পরী

আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। দুরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সব ঝাপসা হয়ে আছে। কাছের পানিতে বৃষ্টির ফোটা পড়া দেখতে দেখতে চোখ আরামে বুজে আসছে। মিসির আলি ঢাউস সাইজের একটা ছাতা নিয়ে দাড়িয়ে আছে পাশে। ছাতার উপর পড়া ফোটাগুলো সোরগোল তুলছে। বিষ্ময় মাখা দৃষ্টি নিয়ে আমরা বসে আছি, না ভুল হচ্ছে আমি শুয়ে আছি কুন্ডুলি পাকিয়ে একটা ছোট্ট ডিঙিতে। লেপ তোষকের ব্যাবস্থা মনে হয় মিসির আলিই করেছে। মনে পড়ছে না। তার সাথে তার গ্রামের বাড়ি এসেছি এটুকু কেবল মনে পড়ছে। মনে মনে তাকে একটা সাবাস দিতে ইচ্ছে করছে। ভরা নদির মাঝখানে এরকম সুন্দর একটা আয়োজন করার জন্য । ব্যাটা মনে হয় এই একটা মজার কাজ করল। ভ্রুঁ কুঁচকে তাকানো ছাড়া আর কোন কাজই সে করতে পারে না আজকাল। শুয়ে শুয়ে নদি, বৃষ্টি, মেঘের গর্জন,নৌকার দুলুনি আর নদির পাগলাটে ভাব বেশ লাগছে। শুধু মনে হচ্ছে, ইস্ , অনন্তকাল যদি এভাবে কাটিয়ে দেয়া যেত!

এইসময় মিসির আলি কি যেন বলল। তার দিকে তাকিয়ে মনে হল দূর থেকে তার কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। এবার তার স্বর অনেকটা স্পষ্ট। আমার নাম ধরে ডাকছে।
কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এরকম পরিবেশে কি আর কথা বলতে ইচ্ছে করে? তারপরও বললাম,
– কি?
– চল্ , বাড়ি ফিরতে হবে।
– মাথা খারাপ, এমন সুন্দর দৃশ্য ফেলে বাড়ি ফিরব!
মিসির আলি এবার আমার গায়ে ধাক্কা দিতে লাগল। গোঙ্গানোর মত স্বরে বললাম,
– থাম্ , পড়ে যাবো তো নদিতে!
কথা না শুনে সে ধাক্কাতেই লাগল। নদিতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম।

বুঝতে কিছুক্ষন সময় লাগল আমি কোথায় আছি। শুয়ে আছি মিসির আলির গ্রামের টীনের চালার বাড়িতে। দীর্ঘ দিন কেউ থাকে না বলে অনেকটা পরিত্যক্ত ভাব ফুটে উঠেছে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে । মনে হচ্ছে ঘরের চালা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ অদ্ভুত লাগছে। আমার গা ঘেঁষে দাড়িয়ে মিসির আলি।

গতকাল বিকেলে জরুরী তলব পেয়ে তার বাসায় গিয়েছিলাম। যাওয়া মাত্রই বলল,
– চল্।
– কোথায়?
– গ্রামে।
গ্রাম শব্দটা শুনেই মন আনচান করে উঠল।
– কখন যাবি?
– এখন।
– এখন মানে?
– কেন সমস্যা আছে?
– না মানে, আমতা আমতা করে বললাম, প্রিপারেশনের ব্যাপার আছে না?
– কিসের প্রিপারেশন, হিমালয় জয় করতে যাচ্ছিস নাকি?
– অন্তত কিছু কাপড় চোপড় তো দরকার!
– দুদিন থাকব, অত কাপড়ের দরকার কি? যেটা পড়ে আছিস যথেষ্ট ।

কথা বাড়ালাম না। যদিও অপরিচ্ছন্নতা মিসির আলির সাথে যায় না। মনে হয় জরুরী ব্যাপার হবে। সত্য বলতে কি মিসির আলিকে বন্ধু মহলে আমরা বেশ সমীহ করেই চলি। তার জীবনের উদ্দেশ্য সে মিসির আলি হবে। মিসির আলি হতে পারবে কিনা জানি না তবে মিসির আলি হওয়ার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি তার মধ্যে দেখছি না। সত্যিকারের মিসির আলির যুক্তি-তর্কের ক্যারিশমা বইয়ে পড়েছি আর এই হবু মিসির আলির সাথে যুক্তিতে আজ পর্যন্ত আমরা কেউ পেরে উঠিনি। তাই যুক্তি-তর্কে না গিয়ে, কি কারণে গ্রামে যাওয়া জিজ্ঞেস না করেই রাজী হয়ে গেলাম। সারারাত বাসে চড়ে ক্লান্ত হয়ে গভীর রাতে অজোপাড়া গাঁয়ে যখন পৌঁছলাম গভীর রাত। গ্রামের জোনাকি দেখার সামান্যতম ইচ্ছেও মনে আসে নি। অন্ধকারে জোছনার ভিতর হেটে তার বাড়ি যখন পৌছলাম রাত একটা । জন মানুষের চিহ্ন নেই। অবশ্য এমন অজোপাড়া গাঁয়ে অত রাতে মানুষ আশা করাও যায় না। আকাশের অবস্থাটা বুঝলাম না। কাল অমন পরিষ্কার ঝকঝকে, অসংখ্য তারা ভরা আর আজ তুমুল বৃষ্টি। এমন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম স্টেশন থেকে হেটে আসতে হয়েছিল বলে প্রকৃতিতে বিভোর হওয়ার বদলে বিছানা টেনে নিয়েছিল। এখন ঢুলুঢুলু চোখে বিছানার পাশে দাড়িয়ে থাকা মিসির আলি কে দেখছি।
মিসির আলি বলল,
– উঠ্ উঠ্ , আর কত বেলা পর্যন্ত ঘুমাবি?
হাই তুলতে তুলতে বললাম,
– ক’টা বাজে?
– সাড়ে ছয়টা বেজে গিয়েছে!
রাগে বিষ্ময়ে বললাম,
– কি বললি, সাড়ে ছয়টা!
– তা নয়ত বলছি কি?
– যা তো ঝামেলা করিস্ না, এগারোটার আগে ঘুম থেকে উঠার প্রশ্নই আসে না।
বলতে বলতে আবার শুয়ে পড়ছিলাম কিন্তু মিসির আলি নামক বস্তু থেকে কি সহজে নিস্তার পাওয়া যায়! ভোরে ঘুম থেকে উঠার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যে লেকচার আরম্ভ( আসল মিসির আলি একাই কাজে নামত, লেকচার দেয়ার লোক না) করল ঘুমের বারটা এমনিতেই বেজে গেল। ঘুম কেটে গেছে তারপরও ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসার ভাবটা বজায় রাখার চেষ্টা করছি। এবার মিসির আলি খানিকটা অনুনয়ের সুরেই বলল, উঠ্ না, প্লিজ । ঘুরতে তো আসি নি, এসেছি কাজে। শহরে ফিরে না হয় ইচ্ছে মত ঘুমাস! আজকাল মিসির আলির অনুরোধ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । তাই দুই একটা হাই দিয়ে উঠে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
– নাস্তার ব্যাবস্থা কি?
– হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে আয়।
– হাত- মুখটা ধুব কোথায়?
– বৃষ্টির পানি ধরে রেখেছি , তাই দিয়ে কর। কলটা নষ্ট হয়ে গেছে!
– আর বাথরুম?
এবার তাকে খানিকটা অসহায় দেখাল।
– গ্রাম তো জানিস, পাকা টয়লেট নেই। আর আমরাও তো থাকি না তাই করাও হয় নি। বাড়ির পিছন দিকে কাঁচা টয়লেট স্থানীয় ভাষায় যাকে টাট্টি বলে একটা আছে। সামনের পর্দাটা ছিড়ে গেছে , আমি কাজ চলার মতন একটা গেরো সকালে দিয়েছি । ঐটা দিয়ে কাজ সেরে আয়।
শুনেই মনটা চুপসে গেল। উপায়ান্তর না দেখে সেদিকেই এগোচ্ছি। মিসির আলি পিছন থেকে বলল, সাবধানে যাস্ , পা পিছলে আবার পড়ে যাস না যেন। ওর উপদেশ আমার ভয়ের মাত্রাটা একটু বাড়িয়েই দিল। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে হঠাৎ। ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত আছে নাকি? মনে হচ্ছে মাঝখানে আছি এখন। দিগ্বিজয় করে নাস্তার টেবিলে এসে মনটা আবার শুকিয়ে গেল।

কয়েকটা নান রুটি আর ফ্লাক্স ভর্তি চা।
– কিরে, রুটি খাব কি দিয়ে?
– চা দিয়ে খা। অনেক খুঁজেছি কিন্তু কিছু পাই নি।

মিসির আলির মুখটা দেখে খেতে বসে গেলাম। বেচারাকে লজ্জ্বা দিতে ইচ্ছে করছে না। চা টা ভাল। খেয়ে সিগারেট ধরিয়েছি এসময় মিসির বলল,
তুই মনে হয় ঘুমে স্বপ্ন দেখছিলি।
– না তো! ( আমার এত সুন্দর স্বপ্নটা মিসির আলির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে চিড়ে চ্যাপ্টা করার কোন ইচ্ছে নাই। স্বপ্নের আমেজটা এখনও রয়ে গেছে।)
– কিন্তু তোর চোখ পিট পিট করছিল, যাকে বলে র্যাপিড আই মুভমেন্ট, স্বপ্ন দেখার সময় হয়।
– তুই ভুল দেখেছিস।
– ভুল দেখিনি, তুই বলতে না চাইলে থাক।

চুপ চাপ খেতে লাগলাম। বললাম,
তোর বিষয়টা কি, শুধু বলেছিস কাজ, কিন্তু কি কাজ এখনো বলিস নি। সে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
– পরী।
আমি বিষম খেলাম। কি বললি?
সে শান্তভাবে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, জ্বীন পরী।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, তুই এসবে বিশ্বাস করিস?
– না, সেজন্যইতো আসলাম ব্যাপার কি দেখার জন্য ।
– তুই এখানকার পরীর খবর শহরে বসে জানলি কিভাবে?
– ওহ্ , কিছুদিন আগে গ্রামের এক দুরসম্পর্কের আত্নীয় টাকার সহযোগিতা চেয়ে বাবার কাছে চিঠি লিখেছে। তার ছেলেকে নাকি পরী ধরেছে। পানি পড়া , ওজা করতে করতে সর্বস্বান্ত।
বললাম,
– ওহ্, তোর পরিকল্পনা কি?
– এখনো ঠিক করি নি, বের হয়ে তথ্য সংগ্রহ করাটায় এখন কাজ।
কিছুক্ষন পর কাঁচা রাস্তা তাও কাঁদা পানিতে মাখামাখি , কোনমতে নিজেদের বাঁচিয়ে হালিম ভাইয়ের বাসার কাছাকাছি পৌঁচতেই অনেক সোরগোল কানে এল। ব্যাপার কি দেখার জন্য আরো কাছাকাছি আসতেই চোখ কপালে উঠার উপক্রম। উঠোন ভর্তি একগাদা বাচ্চা কাচ্চা। সবার চোখে মুখে একই সাথে ভয় রহস্য আর আনন্দ খেলে করছে। কিছু যুবা বৃদ্ধ পুরুষ মহিলাও হাজির হয়েছে। সবার চোখে মুখে উত্তেজনা। তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম একজন লোক বৃষ্টি ভেজা মাঝারি আকারের আমগাছের ডগায় উঠে বসে আছে। আপন মনে এমনভাবে কথা বলছে যেন কারো সাথে কথা বলছে। নিচের এই হৈ হট্টগোলের ব্যাপারে একেবারে নির্বিকার। দেখে গা দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। যে কোন সময় লোকটা পড়ে যেতে পারে। এসময় একজন মাওলানা টাইপ মানুষ দেখলাম ক্রমাগত দোয়াদরুদ পড়ছে আর কাছে থাকা যুবকদের কি যেন বলছে। ওরা সবাই ঠিক গাছের নিচে। আর সবাই ঠিক দূর থেকে দাড়িয়ে সামনে ঘটা অস্বাভাবিক কান্ড দেখছে। আমি আর মিসির আলি আছি তাদেরও পিছনে। গ্রামের এই হঠাৎ ঘটা ঘটনায় আগন্তুক হিসেবে দুজনেই খানিকটা ভড়কে গিয়েছি। যুবকদের লুঙ্গিতে গেরো দেয়া দেখে মনে হচ্ছে তারা গাছে উঠবে আর হুজুর তাদের ভরসা যোগাচ্ছে।
মিসির আলিকে জিজ্ঞেক করলাম, গাছে বসে আছে লোকটা কে?
মিসির আলি অনুচ্চ স্বরে বলল, ঐটাই হালিম ভাই।
মিসির আলির মত গলা খাদে নামিয়ে বললাম, বলিস কি ! ওখানে কি করছে?
মিসির আলির মুখে এবার একটু রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।
-জ্বীন পরীর সাথে কথা বলছে মনে হয়।
এতক্ষন পর আমিও চোখের সামনের এইসব ঘটনার আবছা একটা সুত্র পেলাম যেন।
-কিন্তু উঠল কি করে?

মিসির আলি ইশারায় যেন বলতে চাইল , এসব আলাপ পরে হবে, এখন কি ঘটে সেটা ভাল করে দেখ। তার কথা মত চুপ করে গেলাম। এরপর কিছুক্ষন যা ঘটল তা অমানুষিক। চারজন মিলি একজন লোককে গাছ থেকে নামিয়ে আনতে কি কষ্টটাই না করে গেল! জ্বীর্ণ দেহ নিয়ে লোকটা যেভাবে ভেজা গাছটার এক শাখা থেকে আরেক শাখায় চলে যাচ্ছে গাছে উঠা যুবকদের এড়াতে আর এদিকে এই পড়ে গেল ভেবে নিচের লোকজনের ভয়ার্ৎ চিৎকার। এভাবে চলতে চলতে যুবকেরা ঠিক কায়দা করে লোকটাকে নামিয়ে আনল একসময়।
মিসির আলি গলা নামিয়ে বলল , চল , এখন এখানে থেকে লাভ নেই, বাসায় যাই। আমিও আর হজম করতে পারছিলআম না । বললাম, চল।
পুরনো একটা কেরোসিনের স্টোভ জ্বালিয়ে দুপুরের খাবারের আয়োজন করলাম । মিসির আলির আত্নিয়-স্বজন মনে হয় নেই তেমন। কাউকে আসতে দেখলাম না। পথে দুয়েকজনের সাথে কুশল বিনিময় এতটুকুই মনে হয় গ্রামের সাথে যোগাযোগ। মিসির আলিও আড্ডা প্রিয় লোক নয়। তার সাথে কারো সম্পর্ক তৈরি হওয়া কঠিন ব্যাপার।
খাওয়া শেষ করে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার প্রতিশোধ নিতে আরেক দফা ঘুমানোর চেষ্টা চালালাম। কিন্তু এরকম ঘটনার পর কি সহজে ঘুম আসে। হালইম ভাইয়ের ওখান থেকে আসার পর পরী নিয়ে আর কোন আলোচনা হয় নি আমাদের মাঝে। মিসির আলি কে জিজ্ঞেস করি নি কিছু । বলার সময় হলে সে নিজে থেকে বলবে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর ভাবনায় নিমজ্জ্বিত। একটা পাগলের পাগলামি ছাড়া তেমন ভাবনা মাথায় আসছে না। একটা গাছে উঠে পরীর সাথে কথা বলছে একে পাগলামী ছাড়া আর কি বলা যায়?
আবার বৃষ্টি পড়ছে। সকালের মতন ভারী না। হালকা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি । তর্জন গর্জন নেই। মিসির আলি বলল , বিশ্রাম নে, হালিম ভাইয়ের ওদিকে একটু স্বাভাবিক হয়ে আসুক। বিকেলের দিকে যাব ভাবছি।
বললাম,
-মাথা খারাপ হয়েছে তোর! এরকম ঘটনার পর কি সহজে স্বাভাবিক হয়?
মিসির আলি হাসল, বলল,
– আমার মনে হচ্ছে এটা হালিম ভাইয়ের নিত্যনৈমন্তিক ব্যাপার।
– কেন তোর এরকম মনে হচ্ছে?
– কেন? মিসির আলি একটু চুপচাপ। তাইতো মনে হল। সকালবেলা লোকজনের চোখমুখ দেখে। এধরণের ঘটনা প্রথম ঘটার উত্তেজনা সেখানা ছিল না। মনে হয়েছিল তারা আগেও অনেকবার দেখেছে। সবাই বেশ স্বাভাবিক ছিল।
-আমার তো তেমন মনে হয় নি?
-তুই নিজে কিছুটা উত্তেজিত ছিলি। তাছাড়া গ্রামীন লোকজনের আচরণের সাথে তুই তেমন পরিচিত না।
অকাঢ্য যুক্তি। ফেলে দেয়ার মতন না।
-চল তাহলে , বৃষ্টি থামার পর যাই।

বৃষ্টি থামার পর কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে হালিম ভাইয়ের বাসায় পৌঁছালাম। জীর্ণ একটা দুরুমের ঘর। চারদিকে ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে আছে। উঠোনে আসতেই অল্পবয়সী এক গৃহবধু ঘোমটা দিয়ে কোনদিকে উধাও হয়ে গেল আর দেখলাম না। ময়লা মেঝেতে দুই-আড়াই বছরের একটা বাচ্চা আপন মনে খেলছে। আর ঘরের একটা খুটির সাথে শিকল দিয়ে হালিম ভাইকে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাড় সর্বস্ব শরীরটা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। আমাদের বিষ্মিত করে তিনি উঠে বসলেন। ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বললেন, জুনায়েদ, তুই কখন আসলি?
অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি তখন মিসির আলি বলল, এইতো কাল রাতে। মনে পড়ল মিসির আলির আসল নাম জুনায়েদ, ভুলেই গিয়েছিলাম।
– ঐটা কে?
– আমার বন্ধু, শহরে থাকে, আমার সাথে এসেছে?
আমি সালামের মত ভঙ্গী করলাম। কিন্তু হালিম নামের লোকটা আতিথেয়তায় ব্যস্ত হয়ে উঠল।
– কই গো , শহর থেকে মেহমান আসছে। নাস্তা পানি কিছু দাও!
কোন সাড়াশব্দ এল না, আশাও করিনি। এদের বাড়িতে আজ খাবার জন্য একটা চালও আছে কিনা সন্দেহ।

মিসির আলি বলল, দাদা ,তুমি ব্যাস্ত হয়ো না, আমরা মাত্র খেয়ে এসেছি, আবার আসলে খাব। কিন্তু তোমার শরীরের এ হাল কিভাবে হল?
– কিভাবে আর হবে? ঐ মাগীটা আমাকে কিছু খেতে দেই? সব নিজের পেঠে ভরে!
এ সময় বেড়ার ওপার থেকে থালা বাটির ঝনঝন আওয়াজ শুনলাম। বুