পিলখানার বিদ্রোহে ঐতিহাসিক প্রেম ∣ তানিম কবির

১.
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ শুরুর দিনই আমার সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন শামুকের শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। আগের রাতটা প্রেসেই কাটে। সকাল সকাল প্রেসের আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে বেরিয়ে আসতে তীব্র রোদে মাথা চক্কর দেওয়ার উপক্রম হয়, তখনই মমতার ফোন পেয়ে ব্যাপারটাকে আমি সামলে নিতে পারলাম।
          সর্বনাশ! শুনছো কী হইছে?
          কী হইছে?—পেন্ডিং থাকা চক্করটা সুযোগ পেয়ে আবার উশখুশ করে।
          পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ। বিডিআর-প্রধানকে নাকি গুলি করে মেরে ফেলা হইছে। ভাবতে পারো!
          বলো কী!—যথাসম্ভব গুরুত্বের সঙ্গে, তবু ছেড়ে দেওয়া হাইটাকে শেষ পর্যন্ত ফিরিয়ে নিতে না পেরে বললাম।
          আশ্চর্য তোমার হাই উঠল এ খবরটা শুনে!—ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে না মমতা।
          তা না, তুমি তো জানোই সারারাত আমি প্রেসে ছিলাম।
          ও হ্যাঁ তাই তো! বের হইল শামুক?
          বাইন্ডিং বাকি আছে,—আমি বলি।
          যাই হোক, তুমি কি জানতা প্রতিদিন আমি পিলখানার ভিতর দিয়ে কলেজে যাই?
          পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে এরচেয়ে গুরুতর তথ্য আর কী হতে পারে?
          মানে কী! কী হইছে বলো তো?—ঝেড়েকেশে এবার জানতে চাই আমি।
          বাসায় যাও, টিভি দ্যাখো।—বলে ফোন ছাড়তে চায় মমতা।
          না তা কেন?—আমি জিজ্ঞেস করি।
          আরে খবর দেখি গিয়ে।—খানিকটা কর্কশ স্বরে এ কথা বলেই লাইন কেটে দেয়।
          আমি রাস্তা পার হয়ে প্রেসক্লাবে ঢুকে পড়ি।
          টিভিস্ক্রিনে তাকিয়ে কান খাড়া করে থাকা সাংবাদিকদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
          বিডিআর সদর দফতর থেকে জনপদে গুলি ছোঁড়াসহ, আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের ছোটাছুটির দৃশ্য। আরো সকালে দরবার হলে ঘটে যাওয়া সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ডের ইঙ্গিত এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনা, র‌্যাব ও পুলিশের ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি গিয়ে টিভির সামনে দাঁড়াই।
          ঢাকা থেকে ফোন পেয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের জেলা প্রতিনিধি আমাদের আগেভাগেই নিশ্চিত করে দেয়, বিডিআরের মহাপরিচালককে গুলি করা হয়েছে। অন্য অনেক অফিসাররাও গুলিবিদ্ধ, বেঁচে আছে কিনা কেউ জানে না।
          বাঁচিয়ে রাখার কোনো কারণ আছে কি? সেনাবিদ্রোহগুলোতে আমরা কী দেখি?—একজন প্রবীণ সাংবাদিক সমবেত বাকিদের উদ্দেশ্যে তার যৎসামান্য সামরিক জ্ঞান ফলাতে শুরু করলে আমি বেরিয়ে আসি।
          রিকশায় উঠে মমতাকে ফোন দিই।
          কী সর্বনাশ, ভাগ্যিস তুমি আজকে কলেজে যাও নাই!
          কী অদ্ভুত দ্যাখো, আমিও হয়তো জিম্মি থাকতাম এতক্ষণে!
          এবার আমার কণ্ঠে সত্যিকারের উৎকণ্ঠা টের পায় মততা। ফলে নিজের কী হতে পারত ভেবে টেনশন করে আরো।
          টিভি দেখছো? ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারছো তো এবার?
          হ্যাঁ হ্যাঁ, দ্যাখো আমার গায়ের লোম দাঁড়াইয়া গেছে।
          কিভাবে দেখব, ভিডিও করে ইমেইল পাঠিয়ে দাও।
          কিন্তু ক্যামেরা সেট তো বাসায়,—আমি বলি।
          ওমা তুমি এখনো বাসায় যাও নাই?
          আরে না, তুমি বিপদে পড়তে যাচ্ছিলা, আমি কি বাসায় যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব নাকি?
          খুশি হয়ে মমতা জানতে চায়,—তো তুমি কী করলা?
          সোজা প্রেসক্লাবে চলে গেলাম। কিভাবে যে রাস্তা পার হলাম, চিন্তাও করতে পারবা না, একটু হলেই ট্রাকের নিচে পড়তাম।
          ফেনীতে দিনের বেলা ট্রাক ঢোকা বন্ধ হইছে, সেদিন বললা?
          তাৎক্ষণিক এই যুক্তি দাঁড় করাতে পারলাম,—এটা তো সবেমাত্র সিদ্ধান্ত হলো, বাস্তবায়িত হয় নাই এখনো।
          কবে বাস্তবায়িত হবে?—আঠার মতো লেগে থাকে মমতা।
          শিগগিরই হয়ে যাবে, কথাবার্তা চলতেছে। তাছাড়া মিলাদ পড়ানোও হয়ে গেছে।
          কী যে বলো তুমি বুঝি না বাবা!—ঘটনার পক্ষে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেয়ে মমতা বিমর্ষ হয়ে পড়ে।
          বাদ দাও তো, এখন বাসায় যাচ্ছি। বাসায় গিয়ে আরো অনেক খবর দেখতে হবে।
          ঘুমাবা না? সারারাত তো ঘুমাও নাই, কালকে আবার জার্নি করে ঢাকায় আসবা।—নিজের নামের প্রতি সুবিচার সম্পন্ন করে মমতা।
          তা একটু ঘুমানো তো দরকার বটেই।—আমি বলার চেষ্টা করি।
          হ্যাঁ হ্যাঁ ঘুমাও, বিপদ কেটে গেছে। আমি তো সুস্থ আছি!
          এবং আমারই আছো,—এটুকু বলে আহ্লাদ করতে চাইলে, মমতাও বলল, তা আছে।
২.
বাসায় এসে দেখি অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েও, বদলে শক্ত হয়ে টিভির সামনে বসে আছে আব্বু।
          আমাকে দেখে, ঘটনা শুনছিস?—বলে দর্শকসারিতে একাকী নিজের সঙ্গে আমাকেও প্রত্যাশা করল। আমি না শোনার ভান করে গোসলে ঢুকে পড়ি।
          বের হতেই, কয়টা বেনসন এনে দিতে বললে অবাক হলাম,—আপনি তো সিগারেট ছেড়ে দিছেন একমাস হয়?
          আরে এত বড় একটা ঘটনা… বুঝোসই তো সিগারেট ছাড়া সামাল দিব কিভাবে?
          হ্যাঁ একটা উছিলা পাইছেন আর কি।
          ভর্ৎসনা করেও সিগারেট আনতে বেরুতে হয়।
          ফোনটা বাসায় রেখে যাই, মমতা ফোন দিলে আব্বু রিসিভ করে। ফিরে এসে দেখি উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে আব্বু সশব্দে কথা বলছে,—না না, এটা আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কিছুই না। নিয়মিতই তুমি পিলখানার ভিতর দিয়া যাও, আজকেও যাইতে পারতা।
          আমি ফোন ফেরত চাইলে, হাতের ইশারায় আব্বু আমাকে থামতে বলে। একইসাথে আমার ব্যাপারে বলে উঠল,—না না ওর এসব কোনো সেন্স নাই, দেশে কী হচ্ছে না-হচ্ছে কোনো খবরই রাখে না।
          সিগারেট ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ফোনটা ফেরত পাই।
          মমতা বলল,—তুমি নাকি খবর না দেখেই ঘুমাতে যাচ্ছিলা?
          কই না তো! আমি তো কেবল গোসলটা করলাম। তারপর গেলাম সিগারেট কিনতে।
          কিন্তু তোমার আব্বু না সিগারেট ছেড়ে দিছে? বললা সেদিন?
          চিন্তা করো অবস্থা,—ক্ষেপে গিয়ে আমি, আব্বুকেও শুনিয়ে শুনিয়ে বলি,—এত কিছু বলতে পারল, ফোনটা কেন তাকে ধরতে হইল, তা বলে নাই!
          হেসে ফেলে মমতা,—থাকুক থাকুক, তোমার আব্বুকে আমার পছন্দ হইছে। আমি পিলখানার ভিতর দিয়ে কলেজে যাই শুনে যারপরনাই উদ্বিগ্ন হলেন।
          তুমিও একটা,—মুখ ফস্কে বলে ফেলি আমি,—পিলখানার ভিতর দিয়ে কলেজে যাও এটা সবাইকে বলতে হচ্ছে!
          সেকি! সমস্যা কী এতে?—অবাক হয় মমতা, এবং মুহূর্তেই আমার ভুল ধরে ফেলে,—ও আচ্ছা তোমার কাছে এটা বড় কোনো ব্যাপার না? তোমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে আমি বাড়াবাড়ি করতেছি, তাই না? তুমি ভাবতে পারতেছো না, প্রতিদিন, তুমি জানো জিগাতলা থেকে আমি পিলখানার ভিতর দিয়ে যাওয়া আসা করি!
          পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রের বাইরে দেখে দেখে ছুটে গিয়ে আব্বুর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট এনে ধরাই।
          দ্যাখো!—বলে অনেকক্ষণ আর কী বলা যায়, খুঁজে পাই না।
          কী দেখব?—প্রশ্ন তোলে মমতা।
          না মানে, আমি এভাবে বলতে চাই নাই। আমি আসলে স্যরি।
          ঠিক আছে,—মেনে নেয় মমতা, আর ঠিকই সেই ঘুমানোর ব্যাপারেই তাগিদ দেয়।
          তুমি এত ভালো কেন বাবু!—আমি বলার চেষ্টা করি। সত্যিকার অর্থেই, কেঁদেও ফেলি একটু। আর প্রথমবারের মতো ফিলও করি, ঠিকই তো, মমতা তো জিম্মি হতে পারত বা মারাও যেতে পারত আজকে!
          তোমার কোথাও লাগে নাই তো বাবু? জিজ্ঞেস করে সশব্দেই কেঁদে ফেলি আমি।
          ধুর বোকা,—মমতাও ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,—কিচ্ছু হয় নাই আমার, এই তো আমি সুস্থ আছি।
          এবং আমার আছো,—বলে সিগারেটটা ফেলে ঘুমিয়ে পড়ি।
৩.
আমি যখন ঘুমিয়ে পড়ছি, সেনা ও পুলিশ সদস্যরা তখন পিলখানার তিন নাম্বার গেট দিয়ে প্রথমবারের মতো বিডিআর সদর দফতরের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে।
          কিন্তু পারে না। বিদ্রোহীরা মর্টাল শেল নিক্ষেপ করলে পিছু হটতে হয়। পরের কিছু সময় যৌথবাহিনীর হস্তক্ষেপ ঠেকাতে পিলখানার সব গেট থেকে রাইফেল ও মেশিনগানের গুলি ছুঁড়তে শুরু করে বিডিআর সদস্যরা।
          আশেপাশের এলাকাগুলোতেও নির্বিরাম গুলি বর্ষণের শব্দ শোনা যেতে থাকে। জিগাতলায় থাকা মমতা তখন ভয় পেয়ে একের পর এক ফোন করে গেলেও, রাতে না ঘুমানো আমি কিছুই টের পাই না। দুপুর দুইটার দিকে সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দুই উচ্চপদস্থ ব্যক্তি সাদা পতাকা হাতে পিলখানার সামনে গিয়ে মাইকে বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। জবাবে গুলিই ছুঁড়তে থাকে তারা। পরে এসব আমি মমতার কাছ থেকে শুনি।
          তখন আমার অবস্থা যদি দেখতা, আমি তোমাকে একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছিলাম,—অভিমানী কণ্ঠে বলছিল সে,—সারা এলাকায় তখন মাইকিং হচ্ছে, সবাইকে দরজা জানালা বন্ধ রাখতে বলা হচ্ছে। ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে। বুঝতে পারতেছো অবস্থাটা?
          স্যরি বাবু, আমার এত ঘুম পাইছিল, তুমি তো জানোই, সারারাত আমি প্রেসে ছিলাম।
          না ঠিক আছে, তোমার তো ঘুম দরকার ছিল, ঘুমাইছো তা নিয়ে কথা নাই।
          পরে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে প্রতিমন্ত্রী গিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দিলে, বিকেল পৌনে তিনটার দিকে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিডিআর।
আমার ঘুম ভাঙে তারও প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে। ততক্ষণে বিডিআরের ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দলকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।                         একঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তাদের বৈঠক চলছে।
          কী মনে হয়, শান্তিপূর্ণ কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারবে আদৌ?—জানতে চায় মমতা।
          নিশ্চয়ই, সেরকম ইচ্ছা না থাকলে তারা বৈঠক করত না।
          ঘুম ভাঙে বাইন্ডিং হাউজের দীপকদার কলে। পঞ্চাশ কপি বাইন্ডিং করে দিচ্ছে আপাতত। এগুলো নিয়ে পরদিন ঢাকায় বইমেলায়, বহেরা তলার লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে থাকার কথা আমার।
          এই গণ্ডগোলে ঢাকায় এসে বিপদে পড়ো যদি?—এবার আমাকে নিয়ে উদ্বেগ দেখায় মমতা।
          কিসের বিপদ, আমি কারওরান বাজারের ওদিকে কোনো একটা হোটেলে উঠব। সেখান থেকে বইমেলায়, এই তো।
          কিন্তু আমাদের তো দেখা হবে না এবার, বুঝতেছো তো? আব্বু বের হতে দিবে না।
          দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি,—সেটা আমিও ধারণা করছি, তাছাড়া বের হওয়াটা রিস্কিও হবে তোমার জন্য।
          ভেবেই কান্না পাচ্ছে, তুমি ঢাকায় আসতেছো আর দেখা হবে না।
          আমি আশার আলো জ্বেলে রেখে বলি,—বৈঠকে হয়তো শান্তিপূর্ণ কোনো সমাধান বেরিয়ে আসবে।
          কিন্তু তাতেও কোনো লাভ নাই, আব্বু মনে হয় না কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে ঘর থেকে বের হতে দিবে।
          ও আচ্ছা!—নিষ্প্রভ হয়ে আমি বলি,—তাহলে তো দ্রুত বিদ্রোহ থামানোরও কোনো তাড়া রইল না।
          তুমি রাগ করতেছো বাপ? প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো!
          রাগ করছিলাম না, কিন্তু মন তো হচ্ছিলই ভীষণ খারাপ। সেটা ঠেকাতেও পারছিলাম না।
          বাইন্ডিং হাউজ থেকে শামুকের কপি নিয়ে রিকশায় উঠতেই, আবারও মমতার ফোন,—খবর শুনছো! সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হইছে। বিদ্রোহীরা অস্ত্রসমর্পণে রাজি!
          ওয়াও, আর তো ভয় নাই কোনো, তুমি কি বের হতে পারবা সেক্ষেত্রে?
          প্রথমে চুপ করে যায় মমতা।
          সেটা তো তোমাকে বললামই। তবু আব্বুকে আবার বলে দেখব,—কথা দেয় শেষে।
          দেইখো, কতদিন তোমাকে দেখি না, বুঝোই তো।—আমি চাপা অনুরোধ জারি রাখি।
          কতদিন বলো তো?—জানতে চেয়ে আমাকে ঝামেলায় ফেলে দেয় মমতা।
৪.
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে পিলখানায় ফিরেই বিদ্রোহী জোয়ানরা অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। গুজব উঠেছে, অস্ত্র-সমর্পণের পর প্রত্যেক বিদ্রোহীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়া হবে। অঙ্গীকার করে এলেও, গুজবে কান দিয়ে অস্ত্র জমা দিতে গড়িমসি করে। নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আরো বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়তা চায় সরকারের কাছে। থেমে থেমে গুলির শব্দ শুনতে পায় মমতা।
          পরিস্থিতি আবারও জটিল হয়ে গেল।
          হ্যাঁ তাই তো দেখছি,—প্রথমত আমার সাদামাটা উত্তর এই। কিছুক্ষণ বাক্যহীন থেকে নিজেই জোর দিয়ে বলে উঠি,—না না, তোমার বের হবার প্রশ্নই আসে না। বিদ্রোহীদের প্রত্যেককে গ্রেফতার করার আগে বের হবা না।
          তুমিও আইসো না এই সময়ে, একটা বছর বইমেলায় না আসলে কিছু হবে না বাবু। তাছাড়া মেলা তো আরো কয়েকদিন চলবে। এর মধ্যে যদি পরিস্থিতি ঠিক হয়, তখন আসো।
          ধরো ঠিক হলো ২৮ তারিখে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক, আমি আসলাম। তখন কি তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে?
          তুমি বারবার এটা বলে আমাকে কষ্ট দিচ্ছো, জানোই তো আব্বু কিছু বললে সেটা না শুনে উপায় নাই।
          সেক্ষেত্রে কালকেও যা ২৮ তারিখও তা। অযথা দেরি করে আসব কেন? লিটলম্যাগ চত্বরে নতুন সংখ্যাটা থাকবে না দুয়েকদিন? বুঝদার হওয়া দরকার মনে করলাম।
          ওকে স্যরি, আমি তোমাকে আসতে বলতেছি না। দরকার নাই এবার দেখা করার। কিন্তু আমার লিটল ম্যাগাজিনটা নিয়ে আমাকে মেলায় আসতে দাও?
          সেটা চাইলে তোমাকে তো ঠেকাতে পারব না আমি।
          প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো, সারা বছরে একটাই সংখ্যা হয়। বইমেলাই থাকে প্রধান টার্গেট।
          ঠিক আছে তুমি আসো,—অনুমতি দিয়ে দেয় মমতা,—কিন্তু ঢাকায় আসা থেকে ফেনী ফেরা পর্যন্ত আমার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করবা না।
          তাই বলে এমন কথা? ইগোতে লাগাটা স্বাভাবিক না?
          কী ভাবো তুমি নিজেকে?—রাগে তোতলাতে শুরু করি আমি,—অদ্ভুত ব্যাপার! শোনো, ঢাকা-ফেনীর কোনো ব্যাপার না। তুমি আর যোগাযোগই করবা না আমার সাথে।
          মমতাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে ফোনের সুইচ অফ করি। বিডিআর বিদ্রোহের খবর দেখতে থাকা আব্বুর পাশে বসি।
কী অবস্থা এখন?
          প্রশ্ন শুনে আরেকটা সিগারেট ধরাতে থাকা উচ্ছ্বসিত আব্বু মুহূর্তেই আবার সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রাপ্ত বেদনার ছাপকে স্পষ্ট করে তুলল চেহারায়।
          আর বলিস না, নতুন শর্ত দিছে এখন। আগে সেনাবাহিনী সরাইতে হবে। তারপর অস্ত্র-সমর্পণ।
          ভালোই তো নাটক শুরু হইছে,—আমার দায়সারা মন্তব্য, যা ঘটনার আগে পরে কোনো গুরুত্বই যোগ করে না।
          আবার সিগারেট কিনলেন! বাঁচার ইচ্ছা নাই নাকি?
          আর বাঁচা। সারা দেশে সেনাবিদ্রোহ শুরু হয় কিনা দ্যাখ্।
          খানিক নীরবতার পর প্রসঙ্গ-প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসে আমার দিকে তাকায় আব্বু,—ওই মেয়েটা, মমতা, সে তো বড় বাঁচা বেঁচে গেল আজকে?
          হুঁ।
          ব্যাপার কী বল তো, মন-মিজাজ খারাপ নাকি?
          জবাব না দিয়ে উঠে চলে আসি।
          পেছন পেছন রুমে এসে শামুকের নতুন সংখ্যা দেখে আব্বু একটু থমকে যায়। চট করেই পরবর্তী কার্যক্রম অনুমান করে ফেলে।
          এই পরিস্থিতিতে তুই ঢাকা যাবি!
          কী পরিস্থিতি?—আমি কিছু জানি না ভঙ্গিতে বলি।
          বিডিআর বিদ্রোহের মধ্যে ঢাকা যাওয়া চলবে না,—কড়াস্বরে জানিয়ে দেয়।
          আমি তো যাব বইমেলায়, বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?
          আগে দেখি সংখ্যা কেমন হইল,—বলে শামুকের একটা কপি উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে।
          আমি জোরগলায় বললাম,—বছরে একটাই সংখ্যা করি, যত্ন নিয়ে করি।
          কিন্তু এই অবস্থায় ঢাকা যাওয়া চলবে না,—সিদ্ধান্ত একই থাকে তার,—তাছাড়া—
          তাছাড়া কী?—চূড়ান্ত অশ্রদ্ধামাখা আমার জিজ্ঞাসা।
          বানান ভুল আছে, স্বাতন্ত্র্যে ব ফলা হবে না।
          বলেন কী! আপনি শিওর?—আমি অবিশ্বাসী চোখে তাকাই।
          অবশ্যই। ডিকশনারি দেখে নে।
          ডিকশনারি তো প্রেসে রেখে আসছি!
          তাহলে পরে দেখে নিস,—এই বলে নাটকীয়ভাবে চলে যেতে থাকা আব্বুকে,—ঢাকা যাচ্ছি, সকাল আটটা পঞ্চাশে আমার ট্রেন,—যাত্রার সময়সূচি জানিয়ে দিই।
৫.
মমতার কী খবর জানি না। মাইকিং করে এলাকাবাসীকে অন্যত্র সরে যেতে বলা হচ্ছে? তেমন একটা সম্ভাবনার কথা মমতা বলেছিল। সেরকম হলে ওরা সবাই মিলে উত্তরায় ওর বড়বোনের শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেবে। এমন বিপদের মধ্যে এতটা রিঅ্যাক্ট না করলেও হতো,—ইত্যাদি ভাবনা-চিন্তাকালে খেতে ডাকতে এসে খুশিকণ্ঠে আব্বু জানাল, বিদ্রোহীরা অস্ত্র জমা দিতে শুরু করেছে।
          ফলে এইবার অন্তত আমার ঢাকায় যাওয়া নিয়ে আপত্তি তুলতে নিষেধ করলাম তাকে।
          ঢাকায় গেলে কি ওই মেয়েটার সাথে দেখা হবে?
          আম্মুর মৃত্যুর পর থেকে আগবাড়িয়ে আব্বু খুব ফ্রি হতে চাচ্ছে! হয়তো এটা তার প্রয়োজন। কিন্তু আমার অস্বস্তি কাটে না। আর অস্বস্তি চাপতে গিয়ে বেরিয়ে আসে রাগ।
          না। দেখা হবে না। সেও আপনার মতোই এক অবিবেচক আব্বু জাতীয় উদ্ভিদের শিকার,—ঘৃণাভরে বলার চেষ্টা করি।
          বের হতে দিবে না?
          আমি নিরুত্তর।
          তাহলে তোর ঢাকায় গিয়ে লাভটা কী?—অর্থপূর্ণ কণ্ঠে জানতে চায়।
          আশ্চর্য তো!—খাবার সরিয়ে রেখে উঠে যেতে যেতে বলি,—আমি কি মেয়েদের সাথে দেখা করতে ঢাকায় যাই বলে আপনার ধারণা?
          মেয়েদের সাথে হবে কেন! মমতার সাথে দেখা করতে যাস, কতদিন দেখা করিস না ফোনের প্রোফাইল রিনেম করে প্রতিদিন ডেট আপডেট করিস। আমি জানি তো। তোর আম্মুই বলে গেছে!
          আমার কিছু বলার থাকে না। আম্মু এসব আব্বুর সাথে শেয়ার করত জেনে আম্মুর প্রতিও একটু রেগে থাকি বোধহয়।
          ঠিক তখনই অফিসারদের আটকে পড়া দুয়েকটি পরিবারকে উদ্ধার করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। উদ্ধার পাওয়া তাদের কাছ থেকেই পিলখানায় দিনমান ঘটে যাওয়া নারকীয় তাণ্ডবলীলার ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যাবে।
          ততক্ষণে, সকাল-সকাল ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে, রুমভর্তি সদ্য মুদ্রিত শামুকের গন্ধ নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। ভোরে দেখা এক স্বপ্নে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্য হিসেবে আবিষ্কার করি নিজেকে। দেখি একটা সাইকেল চলার মতো সরু রাস্তা ধরে পিলখানার ভেতর দিয়ে মমতা হেঁটে যাচ্ছে। ওকে দেখে বিদ্রোহরত আমি বিরক্তকণ্ঠে বলি,— তোমাকে না বললাম, আজকে কলেজে যেতে হবে না!
          তোমার কথা শুনব কেন?
          সব তোমাকে খুলে বলার উপায় ছিল না, বিদ্রোহ হবে আগেই জানতাম, সেজন্যই এত করে তোমাকে নিষেধ করলাম।
          শুনলাম তোমরা সব অফিসারদের মেরে ফেলতেছো?
          উপায় ছিল না, তবে আমি কাউকে মারি নাই, আমি এখানে মূলত বিডিআরদের সাইকেল পাহারা দিচ্ছি।
          তাহলে তো তুমি নির্দোষ, চলো পালিয়ে যাই!
          আমার পালানোর সুযোগ নাই রে! তোমার আছে, চলো তোমাকে পার করে দিই।
          একটা সাইকেল, সামনে মমতাকে বসিয়ে পিলখানার ভেতর দিয়ে এলোমেলোভাবে চালিয়ে যাই।
          কোন দিক দিয়ে বের হব আমরা? সবদিকেই তো সেনাবাহিনী ঘিরে রেখেছে।
          আছে একটা দিক, তোমাকে নিরাপদে পার করে দিব,—আশ্বস্ত করি আমি ওকে স্বপ্নে।
          কিন্তু হঠাৎই আরেক বিদ্রোহী জোয়ানের সামনে পড়ে যাই।
          এই মেয়ে কোত্থেকে আসলো, এ কি কোনো সেনা অফিসারের মেয়ে?—বিদ্রোহী জোয়ানের এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে গিয়ে নিরুত্তর থাকি।
          দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার আগেই ঘুম ভাঙে। ফোন সুইচ অন করে মমতাকে কল দিই। নাম্বার বিজি। ডিসপ্লেতে ওয়েটিং লেখাটা দেখতে চাই না জন্য আমিই বলে-কয়ে ওয়েটিং অপশন বন্ধটা করিয়েছি।
          বিশ মিনিট পার হয়ে গেলেও মমতার নাম্বার বিজিই দেখিয়ে যাচ্ছে। যান্ত্রিক কোনো ত্রুটি? নয়তো এই ভোরে এতক্ষণ ধরে কার সঙ্গে কথা বলবে মমতা? কিছু বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু কষ্ট পেতে আরম্ভ করি। এসএমএস পাঠাই, তোমাকে স্বপ্নে দেখে ঘুম ভাঙল, তুমি কার সঙ্গে কথা বলতেছো এতক্ষণ? তারও কোনো রিপ্লাই আসে না। একঘণ্টা পেরিয়ে গেলে মমতার কল আসে।
          স্যরি বাবু, তোমার মেসেজগুলা আমি ভাবছিলাম ওয়েলকাম টিউনের মেসেজ। তাই খুলে দেখি নাই। না হলে তোমাকে কি আমি এতক্ষণ অপেক্ষা করাই, বলো?
          সে বিষয়ে আমি একমত, আমার মেসেজ টের পেলে তখনই আমাকে কল দিয়ে কিছুতেই তুমি এটা বুঝতে দিতে না যে, আরো কারো সঙ্গে তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলতে পারো।
          দ্যাখো রাগ কিন্তু আমার দেখানো উচিত, তুমিই সন্ধ্যা থেকে ফোন বন্ধ করে রাখছো।
          দেখাও, এটাই তো পাল্টা রাগ দেখানোর সময়। তাছাড়া ঠিকই তো, আমার ফোন যেহেতু বন্ধ ছিল তাতে অন্য কারো সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলার বৈধতা তৈরি হয় তোমার।
          শোনো, ঘটনা না জেনে এভাবে সন্দেহ করাটা কিন্তু ঠিক না।
          বলো, কী সেই ঘটনা,—আমি আগ্রহ দেখাই,—কার সঙ্গে কথা বলতেছিলা এতক্ষণ ধরে?
          এই তো ভালো ছেলের মতো কথা। শোনো, উনি আজিমপুরে আমাদের প্রতিবেশী ছিল। আমাদের অনেক সিনিয়র—
          বাগড়া দিয়ে বলি,—সিনিয়রই তো ভালো, তাই না? সমবয়েসী প্রেমের কোনো ভবিষ্যত আছে নাকি!
          প্লিজ আমাকে বলতে দাও—
          আচ্ছা আচ্ছা, বলো।
          আমরা জিগাতলায় চলে আসার পরে আর দেখা হয় নাই কখনো। গত বছর একদিন হঠাৎ শাহবাগে সেলিম ভাইয়ের সাথে দেখা—
          ব্যক্তির নাম তাহলে সেলিম,—আমি বাম হাত ঢুকাই।
          ওফ্, থামো তো প্লিজ,—মমতা মহা বিরক্ত,—উনি মূলত সেনাবাহিনীতে আছেন। এখন জাতিসংঘের শান্তিমিশনে।
          সেটার সাথে এক ঘণ্টা কথা বলার কী সম্পর্ক?
          রিলেট করতে পারতেছো না? পিলখানার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। উনি দার্ফুরের কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছেন যেন। ঠিকমতো বিডিআর বিদ্রোহের আপডেট পাচ্ছিলেন না। সেজন্য সারাদিনই কয়েকবার কথা হইছে। উনি খোঁজ নিচ্ছিলেন। এই হলো ব্যাপার।
          আচ্ছা আচ্ছা!—আমি নাটকীয়ভাবে হেসে উঠলাম,—সারাদিন বিনিময়কৃত খবর নিয়ে শেষ রাতের স্পেশাল টকশো করলা তাহলে?
          দ্যাখো বাজে ইঙ্গিত অনেক করছো, এবার থামাতে হচ্ছে। শোনো, আর ফোন দিবা না। এত নোংরা মানসিকতার কারো সাথে সম্পর্ক থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।
          লাইন কেটে দেয় মমতা। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে একটা শামুক উল্টেপাল্টে দেখছিলাম কোথাও কোনো ভুল রয়ে গেল কিনা। স্বাতন্ত্র্য বানানটার দিকে চোখ পড়ে। স্বাতন্ত্র্য নাকি সাতন্ত্র্য—কোনো মানে হয়? এবং মমতাকে কি আসলেই বিশ্বাস করা যায়?
৬.
রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জোয়ানরা অস্ত্রসমর্পণ শুরু করে। কিন্তু আটকে পড়া দুয়েকটা পরিবারকে উদ্ধার করে তিনি ওই স্থান ত্যাগ করলে এই প্রক্রিয়া থেমে যায়। সকাল থেকে আবারও দু পক্ষের মধ্যে অস্ত্রসমর্পণ বিষয়ে কথাবার্তা চলতে থাকে। একই সময় একজন দুজন করে জিম্মিদের মুক্ত করতে থাকে বিদ্রোহীরা।
          বেরিয়ে তারাই, ভেতরে ঘটে যাওয়া নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিলে, সুযোগ-সুবিধা-বঞ্চিত ও বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত বিডিআরের প্রতি তৈরি হওয়া গণ-সহানুভূতি গতিপথ পাল্টে নিহত সেনা অফিসারদের দিকে চলে যায়।
          প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ভাষণেও বিদ্রোহীদের প্রতি আগেকার নমনীয়ভাব উবে গিয়ে প্রতিস্থাপিত হয় দ্রুত ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ এবং অন্যথায়, কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা।
          বিচার ও শাস্তির ভয়ে অনেক জোয়ান পিলখানা ছেড়ে পালিয়েছে। সারাদেশে ক্যাম্পগুলোতেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে—ট্রেনে বসে এমন অনেক গুজব শুনি।
          সেটা সত্যিকারের আতঙ্ক হয়েই দেখা দেয়, যখন ট্রেনের সব যাত্রীরা মিলে টের পাই, কারো মোবাইলেই নেটওয়ার্ক নেই। কেউ কেউ সবই জানে, তারা বলল, ফোনে ফোনে যেন দেশব্যাপী বিদ্রোহ ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্যই নাকি নেটওয়ার্ক নাই।
          ট্রেন তখন কুমিল্লা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সীমান্তঘেঁষা এলাকা অতিক্রম করছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কারা যেন সারা ট্রেনে দ্রুত এই গুজব ছড়িয়ে দিল যে, সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোতে এরমধ্যেই বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে। ট্রেনেও হামলা হতে পারে এমন আশঙ্কায় আতঙ্কগ্রস্ত যাত্রীরা তৎপর হয়ে ট্রেনের জানালাগুলোর অ্যালুমিনিয়াম শাটার বন্ধ করে দেয়।
          এমতাবস্থায় বিদ্রোহস্থল থেকে সামান্য-দূরত্বে থাকা মমতার কথা ভেবে হঠাৎই আমি ব্যাকুল হই। রাগ বাদ দিয়ে কল দিতে নিই, মনেই থাকে না, কারো মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। দেশের পরিস্থিতি কি আসলেই এত খারাপ?
          ট্রেন আখাউড়া জংশনে এসে দাঁড়ালে, প্ল্যাটফর্মে হকারদের হাঁকডাক শুনে আশ্বস্ত হয়ে, তাও কিছুটা ভয়ে ভয়ে জানালা খোলে যাত্রীরা। সীমান্তবর্তী স্টেশন হিসেবে দুয়েকজন বিডিআরকেও বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় প্লাটফর্মে। কিন্তু তাদেরকে বিদ্রোহী বলে মনে হয় না।
          ঢাকায় পৌঁছানোর একটু আগে মোবাইল নেটওয়ার্ক ফিরে আসে। আব্বুর কল ঢোকার মধ্য দিয়ে বগিতে আমিই নেটওয়ার্ক ফিরে আসার প্রথম সাক্ষী হয়ে যাই। দেখাদেখি বাকিরাও মোবাইলে নিকটজনদের কল দিতে শুরু করলে মুখর হয়ে ওঠে পুরো বগি।
          কী অবস্থা, সব ঠিকঠাক?—আব্বু জানতে চায়।
          ফোনে নেটওয়ার্ক ছিল আপনার?
          না, মাত্রই আসলো।
          তারমানে সারা দেশেই নেটওয়ার্ক ছিল না!
          কখন কোথায় থাকছি, আপডেট জানাতে বলে আব্বু ফোন ছাড়লে মাত্রই মমতার কল ঢোকে।
          আসছো তুমি? কোথায় এখন?
          ফোন পেয়ে সব ভুলে মমতাকে আমি বুকে টেনে নিলাম। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে গেলাম,—কী হইছে জানো না, সারা ট্রেনে সে কী আতঙ্ক, সীমান্তঘেঁষা এলাকা যখন পার হচ্ছিল, ফোনে নেটওয়ার্ক নাই। সবাই বলতেছে বিদ্রোহী বিডিআররা নাকি ট্রেনে গুলি ছুঁড়বে—
          গুছিয়ে উঠতে না পেরেও কয়েক বাক্যেই পরিস্থিতি বুঝিয়ে ফেলতে চাই আমি। তখনই স্টপেজ না থাকা তেজগাঁও স্টেশনে অনির্ধারিতভাবে থেমে গেলে লাইন কেটে তড়িঘড়ি করে ট্রেন থেকে নেমে পড়ি।
৭.
ইতোমধ্যে পিলখানায় ঘটে যাওয়া নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ মিলতে শুরু করেছে। বুড়িগঙ্গা থেকে উদ্ধার হয়েছে ছয়জন উচ্চপদস্থ অফিসারের লাশ। পরিস্থিতি তাদের পক্ষে নেই বুঝতে পেরে ছদ্মবেশে বিদ্রোহীরা পালিয়ে যাচ্ছে। খবর পেয়ে আব্বু কল দেয়।
          ঢাকায় কোনো বন্ধু-বান্ধব নাই যার বাসায় ওঠা যায়?
          হ্যাঁ অনেকেই আছে, কিন্তু আমি কারো বাসায় উঠতে চাই না।
          পরিস্থিতি ভালো না, বিদ্রোহীরা পালাচ্ছে। তারাও তোর মতো হোটেলে উঠতে পারে। দেখা যাবে নতুন কোনো পরিস্থিতিতে তুইও জিম্মি হয়ে গেলি।
          আমি এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিপদ-কল্পনা করতে নিষেধ করলাম। কিন্তু আব্বু কোনোভাবেই এটাকে অতি-কল্পনা বলে স্বীকার করল না।
          এখন তুই কোথায়, ঠিক কোন জায়গায়? কী করতেছিস?
          তেজগাঁও স্টেশনে নামছি। স্টেশনের বাইরেই একটা হোটেলে ভাত খাই। এদিকেই কোনো হোটেলে উঠব।
          এটা করিস না, বরং সরাসরি বইমেলায় চলে যা।
          এমন জার্নির পর একটু গোসল না করে, ফ্রেশ না হয়েই বইমেলায় চলে যাই কিভাবে?
          আব্বুর প্রায় কোনো কথাই আমি কানে তুলি না। কিছুক্ষণ পর একটা আবাসিক হোটেলের ম্যানেজারের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কোত্থেকে এসেছি, আগমনের উদ্দেশ্য ইত্যাদি লেখার ফরম হাতে নিয়ে মৌখিকভাবেও এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। ভাবলাম সেটা হয়তো বর্তমান পরিস্থিতির কারণেই।
তারপর ম্যানেজারের যেকোনো সাধারণ কৌতূহলকেও পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ বলে মনে হলো। ভোরে দেখা স্বপ্নের প্রভাবে নিজের মধ্যেও কেমন যেন একটা পালিয়ে আসা বিডিআরভাব জাগ্রত হচ্ছে, অনেক চেষ্টা করেও যেটা থামানো যাচ্ছে না।
          ফরমে লিখিত বয়স দেখে আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকায়। অবিশ্বাসের প্যাটার্নে ভ্রু কুঁচকে যায় তার,—কী বলেন! বয়স এত কম? দেখে তো মনে হয় না।
          হয়তো সরল কোনো মন্তব্যই ছিল। কিন্তু আমি বলে বসলাম,—কেন, এই বয়স তো বিডিআরে থাকার জন্য যথেষ্ট!
          এই জবাবে ভ্যাবাচেকা খাওয়া ম্যানেজারকে দেখে প্রথমবারের মতো মনে হয়, লোকটা আসলে সাধারণ কৌতূহল থেকেই প্রশ্ন করেছে। ভোরের স্বপ্নের আর কিছুক্ষণ আগে আব্বুর কথাবার্তার প্রভাবে, সামান্য রেজিস্টার খাতার সামনে দাঁড়িয়ে ঘামতে নিচ্ছিলাম!
          আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে রুমে একটা সাবান ও মিনিপ্যাক শ্যাম্পু পাঠিয়ে দিতে বলে করিডোর ধরে হাঁটা দিতেই পেছন থেকে ডেকে বলল,—চাবি নিবেন না?
          সত্যিই এবার আমি ধরা পড়ে গেলাম। বিদ্রোহ থেকে পালিয়ে আসার উত্তেজনা গোপন রাখা গেল না জন্য যেন আমার পিঠের দিকে পিস্তল তাক করেছে হোটেল ম্যানেজার।
          কিন্তু তা নয়, তার হাতে একটি নিরীহ চাবি মাত্র, এবং চাবিটি আমার হাতে তুলে দেওয়ার আগ মুহূর্তে সে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে।
          নাহ, আপনারে একটা নিরিবিলি রুম দিই।
          কেন? নিরিবিলি রুম কেন?—মুহূর্তে সচকিত আমি।
          খাতায় লিখলেন না, লেখক মানুষ? ভাবলাম নিরিবিলি একটা রুম দিই।
          ও আচ্ছা,—বেড়ে যাওয়া হার্টবিটে ব্রেক কষতে কষতে আমি বলি,—না বরং কোলাহলের মধ্যেই একটা রুম দেন।
          ম্যানেজার তবু আগের চাবিটাই হাতে তুলে দিয়ে, করিডোর দিয়ে নয়, বরং পাশের সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে যেতে বলল।
          আপনার মতো আরেকজন আছে তো হোটেলে, উনি একটা নিরিবিলি রুম চাইলেন, তাই আপনাকে বলা।
          আমার মতো একজন বলতে কী বোঝাচ্ছে? তবে কি এই হোটেলে আগে থেকেই পালিয়ে আসা বিদ্রোহীরা থাকতে শুরু করেছে?
          আমার মতো বলতে?—প্রশ্ন করি ম্যানেজারকে, ঠিক তখনই মমতা কল দিয়ে বলে,—আচ্ছা, আমাকে স্বপ্নে দেখে যে ঘুম ভাঙছিল তোমার, কী দেখলা স্বপ্নে, বললা না তো!
          আমি কী বলব ভেবে পাই না। হোটেল ম্যানেজারের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সব কি বলতে শুরু করা যায়?
          মমতাকেইবা কী বলে এড়াব?
          আমি হোটেলে উঠতেছি, রুমে গিয়া বলি?
          না না, এক্ষুনি বলো প্লিজ, হঠাৎ মনে পড়ার পর থেকে খুব কৌতূহল হচ্ছে।
          অগত্যা বলতে নিলাম,—পিলখানার ভিতরে একটা সাইকেল চলার উপযোগী রাস্তা ধরে তুমি হাঁটছো। আমি খুব রেগে গেলাম তোমাকে দেখে। বললাম, আজকে তোমাকে কলেজে যেতে নিষেধ করলাম, আগেই জানতাম আজকে বিদ্রোহের দিন। তুমি বললা আমরা সত্যিই ডিজিকে মেরে ফেলছি কিনা, আমি বললাম, উপায় ছিল না। তবে আমি সেখানে ছিলাম না, আমি এখানে বিডিআরদের সাইকেল পাহারা দিচ্ছি। তখন তুমি আমাকে পালিয়ে যেতে বললা—
          এটুকু শুনেই হোটেল ম্যানেজার তার চেয়ার থেকে যেনবা বসে থাকলে দাঁড়িড়ে পড়ত, বদলে দাঁড়িয়েই থাকার কারণে, বসে পড়ল।
          তার বসে পড়া দেখে,—ও আচ্ছা আমি তো সিগারেট কিনি নাই,—মৃদু এই উচ্চারণপূর্বক হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি। যেন একটা সিগারেটের দোকানই খুঁজছি এমন ভঙ্গিতে একটু এগিয়ে যেতে যেতে, তারপর কোনো দোকানে কাঙ্ক্ষিত সিগারেটই পাচ্ছি না এমন ভাব করে করে হোটেল থেকে অনেকটা দূরে চলে আসি।
৮.
কুড়ি কপি শামুকসহ বইমেলায় ঢুকে দেখতে পাই দোকানপাট বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। পরিস্থিতি বুঝতে না পারা পায়ে এগুতে থাকি। বহেরা তলায় গিয়ে দেখলাম এখানকার দোকানপাট আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। একমাত্র আশিক আকবরই শেষ ব্যক্তি হিসেবে তার স্টলের মালপত্র গোটাচ্ছে।
কী ব্যাপার আশিক ভাই, মেলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কেন?
একাগ্রচিত্তে আশিক আকবর মালপত্র গোটাতেই ব্যস্ত থাকে।
শামুকের নতুন সংখ্যা বের হলো, সেটা দিতে আসছিলাম, সবই স্টলই তো বন্ধ, কাকে দিব?
প্রতিষ্ঠানবিরোধী মুভমেন্টে সরাসরি যুক্ত থাকা ব্যক্তি হিসেবে এবার তিনি সাড়া দেন। অবশ্য মৃদুচালে।
আমাকে দিয়ে যেতে পারেন কয়েক কপি, তবে সবগুলো নয়!—কিছুটা নির্দয় স্বরে দয়া দেখাতে ভালোবাসে বলে মনে হলো। তাও যথেষ্ট, আপাতত চলবে।
বিশ কপি শামুক দিতে চাইলাম। জবাবে,—মেলা প্রায় শেষ, অবিক্রিত শামুকে পা কাটতে চাই না,—বলে তিনি মাত্র পাঁচ কপি শামুক নিতে চাইলেন।
২৮ তারিখ বিকালে এসে দাম নিয়ে যাবেন।
বিক্রি হলে আর কি!
না হলে অন্তত শামুকগুলো তো নিয়ে যাবেন?
অবশ্যই অবশ্যই,—ব্যস্ত বাক্য সমাপ্ত করি।
স্টল ফাইনালি বন্ধ করে এবার আমার শুরুর দিকে করা প্রশ্নটির প্রতিও সদয় হয়,—বিডিআর ইস্যু,—তবে খুবই সংক্ষিপ্ত জবাব। যেন এটুকুতেই রিলেট করতে পারি কিনা সেই পরীক্ষা। কমরেডকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় হই।
বইমেলা থেকে বেরিয়ে মমতাকে কল দিই। ফোন বন্ধ। এত করুণ লাগে সব। নিজেকে। কাঁধের জামা-কাপড়বোঝাই ব্যাগ, শামুকের অবশিষ্ট ঢাউশ কপিগুলোর ওজন। নিতে পারছিলাম না। আব্বুকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,—ফেনী আসার বাস ঢাকার কোত্থেকে যেন ছাড়ে?
বলিস কী! তুই বাসে আসবি?—আমার বাসভীতির ব্যাপারে আদ্যোপান্ত জানা আব্বু বিস্মিত,—তোর না বাসে বমির সমস্যা?
তা আছে, সেজন্য বমির ট্যাবলেট খেয়ে নিব নে,—দুখী কণ্ঠে আমি আব্বুকে বলি।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত