অফিসে ঢুকতেই পলাশ ভাই বলে উঠলেন, ‘তোমার তো বদলির নোটিশ এসে গেছে।’ কয়েকদিন ধরেই শুনে আসছিলাম আমাকে বদলি করা হবে৷ সত্যি বলতে এ নিয়ে আমার তেমন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। অন্য কেউ হলে হয়ত বেঁকে বসত৷ নরম সুরে বসকে পরিবারের দোহাই দিত কিংবা যথাযথ তদবির করত বদলি ঠেকানোর। আমি এসব বিষয়ে নির্বিকার। স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে বেশ ক বছর আগে। একমাত্র সন্তান থাকে মায়ের সাথে। ডিভোর্সের প্রথম দিকে ছেলের সাথে বিস্তর কথা হতো আমার। আস্তে আস্তে সেই কথার পরিমাণ কমতে কমতে এখন গিয়ে ঠেকেছে শূন্যের কোঠায়৷ এখন কেন যেন মায়ের মতো সন্তানও সহ্য করে না আমাকে। এর কারন মায়ের প্ররোচণা নাকি ইডিপাস কমপ্লেক্স তা স্পষ্ট বোঝা যায় না৷ শেষ কবে আমাদের দেখা হয়েছিলো কিংবা ভালোভাবে কথা হয়েছিলো আমার তা মনে করতে কষ্ট হয়৷ আমি আর আমার পরিবার, মাঝখানে এক সমুদ্র দূরত্ব।
নতুন শহরে বদলি করা হয়েছে আমাকে৷ প্রতিদিন অফিস করি। ছুটির দিনে নিয়ম করে বই পড়ি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় নতুন শহরকে একটু ঘুরে ফিরে দেখি। কিন্তু আমার ঘরকুনো স্বভাবের কাছে বারবার পরাজিত হতে হয়। তবুও কোনো এক বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম। নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই। রিকশাওয়ালাকে বললাম আশেপাশের কোনো এক নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে যেতে৷
রিকশায় চড়লে আমার দৃষ্টি সর্বদাই থাকে আশেপাশে। পাঁচ-ছয় বছরের একটা বাচ্চা ছেলে লেবু নিয়ে বসেছে, বৃদ্ধ গোছের এক লোক পানের পিক ফেলছে৷ বৃদ্ধের চশমার কাচ ভাঙ্গা৷ আমার এদের গল্প জানতে ইচ্ছে করে। লেবু বিক্রি করা ছেলেটার হয়ত বাবা নেই। এখন যার মাঠে ছুটে বেড়ানোর কথা কিংবা মায়ের পাশে শুয়ে ভাতঘুম দেয়ার কথা তাকে কিনা এখন লেবুর দাম হাঁকতে হচ্ছে, লড়তে হচ্ছে জীবনযুদ্ধে! যে বৃদ্ধের চশমা ভাঙ্গা তিনি কি তার কোনো সন্তানকে বলতে পারেন না নতুন চশমার কথা? হয়ত হতে পারে তিনি নিঃসন্তান কিংবা নতুন চশমা কেনা তাদের জন্য বিলাসিতার পর্যায়ের৷ রিকশার গতি বাড়ে। আমার মস্তিষ্ক থেকে এসব স্মৃতি ম্লান হতে থাকে। সারি সারি গাছের পাশ ঘেঁষে রিকশা এগিয়ে চলে। সামনে নদী দেখা যায়।
নদীর পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেঘের সরে যাওয়া দেখছি৷ চারিদিকে অথৈ জলরাশির সামনে নিজেকে বড্ড তুচ্ছ মনে হচ্ছে। নদীর কোল ঘেঁষে একটু দূরে রীতিমত একটা বাজার বেড়ে উঠেছে। সব দোকান ছাপিয়ে একটা দোকানে বেশ লোক সমাগম। নিশ্চয়ই বিরিয়ানী বা খিচুড়ির দোকান হবে৷ এখন এক প্লেট খিচুড়ি দিয়ে পেটটা ভরাতে পারলে মন্দ হতো না। ভীড় ঠেলে দোকানে উঁকি দিয়ে আমার চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। ক্যাশ বাক্সে বসে থাকা লোকটা আমার বেশ পরিচিত। সেই বিড়ালাক্ষী চোখ, বাম গালে আবার কাটার দাগও আছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত এ আমার পুরোনো বন্ধু রফিক। চোখে চোখ পড়তেই তার চোখেমুখেও স্পষ্ট হাসির ছাপ ফুটে উঠল। তখন আমি নিশ্চয়তার আগে মোটামুটি বিশেষণ বাদ দিয়ে পুরোপুরি বিশেষণ যোগ করলাম মনে মনে৷ আমাদের শেষ কবে দেখা হয়েছিল কারোরই মনে নেই। শুধু মনে আছে আমরা দুজনে একসাথে কাটিয়েছি জীবনের অনেকটা মধুর সময়। নৌকা বেয়ে একসঙ্গে শাপলা আনতে যেতাম দূরের বিলে, শীতের সকালে গাছ বেয়ে নামাতাম খেজুরের রস!
বয়সের সাথে সাথে বন্ধুদের আড্ডার বিষয়বস্তু পরিবর্তন হতে থাকে। একসময় আমাদের আড্ডার টপিক ছিলো হাডুডু, ডাংগুলি। কৈশোরের শেষে তা ঠেকেছিলো নারীতে গিয়ে। এখন আমরা অন্যান্য চল্লিশ পেড়োনো পুরুষের মতো কথা বলছি সংসার নিয়ে। আমাকে বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে জীবন নিয়ে একতরফা অভিযোগ করে চলেছে রফিক। পরিবারের ভরণপোষণ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে৷ হোটেলে তেমন বেচাকেনা হয় না৷ মাসে দুএকদিন হয়ত লোক সমাগম হয় তবে তাতে যা উপার্জন হয় তা অধিকাংশ দৈনন্দিন প্রয়োজনই মেটাতে পারে না। রফিকের গায়ের ময়লার আস্তরণ পড়া শার্ট দেখেই তা আন্দাজ করা যায়। সরাসরি না বললেও কথার ইঙ্গিতে রফিক বুঝিয়ে দেয় যে তার থেকে আমি নিশ্চয়ই ঢের সুখী৷ আসলেই কি তাই?
হোটেলের সাথেই লাগোয়া বাসা রফিকের৷ আমাদের অতি উচ্চ ডেসিবেলের কথা শুনেই হয়ত একজোড়া চোখ উঁকি দেয় দরজার পর্দা ভেদ করে। রফিকের চার বছরের মেয়ে বাবা বাবা বলে রফিককে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটা দেখতে হুবহু বাবার মতই হয়েছে৷ বাবা মেয়ের খুনসুটি দেখে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার সন্তানের একটা আবছা মুখ৷ আমি কি এত সহজেই সন্তানের ওম পেতে পারি? শেষ কবে বাবা ডাক শুনেছিলাম, সন্তানকে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম এসব স্মৃতি মস্তিষ্ক থেকে আবছা হয়ে গেছে। আমার ইচ্ছে করছে রফিককে সবকিছু খুলে বলতে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন আমি। আমাকে যতটা সুখী ভাবছে ও আমি মোটেও ততটা সুখী জীবন কাটাচ্ছি না। আমরা কেউ কি আদৌ পরিপূর্ণ সুখী? আমার তো মনে হয় সৃষ্টিকর্তা জন্মের সময় একেক জনকে একেক ধরনের কষ্ট দিয়ে দুনিয়াতে পাঠান। আর্থিক, মানসিক, শারীরিক। কাকে কি কষ্ট দেবেন তা একান্ত তাঁর ব্যাপার। আমরা শত চেষ্টা করেও এইসব কষ্ট থেকে পুরোপুরি নিস্তার পাই না। আমরা সবাই বেদনার সন্তান৷
রফিকের থেকে যাওয়ার শত অনুরোধ উপেক্ষা করে, আবার আসার ওয়াদা দিয়ে যখন বিদায় নিলাম আকাশে তখন মেঘ জমতে শুরু করেছে। কিছুদূর হাঁটার পর হঠাৎই শুরু হল বৃষ্টি। আকস্মিক বৃষ্টিতে সবাই হতভম্ব। দু একজনের কাছে ছাতা ছিলো, বাকিরা আশ্রয় নিচ্ছে পাশের দোকানগুলোতে। আমি বৃষ্টিকে পরোয়া না করে হাঁটছি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে৷ চোখের জলে যাকে ভিজতে হয় রোজ, সে কখনো বৃষ্টির জলকে ভয় পায় না৷