মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড

তাড়া ছিল। প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশন তিনটায়। প্রায় দুইটা বাজে। সিএনজিতে যাবার টাকা ছিল না। সিএনজিতে যাবার টাকা না থাকলে সাধারণত আমরা ভাবতে ভালোবাসি যে সিএনজিওয়ালাদের যা দেমাগ, কে তাদের হাতে পায়ে ধরতে যায়? তারচেয়ে বাসই ভালো। আমি সেইজন্য বাসের কাউন্টারের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর তখনই একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল আমার পাশেই। আমার তাড়া ছিল। তবু তাকালাম। ছেলেদের যতই তাড়া থাকুক, একটা মেয়ে পাশে এসে দাঁড়ালে তাকানোই নিয়ম। মেয়েটা বয়সে আমার চেয়ে বড়ই হবে। তবে দেখে মনে হয় বয়স বেশি না। মেয়েটার পোষাক বেশ পুরান, কিন্তু সেই পুরানকেই মাড় টাড় দিয়ে নতুন ও পরিপাটি করে তোলার একটা বিশেষ যতœও চোখে পড়ল আমার। আর তাছাড়া মেয়েটার চেহারা খুব মিষ্টি। দুইটা কারণে মেয়েটার চেহারা খুব মিষ্টি। মেয়েটার থুতনির নিচের দিকে একটা ভাঁজ আছে। এই ভাঁজটা সাধারণত মেয়েদের মুখ মিষ্টি করে তোলে। দ্বিতীয় কারণটা হল মেয়েটার একটা গজদাঁত আছে। গজদাঁত সাধারণত মেয়েদের চেহারা মিষ্টি করে তোলে। আর আমি ভাবছিলাম, থুতনির নিচের এই ভাঁজ আর গজদাঁত, আমি হয়ত কোথাও দেখছি। কিন্তু আমার সত্যি খুব তাড়া ছিল।
আমি খেয়াল করে দেখেছি, খুব তাড়া থাকলে আবোল তাবোল ভাবনা বেশি আসে। একদম অপ্রাসঙ্গিক সব ভাবনা মাথায় আসে। খালি মাথায় আসে না, মাথাটা একবারে দখল করে ফেলে। আমার মাঝে মাঝে ক্ষীণ সন্দেহ হয়, হয়ত আমি সিরিয়াস কোনও কাজ সবসময় এড়াতে চাই। সেইজন্য হয়ত আমাকে কেউ অন্য ভাবনায় নিয়ে যায়। কেউ মানে আমিই তো। আমি হয়ত দুইজন। একজন আমি সবসময় পালাতে চাই। আরেকজন আমি’র অত জোর নাই যে তাকে ফাঁকি দেয়।
এই যে আমার এখন তাড়া, প্রেজেন্টেশনটা কিভাবে শুরু করব সেইসব নিয়ে আমার এখন ভাবা উচিত। প্রজেক্টটা পেতে হলে খুব আলাদা করে ওদের নজরে পড়তে হবে। ওদের ইমপ্রেস করতে হবে। আর আমি ভাবতেছি মেয়েটার চেহারা কেন মিষ্টি। হয়ত মেয়েটাকে আমি আগে কোথাও দেখে থাকতে পারি। কিন্তু মেয়েটা আসলে আমার মনোযোগ পায়, কারণ তাকে খুব কনফিউজড দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সে জানে না কোথায় যাইতে হবে, কোন বাসের টিকেট কাটতে হবে। মনে হচ্ছিল, সে বুঝি ইচ্ছা করে বাসস্ট্যান্ডে আসেনাই। কেউ তাকে নিয়ে আসছে। কেউ তো সে নিজেই। সেও হয়ত তাইলে আমার মতো দুইজন। সেইজন্যই হয়ত আমার শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও সে আমার চোখে পড়ে। আর তখন আমার মনে হয়, তাকে বোধহয় আমার সাহায্য করাই উচিত।
কিন্তু আমি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। আমি তাকে এড়িয়ে যেতে চাইলাম। কারণ আমার তখন সম্পূর্ণ মনোযোগ থাকা উচিত সময়ের ব্যাপারে। আমার অন্তত দশ মিনিট আগে পৌঁছনো লাগবে। টয়লেট ফয়লেট সব সেরে ঠান্ডা হয়ে বসতে হবে প্রেজেন্টেশন শুরুর আগেই। ল্যাপটপটাকে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের সাথে কানেক্ট করে নেয়া লাগবে ঠিকমতো। আমি আগেও দেখেছি, এটা অনেক ঘাপলা করে। ঠিক প্রেজেন্টেশন শুরুর মুহূর্তে, কোনও কারণ নাই, ডিসপ্লে আসবে না। এটা গুতাও, সেটা খোলো, হাবি জাবি। একসময় অডিয়েন্স অধৈর্য হয়ে বলা শুরু করবে, থাক ল্যাপটপ দরকার নাই, মুখেই বলেন। প্রেজেন্টেশন দেখায়ে ট্যারা করে দেয়া আর বাহ্বা পাওয়ার আশা তখন শেষ, খালি মুখে তখন বিরক্তিকর বক্তৃতা দিয়েই কাজ সারতে হয়। বিরাট লস। কাজেই এই মুহূর্তে একটা মেয়েকে সাহায্য করার আনন্দ বিসর্জন দিতেই হচ্ছে। তা যতই মিষ্টি চেহারা হোক।
একবার চট্টগ্রাম থেকে ফিরছিলাম। শীতের দিন ভোর ছয়টায় শনির আখড়া এসে বাস বন্ধ। কী হয়েছে? হরতাল। দেখলাম অন্যরা জানত। আমি জানতাম না। অন্ধকারে হাঁটা দিলাম। ঢাকার দিকে। সবাই হাঁটা দিল। হয়ত সবাই দৌড় দিল। অনেকে বাচ্চা কাচ্চা আর বড় বড় লাগেজ নিয়ে ঝামেলায় পড়ল। কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকাল না। আমিও বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বিপদগ্রস্ত মোটা মোটা মহিলাগুলার দিকে তাকালাম না। তাকালেই হয়ত সাহায্য চেয়ে বসবে।
এক্সকিউজ মি! মিষ্টি একটা গলা শুনে তাকিয়ে দেখলাম, সেই সি-ফোরের একা মেয়েটা। আমার ছিল ডি-ফোর। বাসে উঠেই তাকে দেখেছিলাম। আর কপাল চাপড়াচ্ছিলাম, ইস আমি কেন সি-থ্রি পাইলাম না। কেন এই ভোম্বল দাস মার্কা লোকটা সিটটা পেল। যাই হোক, মেয়েটা এবার লজ্জার মাথা খেয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেই বসল, আমি কোনদিকে যাবো?
আর তখন আমি তার একটা লাগেজ ঘাড়ে তুলে নিলাম। আর তখন তার শীত শীত লাগতেছিল বলে আমার চাদরখানা তাকে দিয়ে ধন্য হলাম। একসাথে নানা গল্প করতে করতে কয়েক মাইল হাঁটলাম।
কিন্তু সেটা ছিল অন্য প্রসঙ্গ। তখন হাতে সময় ছিল। তাছাড়া অন্ধকারে মানুষের সঙ্গী দরকার হয়। বিপদে মানুষের সঙ্গী প্রয়োজন হয়। কিন্তু এখন তো তাড়া। এখন এসব দিকে মনোযোগ দিলেই মুশকিল। কিন্তু বাসই তো আসছে না। আমি খুব খেয়াল করে দেখছি, যখন কোথাও দেরিতে পৌঁছতে চাই, তখন কাউন্টারে আসামাত্র বাস এসে হাজির হয়। আর এখন তাড়া, এখন বাসের কোনও খবর নাই। সোয়া দুইটা বাজে। মনে হচ্ছে আজকে লেট হবে।
আমি খেয়াল করছি, যখন তাড়া থাকে তখন আবোল তাবোল কথা বেশি মনে আসে। আজকে নিশ্চয়ই বাসে বেশি ভিড় হবে। তা তো হতেই হবে। আজকে যা সামান্য একটু মাঞ্জা মারছি তা বাসের ভিড়ে ডলাডলিতে পয়মাল হবে, এ তো জানা কথাই। আর আজকে তো আমার সিএনজিতে যাবার পয়সা থাকবেই না।
এরই মধ্যে কাউন্টারের সামনে লোক কম জমেনাই। এতো লোক ডেইলি গুলশান যায়? মোটাসোটা একজন লোক কাউন্টারের লোকটাকে ঝাড়ি দিল। ‘কিরে ভাই গাড়ির খবর কী?’ কাউন্টারওয়ালা বেশি পাত্তা দিল না। মনোপলির ডাঁট। মোহাম্মদপুর থেকে গুলশানের বাস তো একটাই। কাজেই তাদের ডাঁট বেশি।
দুইটা বিশ। শেষ পর্যন্ত বাস আসল। কিন্তু লাইন অনেক লম্বা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এই বাসে জায়গা হবে না। না না হবে হবে। আশা আছে। তখন আমি বিদায় নেবার আগে আরেকবার মেয়েটার দিকে তাকালাম। আর তখন মেয়েটা আমাকে দেখে হাসল। আর তখন আমি দেখলাম মেয়েটার মধ্যে থেকে শিরিন আপা হেসে উঠল। আর তখন আমি বাসে উঠলাম না। আমার পেছন থেকে লোকগুলা বাসে উঠে গেল, বাস ছেড়ে দিল। আর তখন শিরিন আপা আমার দিকে এক পা এগিয়ে আসল।
‘আমার প্রথমেই মনে হইছিল তুমি পিন্টু। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না। তুমি এত লম্বা হইছো?’
আর আমি অনেক্ষণ পর আমার ভেতর থেকে জেগে উঠলাম। আমি যখন জেগে উঠলাম তখন দেখলাম আমি নুরজাহান রোডের একটা বাসায় বসে আছি। খুব ছোটখাটো একটা বাসা। কিন্তু অনেক যতœ করে গোছানো। ফার্নিচার আর পর্দাগুলাতে একইসাথে পুরানো হয়ে ফুরিয়ে যাওয়া আর আপ্রাণ চেষ্টা ও বহু যতেœ সুন্দর করে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। এটা যে একা শিরিন আপার যুদ্ধ সেটাও স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। আমি কেমন করে বুঝতে পারি তা আমি জানি না। কিন্তু এগুলা আমার মনে হয়।
কিন্তু শিরিন আপা যত যতœই করুক, পুরা বাসায় কেমন একটা অসুখ অসুখ গন্ধ। ‘অসুখ অসুখ গন্ধ’ কী তা আমি জানি না। কিন্তু যে গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে, কেন যেন আমার মনে হচ্ছে, এটাই অসুখ অসুখ গন্ধ। আর পুরা বাসাটা খুব বেশি নিরব। শুধু রান্নাঘর থেকে চা বানানোর শব্দ আসছে। আর শিরিন আপা রান্নাঘর থেকেই গলা উঁচু করে আবার বলল, ‘তুমি এতো লম্বা হইছ পিন্টু, আমি তো প্রথমে চিনতেই পারিনাই। তুমি কিন্তু সবসময় একটু খাটো ছিলা। আমরা তো ভাবতাম তুমি বোধহয় আর বড় হবা না।’
শিরিন আপা আমাকে নিয়ে তখন ভাবত? আমি বিশ্বাস করতে পারি না। শিরিন আপা শাহজাদপুরে আমাদের পাশের বাসায় থাকত। আর আমি কত চেষ্টা করতাম তখন শিরিন আপার একটু নজরে পড়ার জন্য। শিরিন আপার সামনে দিয়ে খামাখা ঘুরতাম। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, আর শিরিন আপা তখন দারুণ টগবগে। শিরিন আপার দিকে তখন তাকানো যায় না। শিরিন আপার গায়ের চামড়া তখন টসটস করত। আসলে টসটসও করত না, কী যে করত, বলে বোঝানো যাবে না। আসলে কোনওকিছু দিয়ে বোঝান যাবে না শিরিন আপা কেমন ছিল। শুধু টগবগে বললে তার কিছুটা প্রকাশ করা হয়। আর এই কারণেই শিরিন আপার আর পড়াশোনা হলো না। মফস্বলে শিরিন আপার মতো সুন্দরী একটা মেয়ে বাইরে যেতে পারত না। কেন জানি না, তখন শিরিন আপাকে দেখলে আমার ‘জীবন্ত পাপ’ মনে হতো। এতই সুন্দর ছিল শিরিন আপা।
সেইজন্য তখন শিরিন আপা সবসময় বাসায়ই থাকত। বাইরে কোথাও যেত না। আর আমি শিরিন আপাদের বাসায় খুব যেতাম। শিরিন আপা আমাকে এটা ওটা আনতে দোকানে পাঠাত। আর আমি উড়ে উড়ে যেতাম। ছুটে ছুটে আসতাম। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হতো না। আমি এনে দিলাম, কি ঝন্টু কাকা এনে দিল, কি তাদের কাজের মেয়ে জমিলা এনে দিল, তার কোনও পার্থক্য ছিল না শিরিন আপার কাছে। হয়ত আমাকে টাকা আর স্যাম্পল দিল দোকান থেকে রঙ মিলায়ে ১৪ গিরা কাপড় আনার জন্য, আর আমি রঙ মিলাতে গিয়ে জান দিয়ে ফেললাম। তবু হাজার দোকান ঘুরে একেবারে ঠিক সেই কাপড়টাই এনে দিলাম। আর বিকালে শিরিন আপাদের বাড়ি গিয়ে শুনলাম শিরিন আপা হাসি হাসি মুখে খালাম্মাকে বলছে, ‘ঝন্টুকা রঙটা মিলাইছে ভালোই’। সে বড় দুঃখের ব্যাপার ছিল। আমার বুকটা ভেঙে যাইত।
আর এখন কিনা শিরিন আপা বলছে, আমার লম্বা হওয়া না হওয়া নিয়ে শিরিন আপা ভাবত। এটা ঠিক যে আমি আর লম্বা হব কি না, লম্বা না হলে পুরুষ মানুষ হিসেবে এই হাইট নিয়ে আমার কী ভবিষ্যত হবে, এটা একটা ভাবনার বিষয় ছিল। তখন আমি নাইন টেনে। সেই সময় ছেলেরা ধাম ধাম করে লম্বা হয়ে যায়। আর আমি তখনও পাঁচ ফুট হইনাই। আমার আব্বা, আম্মা আর বড় আপারা এমনকি কাকারা, খালারা এসব নিয়ে ভাবত। চিন্তিত হতো। কিন্তু শিরিনও আপাও আমাকে নিয়ে ভাবছে? আহারে, এতোদিন কেন জানিনাই? তখন যদি কোনওভাবে জানতে পারতাম, আমি এক রাতে এরচেয়ে অনেক বেশি লম্বা হয়ে যেতে পারতাম।
আমি উঠে দাঁড়াই। আমি খাট থেকে নেমে দাঁড়াই। আর আমি মেঝেতে দাঁড়িয়ে, উপর থেকে আমার পায়ের দিকে তাকাই। আমি বড় হইছি, শিরিন আপা, লম্বা হইছি, এই দেখ। এই লম্বা কি যথেষ্ট না?
শিরিন আপা চা নিয়ে এসে দেখতে পায় আমি দাঁড়িয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। শিরিন আপা ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চায় আমি দাঁড়িয়ে আছি কেন। আমি লজ্জা পাই। আমি কোনও সদুত্তর দিতে পারি না। শিরিন আপা একটু হেসে জিজ্ঞাসা করে যে আমি বিস্কুট খাবো কি না। আমি বোকার মতো হ্যাঁ বলি। অবশ্য আমি ‘হ্যাঁ’ বলি না। আমি বলি, ‘খাওয়া যায়’। শিরিন আপা তখন বিস্কুট আনতে উঠে যায়।
আমি শিরিন আপার মুখে প্রথমবারের মতো খুব সুক্ষ্ম একটা কষ্ট লক্ষ করি। হয়ত কষ্ট না, কষ্টের ছাপ। আমি জীবনে শিরিন আপার মুখে কষ্ট দেখিনাই। শিরিন আপা মানেই টগবগে কিছু। শিরিন আপা মানেই হাসি। যতদিন যতবার শিরিন আপার বাসায় গেছি, যতবার শিরিন আপাকে দেখছি, মুখে হাসি। কোনোদিন শিরিন আপার অসুখ করেনাই। কোনোদিন একটু জ্বর হয়নাই। কোনোদিন হাতে পায়ে কোথাও একটু কেটে যায়নাই। শিরিন আপা কোনোদিন ব্যথা পায়নাই। সেইজন্য শিরিন আপার মুখে কষ্ট দেখে আমি খুব চমকে যাই। আর এই এক মুহূর্তেই আমি দেখে ফেলি শিরিন আপার মুখে কষ্টের ছাপ একেবারেই মানায় না।
আমি ভাবতে বসি বিস্কুট খেতে রাজী হওয়ায় শিরিন আপার কষ্ট পাওয়ার কী আছে। বিস্কুট কি নাই? না না, থাকবে না ক্যান? না থাকলে তো শিরিন আপা বিস্কুট খাবো কি না তা জিজ্ঞাসাই করত না। আমি খুব খেয়াল করে দেখছি, আমার অনুভূতি সবসময়ই একটু ভোঁতা। সবকিছু আমি খানিক পরে বুঝতে পারি। আমার সমবয়সী সবাইকে দেখছি ওরা অনেক কিছু মুহূর্তে বুঝে যায়, যেটা আমি বুঝতেই পারি না। পারলেও অনেক পরে পারি। আর তখন আমি বুঝতে পারি শিরিন আপার বাসায় অসুখ অসুখ গন্ধ ক্যান। বুঝতে পারি ক্যান বিস্কুট আনতে উঠে যাবার সময় তাই শিরিন আপার সুন্দর মুখে কষ্টের ছায়া পড়েই মিলিয়ে যায়।
আসলে তখনও বুঝতে পারিনাই। শিরিন আপা কাচের বয়মে রাখা বিস্কুট এনে আমার সামনে খুলে দিয়ে অনেকক্ষণ আনমনা হয়ে বসে থাকে। আমি বুঝতে পারি শিরিন আপা ভাবছে কোথা থেকে কথা শুরু করবে। অনেক্ষণ চুপ করে থাকার পর শিরিন আপা বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে থাকে। আমি কোথায় চাকরি করি, আমার আম্মার আসলে কী হইছিল, হঠাৎ করে মারা গেল ক্যান, আমার বড় বোন ঝর্ণার কোথায় বিয়ে হইছে, বাচ্চা কাচ্চা আছে কি না এইসব অপ্রয়োজনীয় কথা থেমে থেমে জিজ্ঞাসা করে শিরিন আপা। আমি হুঁ হাঁ করে, অল্প দুইএকটা গুরুত্বহীন শব্দে সেইসব প্রশ্নের উত্তর দেই আর ভাবতে থাকি আমিও পাল্টা শিরিন আপার সব কথা জিজ্ঞাসা করব কি না। শিরিন আপার সব কথা কি আমি জিজ্ঞাসা করে করে জেনে নেব, নাকি শিরিন আপার নিজে থেকেই বলার জন্য অপেক্ষা করব? তখন পাশের ঘর থেকে শিরিন আপার হাজব্যান্ড ফরহাদ ভাই ‘শিরিন’ বলে ডাক দেয়।
শিরিন আপা গেলে আমি এই ঘর থেকেই শুনতে পাই ফরহাদ ভাই বলে, কে আসছে? পিন্টু নাকি? এইঘরে আসতে বল। কতদিন পিন্টুকে দেখি না। তখন আমি কারও ডাকার আগেই হাসি হাসি মুখে উঠে ওইঘরে গিয়ে চমকে যাই। আমার বিশ্বাস হয় না এটা ফরহাদ ভাই। প্রথমে আমি ফরহাদ ভাইকে দেখতেই পাইনি। পরে দেখি বিছানার সাথে মিশে আছে হাড্ডিসার একজন মানুষ। কেবল চোখ দুইটার কারণে আমি ফরহাদ ভাইকে দেখতে পারলাম। আমি স্পষ্ট দেখলাম, শিরিন আপা এইটা পছন্দ করল না। কিন্তু এইটাও সত্য যে, শিরিন আপা এতো বড় একটা সত্য আমার কাছে গোপনও করতে পারল না। চেষ্টা করেও পারল না।
ফরহাদ ভাই কিন্তু আমাকে দেখে খুশী হলো। সত্যি সত্যি খুশী। আমি তার চোখ দেখেই সেইটা বুঝতে পারলাম। আর তখন শিরিন আপা আমাকে ওই ঘরে গিয়ে বসতে বলল। আমি ফরহাদ ভাইয়ের কথার কোনও জবাব না দিয়ে এই ঘরে এসে বসলাম। আমি বুঝলাম কেন এই বাসায় এমন অসুখ অসুখ গন্ধ। শিরিন আপা প্রাণপণে সেই গন্ধ ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু শিরিন আপা আর পারছে না।
তখন আমার মনে একটা প্রশ্ন আসল, সেটা হচ্ছে, শিরিন আপা কোথায় যাবার জন্য বাসস্ট্যান্ডে গিয়েছিল আর ক্যান আমাকে বাসায় ডেকে আনল? অনেকদিন পর আমাকে দেখেছে বলে শিরিন আপা কি তার যাওয়া ক্যানসেল করল? আমার তা মনে হলো না। আমার কেন যেন মনে হলো, শিরিন আপা কোথাও যাচ্ছিল না। তাহলে শিরিন আপা নুরজাহান রোড থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে ক্যান গেছিল? আমি এই প্রশ্নের কোনও উত্তর পেলাম না।
খানিক্ষণ পর শিরিন আপা এসে আমাকে আবার জিজ্ঞাসা করল, আমি কোথায় চাকরি করি। আমি বললাম, একটা এনজিওতে চাকরি করি। শিরিন আপা জিজ্ঞাসা করল, আমার অফিসে কোনও চাকরি খালি আছে কি না, আমার অফিস শিরিন আপাকে চাকরি দিতে পারে কি না। শিরিন আপা বলল যে তার চাকরি করার দুই বছরের অভিজ্ঞতা আছে। একটা প্রাইভেট কোম্পানির অফিসে, একাউন্টস ডিপার্টমেন্টে। তখন আমি কিছু বলতে পারলাম না। না, তখন আমি বললাম, দেখি। তখন শিরিন আপা বলল যে তার একটা চাকরির খুব দরকার। ইমিডিয়েট দরকার। আমি জানি যে শিরিন আপাকে দেখলেই যে কেউ তাকে চাকরি দিতে চাইবে। শিরিন আপা এখনও এতো সুন্দর। আমি তাই দেখলাম।
আমার মনে আসলেও আমি শিরিন আপাকে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না যে, শিরিন আপার সেই চাকরিটা চলে গেছে কি না। কারণ, তখন শিরিন আপা আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে আমার মুখে হাত দিয়ে একটা ব্রণের গোটা বের করে আনল। আমার মুখে খুব ব্রণ। আর শিরিন আপা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আমি কেন একদম মুখের যতœ করি না। মুখের যতœ করতে হয়। কারণ মানুষ মুখের দিকেই তাকায়। তখন আমি কোনও উত্তর দিলাম না, তবে শিরিন আপার হাতের স্পর্শে আমি বিদ্যুতস্পৃষ্ট হইলাম। আমি কোনোদিন বিদ্যুতস্পৃষ্ট হইনাই। তবু আমি বুঝলাম, এইটাই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট।
আর তখন আমি টের পেলাম শিরিন আপা এখনও ভীষণই টগবগে। আমি এও খেয়াল করলাম যে ব্রণ বের করার জন্য যতখানি প্রয়োজন, শিরিন আপা তার চেয়ে খানিকটা বেশিই আমার গায়ের কাছে আসল। খুব সামান্য, প্রায় বোঝা যায় না, এতটুকু বেশি। তবু বেশি যে, সেটা স্পষ্ট। তখন আমার শরীরে শিরিন আপার শরীরের স্পর্শ লাগল। আমার সারা শরীরে এক অজানা বিদ্যুত খেলে গেল। এই অভিজ্ঞতা আমার কোনোকালে হয়নি। আমি কোনোদিন কোনও নারীর শরীরের স্পর্শ পাইনি। আর আমি তখন বুঝতে পারলাম না আমার কী করা উচিত।
তখন আমার ভেতরে এক ধরনের হাহাকার আর এক ধরনের আফসোস জন্ম হলো। কয়েক বছর আগে এমন স্পর্শ তো দূরে থাকুক, শিরিন আপার সামনে গিয়ে একবার দাঁড়ানোর জন্য কত অপেক্ষা করে থাকতাম। নানা রকম ফন্দি করতাম শিরিন আপার কাছে যাবার কোনও খুবই প্রয়োজনীয় কারণ বের করার। আর এখন এতো বছর পর শিরিন আপা আমার শরীরের সাথে সেঁটে এসে অসম্ভব সুন্দর আর কোমল হাত দিয়ে খুব যতœ করে আমার মুখ থেকে ব্রণের গোটা বের করে আনে।
শিরিন আপার বিয়ে হয়ে যাওয়া, বিয়ের পর ফরহাদ ভাইয়ের সাথে ঢাকায় চলে আসা, আমার আম্মা মারা যাওয়া, মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্টে ঝামেলা, দৌড়াদৌড়ি, তারপর রেজাল্ট পাবার পর চাকরি খোঁজা আর চাকরি পাবার পর ব্যস্ততা ইত্যাদি হাজার ঝামেলায় আমি সত্যি সত্যি শিরিন আপার কথা ভুলে গেছিলাম। তবু স্যাঁতস্যাঁতে মেসে একলা ব্যাচেলর জীবনের কোনও কোনও রাতে ঘরে ফিরে, একলা অন্ধকারে অতৃপ্ত যৌনজীবনে আমি বহুবার শিরিন আপার কথা ভাবছি। তবু সেইসব ছিল গোপন। এমনকি আমার কাছেও গোপন ছিল। সচেতনভাবে বহুদিন শিরিন আপার কথা আমার মনে পড়েনাই, এটা সত্য।
খুব ক্ষীণভাবে আমার একবার মনে হয়, এটা কোনও উদ্দেশ্য প্রণোদিত স্পর্শ কি না। শিরিন আপা কি আমাকে প্রলুব্ধ করতে চাচ্ছে? ফরহাদ ভাই অনেকদিন ধরে অসুস্থ। তাই যদি না হবে, তাহলে শিরিন আপা আমাকে বাসায় ধরে নিয়ে আসল কেন?
আমি ভাবতে থাকি, শিরিন আপা কী করে? চলে কিভাবে? বাসস্ট্যান্ডে স্বল্প সময়ের মধ্যেও আমি লক্ষ করেছি, তখন শিরিন আপা বাসস্ট্যান্ডে গেলেও কোনও টিকিট কাটেনাই। শিরিন আপা বরঞ্চ সবার দিকে তাকাচ্ছিল। মানুষ দেখছিল। তবে কি শিরিন আপা …? না না। তা কেন হবে? শিরিন আপা তাহলে ক্যান বাসস্ট্যান্ডে গেছিল, আমি তা এই জীবনে কোনোদিন জানতে পারব না। শিরিন আপা কোনোকিছু কিনতেও যায়নি। আমাকে নিয়ে বাসায় আসতে আসতে বলছিল, একটু আগেই বাসা থেকে বের হয়েছে। শিরিন আপা কি রেগুলার বাসস্ট্যান্ডে যায়? মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে?
চা খাওয়া শেষ। আমি কি এখন চলে যাবো? চারটা বাজে। আমি জানি না, কাল অফিসে গিয়ে কী বলব, ক্যান গুলশান গেলাম না? আমার আম্মা মারা গেছে বলব? আমি জানি, আমার অফিসের কেউ জানে না যে আমার আম্মা বেঁচে নাই। কিন্তু আম্মা মারা যাবার পরদিনই কি কেউ অফিসে যায়? তাইলে কি আমি কয়দিন পর অফিসে যাবো? গিয়ে বলব যে ঐদিন আমার আম্মা মারা গেছিল? কিন্তু সেই ক্ষেত্রে তো আমার আজকেই অফিসে ফোন করে বলা উচিত যে আজকে সকালে আমার আম্মা মারা গেছে। কিন্তু অফিস থেকে যদি দেখতে আসে? কলিগের আম্মা মারা গেলে মানুষ সহানুভূতি নিয়ে দেখতে আসে। দাফন কাফনে সাহায্য করে।
আমি দেখেছি, আমি খুব খেয়াল করে দেখেছি, যখন যে বিষয় নিয়ে ভাবার কথা, আমি কখনও সেই বিষয় নিয়ে ভাবতে পারি না। আমি সবসময় অপ্রাসঙ্গিক আর অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে ভাবি। হয়ত এই কারণেই এতো বছরেও আমার কোনও উন্নতি হয়নি। নাইন টেনের মতো এখনও খাটো হয়েই আছি।
আমি একটা কাজ করতে পারি, এখন সোজা গুলশান গিয়ে ওদের বুঝিয়ে বলতে পারি, যুতসই একটা কারণ দেখালে নিশ্চয়ই আমার দেরি ওরা এক্সসেপ্ট করবে। একটা যেনতেন প্রেজেন্টেশন দিলেই চলবে। পরে বলা যাবে ওরা পছন্দ করেনি। অন্য কেউ পাবে প্রজেক্ট। আর তখন আমার মনে হয়, এই প্রজেক্টটা না পেলে আমাদের এনজিওটা বন্ধ হয়ে যাবে। এমনিতে বেতন হচ্ছে না দুই মাস। সবাই মিলে অনেক খেটেখুটে এই প্রজেক্টটা তৈরি করা হয়েছে। আমার প্রেজেন্টেশনের উপর সবার আস্থা আছে বলেই আমার যাওয়া। সারওয়ার ভাইও যেতে চাচ্ছিল। আমি তখন বলছি যে থাক, খামাখা দুইজন যাওয়ার দরকার নাই। কিন্তু এখন চারটা বাজে। আমি এখন কী করি?
আর তখন শিরিন আপা আমার কাঁধে একটা হাত রাখে। আর আমার পিঠে ঠেস দেয়। আর আমি টের পাই শিরিন আপার ভীষণ নিষ্ঠুর, উত্তপ্ত আর সর্বগ্রাসী এক কোমলতা আমার পিঠে চেপে বসছে।
একবার শিরিন আপাদের বাড়ি গিয়ে দেখছিলাম বাসায় কেউ নাই আর শিরিন আপা বারান্দার ইজি চেয়ারে ঘুমিয়ে আছে। আর তখন আমি চুপি চুপি শিরিন আপার একদম কাছে গিয়ে শিরিন আপার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। খুব কাছে থেকে মুখটা ভালো করে দেখছিলাম। মুখের অনেক কাছে গিয়ে প্রতিটা ডিটেল দেখছিলাম। অসামান্য সেই মুখ দেখে তখন আমার বুকের মধ্যে ভয়ঙ্কর ঢিপ ঢিপ শব্দ হচ্ছিল। হৃদযন্ত্রের শব্দের চাপ সহ্য করতে না পেরে একসময় আমি চলে আসছিলাম। তারপর বহুদিন ক্লোজশটের মতো শিরিন আপার কোমল গোলাপি মুখটা তার সকল ডিটেলসহ আমার চোখের মধ্যে লেগে ছিল। চোখ বুজলেও, অনেক সময় চোখ খোলা রেখেও, আমি তা দেখতে পারতাম, শিরিন আপার নাকের ঠিক নিচে উপরের ঠোঁট পর্যন্ত একটা তীক্ষè ভাঁজ, খুব ছোট ছোট সোনালী ভাতলোম, আর কয়েকবিন্দু পরম সৌভাগ্যবান ঘাম। ভ্রুর কাছে কী অসামান্য বাঁক। মানুষ এতো সুন্দর হয়? এতো নিখুঁত হয়? টসটসে দুইটা ঠোঁট সামান্য হা হয়ে ছিল। সেই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প নিঃশ্বাস আসছিল। আমি শিরিন আপার নিঃশ্বাসের অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘ্রাণও পাচ্ছিলাম। তারপর বহুদিন আমি নিঃশ্বাসের সাথে আসা সেই ঘ্রাণ অনুভব করতে পারছি। আর আজকে শিরিন আপা আমার এতো কাছে। শিরিন আপা আমার হাতের মুঠায়। কিংবা আমিই শিরিন আপার হাতের মুঠায়। কারণ আমার হাতের মুঠায় কোনোদিন কিছু আসেনাই।
আমি শিরিন আপার মুখের কাছে মুখ নিয়ে যাই। আর কিছু না, কেবল দেখার জন্য যে তার নিশ্বাসরে গন্ধটা এখনও সেইরকমই আছে কি না। কিংবা হয়ত নতুন কোনও ঘ্রাণ পাবার জন্য। আর তখন আমি ভীষণ অবাক হয়ে দেখলাম যে, শিরিন আপার নিঃশ্বাসে অদ্ভুত সেই গন্ধ এখনও আছে। এটাকেই কি মদির গন্ধ বলে? আমি জানি না। আমাকে কেউ কোনোদিন শিখিয়ে দেয়নি মদির গন্ধ কাকে বলে। আমি শুধু বইয়ে পড়েছি।
এখন আমার আর মনে পড়ে না, তারপর আমি শিরিন আপাকে ঠিক কী বলে উঠে চলে আসছিলাম? বহুদিন আমি চেষ্টা করছি মনে করতে। বহুদিন কেন, সেইদিনই গুলশান যেতে যেতে সারাপথ মনে করতে চেষ্টা করেছি, ঠিক কী বলে আমি চলে আসছিলাম।
আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখিনাই আমার প্রত্যাখ্যানে শিরিন আপা অপমানিত হয়েছিল কি না। আহত দৃষ্টিতে আমার গমন পথের দিকে তাকিয়ে ছিল কি না। আমি অনেকখানি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলাম, আর শিরিন আপারও আপত্তি ছিল না, সেটা আমি পরিষ্কার বুঝেছিলাম। তবু আমি চলে আসছিলাম। শিরিন আপা হয়ত তখন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। শিরিন আপার মতো মেয়ে কোনোদিন প্রত্যাখ্যাত হতে পারে না। হওয়া উচিত না। আর আমি তো আমার জীবনে কোনোদিন কাউকে প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি, আমার সেই যোগ্যতাই নাই। তবু আমি উঠে চলে আসছিলাম। শুধু উঠে চলে আসছিলাম।
আমি ক্যান চলে আসলাম? তখন হয়ত আমার মনে হয়েছিল, শিরিন আপা এইরকম করে প্রতিদিন বাসস্ট্যান্ড থেকে একজন করে নতুন মানুষ বাসায় নিয়ে আসে। আমি এইরকম ভাবতে পারি কিন্তু। কারণ, শিরিন আপার চাকরি চলে গেছে।
শিরিন আপা বলছিল, একাউন্টসে টাকার ঝামেলা হইছিল। শিরিন আপা তদন্ত কমিটিকে দেখিয়ে দিয়েছিল টাকার ঝামেলাটা কোথায়, তাও শিরিন আপার চাকরি থাকেনাই। হয়ত মানুষ সুন্দর সহ্য করতে পারে না। শিরিন আপার সৌন্দর্য সত্যি সহ্য করার মতো না। কিন্তু তত্ত্ব কথা যাই হোক, সত্য হলো যে শিরিন আপার চাকরি চলে গেছিল। সত্য হলো, ফরহাদ ভাই আর বাঁচবে না। না বাঁচাই ভালো। কিন্তু সত্য হলো, শিরিন আপার বোঝা হয়ে কিংবা শিরিন আপার অসাধ্য ভীষণ বড় একটা খরচ হয়ে এখনও বেঁচে আছে ফরহাদ ভাই। এই খরচ কোথা থেকে জোটে শিরিন আপার? আর দুই তিন বছর ধরে শিরিন আপা শারীরিকভাবেও তো বঞ্চিত। আর সবচেয়ে বড় কথা, শিরিন আপা যে বাসস্ট্যান্ডে গেল, টিকিট তো কাটল না, কাউকে তো জিজ্ঞাসা করল না, অমুক জায়গায় যাবার বাস কোথায়? কীভাবে যাবো? সেইসব না করে বরং শিরিন আপা বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হওয়া লোকগুলার মুখের দিকে এক এক করে তাকাচ্ছিল, আমি দেখেছি। ডিডাকশন করলে কী দাঁড়ায়? তবু আমি নিশ্চিত হতে পারি না। আমি তো ভুলও দেখতে পারি। এর সবই হয়ত আমার ধারণা। আমার কল্পনা। না পাওয়ার ঈর্ষাপ্রসূত কল্পনা।
অথবা, আমার হয়ত তখন মনে হয়েছিল, এখনও গুলশান যাবার সময় আছে। গিয়ে ওদের বুঝালে, একটা ভালো কারণ দেখাতে পারলে হয়ত ওরা বুঝবে। হয়ত আমি প্রেজেন্টেশনটা তাদের দেখতে রাজী করাতে পারব। হয়ত এমনকি আমি তাদের ইমপ্রেসও করতে পারব। হয়ত আমি গিয়ে ওদের বলতে পারি, আমার আম্মা অসুস্থ্য, ভীষণ অসুস্থ্য, বাঁচবে না, তবু আমি আসছি। ওরা হয়ত তখন সিমপ্যাথি দেখাবে। প্রজেক্টটা পেতে হলে আমাদের সিমপ্যাথির বড় প্রয়োজন। ওরা তো আর আমার মেসবাড়িতে এসে ভেরিফাই করবে না, সত্যিই আমার আম্মা মারা গেছে কি না। প্রজেক্টটা পাশ না হলে চাকরি তো চাকরি, এনজিওটাই বন্ধ হয়ে যাবে। সবাই মিলে গত তিনদিন ধরে এতো খাটাখাটনি করে প্রেজেন্টেশনটা তৈরি করলাম। তাছাড়া আমার একার চাকরিও তো না, এতোগুলা মানুষের চাকরি। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি উঠে আসার আগে শিরিন আপাকে হয়ত বলছিলাম, আচ্ছা আজ তাহলে যাই। আমার একটু তাড়া আছে। অথবা আমি হয়ত কিছুই বলিনি। আমার এখন আর মনে নাই। আমি হয়ত পালিয়ে আসছি। যেমন করে একদিন ঘুমন্ত শিরিন আপার মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে আমি তার সুন্দর, অসম্ভব সুন্দর মুখটা একবার দেখে পালিয়ে আসছিলাম। আর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখার সাহস পাইনি। কিন্তু আমার এখন কেন যেন মনে হয়, সেইদিনও শিরিন আপা ঘুমিয়ে ছিল না। আমি চলে আসার সময় পেছন থেকে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। শিরিন আপার চোখে তখন কী ছিল? হায়, আমি কোনোদিন তা জানতে পারব না।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত