সোনাইর বিয়ে পাখির সাথে

ঝুলবারান্দার জানালায় নয়া সকালের নরম রোদে এক শালিকের সাথে ছোট সোনাইয়ের আলাপ করা দেখে টাসকি মেরে গেলেন আবুবর সাহেব। তিনি চুপিসারে সোনাইর পেছনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন কী আলাপ চলছে তাদের ভেতর। কিন্তু শালিকটি তাঁকে দেখে লেজ নাড়িয়ে ওপরের গ্রীলে উঠে গেল। সেখানে গিয়ে লাফাতে থাকল আর ঠোঁট ঠুকরাতে লাগল শব্দ করে। সোনাই মাথা ঘুড়িয়ে ঠোঁটে আঙুল রেখে আবুবর সাহেবকে ইশারায় বলল, চুপ! চুপ! আলাপ করছি ওর সাথে।
– কী আলাপ? হাত ইশারায় জানতে চাইলেন আবুবর সাহেব।
– আমার বিয়ার আলাপ।
ফিসফিস করে বলল সোনাই। বারো তেরো বছরের ছোট মেয়ে সোনাই পাখির সাথে তার বিয়ে নিয়ে আলাপ করছে। আবুবর সাহেব অবাক হলেন। তোতলাতে লাগলেন। বললেন, তো-তোর বিয়ে? কা-কার সাথে?
– পাখির সাথে।
–  পা-পা.., প্রায় হেসে ফেলতে যাচ্ছিলেন তিনি, কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, পাখি কি বলে?
– ভা-ভা-ভা  লো-লো-বাস্। ভালোবাসতে বলে দাদু।
– তাই নাকি?
– হ্যা । চুপ করে দেখো বলবে আবার।
আবুবর সাহেব চুপ হয়ে বসে পড়লেন। সোনাই মাথা ঝাকিয়ে শালিককে কী যেন জিজ্ঞেস করল। পাখি চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর এখানে ওখানে লাফালাফি করল। সোনাই একই ইশারায় আবার পাখিকে জিজ্ঞেস করল। অমনি পাখিটি বলল, কু-কু-কু  কো-কো-কোক।
– দেখলে দাদু, ভা-ভা-ভা  লো-লো-বাস্।
– দারুণ তো! এটা তুই ভালোবাস্ ধরে নিয়েছিস।
– সেটাই তো বলছে। দেখো আবার শোনো।
আবার পাখিকে জিজ্ঞেস করল সোনাই। কিন্তু পাখি আর বলল না।
– লজ্জা পাচ্ছে তো, তোমার সামনে বলতে চাচ্ছে না। থামো আর একটু দেখি, তুমি চুপচাপ বসে থাকো। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর পাখি আবার কু-কু-কু কো-কো-কোক করে উঠল।
– দেখলে?
– কই, সেই একই তো কু-কু-কু  কো-কো-কোক বলছে।
– আরে দাদু, শব্দকে মাথার মধ্যে আগাম ধরে রাইখো না। ছেড়ে দাও, না হলে শব্দের চমৎকার রূপ দেখতে পাবে না। শুধু আগে থেকেই তুমি মাথায় কুকুকু শব্দ ধইরা রাখছ। তারপরেই বলল, কেমন প্রেমের চোখ ওর। দেখো কেমন মায়ামায়া লাগে। জানো দাদু, কোমরে হাত রেখে বলল সোনাই, ওকে এতো ভালোবাসি, তাও ওর মন ভরে না। খালি বলে, ভা-ভা-ভা  লো-লো-বাস্। আর কতো ভালোবাসি কন তো?
– ভালোবাসার কি আর শেষ আছে রে? তুই ভালোবাসতেই থাক। ভালোবাসতে বাসতে জীবনটা দিয়ে দে।
– বোকা দাদু। ভালোবেসে জীবন দিলে সেটা কি আর ভালোবাসা থাকে? দহন হয়ে যায়। ভালোবাসার দহন।
– ধুরো পাগল। লাইলি-মজনু শিরিফরহাদ জানিস না, সম্রাট শাহজাহানরে নিয়া মমতাজের প্রেমকাহিনী শুনিস নি?
– শুনছি। কিন্তু কই সেখানে ভালোবাসা দাদু। সবই তো দহন দেখি। বিরহ দহন।
– ভালোবাসলে দহন তো থাকবেই।
– হয়ত এটাই বুঝি ভালোবাসা, তাই না দাদু? যেমন আমার এই পাখিটা, এতো ভালোবাসি তারে, তাও এক কথা বলে। ঐটারে কলিজা কাটি খাওয়াইলেও কইবে, ভা-ভা-ভা  লো-লো-বাস্। হাত নাড়িয়ে বলল সে।
আবুবর সাহেবের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। জামানা কি বদলে গেছে পুরোদমে?
– তুই একটা পিচ্চি মেয়ে, এতোসব বুঝিস কেমনে রে, হ্যা।
– বুঝি দাদু। আমি যে একজনরে ভালোবাসি।
– তুই ভালোবাসিস? একটা পিচ্চি মেয়ে কী বুঝিস ভালোবাসার? হ্যা, কাকে ভালোবাসিস?
– পাখিকে।
বলেই সে উঠে পরে। পিটপিট তাকিয়ে মৃদু হাসির ছলে গুনগুন করে গান ধরে আর হাঁটতে হাঁটতে পেছন ফিরে তাকাতে তাকাতে গাইতে থাকে,
ফুড়ুৎ করে আসে পাখি
বাজরা ক্ষেতে নামে ঝর
তুই বন্ধুরে আমার ভেতর ঘর।
বন্ধু-রে…
আবুবর সাহেব হা হয়ে তাকিয়ে থাকেন।
সোনাই হাসতে হাসতে চলে যায়। দু’একবার পেছন ফিরে তাকানোর পর আর সে তাকায় না। হাসতে হাসতে গাইতে গাইতে সে আপন মনে যেতে থাকে। আবুবর সাহেব খেয়াল করেন, সোনাই চলে যেতে যেতে একটা সুর যেন ধরিয়ে দিয়ে তাঁর প্রাণে। তিনিও গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন,
ফুড়ুৎ করে আসে পাখি—

 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত