টর্চলাইট

আমি অনেক হাঁটতে পারি। মাঝে মাঝেই হল থেকে বের হয়ে শহরের রাস্তা ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটা ধরি। যদি একজোড়া ডানা থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই ওড়ার উদ্দেশ্যেই বের হতাম। আমার একজোড়া  পা আছে। তাই আমি হাঁটি। প্রায়ই ক্লাসে যাই না। মাঝেমাঝে মিডটার্ম মিস করি। তারপর সেমিস্টারের শেষের দিকে বাবা এসে স্যার আর ম্যাডামদের সাথে আলাপ করেন। বলেন, আমার ছেলেটা অসুস্থ, দেখেন কিছু করা যায় কিনা। প্রতি সেমিস্টারেই দেখা যায় একজন দুজন মিডটার্ম মেকাপ দেয়, আমিও তাদের সাথে দেয়ার সুযোগ পেয়ে যাই। কোনো কোর্সে কোনোমতে পাশ করি। কোনো কোনো কোর্সে ফেল করে, পরের বছর আবার পরীক্ষা দেই। এভাবে “কোনোমতে” আমি এখনো টিকে আছি। তিন বছর ধরে দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার পর্যন্ত সব কোর্স শেষ করে এখন চতুর্থ সেমিস্টারের কোর্স নিচ্ছি। দুইবার পরের ব্যাচের ছাত্রদের সাথে নতুন করে ভর্তি হওয়ায় পরপর তিন ব্যাচের ছেলেমেয়েরাই আমাকে চেনে।

আমার চোখদুটো ঘোলাটে। মনিটা ঠিক বাদামীও নয়, আবার কালোও নয়। চোখের সাদা অংশে বাদামী রঙের ছোপ ছোপ দাগ। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেই বুঝতে পারি না চোখ দুটো ঠিক কোন দিকে তাকায়। মাথায় চুল উঠলেই মনে হয় শরীরে শত্রুরা বেড়ে উঠছে। আরেকটু বাড়তে দিলেই আমার সব শক্তি শুষে খেয়ে ফেলবে। তাই আমি ঘন ঘন মাথা ন্যাড়া করি। প্রায়ই নাপিতের কাছে গিয়ে গালে থুতনিতে ঘাসের মত বিচ্ছিন্ন ভাবে গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট দাড়িগোফ কামিয়ে আসি। পলাশীর মোরে নাপিত একদিন বলেই বসলো সকালবেলাই দাড়ি কামাইয়া গেলেন, আবার বিকালে কি? শরীরের আর অন্য কিছুর ব্যাপারে যত্নবান না হলেও দাড়িগোফ কামানো এবং চুল ফেলে দেয়ার ব্যাপারে আমি খুব যত্নবান।

এসএসসি আর এইচএসসিতে আমি ভাল রেজাল্ট করেছিলাম। কিভাবে করেছিলাম তা অবশ্য জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও কেন হেলায় নষ্ট করছি এনিয়ে প্রতিদিন আমাকে অনেকের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়। তাই আমি পারতে কারো সাথে এবিষয়ে কথা বলিনা। কিন্তু আমার বাবা নাছোরবান্দা। তিনি প্রায়ই ফরিদপুর থেকে ঢাকায় পৌছে সোজা হলের ভেতর চলে আসেন। হলের বড় ভাইদের সাথে কথা বলেন। সবাইকে বোঝান আমি অসুস্থ। সবাই যখন জিজ্ঞেস করে কি অসুস্থতা, উনি বলেন, মানসিক অসুস্থতা। আশেপাশে বেশ কয়েকজন আমার সাথে মিশে বোঝার চেষ্টা করেছে আমার সমস্যাটা কি। কেউই সন্তুষ্ট হবার মত উত্তর পায়নি। অস্বাভাবিক রকম চুপচাপ থাকায়, কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না দেখানোয়, এবং এমনকি নিজের প্রয়োজনীয় বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকায় অনেকেই দুই একটা কথা বলবার পর আর কোনো কথা বলার আগ্রহ পায় না।  ঘরের ভেতর আসবাবপত্রের মত আমাকেও একটি জড় পদার্থ মনে করে যে যার কাজে ব্যাস্ত হয়ে যায়। কেউ আর মনযোগ দেয় না। প্রথম দিকে আমাকে অদ্ভুত লাগলেও প্রতিদিন একইরকম দেখে এতদিনে তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন এমন হয়েছে যে মাঝে মাঝে যখন রাতে ফিরে আসি না, কেউ আমার খোজও নেয় না। কোথায় গিয়েছিলাম, কেন গিয়েছিলাম কেউ জানতেও চায় না। এতে আমার জীবন আরো সহজ হয়েছে হয়তো।

হলে যে রুমে থাকি সে রুমে আমার সাথে আরো পাঁচজন থাকে। তারা সবাই চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। আর আমি চতুর্থ বর্ষে এসেও দ্বিতীয় বর্ষের। এর মধ্যে একজন ছাত্র আছে বাণিজ্য অনুষদের। নাম সাকিব। সাকিব ছেলেটা সবসময় ট্রাউজার আর টি শার্ট পরে থাকে। মাথায় থাকে একটা ক্যাপ। সকালে উঠে ব্যায়াম করতে যায়। ফিরে এসে গোসল করে ক্লাসে যায়। ক্রিকেট খেলে। সেদিন সে একটা উইন্ডব্রেকার জ্যাকেট আর একটা স্লিপিং ব্যাগ কিনে এনে সবাইকে দেখাচ্ছিল। সে নাকি নেপালে ট্রেকিং-এ যাবে। দারুন উৎসাহ। আমার সাকিবের এই উতসাহ দেখে খুব ভাল লাগলো। যদিও নিজে এব্যাপারে সরাসরি কথা বলিনি, বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনছিলাম অন্যদের সাথে কথপোকথন আর আরচোখে দেখছিলাম স্লিপিং ব্যাগটা।

সেদিন রাতে ১০টার দিকে আমি বের হয়ে গেলাম হল থেকে। ঠিক করলাম, রাস্তায় হাঁটতেহাঁটতেকল্পনা করবো আমি পাহাড়ে উঠছি। হেটে হেটে শাহবাগ মোরে এসে দেখি লোকজন ভীর করে ক্রিকেট খেলা দেখছে বড় স্ক্রীনে। পাকিস্তান বাংলাদেশ খেলা। বাংলাদেশ ব্যাটিং করছে। আমি প্রস্তুতি নিলাম। শুরু হল কল্পনা। গন্তব্য কেওক্রাডং এর চূড়া। প্রথম ১০-১৫ মিটার পথের ঢাল কম। তারপর মাঝারি ঢাল। ৩০ মিটার একটানা উঠে একটু জিরানোর জন্য দাড়ালাম। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের পাদদেশে অনেক মানুষ ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সবাইকে একটু আগেই টিভি স্ক্রীনের সামনে দেখে এসেছি তালি দিচ্ছিল ছক্কা পেটানোয়। এখন আমার সাফল্যে তারা তালি দিচ্ছে আর চিৎকার করে উচ্ছাস প্রকাশ করছে। তালির শব্দ অন্য পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে। উল্লাস জানানোর শব্দ আসলেই পাহাড়ে ওঠা থামিয়ে দিয়ে উল্লসিত জনতার দিকে ফিরে হাত উচিয়ে দুই আঙ্গুল দিয়ে ভি চিহ্ন দেখাচ্ছি। এভাবে একে একে ধাপ পেড়িয়ে উপরে উঠি আর কিছুক্ষন আনমনে নীচের দিকে সাপের মত একেবেকে এগিয়ে যাওয়া নদীটার দিকে তাকাই। এক সময় এত উপরে উঠে গেলাম যে নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের আর দেখা গেল না। তাদের শব্দ ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হতে লাগলো। একটা খাড়া ঢাল পেয়ে এক প্রান্তে আংটা লাগানো একটি বিশেষ ধরনের ট্রেকিং এর দড়ি উপরের দিকে ছুরে একটা শক্ত পাথরে আটকালাম, তারপর ওটা বেয়ে বেয়ে উপরে ওঠা শুরু করলাম। আরেকটু হলেই পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম এবার নীচের থেকে মানুষেরা উল্লাস প্রকাশ করবে। কিন্তু বেশ অনেকক্ষন হয়ে গেল কারো কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম। তাকিয়ে রইলাম নীচের নদীটার দিকে। কে যেন আমাকে পেছন থেকে ডাকলো। তাকিয়ে দেখি একজন পুলিশ। তখন আমি কোনো একটা ফুটওভার ব্রিজের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছি। ব্রিজের নীচে দিয়ে চলে যাচ্ছে ভীষন গতিতে চলতে থাকা বাস, গাড়ি, ট্রাক।

এখানে কি কর?

পাহাড়ে উঠছি।

এটা তো ব্রিজ।

ব্রিজ ভাবলে ব্রিজ, পাহাড় ভাবলে পাহাড়।

নাম কি?

সাকিব।

এখানে কি?

বললাম না একবার, কেওক্রাডং  এ মানুষ কেন আসবে?

পুলিশ আমার শার্টের কলার ধরে আমাকে দাঁড় করালো। চল থানায় চল।

আমি মাথা নীচু করে ওনার সাথে হাঁটা ধরলাম। কোনো বাধা দিলাম না দেখে ওনার একটু সন্দেহ হল। ভালমত আমার চেহারা দেখলেন। অন্যদের মত ওনারও বোধ হয় মনে হল আমার মাথা খারাপ। জিজ্ঞেস করলেন, বাসা কোথায়?

হলে থাকি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র?

হ্যা।

এত রাতে এখানে কি?

খেলা দেখতে বের হইছিলাম। তারপরে মনে করলাম আজকে কেওকেরাডাং এ উঠবো। তাই কল্পনা করতে করতে হাটতেছিলাম।

কি?

সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিশ্বাস করবেন কি করবেন না বুঝতে না পেরে খুব আজব একটা চাহনী দিলেন সেই পুলিশ। ওয়াকিটকিতে কার সাথে যেন নীচু স্বরে বললেন, পাগল মনে হয়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এত রাতে বাইরে ঘোরা ঠিক না। খেলা শেষ। ইউনিভার্সিটি ফিরে যাও। আমি বললাম, আচ্ছা। তারপর হাঁটাশুরু করলাম। পুলিশটি আমাকে থামিয়ে বলল, ঢাকা ইউনিভার্সিটি এদিকে না। ঐদিকে। আমি তার নির্দেশ মতো উল্টাদিকে হাঁটাশুরু করলাম। হাঁটতে কোনদিকে যাচ্ছিলাম জানি না। যখন ভোরের আজান দেয়া শুরু করলো, দেখলাম আমি ফার্মগেটের দিকে। রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে কয়েকজন। সেদিন সেই অভিযানটা পুরোপুরি শেষ করতে পারিনি ওই পুলিশের জন্য। পরদিন ক্লাসে যেতে পারিনি। সেদিন মিডটার্ম পরীক্ষার ডেট দিয়েছিল কিন্তু আমি জানতাম না। পরের সপ্তাহে ক্লাসে গিয়ে জানলাম ক্লাস বাতিল হয়েছে কারন বিকাল ৪ টায় পরীক্ষা। এক ঘন্টায় আর কি প্রস্তুতি নেব। তাই পরীক্ষা দিতে গেলাম না।

এই ঘটনার কয়েকদিন পর সকালের দিকে টিভিরুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি একটা হিন্দি গান দেখাচ্ছে, শাহরুখ খান একটা সাদা ক্যারাভানে চালাচ্ছেন আর তার পাশে বসা লম্বা চুলওয়ালা একজন গ্রাম্য বাউল। গান গাইতে গাইতে গ্রামের পথ দিয়ে যাচ্ছেন। পথে পড়ছে ভেরার পাল, গ্রামের মানুষদের গোসলের দৃশ্য, মেয়েদের মাথায় পানি নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। রৌদ্রজ্জ্বল দিনে গান গাইতে গাইতে এই ছুটে চলা দেখতে আমার ভীষন ভাল লাগলো। সিনেমাটা দেখতে বসে গেলাম। সিনেমাটির নাম স্বদেশ। শাহরুখ খান নাসার একজন বিজ্ঞানী। চাকরী থেকে ছুটি নিয়ে এসে ইন্ডিয়ার একটা গ্রামে সাধারন মানুষের সাথে দিনযাপন শুরু করেন। ঘটনাক্রমে গ্রামের জীবনের নানান সমস্যা সমাধানের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেলেন। কারেন্টের অভাবে সেচ দিতে না পারা কৃষকদের জন্য একটা  হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাম্পের ব্যাবস্থা করে দেন। গ্রামের মানুষের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে যান যে শেষে গিয়ে দেখা যায় নায়ক সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিনেমাটা দেখে আমার এত ভাল লাগে যে তারপরদিন সকালে উঠে আমি আবার হাঁটাশুরু করি। সেদিন সারাদিন ধরে আমি হয়ে যাই নাসার বিজ্ঞানী। মানুষের সুখে দুখে তাদের পাশে দাঁড়াই। প্রতিটি দৃশ্যে নিজেকে কল্পনা করতে করতে কাটিয়ে দেই। ফিরতে ফিরতে যখন সন্ধ্যা। হলে এসে জানতে পারি বাবা এসেছিলেন এবং তিনি আমাকে খুজতে ডিপার্টমেন্টে গেছেন। রুমে ফিরে একটা ঘুম দেই। রাত ১০ টায় যখন ঘুম ভাঙ্গে দেখি বাবা আমার পাশে শুয়ে আছেন। সকালে বাবা জিজ্ঞেস করেন, কই গেছিলি। আমি জবাব দেইনি। তখনো আমি আগেরদিনের স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলাম।

 

আমার ক্লাসে একজন সহপাঠী আছে। নাম হায়দার আলী। দুই বছরের জুনিয়র। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হলেও সিট না পাওয়ার কারনে এখনো ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের সাথে গণরুমে থাকে। প্রায়ই ক্লাসে না গেলে ক্লাসে কি পড়ানো হয়েছে আমাকে খবর দেয়। ক্লাস নোট যোগার করে দেয়। মাঝে মাঝে একসাথে পড়ার জন্য বই খাতা নিয়ে চলে আসে। হায়দারকে নিয়ে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা অনেক ঠাট্টা করে। গায়ের রঙ কালো বলে অনেকে ওকে ডাকে “হায়দার কালী” বলে। ছেলেটা অনেকবার শিক্ষকদের বলে চেষ্টা করেছিল ডিপার্টমেন্ট বদলাতে কিন্তু পারেনি। ওর নাকি বিষয়টা খুব কঠিন লাগে। পড়াশোনার ধরন ও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। মুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়ায়। প্রায়ই দেখি সে তার গ্রামে একটা লাইব্রেরি বানানোর জন্য এখানে ওখানে ছুটোছুটি করছে।

এক প্রবাসী বাংলাদেশী  হায়দারকে বই সংগ্রহ করতে সাহায্য করেন। নাম মাহবুবুল আলম। মাহবুব ভাই আমেরিকায় থেকেও দেশে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের সাথে যুক্ত। হায়দারের গ্রামের লাইব্রেরী তার অন্যতম প্রজেক্ট। বাংলাদেশে এসে মাহবুব ভাই একদিন দেখা করতে এসেছিলেন হায়দারের সাথে। ভদ্রলোক বিজনেস ফ্যাকাল্টির ফুড কোর্টে এসে ফোন দিয়ে বলেছিলেন সেখানে দেখা করতে। হায়দারের সাথে আমিও ছিলাম। ফ্যাকাল্টির গেটের সামনে এসে হায়দার থেমে গেল। ফোন করে মাহবুব ভাইকে বলল বাইরে এসে দেখা করতে। ফুডকোর্টে ঢোকার ইচ্ছা তার ছিল না। ফুডকোর্টের খাবার বাইরের তুলনায় দামী। বেশীরভাগ ফাস্টফুড পাওয়া যায়। বুঝতে পারছিলাম এরকম জায়গার প্রতি হায়দারের একটি ভীতি বা গভীর অনিচ্ছা কাজ করে। বোধ হয় হায়দার ভাবে শহরের সব মেধাবী, তেজোদীপ্ত, উচ্চবিত্ত, ও ঔদ্বত্য মানুষেরা এখানে আসে, খায়, আড্ডা দেয়। তাদের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে না। হায়দারের কাছে বা আমার কাছে এইসব দামী রেস্টুরেন্ট তেমন কোনো অর্থ বহন করে না। যাদের কাছে অর্থ বহন করে তারা আবার মনে করে আমাদের বুঝি এখানে আসার খুব ইচ্ছা, শুধু  কিনে খেতে পারিনা বলে ঈর্ষা করি ওদের। তাদের এরকম ভাব দূর থেকে দেখে আমি বেশ মজা পাই। আমি অবশ্য হায়দারের মতো অতো ভয় পাই না। আমাকে যেতে হলে আমি ভেতরে চলে যাব। আমার ধরন আর হায়দারের ধরন এক নয়। আমাকে সবাই প্রচলিত অর্থে মানসিক ভাবে অসুস্থ হিসাবে জানে। হায়দারকে জানে অন্যভাবে। হায়দার মানসিকভাবে একজন সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। তার ভয় আছে, লজ্জা আছে, সমাজের বিশেষ শ্রেনীর বিশেষ ধরনের মানুষের প্রতি তার রাগ ক্ষোভ ভীতি দুইই আছে। মেয়েদের দেখলে সে দৌড়ে পালায়, কথা বলতে এলে অন্যদিকে হাঁটাশুরু করে। আমার এরকম কিছু নেই। আমি নির্বিকারে কথার উত্তর দেই। নিজে থেকে প্রশ্ন করি না। জবাব দিতে ইচ্ছা না করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। ফ্যাকাশে গালের কাটা দাগটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে, বিশ্রী বাদামী দাগওয়ালা ঘোলাটে চোখ তুলে আমি যেই নির্লিপ্ত চাহনী দেই তাতে সবাই মনে করে আমি মানসিকভাবে অসুস্থ। আর হায়দার মাথা নীচু করে রাখে, কেউ ক্ষেপালে ক্ষেপে যায়। চেহারা দেখে কষ্ট লুকানোর চেষ্টা বোঝা যায়। সে গোপনে বাথরুমে গিয়ে কাঁদে। আমি কাঁদি না। মানসিকভাবে অসুস্থ – এই ভাবনাটা কারো মাথায় গেঁথে গেলে আমাকে আর কেউ বিরক্ত করে না। আমার শীতল চাহনীর মধ্যে কেউ মজা খুজে পায়না। কাউকে রাগালে যদি সে না রাগে, প্রশ্ন করলে যদি কেউ না বোঝার ভান করে, তাকে নিয়ে কেউ মজা করতে চায় না। কিন্তু হায়দারকে নিয়ে মজা করা যায়।

 

মাহবুব ভাই গেটের কাছে এসে যখন প্রশ্ন করলেন, তুমি ভেতরে দেখা করতে চাইলে না কেন, হায়দার এক কথায় বলল, আমি ওখানে যাই না। মাহবুব ভাইকে দেখে মনে হল হায়দার কি কারনে ওই দামী রেস্টুরেন্টে ঢুকতে চায় না তা বুঝতে পারলেন না। উনিই তো খাওয়াতেন। টাকা তো আর হায়দারকে দিতে হত না। এরপর আমরা হেটে গিয়ে বসলাম মধুর ক্যান্টিনে। মাহবুব ভাই আমাদের চা আর মিষ্টি খাওয়ালেন। তারপর খানিকক্ষন পাঠাগারের বই নিয়ে আলাপ করে গাড়ি থেকে অনেকগুলি বই নামালেন। হায়দার আমাকে নিয়ে এসেছিল এই বইগুলো বহন করে হলে নিয়ে যেতে। সে যেহেতু গণরুমে থাকে, বইগুলো রাখার কোনো জায়গা তার নেই। বইগুলো আমার কাছে রাখতে চায়। সেদিন আমরা দুজনে মিলে প্রায় পঞ্চাশটা বই বহন করে নিয়ে এসে আমার খাটের নীচে ঢুকিয়েছিলাম। এরপর থেকে প্রতি বৃহষ্পতিবার বাড়িতে যাওয়ার সময় সে পাঁচটা পাঁচটা করে বই আমার কাছ থেকে নিয়ে যেত। সেই সুবাদে হায়দারের সাথে আমার যোগাযোগ একটু বেড়ে গেল।

 

আগে থেকে রিডিং-রুমে জায়গা রেখে, রাতে পড়তে যাওয়ার আগে হায়দার আমাকে ডেকে নিয়ে যেত। পড়ালেখায় ফাঁকি দিতে দিতে আমার এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে হায়দারের এই সৌজন্যটুকুর জন্য পড়াশোনার জন্য সময় দেয়া ধীরে ধীরে বেড়ে গেল। একদিন রিডিং-রুমে পড়ার সময় হঠাত কারেন্ট চলে যায়। অন্ধকারে সবাই যখন মোবাইল ফোন জালানো শুরু করেছে হায়দারকে দেখলাম একটা টর্চ লাইট বের করে জ্বালালো। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম। আজকাল কেউ কি আর টর্চলাইট নিয়ে ঘোরে? ১০ মিনিট পরেই কারেন্ট চলে এসেছিল কিন্তু হায়দার টর্চ লাইটটা জালানোয় সেটা অন্যদের চোখে পড়ে যায়। এক বড় ভাই এসে জোর করে তার টর্চটা নিয়ে যায়। হায়দার মাথা নীচু করে টর্চটি দিয়ে দেয়।

তারপরদিন হায়দার আর আমাকে নিতে এলো না। আমি অপেক্ষা করলাম। গণরুমে ওর খোজ করতে গেলাম। জানলাম সে হলে নেই। পরদিন সে ক্লাসেও এলো না। আমি বিকালের দিকে হলে গিয়ে প্রথমেই গণরুমে খোঁজ করলাম। দেখি মেঝেতে এককোনে খালিগায়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে হায়দার। আধো আলোয় তার আধার-কালো শীর্ন শরীরের ভেতরের বুকের খাঁচাটা নিশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে ওঠানামা করছে। আমি কাছে গিয়ে বসলাম। ঘুম ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেখছিলাম এই রুমে অন্তত ত্রিশ জন গাদাগাদি করে কোনো রকমে ঘুমায়। ফার্স্ট ইয়ারে আমাকেও এরকমভাবেই থাকতে হত। তখন সামনে থেকে দেখেছি একটা সিট পাওয়ার জন্য কি না করতে হয়েছে ছেলেদের। হায়দারও যে অনেক চেষ্টা করেনি তা না। সে কারো সাথে বেয়াদবি করে না। সব কথাতেই জি জি করে। মিছিলে নিয়মিত যায়, বড় ভাইদের খুশী রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরও পরিচিত কেউ না থাকায় বা আগ বাড়িয়ে নিজেকে জাহির করতে না পারায় সে ক্রমাগত এই ইদূর দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে। ভাবতে ভাবতে হঠাত গোঙ্গানীর মত শব্দ শুনে তাকাই। দেখি হায়দার বীকট শব্দ করে ধরমর করে উঠে বসলো। আমি তার হাত ধরে বললাম, কি হইছে?

চোখ কচলাতে কচলাতে হায়দার বললো, স্বপ্ন দেখতেছিলাম।

কি স্বপ্ন?

না, তেমন কিছু না।

দেখে মনে হয় ভয় পাইছিলি খুব?

ভয়তো আছেই। যেকোনো সময়ই মাইর খাইতে পারি।

কেউ ভয় দেখাইছে?

না।

বুঝলাম কিছু হলেও সে সহজে বলবে না আমাকে। জিজ্ঞেস করলাম, টর্চ ফেরত দিছে?

না।

টর্চ নিয়া ঘুরতেছিলি ক্যান?

এমনেই। অভ্যাস।

আমি আর কিছু বললাম না। এরপর থেকে প্রায়ই দেখি হায়দারকে রাতের দিকে হলে পাওয়া যায় না। ক্লাসেও অনিয়মিত। আরেকদিন ক্লাসে যায়নি বলে বিকেলে ওকে গণরুমে খুজতে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আজকে ক্লাসে গেলি না ক্যান?

প্যান্ট ছিল না।

চুড়ি হইছে?

না। ফার্স্ট ইয়ারের একটা ছেলে না বইলা পইড়া গেছিলো গিয়া।

কেন নিছিল?

মনে হয় নিজেরটা ধোয়া ছিল না।

তো আমারটা নিতি।

আপনি ছিলেন না। আর আপনার প্যান্ট তো আমার লাগতো না।

গণরুমে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের সাথে সিনিয়রদের থাকাটাই অপমানজনক। তারমধ্যে যত দরকারই থাকুক একটা জুনিয়র ছেলের সিনিয়রের প্যান্ট না বলে নিয়ে নেয়ার কথা না। আমার মনে হল হায়দারকে নিয়ে জুনিয়ররাও তামাশা শুরু করেছে কিন্তু হায়দার স্বীকার করছে না। এই হতাশা কাউকে দেখানোও যায় না।

সেদিনের পর একটানা কয়দিন হায়দারকে রাতে না পেয়ে একদিন রাতে নিজেই বের হয়ে গেলাম। ভাবছিলাম আমার মতো হায়দারও কি রাতবিরাতে ঘুরে বেড়ানো শুরু করল? চতুর্থ বর্ষের ছাত্রদেরকে পলিটিকাল ছেলেরা একটু কম ঘাটাঘাটি করে। তাই আমাকেও ঘাটায় না। তার মধ্যে প্রায়ই বাবা এসে মানসিক অসুস্থতা নিয়ে কথা বলে যাওয়ায় আমার তেমন সমস্যা হয়না । কিন্তু বুঝতে পারি হায়দার খুব সমস্যায় আছে। আমি বের হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটাশুরু করি। মনে মনে হায়দারকে খুজি। চোখে পড়ে, কিছু ছেলে এক জায়গায় জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটু কাছে যাই দেখার জন্য। বুঝতে পারি পলিটিক্যাল ছেলেরা এখানে একসাথে জড়ো হয়ে এসেছে। আরেকটু সামনে যেতেই হায়দার আমাকে দেখে এগিয়ে আসে। কাধে হাত দিয়ে বলে, একটু এদিকে আসেন ভাইয়া। আমি তার সাথে হেটে জটলা থেকে একটু দূরে যাই। হায়দার আস্তে আস্তে বলে, ভাইয়া আপনি এখানে আসছেন কেন? আমাদেরকে এইখানে নিয়া আসছে ডিসিপ্লিন শিখাইতে। প্রায়ই রাতে ডিসিপ্লিন শিখায়। আপনি সাতেও নাই পাঁচেও নাই। এইখান থেকা চইলা যান।

আমাকে আর কিছু বলতে হল না। বুঝে গেলাম। হায়দারকে সেখানে রেখে হাঁটাশুরু করলাম। শহীদ মিনারের দিকে। দূর থেকে দুই-একবার  পেছন ফিরে দেখলাম হায়দার মিছিলের মধ্যে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছে। বারবার পেছনে পড়ে যাচ্ছে। তারপর একটু দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে সবার পেছনে পেছনে। উদয়ন স্কুল পর্যন্ত হেটে আসতে আসতে দেখি হায়দারদের মিছিল স্মৃতি চিরন্তন পর্যন্ত চলে গেছে। জগন্নাথ হলের সামনে এসে যখন পৌছেছি মনে হল, হায়দারের পায়ে কি হয়েছে জানা হল না।

সেদিন বৃহষ্পতিবার দুপুরের দিকে হায়দার এলো আমার কাছ থেকে সেই বইগুলো নিতে। জিজ্ঞেস করলাম, পায়ে কি হইছে?

কিছু হয় নাই, একটু রগে টান পড়ছে।

উত্তরটা সত্য না মিথ্যা তা যাচাইয়ের কোনো পথ নেই। বললাম, চল তোরে বাসে উঠাইয়া দিয়া আসি।

না, আমার টিউশনি আছে। তারপরে এক এজেন্টের কাছে যাইতে হইব। আরেকটা টিউশনি পাওয়ার জন্য আগাম টাকা দিয়া রাখছিলাম তিন-চার মাস আগে। টিউশনিও যোগার কইরা দেয় না, টাকাও ফেরত দেয় না। খালি ঘুরায় ওই ধান্দাবাজ। সব কাজ শেষ কইরা স্টেশনে যাইতে দেরী হইব।

হায়দার সেবার গ্রাম থেকে ফেরার সময় আরেকটা টর্চ লাইট কিনে নিয়ে এলো। রবিবার সকালে টর্চটা হাতে নিয়ে সে যখন আমার রুমে এলো তাকে বেশ উতফুল্ল দেখালো। বাড়ি থেকে ঘুরে এলে সবারই বোধ হয় এমন খুশী লাগে। মুখের হাসি আর বন্ধ হয় না। হায়দারের খুশীর অবশ্য আরেকটা কারন আছে। সে বললো, আরেকটা নতুন টিউশনি পাইছি। কালকে বিকালে মিরপুরে যাইতে হইব।

কিন্তু পড়শু যে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু।

এতদিন পর টিউশনি পাইলাম। না গেলে যদি হাতছাড়া হইয়া যায়।

 

ফাইনাল পরীক্ষা শুরু আগের দিন সন্ধ্যায় হায়দার আমার রুমে এসে হাজির। মুখ প্রায় কাঁদো কাঁদো। জিজ্ঞেস করলাম, কি হইছে?

আজকে মিরপুরে যেই বাসায় গেছিলাম সেইটা একটা ভুল ঠিকানা। বাড়ির মালিকরে যেই বললাম টিউশনি করতে আসছি, খুব আজেবাজে কথা শুনাইল। আরেকটু হইলে মাইরই খাইতাম।

ভুল ঠিকানায় গেলি ক্যান?

আমি তো ভুল করি নাই, ওই এজেন্ট টিউশনি যোগার করতে না পাইরা আমারে আন্দাজে একটা ঠিকানা দিয়া দিছে।

হায়াদারের প্রতারিত চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। আমার কেন যেন মনে হল সে মার খেয়েছে কিন্তু লজ্জায় বলছে না। প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য আমি বইখাতা হাতে নিয়ে বললাম, বাদ দে এইসব। কালকে পরীক্ষা। চল রিডিং-রুমে যাই।

রিডিং-রুমে এখন জায়গা পাওন যাইব না।

চল চেষ্টা করি।

রিডিং-রুমে গিয়ে দেখি সব জায়গা প্রায় দখল। একটা জায়গায় একজন ব্যাগ রেখে গেছে, পরে আসবে। ওখানে আপাতত বসা যায়। কিন্তু জায়গার দখলদার এলে উঠে যেতে হবে। আমি আর হায়দার চাপাচাপি করে একজনের জায়গায় দুইজন বসে বইখাতা খুললাম। রাত দশটার দিকে সেদিন আবার হঠাত কারেন্ট চলে গেল। হলের বড়ো ভাইদের মধ্যে একজন অন্ধকারের মধ্যেই বলা শুরু করলো হায়দার “কালী” কই? টর্চ ওয়ালা? চারদিক তো কালা হইয়া গেল। কেউ বলতে লাগলো, অন্ধকারে মিস্টার কালীকে দেখা যায় না, চোখ দেখা যায় শুধু। বলে হাসতে হাসতে আরেকজন বলে উঠলো, চল ওর ব্যাগ থেইকা টর্চ বাইর করি। বলেই কয়েকজন এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। আর ঠিক তখনই কারেন্ট চলে আসায় সবাই আবার যার যার জায়গায় চলে গেল। টর্চ বের করাটাও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। সেদিন জানলাম শুধু আমিই জানতাম না যে হায়দার টর্চ নিয়ে ঘোরে। হলে সবাই জানে হায়দারের কাছে সবসময় একটা টর্চ থাকে।

পরদিন হায়দার আর এলো না আমাকে নিতে। প্রথম পরীক্ষাটা দুজনেরই খারাপ হয়েছিল। ডাইনিং-এ খাবার খেতে গিয়ে খুজলাম চারিদিকে। মনে প্রশ্ন জাগলো, হায়দার কি আবার ডিসিপ্লিন শিখতে গেছে? এই পরীক্ষার মাঝখানেও? আমার আর পড়তে বসতে ইচ্ছা করল না। ভাবলাম একটু হেটে আসি। হাঁটতেহাঁটতেকিছুদুর গিয়ে দেখি প্রক্টরের গাড়ি থেকে ছেলেমেয়েদের রাস্তা থেকে উঠে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। গাড়িটা গিয়ে থামলো ফুলার রোডে বৃটিশ কাউন্সিলের পাশে ল্যাম্পপোস্টের কাছে। দূর থেকে দেখলাম প্রক্টরের গাড়ি থেকে একজন নেমে কাকে যেন উঠে যেতে বলছে। একটু কাছে গিয়ে দেখলাম টর্চ হাতে হায়দার। অন্য হাতে বই । সে সব গুছিয়ে উঠে আসছে। আন্দাজ করলাম সে বাইরে টর্চলাইট জালিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিল। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া কই যান?

এইতো আজকে সারারাত হাটবো।

পড়বেন না?

না।

কেন?

এমনি। ভাললাগতেছে না।

আপনের আব্বা আইসা তো আমারে বকবো?

না বকবো না।

তুই হলে যা। পড় গিয়া।

আজকে আপনার সাথে হাঁটতেযাই?

না। পড় গিয়া।

হায়দার আর কিছু না বলে চলে গেল। আমি পেছনে ঘুরে দেখলাম হাতের টর্চটা বারবার জালিয়ে নিভিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে হলের দিকে। এরপর আরো তিনটা পরীক্ষার মধ্যে দুইটা আর দেইনি। হায়দারের পরীক্ষা কেমন হয়েছে তাও জানি না। পড়ালেখা নিয়ে অনেক আগেই আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি। তাও জোর করে মাঝেমধ্যে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলি, যখন দেখি আমি কোনো কোর্সে “এ” পাবো না, তখন আমি প্রথমেই আশা ছেড়ে দেই।

 

 

শেষ পরীক্ষাটা আমি দিয়েছিলাম। পরীক্ষা যেদিন শেষ সেদিন দুপুরে ব্যাগ গুছাচ্ছিলাম। ফরিদপুর যাব। হঠাত মনে হল হায়দারের খোঁজ নেই। গণরুমে গেলাম। দেখি হায়দার দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। নিশ্চয়ই সারারাত ধরে পড়েছিল। কাছে গিয়ে ডাকাডাকি করলাম। কোনো সাড়া শব্দ নেই। দেয়ালে টাঙ্গানো একটা আয়নায় হায়দারের মুখটা দেখা যাচ্ছে। চেহারা দেখে মনে হল না ঘুমাচ্ছে। মুখটা গম্ভীর। আবারও ডাকলাম, হায়দার। হায়দার ফিরে তাকালো না। নিশ্চয়ই পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। কি করব বুঝতে না পেরে আবার নিজের রুমে ফিরে গেলাম। হায়দার তো আমার মত না  যে পরীক্ষা খারাপ হলে নির্লিপ্ত ঘুরে বেড়াবে। রুমে এসে খাটের নীচ থেকে বইগুলো বের করে ৫-৬টা বই ঝেড়ে মুছে রেখে দিলাম যদি হায়দার নিয়ে যায়। তারপর দাড়ি কামিয়ে রুমে এসে বাবাকে ফোন দিলাম। বললাম, আজকে রওনা দিব।

তারো আধা ঘন্টা পর ব্যাগ নিয়ে বের হব এরমধ্যে হঠাত শুনি হই চই। কয়েকজন ভয়ে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে। কেউ কিছু জানে না কি হয়েছে। একজন শুধু বললো একটা ছেলে উপর থেকে পরে মারা গেছে। আমি অন্যদের অনুসরন করলাম। হলের স্টাফদের একজন অন্যজনকে বলছে, সামনে না, পেছনের দিকে।  কি হয়েছে দেখার জন্য অনেকেই জোর করে ডাইনিং রুমের বাইরের দিককার গেট দিয়ে বের হতে চাইছে। কিন্তু আমাদের হলের দারোয়ান সিদ্দিক ভাই কাউকে ওদিক দিয়ে বের হতে দিচ্ছে না। এই নিয়ে লেগে গেল ঝগড়া। জানালা দিয়ে অন্যদের উকি দিতে দেখে আমিও উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। কিছুই বোঝা গেল না। ক্যান্টিনের নাজিম ভাই এসে খবর দিল, উপর থেইকা লাফ দিয়া এক ছেলে আত্মহত্যা করছে। টর্চওয়ালা কইতো পোলাপান তারে।

শরীর হিম হয়ে গেল। কি কারনে আত্মহত্যা করল হায়দার? নিশ্চয়ই পরীক্ষা খুব খারাপ হয়েছে। দ্বিতীয়বার ফেল করার রেজাল্ট যেন দেখতে না হয় সেজন্য আগেই সারা জীবনের জন্য চোখ বন্ধ করলো? বাইরে দিয়ে দেয়াল টপকে গিয়ে দেখি হায়দারের থ্যাতলানো শরীরটা মাটিতে পড়ে আছে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে কান পর্যন্ত পৌছে গেছে। আমি সাথে সাথে একটা আসবাবপত্রের মতো দেয়ালের সাথে লেপ্টে গেলাম। কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। উত্তেজিত মানুষের ছূটাছুটি দেখতে লাগলাম। অন্যদের কথপোকথন শুনতে লাগলাম। প্রভোস্ট এলো, হাউজ টিউটররা এলো। ৬ তলায় যারা থাকে তাদের ভাষ্য শোনা হল। তাদের মধ্যে একজন সাক্ষ্য দিল হায়দারকে দেখা গেছে বারান্দায় পায়চারি করতে। এটা যে আত্মহত্যা তা আরো নিশ্চিত করলো আরেকটা ছেলের সাক্ষ্য। লাফ দেয়ার সময় দূর থেকে সে দেখেছিল, আশেপাশে কেউ ছিলনা। কেউ কেউ বলল হায়দারের রেজাল্ট খারাপ ছিল। কারো সাথে মিশতো না। একা একা থাকতো। আমাকে দেখিয়ে বললো এই ছেলেটার সাথে ঘুরতো। একজন মন্তব্যে করলো, এই ছেলেটা তো মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিল, ওর সাথে যখন মিশতো তারমানে হায়দারের মাথায়ও নিশ্চয়ই সমস্যা ছিল। এসব কথা কিছুই আমার গায়ে লাগলো না। বাতাসের মতো মিলিয়ে গেল সব কথা। আমার মন এখানে নেই।

কিছুক্ষন পর একটা অ্যাম্বুলেন্স আনা হলো। অ্যাম্বুলেন্স-এ আমি হায়দারের নিথর দেহটার পাশে গিয়ে বসলাম। যতক্ষন বসেছিলাম মনে হচ্ছিল হায়দার এখনই উঠে বসবে। জিজ্ঞেস করবে, আমার টর্চ লাইটটা কোথায়? কিন্তু মেডিকেলে নেয়ার পর  ডাক্তার পরীক্ষা করে নির্মমভবে ডেথ সার্টিফিকেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।

মেডিকেলে অপেক্ষা করার সময় আসবাবপত্রের মত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কি করার ছিল? আমি নিজেকে হায়দার ভাবা শুরু করলাম। চোখ দিয়ে কোনো পানি বের হল না। খুব শক্ত করে হায়দারের হাত ধরে বসে থাকলাম। সন্ধ্যা ৮ টা বাজলো হায়দারের বাবার ঢাকা পৌছাতে। উনি আসার পর মেডিকেল থেকে লাশ নিয়ে ট্রাকে উঠানো হল। ট্রাকেও আমি আসাবাবপত্রের মতো এক কোনায় বসে থাকলাম। সাথে রয়েছেন হায়দারের বাবা, চাচা ছাড়াও আরো প্রতিবেশীরা। ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে ট্রাক আগানো শুরু করলো। সবাই কথা বলছে, কেন আত্মহত্যা করলো এই নিয়ে। কেউ কিছু জানে না। হায়দারের আরো দুইজন সহপাঠীও আমাদের সাথে রয়েছে। তারা একে অপরকে বলতে লাগলো সহপাঠীরা কতবার তাকে বিভিন্নভাবে অপদস্ত করেছে। যে যার মত বিশ্লেষন করতে লাগলো। হায়দারের কতকিছুই আমি জানিনা। সেদিকে আমার মন নেই। আমি শুধু চিন্তা করছি হায়দারের টর্চটা কোথায়।

 

গভীর রাতে ট্রাকটা গিয়ে থামলো একটা নদীর পারে। এই জায়গাটার নাম কি আমি জানি না। জানার ইচ্ছেও নেই। লাশটা খাটিয়া সহ একটা ইঞ্জিন নৌকায় নামানো হল। নৌকায় আমরা সবাই উঠলাম। দূর থেকে নদীর ওই পারে আলো দেখা যাচ্ছে। কিছু আলো নড়ছে। আলোর রশ্মি নদীর বুকে যে দীর্ঘ রেখাগুলো তৈরী করছে সেগুলো তির তির করে কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে না ওই পারে কি আছে। নৌকা ডাঙ্গার কাছে আসতেই দেখলাম যারা দাঁড়িয়ে আছে সবার হাতে একটা করে টর্চ। বাড়িঘরের ভেতর কোনো আলো জ্বলছে না। ওই গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি এখনো। সবাই হারিকেন বা টর্চ হাতে নিয়ে ঘুরছে। হায়দার তাহলে এজন্যই সবসময় টর্চ হাতে নিয়ে ঘুরত?

