এই ফ্লাটের বেলকনিতে দিনভর শুকোতে থাকে বিচ্ছেদ। কিংবা বলা যায়, জমাট অনধিকারের গাঢ় প্রলেপ। সরোজের ইদানীং তা-ই মনে হয়। মনে হয়, পূর্ববর্তী সাবলীলতার মতো এখন আর অগ্রতির কাছে যেতে পারে না, পারে না বলতে ভয় লাগার কথা- আগে যেমন বলতো দুঃস্বপ্ন দেখে ঘেমে আতঙ্কিত হয়ে অগ্রতির কোলে মাথা লুকিয়ে। যেন মাথা লুকোলেই সেই দুঃস্বপ্ন, সেই ভয় আর তাকে গ্রাস করতে পারবে না। সেইসব দিনের স্মৃতিগুলোর সাথে বর্তমান মেলালে বর্তমানকেই খুব দুঃস্বপ্নপ্রবণ লাগে। মনে হয়, হতাশার অন্তিম পর্যায়ে এসে থেমেছে তার জীবনগাড়ি; এটাই যেন শেষ টার্মিনাল, এর পরে আর কোনো অনুভূতি নেই, নেই কোনো স্বপ্নের অনুভব। একটা দীর্ঘশ্বাস মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবার পর সরোজ বেলকনির দিকে তাকায়। কাপড় শুকোতে দেয়া দড়িতে মনে হয় শুকোচ্ছে বিচ্ছিন্ন শোক, হতাশা, অভিমান, দূরত্ব। সেসব শুকোতে শুকোতে আরো শক্ত হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে। কিছু সময় আগেও ওগুলো কাঁচা ছিল, কিছু সময় আগেও অগ্রতি ভাত বেড়ে দিয়ে বলতো, ‘সরোজ, এসো; খেয়ে নাও।’
সরোজ তখন ‘যাই’ বলে আরো কিছু সময় লাগালে অগ্রতি রান্নাঘরে চুলোর আঁচে মুখ লাল করে এসে সরোজের হাত ধরে নিয়ে যেতো। বলতো, ‘আমার অনেক কাজ। এসো তো।’
সরোজের তখন আর কোনো উপায় থাকতো না। রান্না অগ্রতির তেমন একটা ভালো না হলেও সরোজ খেয়ে নিতো স্বভাবতই। এই একটার অপূর্ণতা ছাড়া সরোজ অগ্রতির মাঝে আর কোনো কিছুর কমতি দেখেনি। সব বিষয়ে অগ্রতি পারফেক্ট।
‘এস পারফেক্ট এস সামবডি নেভার ক্যান বি’
মুখ ফুটে অজ্ঞাতেই কথাটা বলে ফেলে। তারপর নিজের মধ্যে এখনো যে অগ্রতির অস্তিত্বটুকু রয়ে গেছে, তা ভেবে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। অগ্রতি যদি এই মুহূর্তে এখানে থাকতো! যদি শুনতে অথবা বুঝতে পারতো সরোজের গোপন অভিসার! কিন্তু কিছুই আর হয়ে ওঠে না।
২.
আনন্দকে তার অফিসের এক কাজে আজকের তারিখটা বলতেই জীবনের ফেলে আসা একটা অধ্যায়ের কথা মনে পড়ে যায় অগ্রতির। আজকের দিনটা কতো আনন্দেই না কাটতো তার আর সরোজের! এমনকি গত বছরেও ওরা খুব জমজমাট করে দিনটা সেলিব্রেট করেছে। অথচ এই এক বছরের ব্যবধানে কী এমন হয়ে গেল যে সব আনন্দই ফিকে হয়ে গেল? মিথ্যে আনন্দ বজায় রাখতেই কি অগ্রতি ‘আনন্দ’ নামের তার অফিসের কলিগকে বিয়ে করেছে? কী এক মোহগ্রস্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে অগ্রতি! পুরনো কথা, ব্যথা, যন্ত্রণা, সরোজের পরকীয়া; হ্যাঁ, পরকীয়াই তো। সে তো হাতেনাতেই ধরেছে সরোজকে আর তার মধ্যবয়সী প্রেমিকাকে। সুন্দর হাসিখুশির দিনগুলোতে অগ্রতি বুঝতে পারেনি যে সরোজ এক্সট্রা মেরিটাল অ্যাফেয়ারে জড়িয়েছে। যেদিন বুঝলো, অর্থাৎ যেদিন রমনা পার্কে নিজে বিষয়টা প্রত্যক্ষ করলো, দেখলো সরোজ আর এক মহিলা হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে সবুজ ঘাস নগ্ন পায়ে মাড়িয়ে, তখন অগ্রতিকে প্রথমে চরম হতাশা ও দুঃখবোধ এবং পরে জেদ ও প্রতিশোধপ্রবণতা চেপে বসলো। অগ্রতি নিজেকে বুঝিয়েছিল যে, মন কখন কার কাছে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়, কেউ জানে না। সুতরাং তার সরে যাওয়াটাই বেটার। বিয়ের ছয় বছর পর এবং তাদের চার বছরের একটা কন্যাসন্তান থাকার পরও অগ্রতি সেপারেট হওয়ার ডিসিশনটাই বেছে নিয়েছিল। সে সরোজকে কিছুই বলেনি। শুধু ডিভোর্স পেপারটা সামনে দিয়ে বলেছিল, ‘সাইন করো আর আমায় মুক্তি দাও।’
৩.
সরোজের কি মনে পড়ে সেদিনের কথা, যেদিন অগ্রতি ওকে ডিভোর্স লেটার দিয়েছিল? মনে পড়ে, চরমভাবে মনে পড়ে। সেই ক্ষত, সেই ব্যথা কি কখনো ভুলে যাওয়ার মতো? প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও সরোজ বুঝতে পারে অগ্রতি তার ব্যাপারে সব জেনে গেছে এবং সবকিছু জেনে, সবকিছু বুঝেই সে এই ডিসিশন নিয়েছে। অথচ সে কীভাবে বোঝাবে যে, সেই ভদ্রমহিলার প্রতি তার সাময়িক কিছুটা দুর্বলতার সূচনা হলেও অগ্রতিই যে তার অন্তিম প্রেম! কীভাবে বোঝাবে যে, অগ্রতি সেপারেট হতে চেয়েছে দেখে তার বুকের সমস্ত রক্ত এক মুহূর্তে শুকিয়ে গেছে! সেই ভদ্রমহিলা অগ্রতির জায়গায় থাকলে কখনোই ভদ্রমহিলার জন্য এমন অনুভূতি হতো না। অথচ সেই মহিলাও তো তাকে প্ররোচনা দিয়েছে, ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে ‘স্যরি’ বলে অজানা রহস্যের হাসি হেসেছে; সেই মহিলাই তো তাকে অ্যাপ্রোচ করেছে নানাভাবে। আর সে-ও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছুটে গেছে সেই মহিলারই পিছুপিছু। কিন্তু অগ্রতি ছেড়ে যেতে চাইছে বলে সব বশ্যতা কেটে যায় সরোজের। অথচ সে কীভাবে বোঝাবে অগ্রতিকে এ কথা! এ যে অব্যাখ্যেয়।
কিন্তু অগ্রতিরও তো ভুল ছিল। সে কেন জেদের বসে তার জুনিয়র কলিগকে বিয়ে করে নিল? কেন? কেন? কেন? এ প্রশ্ন নিজেকেই করে গেছে সরোজ এতোদিন। অগ্রতিকে কখনো করা হয়নি। অগ্রতি সেই ঘটনার পর থেকে আজ পর্যন্ত সরোজের সাথে একটা কথাও বলেনি। শেষ কথাটা ছিল, ‘সাইন করো আর আমায় মুক্তি দাও।’
সরোজ অবশ্য চেষ্টা করেছিল অগ্রতির সাথে কথা বলার- কেমন আছে, না আছে জানার; কিন্তু অগ্রতি কোনো রাঁ করেনি। তাদের ছোট মেয়ে ঐকান্তিকাকে প্রতি সপ্তাহেই দেখতে যায় সরোজ; অগ্রতি আর আনন্দের নতুন বাসায়। সেই বাসায় যেতে নিজেকে খুব ছোট, নীচ মনে হয় তার। সে তাই ঐকান্তিকার সাথে দেখা করতে গেলে ওকে চুপ করে শিখিয়ে দেয়, ‘আম্মুকে বলিও যে তুমি আব্বুর ওখানে যেতে চাও।’ ঐকান্তিকা ওর মা’কে কথাটা বলে হয়তো, কিন্তু অগ্রতির কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। মৌনতাই কি মনের দূরত্বকে আরো দূরে ঠেলে দেয়?
৪.
অগ্রতি কি বুঝতে চেষ্টা করেছে সেদিন সরোজ কি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিল? করেনি। করলেও বা কি, মিথ্যে ব্যাখ্যা ছাড়া কিছু ছিল কি সরোজের কাছে? ছিল না। কেননা হাতেনাতেই ধরা পড়েছিল সে। নিজের চোখে সব দেখেছে অগ্রতি। আর সেই দৃশ্য তো আর মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু… কিন্তু… কিন্তু সে-ও কি খুব তাড়াহুড়ো করে বসলো না! জেদের বসেই আনন্দকে বিয়ে করে নেয়াটা কি ঠিক হলো তার? আনন্দ অবশ্য অফিসের প্রথম দিন থেকেই অগ্রতির পিছুপিছু ঘুরতো, কেয়ার করতো; কলাকুশল হতো তাদের রোজ। তারপর একদিন আনন্দ ভালোবাসার কথা বললে অগ্রতি হেসে উড়িয়ে দেয়। অথচ তবুও আনন্দ নাছোড়বান্দার মতো লেগেই থাকলো। নিজের দুই বছরের জুনিয়র এই কলিগের কাণ্ডকারখানায় অগ্রতি মজা পেতো ভালোই। কিন্তু সরোজের লুকোনো সত্য জেনে যাবার পর একরকম জেদের বসেই সে আনন্দকে বিয়ে করে নিল। আজ, এতোদিন পর অগ্রতির মনে প্রশ্ন জাগল- যা সে করেছে, ঠিক করেছে তো? এতোদিন পর কেন যেন সরোজের প্রতি হারিয়ে যাওয়া এক টান অনুভব করলো আজ। আনন্দের সাথে বিয়ের আটমাসের সময়টা ঠুনকো মনে হলো। মনে হলো যেন কিছুই হয়নি, মনে হলো যেন সরোজ তার সামনে এসে হাতদুটো মেলে দিলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার বাহুবন্ধনে। মিশে যাবে অন্তিম আমোদে, শুঁকবে চির পরিচিত এক গন্ধ, যেই গন্ধ আনন্দের বুকে কখনো পায়নি সে। আজ আনন্দ তাকে তারিখ জিজ্ঞেস করলে, সেটা বলতে গিয়েই অগ্রতির কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে আসে। মুখের কথাটা তার কেঁপে কেঁপে মিইয়ে আসে। আজ ওর আর সরোজের বিবাহবার্ষিকী। আজ থেকে ছয় বছর আগে ওরা সংসার বেঁধেছিল। সংসার না বৈরাগ্য? অগ্রতির কেন জানি খুব আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে মন চায়। যেসব দিন ছিল চির রঙিন, পাতাবাহারের মতো; যেসব দিন ছিল খোলা আকাশে উড়ে বেড়ানো যুগল পাখির মতো অনাবিল। সেসব দিন কি ফিরে পাওয়া যাবে? আচ্ছা, তার ফেলে আসা ডিভোর্স পেপারে সরোজ কি সাইন করেছে?
৫.
সরোজ ড্রয়ার খুলে অগ্রতির ফেলে যাওয়া ডিভোর্স পেপারটা বের করে। ঝুল ও ময়লা জমেছে সেটায়। সেদিন অগ্রতি সরোজকে সাইন করতে বললেও সরোজ সাইন না করে তাকে বোঝাতে চাইলে, অগ্রতি ঐকান্তিকাকে নিয়ে এ ঘর ছেড়ে চলে যায়। সরোজ সেদিন বুঝতে পারেনি সেই যাওয়াই অগ্রতির শেষ যাওয়া হবে। সরোজের এই মুহূর্তে কবি রুদ্র’র ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়’ কবিতাটা খুব মনে পড়ছে। সে যে এখনো পেপারে সাইন না করে ডিভোর্সের সম্মতি দেয়নি, সে কথা কি অগ্রতি জানে? অগ্রতি তো চাইলেও চলে আসতে পারে তার কাছে। মিশে যেতে পারে তার বুকে সারাটা সন্ধ্যাজুড়ে। সরোজও অগ্রতির কোলে মাথা রেখে জয় করতে পারে সকল ভয়।
সরোজ এখনো ভয় পায়, ভয় পেলে কাঁথার নিচে মাথা লুকোয়। কিসের ভয়? নিজের প্রতি নিজেরই ভয় বলে মনে করে সরোজ। সে কি আর একবারও ভয় পেলে অগ্রতির কোলে মাথা রাখতে পারবে না? আজকের বিবাহবার্ষিকীর দিনটি আর আগের বছরের দিনটির মতো নয় বলে খুব ভয় হতে থাকে সরোজের। ভয়ে ঘামতে থাকে অবিরত। ভাবনাগুলো সব এলোমেলো হয়ে যায়। এই মুহূর্তে অগ্রতিকে খুব প্রয়োজন তার। অগ্রতিকে যদি জানাতে পারতো যে, তার জন্য সরোজ স্বাগত ফুল নিয়ে এখনো ফিরে আসার অপেক্ষায় বসে! সে কি একবার ফোন করবে অগ্রতিকে? ফোন করে কি বলবে, ‘অগ্রতি, হ্যাপি অ্যানিভারসারি। আজকের দিনটা শুভ হোক তোমার।’?
৬.
বেলকনির ঝুলে থাকা শূন্য দড়িতে শুকোতে থাকে হাহাকার। একসময় সেটাও শুকিয়ে যাবে। কিছুই আর থাকবে না অবশিষ্ট। সরোজ ইজিচেয়ারে বসে খোলা দৃষ্টিতে বেলকনির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে বারবার অগ্রতির চলে যাওয়ার দৃশ্য মনে পড়তে থাকে। তখন কবিতার একটা লাইন অজান্তেই বেরিয়ে আসে মুখ থেকে-, ‘চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে।’ পূর্বের বেলকনির শূন্য দড়িতে তখন একটা চড়ুই এসে বসে নিজের অস্তিত্বের কথা জানিয়ে দেয় ডানা ঝাপটে।