২
আবুবর সাহেবের মতে, হেডস্যারকে ‘মাকড়সা’ বললে ‘নরখাদক’ লাগানো দরকার হয় না। কারণ মাকড়সা এমনিতেই নরখাদক। বরং স্যারকে মাকড়সা যদি বলতেই হয়, তবে ‘পোর্শিয়া মাকড়সা’ বলা উত্তম। কারণ পোর্শিয়া মাকড়সা হচ্ছে সুযোগসন্ধানী, সিনেমার ভিলেনের মতো। আর তার পাছায় থাকে জাল বোনার মেশিন। তাছাড়া পোর্শিয়া অন্য মাকড়সার ভাষা রপ্ত করে হুবহু নকল করতে পারে। সুবিধাবাদী হয়ে কোনো মাকড়সার সাথে খাতির জমিয়ে জালের সুতোয় কৌশলী সাড়া দেয়। তার পরই কাছে টেনে নিয়ে নিমেষেই কাবু করে শিকার বানিয়ে ফেলে মাকড়সাদের। এরপর আস্তে আস্তে তিলে তিলে খায়। অনেক পুরুষ মাকড়সা তো আপনা থেকেই তার কাছে মরতে আসে। যেমন তেলবাজ রতন স্যার।
কথাটা অন্য স্যারদের খুব পছন্দ হয়। দ্রুত ছড়িয়ে যায় চারদিকে। সবাই বলে, আবুবর সাহেব হেডস্যারকে ‘পোর্শিয়া মাকড়সা’ উপাধি দিয়েছেন।
তবে হেডস্যারের কান পর্যন্ত কথাটা যায় কি না কেউ নিশ্চিত হতে পারেন না। না গেলেও সবাই হেডস্যারকে আড়ালে ‘পোর্শিয়া’ বলে ডাকেন।
অন্যরা ডাকলেও আবুবর সাহেব ডাকতে পারেন না। তবে তিনি বহুবার মনে মনে ভেবেছেন, আরেকবার যদি মাকড়সা গবেষক বলেন স্যার, তবে তিনি উচিত জবাবা দিবেন। বলবেন, জি স্যার, পোর্শিয়া মাকড়সা নিয়ে গবেষণা করছি। আর সেই মাকড়সাটি হচ্ছেন আপনি। দারুণ না স্যার? নিশ্চয়ই কথাটি শুনে স্যার এখন ব্যাঙের মতো লাফাবেন। লাল হবেন, ফুলবেন আর লাফাবেন। কেমন হবে দেখতে?
– কী ভাবছেন মাকড়সা গবেষক, আমাকে মাকড়সা ভাবছেন, তাই না?
বেশ লজ্জায় পড়ে গেলেন আবুবর সাহেব। কান গরম হতে থাকল তাঁর। মনের কথা স্যার ধরে ফেলেছেন। হেডস্যার আরো বললেন, আসেন, ক্লাস শেষ করে আসেন। একটা মিটিং করি। সবাইকে বলেন মিটিং রুমে আসতে। মাকড়সা নিয়ে জরুরি মিটিং।
আবুবর সাহেবের কান গরম হতে থাকল। মনে হলো, চ্যাপটা হচ্ছে কান। কানের লতি নেমে যাচ্ছে। আবুবর সাহেব লজ্জিত হয়ে চক-ডাস্টার হাতে নিয়ে ক্লাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতেই বুঝতে পারলেন, কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে তাঁর। কানগুলো শুধু হাতির কানের মতো বড় হচ্ছে না, বেশি বেশি শুনতে পাচ্ছেন তিনি। বড় কানের জন্য হাতি কি বেশি শুনতে পায়? জানা থাকলে ভালো হতো। তাঁর মনে হচ্ছে, তিনি বেশি বেশি শুনছেন।
প্রধান শিক্ষক অফিস রুমে বসেছেন। রুমের ভেতর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ বসে আছেন। স্যারের সঙ্গের লোকেরা অতিমাত্রায় তাল মিলিয়ে হাসছেন, জি হুজুর জি স্যার বলছেন। গল্পে মশগুল হলেন তাঁরা। আবুবর সাহেব ক্লাসে চলে গেলেন।
ক্লাসের টেবিলে চক-ডাস্টার রেখেই চেয়ার টেনে বসলেন। কিন্তু চেয়ারে বসতে গিয়েই বাঁধল বিপত্তি। চেয়ারটা আঁটসাঁট হয়ে গেছে যেন। তাঁর শরীর-পাছা চেয়ারে খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে না। তবু ঠেসে বসলেন। এতটা মোটা তিনি নন। হঠাৎ করে পচ্ছদেশ এতটা স্ফীত হওয়ার কথা না। বুঝতে পারছেন না এটা রোগ কি না। তবে বিশেষ বিশেষ সময়ে এই অবস্থা তৈরি হচ্ছে। কান গরম হচ্ছে, চ্যাপটা হচ্ছে। আর এখন পাছা মোটা হচ্ছে। মনের কথা হেডস্যার ধরে ফেলার কারণে এমন হতে পারে, বিব্রত অবস্থা তৈরি হলে, বেইজ্জতি অবস্থায় পড়লে, সম্মানবোধে আঘাত লাগলে, তখন হচ্ছে। শুধু কি তখনই হচ্ছে? বুঝতে পারছেন না।
ক্লাসে মন বসছে না তাঁর। ছেলেমেয়েরা হইচই করছে। বিরক্ত লাগছে।
– এই, তোমরা চুপ হও।
– স্যার, আমরা তো চুপচাপই আছি। ম্যানম্যান করে বলল মাথা মোটা আব্দুর রহমান। অন্য ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে নীরব তাকিয়ে স্যারের দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু স্যার হাতের ডাস্টারটা জোরে টেবিলের ওপরে মেরে শব্দ করে বললেন, চুপ হও।
চুপচাপ ক্লাস। তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে ভার উত্তোলনের দুটো পদার্থের অঙ্ক কষতে দিয়ে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। ঝিম ধরে থাকলেন কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করে টেবিলের উপর ডান হাতের কনুই ঠেকিয়ে থুতনি ধরে মাথাটা আটকে রাখলেন হাতের মুষ্টিতে। ঝিমাচ্ছেন তিনি আর ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছেন। জরুরি মিটিং ডেকেছেন হেডস্যার। মিটিং হবে মাকড়সা নিয়ে। তখন সবাই বলবে, বুদ্ধিটা আবুবর সাহেবের।
(চলবে…)
শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ
৯. আবুবর- ঘোড়া পাছায় হাঁটছেন
পর্ব – ১. আবুবর- ঘোড়া পাছায় হাঁটছেন
৮. আবুবর- কোনোকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই
৭. মাকড়সার জালে অনাথের হাসি