৩
একটা বিষয় বুঝতে পেরেছেন আবুবর সাহেব, শরীরটা বিকৃত হতে শুরু করলে তাঁর হিম্মতে একটা শক্তি পয়দা হয়। পা লম্বা হলে লাথি দিয়ে সবকিছু ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই যে শব্দ বেশি শুনতে পাচ্ছেন, এই যে পাছা মোটা হয়ে গেল, এর দ্বারা কী পয়দা হবে বুঝতে পারছেন না। তিনি কি মোটা পাছায় বসে উশুমাতি মুরগির মতো ডিম পারবেন এখন? নাকি পাছায় কোনো শক্তি উৎপন্ন হবে? অনুভব করার চেষ্টা করলেন শক্তির জন্য। মাথার মগজ যেন প্রশস্ত হয়ে যাচ্ছে। তিনি সবকিছুই বুঝতে পারছেন। স্পষ্ট দেখতে থাকেন কারা কী ভাবছে আর কোন গোপন মতলব প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থে কারা কিভাবে মাতোয়ারা হয়ে জোট তৈরি করে গোটা স্কুলটাকে গিলে খেতে চাইছে।
এর আগেও বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে তাঁর। কিন্তু তিনি কঠোর প্রতিবাদ করতে পারেন না। নিজে নিজে ঘামতে থাকেন। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ আর ঘৃণায় এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে একসময় বেসামাল হয়ে পড়েন। তখন তাঁর যা করা উচিত তা করতে পারেন না। বরং ভিন্ন কিছু ঘটনা ঘটিয়ে ফিরে আসেন। যেমন ভোটকেন্দ্রে লাথি মারার ঘটনা। যেমন তাঁর ছোট শালির হাসি বিষয়ক সমাধান।
একবার দেখতে পেলেন, হেডস্যার জরুরি মিটিং ডেকেছেন। মিটিংয়ের উদ্দেশ্য তাঁর ছোট শালির হাসি। ছোট শালির নাম তনু। তনু খিলখিল করে হাসে। এটাই দোষ। এতে নাকি ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধা হয়। মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। শুধু ছাত্রছাত্রী না, স্যারদেরও সমস্যা হয় বলে জরুরি মিটিং ডাকা হয়েছিল। তাই তাঁরা মনে করেছিলেন, স্কুলে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের হাসির একটা নিয়ম থাকা দরকার। যেমন পরিধানের নিয়ম, স্কুলে আসা-যাওয়ার নিয়ম, আদব-কায়দার নিয়ম, সেই রকম একটা নিয়ম থাকা চাই হাসির ক্ষেত্রেও। ঠিক কতটুকু হাসা যাবে সেটা যেন নিয়মমতো হয়। সেই নিয়মগুলো নিয়ে আইন তৈরি করা হবে। এই স্কুলের আইন। এই আইন অমান্য করলে জারিমানা দিতে হবে।
– কিন্তু স্যার, হাসি নিয়ন্ত্রণ আইনের থেকে নেশাগ্রস্ত ছেলেদের নেশা থেকে ফেরানোর ব্যবস্থা করেন। নেশা শেষ করে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
– এর কারণ হচ্ছে লেজুড়বৃত্তি। আবুবর সাহেবের কথা থামিয়ে দিয়ে তারেক স্যার বললেন।
– লেজুড়বৃত্তি মানে? হেডস্যার জানতে চাইলেন।
– লেজুড়বৃত্তি মানে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি। সেখান থেকে শক্তি পেয়ে তারা কারো কথা মানছে না।
– আপনি কি মনে করেন নেতারা এসে লেজুড়বৃত্তির শক্তি এনে ঢেলে দিচ্ছে ওদের গায়ে? আর ওদেরকে বললেই ওরা ওখান থেকে সরে যাবে?
– শুধুই নেতারা না, প্রশ্রয়দাতারা সবাই তাদের ব্যবহার করছে।
– কিন্তু তারা তো স্কুলে নেশা করছে না।
– করছে না মানে? সবখানেই করছে। আপনি দেখছেন না শুধু।
– তাহলে আমাকে দেখান। দায়িত্ব নেন। কিন্তু শুনেন, স্কুলে যতই বলেন যে ব্যবস্থাই নেন, এসব পরিবার, সমাজ থেকে আসতে হয়। যে দেশের সমাজব্যবস্থাই ঠিক নাই, সেখানে আপনি-আমি কতটুকু করতে পারি? তার পরও করতে হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য যা দরকার করব। কেউ নেশা করলে প্রথমেই জরিমানার ব্যবস্থা করেন। গার্ডিয়ানকে ডেকে শাসন করেন। না হলে স্কুল থেকে বের করার ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া আমাদের কী করার আছে?
– অনেক কিছুই করার আছে স্যার। আবুবর সাহেব বললেন। এতক্ষণ তিনি চুপ ছিলেন। অন্যরা সবাই তাঁদের নানান যুক্তি দিচ্ছিলেন। এবার তিনি গরম হয়ে উঠলেন। কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিলেন প্রধান শিক্ষক। বললেন,
– শুনেন ভাই, এক বিষয়ে আরেকটা ঢুকাবেন না। যেটা নিয়ে মিটিং ডাকা হয়েছে সেটা আগে শেষ করেন। তাছাড়া সমাজ ঠিক করার জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠানই শুধু চুক্তি নেয় নাই। এসবের জন্য সরকার আছে। তারা দেখুক।
– তাছাড়া তারা রাজনীতি চর্চা করলে দোষ কোথায়? তাদের বুঝতে তো হবে রাজনীতি কী। আমার মনে হয় আবুবর সাহেবের ধারণা ছেলেরা রাজনীতি করছে বলে নেশাগ্রস্ত হয়ে গেছে। এমনটা নয় আবুবর সাহেব। দু-একজন বখাটে এমন হতেই পারে। সবাই না। তারাই তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, কেন তারা রাজনীতি বুঝবে না?
প্রধান শিক্ষকের কথার সুর ধরে ইংরেজির জাহাঙ্গির আলম স্যার সাফাই গাইলেন। আবুবর সাহেব শান্তভাবে বললেন, রাজনীতি চর্চার জ্ঞান অর্জনের চেয়ে তারা লেজুড়বৃত্তি, চামচামি করে। তাছাড়া স্কুলের ছাত্রদের দলীয় রাজনীতির দরকার আছে কি না সেটা নিয়ে ভাবেন। তারা ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং তারা দিনকে দিন বিজ্ঞান থেকে সরে যাচ্ছে।
– বিজ্ঞান ক্লাসের কথা বলে কী শেখান আপনি? ধর্মবিরোধী কথা শেখান। শেখান ডারউইন, নিউটন-যত্তসব নাস্তিকের কথা। আপনাকে শেখাতে হবে ধর্মে যে বিজ্ঞান আছে সেইটার মতো। তা না হলে ছাত্ররা মজা পাবে কেন? মজা করে তো শেখাতেও পারেন না আপনারা। তাই ছেলেরা ক্লাস না করে বাইরে আড্ডা দেয়।
– কী ভয়ানক কথা বলছেন স্যার আপনি? একজন প্রধান শিক্ষক হয়ে আপনি একথা বলতে পারেন না।
– আপনার কি ধারণা উনি না বুঝে কথা বলছেন? তারেক স্যার আবুবর সাহেবের কাছে জানতে চাইলেন।
– আমার তা-ই মনে হচ্ছে। আর যদি বুঝে বলে থাকেন, তাহলে তিনি জঘন্য কথা বলেছেন। কিন্তু আবুবর সাহেব অনড়। স্থির তাঁর দৃষ্টি। কণ্ঠ ভরাট।
– কী জঘন্য কথা! ধর্মের মতো করে বিজ্ঞান পড়ানোর কথা বলেছি বলে এটা জঘন্য কথা হলো? আপনি তো একটা নাস্তিক মানুষ হে। তারেক স্যার বলে উঠলেন।
– আরে ওয়াজ মাস্টার, থামেন তো! সব জায়গায় আপনি ওয়াজ ছাড়েন কেন? আসল কথায় আসেন। তাঁর ছোট শালি দুলাভাইর কাছে হাসবে হাসুক! শালি বলে কথা। কিন্তু সবার কাছে সবখানে তো আর হাসা যাবে না। কিন্তু কথা হলো ছোট শালি, মানে, কী নাম মেয়েটার, হ্যাঁ তনু, তনুর হাসিটা বাড়িতে একটু শাসন করে থামাতে পারেন না আবুবর সাহেব? সব কি স্কুল করে দেবে?
– মেয়েরা একটু-আধটু হাসতেই পারে স্যার। আপনি তাই নিয়া আইন বানাতে চান? কেন?
তারেক স্যার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে হেডস্যার বললেন, বাদ দেন। বরং যেটা বলতে চাইছিলেন সেটা বলেন।
– কী বলব স্যার, বেগানা মেয়েছেলের হাসি কেন, কণ্ঠও পরপুরুষের কানে যাওয়ার নিয়ম নাই। আর তাঁর শালি খিলখিল করে হাসে। কী বেয়াদব! কোনো আদব-কায়দা নাই এমন মেয়েছেলেকে কে শিক্ষা দেবে? আমরা, নাকি স্কুল, নাকি তাঁর পরিবার? তখন তো সবাই বলে বেড়াবে, এটা ‘হাসি থামানোর স্কুল’ বানাইছি।
– আরে থামেন তো। মিটিংয়ের পরের পয়েন্টে যান।
– আশ্চর্য, এসব সাধারণ বিষয় নয় স্যার। এভাবে…
তারেক স্যারকে আবার থামিয়ে দিয়ে হেডস্যার বললেন, নেক্সট।
– স্যার, মনে হচ্ছে আবুবর সাহেবের ছোট শালিকে তারেক স্যার ছেলের বউ বানাবেন, তাই এত শুদ্ধ করতে চাইছেন।
জাহাঙ্গির স্যারের কথায় এবার হেসে ওঠেন সবাই। কিন্তু আবুবর সাহেব এসব তামাশা পছন্দ করলেন না। তিনি মিটিং থেকে উঠে গেলেন। চোখগুলো বড় আর লাল লাল হয়ে গেছে তাঁর। তিনি হঠাৎ আগুন দেখতে পেলেন। দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। সবাই মজমা করে গোটা স্কুলটায় আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তিনি চিৎকার করে লাফ দিয়ে দৌড়ে বাসার দিকে ছুটতে লাগলেন। বাসায় পৌঁছে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, আগুন আগুন।
– কোথায়? বিলকিস বেগম ছুটে এসে জানতে চান।
– স্কুলে। গোটা স্কুল পুড়ে যাচ্ছে।
স্কুল আগুনে পুড়ছে আর তিনি বাড়িতে চলে এলেন, ব্যাপারটা কেমন কেমন লাগল বিলকিস বেগমের। তিনি স্বামীকে পানি এনে দিলেন হাত-মুখ ধোয়ার জন্য। এ সময়ই স্কুল দপ্তরি হন্তদন্ত হয়ে বাসায় উপস্থিত হলো।
– কী ব্যাপার রহমত? আগুন লাগল কিভাবে?
– ম্যাডাম, আগুন তো লাগে নাই। কিন্তু স্যার আগুন আগুন করে চিৎকার দিয়ে বাসায় এলেন।
– মানে কি? আগুন লাগে নাই? তুমি কি স্কুল থেকে আসছ?
– জি ম্যাডাম, স্কুল থেকেই আসছি। কিন্তু স্কুলে আগুন লাগে নাই। মিটিং হচ্ছিল। স্যার সেখান থেকে আগুন আগুন করে চিৎকার দিতে দিতে বেরিয়ে এসেছে।
– মিথ্যে কথা! রহমত, কী বলছ মিথ্যে কথা তুমি? আবুবর সাহেব বাথরুম থেকে বেরিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন। গোটা স্কুল দাউদাউ করে পুড়ছে আর এরা দেখতে পাচ্ছে না।
রহমত চুপ হয়ে গেল। বিলকিস বেগম বুঝতে পারলেন, কিছু একটা গড়বড় হয়ে গেছে। আবুবর সাহেবকে তিনি ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে রহমতকে নিয়ে আড়ালে গেলেন। ফিসফিস করে জানতে চাইলেন, ঘটনা কী?
– ম্যাডাম, স্কুলে মিটিং চলছিল। আমি চা দিতে দিতে দেখলাম চেঁচামেচি হচ্ছে। তার পরেই স্যার আগুন আগুন করে বেরিয়ে এলেন। সবাই অবাক। হেডস্যার তাই আমাকে পাঠালেন দেখতে।
– কী নিয়ে চেঁচামেচি হচ্ছিল মিটিংয়ে?
একবার চারদিকে দেখে নিয়ে রহমত বলল, আপনার ছোট বোন, তনু আছে না? তনুর হাসি নিয়ে।
– তনুর হাসি নিয়ে!
– জি ম্যাডাম। কারা নাকি অভিযোগ করেছে, ওইভাবে খিলখিল করে স্কুলে হাসা যাবে না।
বিলকিস বেগম নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু নীরবতা ভেঙে দিলেন আবুবর সাহেব। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সজোরে একটা চটকনা বসালেন রহমতের গালে, স্কুলটা দাউদাউ করে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে, আগুন নেভাতে পারিস না, আর এখানে ফিসফিস করছিস? যা, এক্ষণ যা, আগুন নেভা।
বিলকিস বেগম রহমতকে সরে যেতে বলে আবুবর সাহেবকে ঘরের ভেতরে বসালেন। গা গরম হয়ে গেছে মানুষটার, সারা শরীর যেন আগুনের হলকায় ফুটছে। চোখমুখের গরম ভাপ বিলকিস বেগমের মুখে-চোখে পড়তে লাগল। বিলকিস বেগম আবুবর সাহেবের মাথায় নারকেল তেল দিলেন। তেলের সাথে পানি মিশ করে মাথার তালুতে হালকা বাড়ি দিতে দিতে আর ডলে দিতে দিতে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করলেন। এবং সত্যি সত্যিই আবুবর সাহেব একসময় চোখ বুজে ঝিমাতে ঝিমাতে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি নাক ডাকা শুরু করলেন। বিলকিস বেগম খুব মনোগোগ দিয়ে আবুবর সাহেবের মুখখানা দেখতে লাগলেন।
মানুষটা যেন বহু দিন পর ঘুমাচ্ছেন এখন। (চলবে…)
শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ
৯. আবুবর- ঘোড়া পাছায় হাঁটছেন
পর্ব – ২. আবুবর- ঘোড়া পাছায় হাঁটছেন
পর্ব – ১. আবুবর- ঘোড়া পাছায় হাঁটছেন
৮. আবুবর- কোনোকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই