কায়েস হাউজ

পনেরো বছর পর মায়ের ফোন পেয়ে নেদারল্যান্ড থেকে বাড়ি ফিরছে কায়েস!
এই পনেরো বছরের মধ্যে তার ছোট বোন মিনু আর ছোট ভাই কামরুলের বিয়ে হয়ে গেছে। কামরুল এখন গ্রামীণফোনে চাকরি করে। থাকে বরিশাল। আর মিনু তার বরের সাথে সেটেলড করেছে সুইজারল্যান্ড। বিয়ের সময় কায়েসকে ফোন করে ওরা বারবার বিয়ের অনুষ্ঠানে আসার জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু কায়েস আসে নি। আসে নি মানে আসতে পারে নি। ছোট ভাইবোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে বড় ভাইয়ের অনুপস্থিত থাকা অস্বাভাবিক। সামাজিকভাবে দেখতেও অসুন্দর। কিন্তু আসবার পথে ছিল অদৃশ্য এক দেয়াল। সেটা ভাঙতে পারে নি। বাবার তৈরি করা দেয়াল ভাঙা সম্ভব নয়। তাই কায়েসের আসা হয় নি।
কিন্তু এবার মা স্বয়ং রেবেকা বেগম তার বড় ছেলেকে ফোন করেছেন। পনেরো বছর পরে মায়ের ফোন পেয়ে কোনো সন্তানের পক্ষে দূরে থাকা সম্ভব নয়। ফলে ফোন পাওয়ামাত্র দেশে ফেরার বন্দোবস্ত শুরু করেছিল কায়েস। অবশ্য মায়ের সাথে কথা বলে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। কারণ মা বলছিলেন, কায়েসের বাবা কায়েসকে দেখতে চান। মায়ের কথা শুনে কায়েস হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল। যদিও রেবেকা বেগম তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ভয়ের কিছু নাই। তার বাবা সুস্থই রয়েছেন। তবে বাড়ি আসতে বলার কারণ হলো—এতদিন পর আশরাফ আলী তাঁর ছেলেকে দেখতে চেয়েছেন।
সত্যিই এটা খুব বিস্ময়কর ব্যাপার যে, আশরাফ আলী কায়েসকে দেখতে চাইছেন। হতে পারে বয়সের কারণে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন, হতে পারে ছেলের প্রতি তাঁর মনে কোনো অন্যায়বোধ কাজ করছে। কিংবা হতে পারে বড় ছেলেকে বহুদিন না দেখতে পেয়ে তিনি মর্মাহত হয়ে পড়েছেন।
সেদিন মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার পর কান্নায় ভেঙে পড়েছিল কায়েস। সহকর্মী কিংবা সিসি ক্যামেরায় বস তার কান্না দেখে ফেলবেন তাই দ্রুত নিজেকে বাথরুমে লুকিয়ে ফেলেছিল কায়েস। টানা পাঁচ মিনিট ধরে কেঁদেছিল বাথরুমে বসে। কাঁদতে কাঁদতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিল। ফিরে গিয়েছিল শৈশবে। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল শৈশবস্মৃতি।
একটা পাপড়ভাজা কেনার জন্যে ছোট্ট কায়েস টয়লেটের ছিটকানি বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আশরাফ আলী। বলছেন, ‘বাইরে আয়। দরজা খুইলা বাইরে আইলেই তরে লয়া আমি পাপড়ভাজা কিনতে দোকানে যামু!’
ঢাকা বিমানবন্দর থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে কায়েস রওয়ানা দিয়েছে বাড়ির উদ্দেশে। ফুলতলা, গৌরীপুর।
বিমান থেকে দেশের মাটিতে নামার পর কায়েসের মনে হয়েছিল, জন্মভূমির একটা ঘ্রাণ আছে। মায়ের শরীরের গন্ধের মতো। আগে কখনো এমন অনভূতি হয়নি কায়েসের। আজই প্রথম অনুভব করল।
চলন্ত ট্যাক্সিতে বসে রাস্তার পাশের সবুজ মাঠের দিকে তাকিয়ে রইল কায়েস। দুরন্ত বাতাস খেলা করছে ফসলের মাঠে। দিগন্ত যেখানে মিশেছে মাঠের শেষে, ঠিক সেই রেখা বরাবর উড়ে যাচ্ছে একটি বিমান। কায়েস নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
পনেরো বছর আগে কায়েস ছিল দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র। অনার্স ফাইনাল ইয়ার। ইংলিশ ল্যাঙ্গজুয়েজ এ্যান্ড লিটরেচার। ঠিক সে সময়, হুট করে তার ক্লাসমেট ও প্রিয়বন্ধু শিউলির বাবা-মা তাদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেন। কিন্তু কায়েস ও শিউলি ছিল একে অপরের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা যতোদিন বাঁচবে দুজনে একসাথে বাঁচবে।
ফলে কাক ডাকা এক ভোরে শিউলি বাড়ি ছেড়ে হাজির হয়েছিল কায়েসের হোস্টেলে।
সেদিনই তারা কাজী অফিসে বিয়ে করেছিল। মানিকগঞ্জ শহরকে বিদায় জানিয়ে চলে গিয়েছিল কায়েসদের বাড়ি। গৌরিপুরের ফুলতলা।

বাড়ির বড় ছেলের বিবেচনাহীন এমন কর্মে কায়েসের বাবা স্কুল শিক্ষক আশরাফ আলী বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। থরথর করে কাঁপছিলেন। তারপর হঠাৎ চাপা কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন, ‘দেখবার চাই না। তোরে আমি আর দেখবার চাই না। তুই আমার দুই চোক্ষের সামনে থিকা দূর হ।’
তারপরও দাঁড়িয়ে ছিল কায়েস। নববধূ নিয়ে সে কোথায় যাবে? মনে মনে ভেবেছিল, নিশ্চয় তার বাবার রাগ কমবে। ছেলেকে না হোক, অন্তত ছেলেবউকে গ্রহণ করবেন।
কিন্তু আশরাফ আলী এক কথার মানুষ। কোনো নড়চড় হয়নি তাঁর কথার। তীব্র কণ্ঠে বলেছিলেন ‘যদি এক্ষনি না যাস, আমি তোরে ত্যাজ্যপুত্র করব। মৃত্যুর পরে আমার মুখ দেখতে আসারও দরকার নাই।’
ঠিক তখন মসজিদ থেকে ভেসে আসছিল মোজাজ্জিনের সুর। পশ্চিম আকাশ ক্রমে লাল হয়ে উঠছিল। কায়েস বের হয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে।
সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, আর ফেরা হয় নি। মা, ও ভাইবোনের সাথে কথা হলেও গত পনের বছরে বাবার সাথে কখনো কথা হয় নি।
মনে আছে, বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময়, খুব গোপনে ছেলের পিছু নিয়েছিলেন মা রেবেকা বেগম। আশরাফ আলী দূর থেকে তা দেখে হুঙ্কার ছেড়ে বলেছিলেন, ‘কই যাও তুমি? আমার মরা মুখ দেখবার চাও?’
এরপর আর এক পা-ও বাড়াতে সাহস পাননি রেবেকা বেগম।
কিন্তু কলেজ পড়ুয়া ছোটবোন মিনু ঠিকই বাবাকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ভাইয়ের সাথে কথা বলবার জন্যে। নদীপাড় দিয়ে যখন কায়েস আর শিউলি হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ পেছন থেকে ভাইয়া বলে ডেকে উঠেছিল মিনু। কায়েস ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেয়েছিল মিনুকে। মিনু কাঁদতে কাঁদতে কায়েসকে জড়িয়ে ধরেছিল। শিউলিকে ভাবী বলে সম্ব্ধেন করেছিল। বারবার শিউলির কাছে স্যরি চাইছিল।
সেদিন মিনু কায়েসের হাতে এক জোড়া স্বর্ণের বালা গুঁজে দিয়েছিল। রেবেকা বেগম তাঁর নিজের হাতের বালা পাঠিয়েছিলেন ছেলের জন্যে। আর যতদিন কায়েস ঢাকায় ছিল, ছোটভাই কামরুল আসত মায়ের পাঠানো চাল, ডাল, তরিতরকারি ইত্যাদি নিয়ে।
তবে মায়ের বালা ব্রিক্রি করতে হয়নি কায়েসকে। কারণ সেই দুঃসময়ে দেবদূতের মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শশাঙ্কদা। দেবেন্দ্র কলেজের সিনিয়র ভাই। শশাঙ্কদা চাকরি করতেন ঢাকায়, ডেইলি স্টারে। তিনি কায়েসের বিয়ের খবর শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। বাহবা দিয়ে বলেছিলেন, ‘চাকরি-বাকরি না হওয়া পর্যন্ত আমার বাসাতেই থাকো। আমি ব্যাচেলর মানুষ। চাল-ডালের কোনো অসুবিধা হবে না।’
কায়েসের জন্য শশাঙ্কদা যা করেছিলেন তা ভোলার মতো নয়। এই শশাঙ্কদাই দৈনিক যুগান্তরে জুনিয়র সাব এডিটর পদে কায়েসের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আর বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারেও সাহস দিয়েছিলেন শশাঙ্কদা।
কায়েস ভালো চাকরি করে। এরইমধ্যে নেদারল্যান্ডে নিজের বাড়ি-গাড়ি হয়েছে। সুখেই দিন কাটছে। জায়ান ও জারিফ নামের দুটি ছেলে সন্তান রয়েছে তাদের।
তবে কায়েস একা এসেছে দেশে। শিউলি কিংবা ছেলেরা কেউ আসেনি। ছেলেদের স্কুল খোলা। তার ওপর সামনের মাসে পরীক্ষা। কোনোভাবেই ওদের আনা সম্ভব হয় নি।
কায়েসের মতো শিউলিও পনের বছর ধরে নেদারল্যান্ডে।
ইউরোপের ব্যস্ত জীবনে চাকরি আর পরিবার সামালানোর পর নিজের মা-বাবা আর ভাইবোনের কথা এখন আর মনে করার সময় মেলে না। নিজের গ্রাম, নদী, স্কুল মাঠ, বাজার, বাড়ি, নিজের পুরনো ঘর, জানালা, উঠোন, টিউবওয়েল, পুকুর, নারকেল-সুপারির বাগান এসব এখন পুরনো ইতিহাস। এসব ইতিহাস মনের এক কোণে পড়ে থাকে, অযত্নে। ইচ্ছে থাকলেও এ পথে পা বাড়ায় না কায়েস। তবে হঠাৎ কখনো কখনো কান্নায় দুচোখ ভরে ওঠে। মন বাধ মানে না। খুব দেখতে ইচ্ছে করে নিজের গ্রামকে। নিজেদের বাড়িলাগোয়া নদীটিকে। বাড়ির জলপাই গাছটিকে। কামরুলকে। মিনুকে। মাকে। বাবাকে!
জায়ান-জারিফের চোখের দিকে তাকালে সে তার বাবার মুখ দেখতে পায়। ছেলেরা যখন তাকে বাবা বলে ডাকে তখন মনে হয়, তার বাবাটি কোথায়! নেদারল্যান্ডে যেদিন প্রচণ্ড রোদ ওঠে, কায়েস আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কামরুলের ঘুড়ি উড়ে যেতে দেখতে পায়। কখনো কখনো বাড়ির উঠানে ছড়ানো মায়ের শাড়িটা বাতাসে উড়ে বেড়ায়। মাচার ঝিঙে ফুলের উজ্জ্বল হলদে রং এসে ঝিকমিকিয়ে ওঠে দুচোখের তারায়। পার্কের বেঞ্চিতে বসে বিকেলের রোদের দিকে তাকিয়ে থাকে কায়েস।
ব্যাগ থেকে মায়ের বালাজোড়া বের করল কায়েস। বালা দেখতে দেখতে বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ঝাপসা হয়ে এল চোখ দুটো।
কায়েস যখন শিউলিকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে, মনে আছে, রেবেকা বেগম জলভরা চোখ নিয়ে ছেলে আর ছেলেবউয়ের দিকে তাকিয়েছিলেন। মায়ের সেই করুণ চেহারাটা এখনো কায়েসের চোখে ভেসে আছে। আরো কত কত দৃশ্য। মায়ের স্মৃতি। তখন কায়েস ছোট। স্কুলে যায়। মা তাকে সাজিয়ে-গুজিয়ে ব্যাগের মধ্যে টিফিন বক্স দিয়ে বলছেন, ‘বাটির সবটা নাস্তা খাবি কইলাম!’ তারপর কায়েস বাবার হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে। কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দুধারে ফসলের মাঠ। কিছুদূর গেলে রাস্তার দুপাশে বাড়ি। বাঁশঝাড়। তারপর আছে সারি করে রোপন করা রেইন ট্রি। পাখির ডাক। প্রজাপতির ওড়াওড়ি। নীল আকাশে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক পাখি। কায়েস বিস্মিয় ভরা চোখে তাকিয়ে আছে। আশরাফ আলী বলছেন, ‘আহা ইসকুলের ঘণ্টা পইড়া যাইব তো! তাড়াতাড়ি চল।’
আশরাফ আলী তাঁর শিশুপুত্রকে একরকম টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আর পুত্রটি বিস্মিত চোখে এটাসেটা দেখে চলেছে। সেনাবাহিনীর মতো ছুটে চলা পিঁপড়ার লাইন দেখে কিংবা দূর্বঘাসের মাঝখানে একটি বুনোফল দেখে থেমে পড়ছে।

গাড়িতে হঠাৎ কড়া ব্রেক পড়ল। বেশ ঝাঁকুনি খেল কায়েস। সম্বিত ফিরে পেল যেন। বলল, ‘কী ব্যাপার ড্রাইভার সাহেব?’
ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, ‘রাস্তা ভাঙ্গা ছিল। খেয়াল করিনাইকা।’
‘প্লিজ, সাবধানে চালান।’
‘অবশ্যই।’
কায়েস তার মায়ের বালাদুটো ব্যাগে ভরে রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মনে মনে ধন্যবাদ দিলো শশাঙ্কদাকে। শশাঙ্কদা তার ঢাকার জীবনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলে মায়ের বালাদুটো বিক্রি করতে হয় নি।
বউদির জন্য একটি স্বর্ণের হার এনেছে কায়েস। আর শশাঙ্কদার জন্য একটি ঘড়ি। শিউলি কিনে দিয়েছে। এই এত বছরেও কায়েস একটিবারের জন্যেও শশাঙ্কদাকে কখনো ধন্যবাদ দেয়নি। কিন্তু এবার শিউলি বিশেষভাবে বলে দিয়েছে, এবার দিতে হবেই, কেননা ধন্যবাদটা শিউলির পক্ষ থেকে দেওয়া। কায়েস ভাবল, দুই একদিনের মধ্যেই শশাঙ্কদার বাসায় যেতে হবে। যেতে হবে শিউলিদের বাড়িতেও। শ্বশুরবাড়ি এবং বাপের বাড়ির প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা উপহারের প্যাকেট করে, তার ওপর মার্কার কলম দিয়ে প্রত্যেকের নাম লিখে দিয়েছে শিউলি। মীনাদি নামের কেউ একজন ওদের বাড়িতে কাজ করত। এখন আর কাজ করে না। ঠিকানা জোগাড় করে মীনাদিকেও যেন উপহারটি পৌঁছে দেওয়া হয়, শিউলি বিশেষভাবে বলে দিয়েছে। কায়েস অবশ্যই শিউলির পাঠানো উপহারটি মীনাদির হাতে পৌঁছে দেবে।
শিউলির প্রতিও কম কৃতজ্ঞ নয় কায়েস। কোনোদিন বলা হয় নি, কোনোদিন হয়তো বলা হবেও না, তবে কায়েস বোঝে, একটি মেয়ে কতটা নির্ভর করলে নিজের পরিবার ছেড়ে চালচুলোহীন একটি ছেলের হাত ধরে চলে আসতে পারে! কতটা ভালোবাসলে সেই ছেলেটির সাথেই বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে থাকতে পারে বছরের পর বছর! পনেরো বছর—সেও তার মাবাবাকে দেখে না। অথচ ভাগ্যক্রমে যখন দেশে ফেরার সময় এল, তখন তার ছেলেদের পরীক্ষা।
আজ কায়েসের জীবনে যা অর্জন, সবটাই শিউলির কারণে। শিউলি তার ভাগ্য। তার নিয়তি। শিউলির সাথে পরিচয় হয়েছিল বলেই জীবনের এতটা পথ সে হাঁটতে পেরেছে। ভাগ্যান্বেষণে নেদারল্যান্ড যেতে পেরেছে। এসব কথা কোনোদিন বলা হয় নি শিউলিকে। চাপা স্বভাবের কায়েস এসব কথা হয়তো কোনোদিন বলতে পারবেও না। তবে সে জানে, শিউলি নিশ্চয়ই বুঝে নিতে পারবে কায়েসের না-বলা কথাগুলো!

রেবেকা বেগম ফোন করার পর থেকে কায়েস ভেবে চলেছে বাবা তাকে কেন দেখতে চেয়েছেন? যদিও রেবেকো বেগম গোপন করেছেন, তবে কায়েসের ধারণা, তার বাবার শরীরটা হয়তো খারাপ। এতদিন জিদ করে থাকতে পারলেও এখন আর পারছেন না। হয়তো নিজের ছেলেকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তাঁর।
কায়েস তার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার পর পরই কামরুল এবং মিনুকে ফোন করেছিল। ওদের সাথে কথা বলে যদিও চিন্তিত হওয়ার মতো কোনো তথ্য পায়নি তারপরও কায়েসের ভয়টা অন্য জায়গায়। আশরাফ আলী এমন একজন মানুষ, যার মনের আসল অবস্থা কী, তা কেউ বুঝতে পারবে না। ফলে দীর্ঘ পনের বছর পর কায়েসকে তিনি কেন দেখতে চাইছেন সেটা এত সহজে বোঝা সম্ভব নয়। তবে এটা স্পষ্ট, কায়েসকে দেখতে চাওয়ার পেছনে নিশ্চয় বড়ো কোনো কারণ রয়েছে। কেননা যাকে নিজের সন্তান হিসেবে স্বীকার করতেই নারাজ এতদিন পর তাকে দেখতে চাওয়া ছোট কোনো বিষয় নয়।

একটি দোতলা বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামল। এই বাড়িটা গত দুই বছর ধরে তৈরি হয়েছে। ধীরে ধীরে। মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে। বেশিরভাগটা বাবার পেনশনের টাকায়। অবশ্য কিছু টাকা দিয়েছে কামরুল ও মিনু। কিছু টাকা ব্যাঙ্ক লোনও করতে হয়েছে। কায়েস টাকা দিতে চেয়েছিল কিন্তু তার টাকা নেওয়া হয় নি।
কায়েস আগেও দেখেছে এই বাড়ি। ছবিতে কিংবা ভিডিওকলের মাধ্যমে। সামনাসামনি এই প্রথম দেখা। এই বাড়িতে আগে তিনটি টিনের ঘর ছিল। এখন আর নেই।

ঢাকা বিমানবন্দর থেকে নিজেদের বাড়ি পর্যন্ত বিশাল একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল কায়েসের। অনেক কিছুই বদলে গেছে। অচেনা হয়ে গেছে।
গাড়ি থেকে নামতেই কায়েসের চোখ পড়ল বাড়ির দরজার দিকে। সে অবাক হয়ে বাড়ির নামটি দেখতে লাগল। কায়েস হাউজ। এই নাম কবে দেওয়া হলো? কামরুল বা মিনু কেউ তো বলল না, তার নামে বাড়ির নাম রাখা হয়েছে? তবে কি আশরাফ আলী বাড়িটা সম্পূর্ণ কমপ্লিট করার পর রেবেকা বেগমকে দিয়ে কায়েসকে ফোন করিয়েছেন যাতে কায়েস অতিসত্ত্বর বাড়ি চলে আসে? কী আছে তার মনে?
পাশ ফিরে তাকিয়ে কায়েস দেখতে পেল শাদা পাঞ্জাবি ও টুপি পরা আশরাফ আলী ব্যতিব্যস্তভঙ্গিতে তার দিকেই হেঁটে আসছেন। বাবার হেঁটে আসার দৃশ্যটা দেখে সে যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গেল। কায়েস ঝাপসা চোখে দেখতে লাগল বাবা বাতাস কেটে কেটে, তাঁর সন্তানের দিকে আসছেন। পনের বছর পর বাবাকে দেখে কায়েসের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।
কাছে এলেন আশরাফ আলী। বাবার মুখের পরিচিত সুগন্ধে ভরে উঠল চারপাশ। কায়েস অস্ফূট কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আব্বা!’
আশরাফ আলী কেঁদে ফেললেন। কায়েসকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমি আর ভুল করব না বাবা। আমারে মাফ কইরা দে।’
কায়েস নিজের বাবাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে লাগল।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত