আবুবর- ঘোড়া পাছায় হাঁটছেন (শেষ পর্ব)


ঘুম থেকে উঠেই আবুবর সাহেব বুঝতে পারলেন, পাছাটা তাঁর ভারি হয়ে গেছে। কোমর থেকে শরীরটাকে কে যেন টেনে ধরেছে নিচের দিকে। পাছার দিকে তাকালেন তিনি, সত্যিই স্ফিত হয়ে উঠেছে পেছনটা। বুনো ষাঁড়ের পাছার মতো থাবলে থাবলে জেগে উঠেছে মাংসগুলো। শরীরের এই স্ফীতির মধ্যে কী এমন শক্তি পয়দা হতে পারে বুঝতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাইব্রিড গরুর মতো মরে যাবেন না তো!
তিনি চিমটি কেটে মোচড়ালেন মাংসগুলো। সেটা মূলত রাগ কমানোর জন্য। বিরক্ত লাগছে তাঁর। একটা বুনো জেদ মহিষের শক্তি হয়ে জেগে উঠে ভর করছে শরীরের ভেতর। তিনি যেন মহিষের মতো ফোঁসফোঁস করে ছুটবেন এখন।
মিটিংয়ে তাঁর ফুঁসে ওঠা ঠিক হবে না। তিনি শান্ত থাকার খুব চেষ্টা করলেন। আজ কোনোভাবেই রেগে যাবেন না। মিটিংয়ে কোনো কথাই শুনবেন না। বলবেন না কোনো কথা। দেখবেন না। জাস্ট মিটিংয়ে থাকতে হয় বলে থাকবেন। আর তা-ও যদি অসহ্য হয়ে ওঠে, অসুস্থ বলে মিটিং থেকে বেরিয়ে যাবেন।

হলোও তা-ই। মিটিং শুরু হলো স্কুলের ল্যাবরেটরি, পেশাবখানা আর নামাজের জায়গা নিয়ে। তাঁর বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিটা ছোট করা হবে। তিনি মানতে পারছিলেন না। এত সযত্নে গড়া ল্যাবরেটরি এমনিতেই ছোট। তিনি আপত্তি করতে থাকলেন। হেডস্যারসহ অন্যরা মানছেন না। সেখানেই করতে হবে। ল্যাবরেটরির জায়গা কি তাঁর বাপের জায়গা নাকি? এত জেদ কেন তাঁর? পরে কোথাও ল্যাবরেটরি বানানো যাবে। পাশের দেয়ালটা ভেঙে নামাজ পড়ার জায়গা বানাই আগে। তারপর ল্যাবরেটরি কোথায় হবে দেখা যাবে। অযথাই এত বড় জায়গা ধরে রাখার প্রয়োজন আছে?
– অযথা? তিনি ঘামতে লাগলেন। বুঝতে পারলেন, তাঁকে শান্ত থাকতে হবে। বললেন, আরো তো জায়গা আছে, সেখানে নামাজের ব্যবস্থা করা যায়। তাছাড়া ল্যাবরেটরিতেও নামাজ পড়তে পারে কেউ, বাধা তো কেউ দিচ্ছে না। কিন্তু ল্যাবরেটরি হাওয়া করতে হবে? গায়েব করতে হবে বিজ্ঞান চর্চা?
– ঘোড়ার ডিমের চর্চা! আরে ওমন ঢঙের চর্চার জন্য ঘর রেখে লাভটা কী?
তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। শান্তভাবেই বললেন, আপনাদের যা ইচ্ছে করেন।
এরপর তিনি মিটিং রুম থেকে বের হয়ে বাসার দিকে হাঁটা ধরলেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি খেয়াল করলেন, ছাত্রছাত্রীরা তাঁর দিকে ঠাট্টার ছলে তাকাচ্ছে। লজ্জা লাগছে তাঁর। শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছে। তার পরই বুঝতে পারলেন, তাঁর স্ফীত হয়ে ওঠা পচ্ছদেশ নিয়ে হাঁটার কারণে হাসাহাসি করছে ওরা।

তিনি খুব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে নিলেন। দ্রুত হাঁটতে লাগলেন বাড়ির দিকে। হাঁটছেন না যেন দৌড়াচ্ছেন তিনি মহিষের মতো। তাঁর দৌড়ানো দেখে আরো জোরে হাঁসছে সবাই। তিনি আরো দ্রুত ছুটতে লাগলেন বাড়ির দিকে। কিন্তু তিনি বাড়িতে গেলেন না, গেলেন রতন স্যারের বাড়িতে। এক দৌড়ে রতন স্যারের বাড়ির উঠানে পৌছে তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে স্যারকে ডাকলেন।
– রতন! রতন!
রতন স্যার ডেমনসট্রেটর হিসেবে আট লক্ষ টাকা দিয়ে স্কুলে নিয়োগ নিয়েছেন তিন বছর আগে। তিনি আজ মিটিংয়ে ছিলেন না। ক্লাসে হাজিরা দিয়েই চলে এসেছেন বাড়িতে। আবুবর সাহেবের উত্তেজিত কণ্ঠ শুনতে পেয়ে তিনি বাইরে এসে দেখলেন ষাঁড়ের মতো হাঁপাচ্ছেন স্যার। ফোঁসফোঁস করছেন আর হাত-পা ঝটকাচ্ছেন। নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে তাঁর। চোখ লাল টকটকে হয়ে উঠেছে।
– কী শুরু করেছে রতন? কী হচ্ছেটা কী?
পেছনের পা দিয়ে যেন মাটি ছুঁড়ে বলতে লাগলেন আবুবর সাহেব।
– কোনটা স্যার?
– ল্যাব বন্ধ করে দিবে? বিজ্ঞান চর্চা হবে না? কি বলতে চায় ওরা?
রতন স্যার বুঝতে পারছেন আবুবর স্যার খুব রেগে গেছেন। তিনি তাঁকে ঘরে নিয়ে বসালেন। স্যারের এমন ভয়ঙ্কর মূর্তি তিনি আগে কখনো দেখেন নাই। তিনি দৌড়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে মায়ের হাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে পাঠালেন আর বললেন মা স্যারকে মনে হয় ভুতে ধরেছে।
মা আবুবর সাহেবের কাছে এলেন।
– কী হয়েছে বাবা? এমন অবস্থা কেনো তোমার?
– কিছু হয়নি খালাম্মা। রতন কই ওকে ডাকেন।
– আসতেছে বাবা। তুমি শান্ত হয়ে বসো।
– না বসবো না ওকে ডাকেন।
– বহুদিন পরে এসেছে অস্থির হইয়ো না। ঠান্ডা পানিটা খাও তো বাবা।
বলেই মা বিড়বিড় করে সুরা পড়ে পানিতে ফু দিলেন। এরপর পরাপানি গায়ে ছিটিয়ে দিলেন আবুবর সাহেবের গায়ে।
পানির ফোঁটা পড়া মাত্র আবুবর সাহেব শিহরিত হলেন। আস্তে আস্তে নরম হতে থাকলেন মানুষটা।
– ধরো মুখ হা করো, দু’ঢোক পানি খাও।
মায়ের কথামতো মুখ হা করলেন আবুবর সাহেব। চুপচাপ পানি খেলেন। যেন বশ হয়ে গেছেন তিনি। এতোটা দ্রুত বশ মেনে গেলেন যে রতন স্যার অবাক হয়ে গেলেন। আবুবর সাহেব আর একটি কথাও বলছেন না। মা চুপচাপ সোফায় এসে বসতে বললে তিনি তাই করলেন। পানি দিলে পানি খেলেন। জবাই করা ষাঁড় যেমন জান ছেড়ে দেয়ার সময় শেষবারে দম ছাড়ে, তেমনি যেন শ্বাস ছেড়ে দিয়ে আবুবর সাহেব নিস্তেজ হয়ে বসে পড়লেন সোফার মধ্যে।
মা খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলেন।
রতন স্যার মোরগ জবাই করে এসে দেখেন আবুবর সাহেব নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। জন্তুর মতো পালোয়ান এক শরীর শিশুর মতো নরম হয়ে নিস্তেজ পড়ে আছে দেখে রতন স্যারের মায়া হলো। তিনি পেছনের দিকে চলে এসে আবুবর সাহেবের পা থেকে জুমো খুলে দিলেন। তার মা সহ কোনোমতো ধরে আবুবর সাহেবকে সোফাতেই ভালোমতো শুয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন।
আবুবর সাহেব দেখলেন রতন স্যার পা ধরে টেনে পাছাটা দুই দিকে চিড়ে ধরে গোটা মেরুদণ্ডটা টেনে টেনে বের করছেন। ঠিক যেমন করে অর্ধগলিত মাছের শরীর থেকে কাটার হাড়কঙ্কাল টেনে বের করা যায় তেমনি করে আস্ত মেরুদণ্ডটি বের করে ফেলছেন। তিনি মেরুদণ্ডহীন একদলা মাংস হয়ে যেন পড়ে আছেন সোফার ওপরে। তিনি ছটফট করতে লাগলেন। চিৎকার করলেন উঠার জন্য। উঠতে পারছেন না। তাঁকে যেন জোর করে ঠেসে মেরুদণ্ডহীন দলা পাকানো মাংস বানানো হচ্ছে। এক ঝটকা দিয়ে তিনি সবাইকে উল্টে ফেলে দিয়ে ঘুম থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
– কে কে? আমি এখানে কেনো?
– স্যার আপনি এখানেই এসেছিলেন।
– এখানে এসেছিলাম?
– জি স্যার। আপনি উৎভ্রান্ত ছিলেন। আর হাঁপাচ্ছিলেন। আর কি যেন বলছিলেন আমাকে।
আবুবর সাহেব চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। ঘুমের তন্দ্র তাঁর ভেঙে গেছে। তারপর বললেন, হুম রতন। ওরা বিজ্ঞান শেখাতে চাইছে না।
– জি স্যার। কিন্তু ওরা যখন চাইছেন না তখন আপনি কেনো চাইছেন স্যার? তাঁরা যা ইচ্ছা করুক না। আপনি এতো অস্থির হচ্ছেন কেন? আপনি বাড়িতে ল্যাব তৈরি করেছেন না? দেখেন আমিও তো করেছি। ঐ যে দেখেন। প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি ল্যাব তৈরি করব। সম্যাসা কি? ব্যবসা তো হবে।
– মানে কি?
– না মানে স্যার আমরা তো বাসায় প্রাইভেট পড়ায়ে শেখাতে পারব তাদের।
আবুবর সাহেব কটমট করে রতন স্যারের দিকে তাকালেন। তারপর তার ল্যাবের দিকে তাকালেন। এটা ল্যাব নয়, বিশাল গোয়ালঘর। ক’দিন আগেও গরু ছিল ওখানে। তার থাকার ঘরটা ভেঙে তিনতলা বাড়ি করা হচ্ছে বলে তিনি গরুগুলো বের করে ওখানে ছাত্রছাত্রীদের পাড়াচ্ছেন এখন। আবুবর সাহেব আস্তে আস্তে উঠে গেলেন ঘরটির দিকে। দেখলেন আশপাশের কয়েকটা স্কুলের ছেলেমেয়েরা ভরপুর ঘরে হৈ-হুল্লোর করছে।
রতন স্যার বললেন, এটা ভেঙে তিন তলা বাড়ির কাজ ধরেছি স্যার। চাকরিটা নেয়ার সময় যে জমিগুলো বিক্রি করে অঅর কিছু বন্ধক রেখে টাকার ব্যবস্থা করেছিলাম, এখন সব ফেরত এনেছি।
আবুবর সাহেব রতন স্যারের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু তাঁর দুষ্টি রতন স্যারের দিকে নেই। অগ্যতা তিনি বলে উঠলেন, হ্যা কি যেন বলছিলাম রতন? হ্যা বলতো আমি কার কাছে কি বলতে এসেছিলাম? কেনো এসেছিলাম?
কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে রতন। গোলমাল হয়ে গেছে। তিনি নীরবে বের হয়ে আপন মনে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন।
পেছন থেকে রতন স্যার তার মা সহ তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করছেন। কিছুতেই পারছেন না আটকাতে। তঁরা বুঝতে পারলেন স্যারকে আর আটকানো যাবে না। অগ্যতা তাঁকে যেতে দিলেন তাঁরা।
যেতে দিলেন, কিন্তু তাঁরা তাকিয়ে থাকলেন আবুবর সাহেবের চলে যাওয়ার দিকে।
আবুবর সাহেব একবারও ঘাড় না ফিরায়ে ঘোড়া পাছায় আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলেন। একা, আপন মনে রাস্তার ধার ধরে ছাতা মাথায় ঘোড়া পাছায় যেন যুগযুগান্তর হাঁটছেন তিনি এখন। (শেষ)


শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ

৯. আবুবর- ঘোড়া পাছায় হাঁটছেন
 পর্ব – ১. আবুবর- ঘোড়া পাছায় হাঁটছেন
পর্ব – ২. আবুবর- ঘোড়া পাছায় হাঁটছেন
পর্ব – ৩ .
আবুবর- ঘোড়া পাছায় হাঁটছেন

৮.  আবুবর- কোনোকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত