুলবুলি উড়ে গেলো। ফুলদল ঝরে পড়লো। পক্ষীরা গান ভুলে স্থাণু বসে রইলো। বাতাস গতি হারালো। লু-হাওয়া ধরণীর অন্তর্দাহ বহন করে মরুদিগন্তে হাহাকার করে ফিরলো। এভাবে সবখানে মাতম ছড়িয়ে পড়লো। মানুষ মনে করতে লাগলো– কী যেনো আজ নেই, কী যেনো আজ হারিয়েছে35।
ওগো নবী, তোমার বিরহে আজ মন আমার জারজার কাঁদছে। ওগো প্রিয়তম, তোমার বিচ্ছেদে দিল আমার তড়পাচ্ছে। ওগো প্রেমাস্পদ, তোমার শূণ্যতায় মন-দিল বেচাইন হয়ে উঠছে। ফিরে এসো, আরবার ফিরে এসো। অভিমান করো না। আর কষ্ট দিয়ো না। এসো, আবার এসো। তোমায় দেখে চক্ষু শীতল করবো। বিষাদের আগুনকে নির্বাপিত করবো। অবসাদের অবসান করাবো। হ্যাঁ, জলদি এসো। ঝটপট এসে পড়ো। দেরি করো না। কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু,, ইস,,,,,,,,