একটা দুটা টর্চ হলে কথা ছিল। এই গভীর রাতে কয়েকশো মানুষ। তাদের প্রায় সবার হাতে টর্চ। এর মানে কি? এটা কি কল্পনার কোনো দৃশ্য? নাকি সত্যি? আমি তো অনেক স্বপ্ন দেখি। এমন স্বপ্নতো আমি কখনো দেখিনি।

নৌকা থেকে নেমে জানলাম হায়দার এই গ্রামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া একমাত্র ছাত্র। বুঝলাম হায়দারের কোনো বড় ভাই না থাকায় সে সিট পাওয়ার ব্যাপারে কারো কোনো সাহায্যও পায়নি। তাদের জানার কথা না হায়দার কি কষ্ট করে ঢাকায় থাকে। খাটিয়াতে করে হায়দার নামে যেই ছেলেটার লাশ নামানো হয়েছে একটু আগেও সে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে একজন ভীতু, শীর্ণ, কালো ছেলে। সবাই যাকে ভাবতো হীনমন্যতায় ভুগতে থাকা একটা গ্রাম্য ছেলে। নৌকা থেকে তার দেহটা নামানোর পর বোঝা গেল সে মোটেই কোনো সাধারন মানুষ নয়। এখানে সে অনেক বড়ো একজন মানুষ। যেন সে একটা ছোট্ট রাজত্বের রাজা। সেই রাজার অন্তর্ধানে দেশের সকল প্রজা এক হয়ে বাইরে নেমে এসেছে। আজকে তাদের বড়ই শোকের দিন। রাজাকে ঘিরে শুরু হল তাদের শোকপর্ব। যারা বলে হায়দার হীনমন্যতায় ভোগে তাদের এই শেষকৃত্য দেখা প্রয়োজন ছিল। আমার দেখা কোনো শিক্ষকের শেষকৃত্যেও এত মানুষ জমায়েত হতে দেখিনি। হায়দারের শরীর যে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা তার ওপর দিয়ে ভোররাতে নদীর শূন্য বুক থেকে আসা হাওয়ার তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। সেই কাপড়ে ঢাকা বুকের উপর মাথা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হায়দারের মা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন।  তাকে ধরে নামিয়ে মুখে পানির ছিটা দেয়া হল।

পাড়া প্রতিবেশী লাশ নিয়ে নদীর পারে সারারাত জেগে রইলো। ছোট-বড়, মেয়ে-ছেলে, জোয়ান-বুড়ো – কারো চোখে ঘুম নেই। সারারাত পায়চারি করে, মাটিতে বসে কাটিয়ে দিল প্রায় শখানেক মানুষ। নদীর পানি দিয়ে গোসল করানো হল হায়দারকে। আমি কখনো কোনোদিন এমন শোক দেখিনি। শেষকৃত্যের প্রতিটি পর্বে চোখ মুছছে প্রতিটি মানুষ। অভিমান করে চলে গেল যে বালক তার উপর সকলের অভিমান হায়দারের গোসলের পানির সাথে ধুয়ে নদীতে মিশে গেল যেন। অন্ধকার বিদীর্ণ করে ফজরের আজানের ধ্বনি আছড়ে পড়লো প্রতিটি উঠানে উঠানে। ঘাপটি মেরে বসে থাকা পাখিগুলিও শেষবারের মত হায়দারের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে দূরে কোথাও চলে গেল। দিগন্তে সূর্য একটু একটু করে উপরে উঠলো, আর আমি দেখতে পেলাম নদীর টলটলে পানির ওপর একটা গ্রাম জেগে ওঠার দৃশ্য। যেই দুই একটা টর্চ জলছিল মাঝেমাঝে, সেগুলোও নিভে গেল। জানাজার জন্য হায়দারের মরদেহ যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তার একটু আগেই জ্বলতে থাকা আগরবাতির ধোয়া ভেদ করে, মাথা নুয়ে, আমি আমার মুখটা হায়দারের কানের কাছে নিয়ে গেলাম। কতকিছু বলবার ছিল। বলা হল না। শুধু একটাই প্রশ্ন, তোর উদারতা যারা ধারন করতে পারেনা তাদের ছেড়ে চলে যেতি তুই। রাজা হয়ে রাজ্য ছেড়ে চলে গেলি কেন ভাই?

ফজরের ওয়াক্তে জানাজা শুরু হল। দোয়া পড়ানোর সময় ইমামের কথায় জানতে পারলাম হায়দারের টিউশনি করে পাঠানো টাকায় তার পুরো পরিবার চলতো। হায়দার যেই পাঠাগার বানিয়েছিল সেখানে শ-খানেক বই আছে। এখানে সবাই অপেক্ষা করছিল হায়দার পাশ করে তাদের জন্য কিছু করবে। কিই বা করার ছিল গভীর বন্ধনে জড়িয়ে থাকা গ্রামের নিরীহ মানুষদের? হায়দারকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা কি তাদের দোষ? এত আশা নিয়ে বসে থাকা মানুষদের কাছে শূন্য হাতে ফিরে আসার সাহস হায়দারের ছিল না।

দাফন শেষে আমি ফিরে এলাম ঢাকায়। বাসে করে ঢাকা পৌঁছে আমার আর হলে ফিরে যেতে মন চাইলো না। হাঁটাশুরু করলাম। স্বদেশ সিনেমার নায়ক শাহরুখ খানকে কল্পনা করে একটা দিন কাটিয়েছিলাম কিছুদিন আগেই। একটা অজো পাড়া গাঁয়ে শাহরুখ খান হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাম্প চালু করে সেচের ব্যাবস্থা করেছিলেন। আজকে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমি যেই কাহিনীটার ভেতরে চলে যাব সেখানে হায়দার তার গ্রামে নদীর ঢেউ ব্যবহার করে মিনিহাইড্রো বসাবে। সেখান থেকে ঘরে ঘরে আলো জ্বলবে। শেষ দৃশ্যে দেখা যাবে হায়দার তার পুরানো টর্চলাইটটা যত্ন করে রেখে দিচ্ছে ব্যাগের ভেতর। তারপর হায়দার আর আমি হাঁটছি। শুধু হাঁটছি। আমাদের হেটে চলার শেষ নেই।

 

[লেখাটি প্রথম আলো ঈদ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালে]

লেখার ছবিটি লেখকের আঁকা

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত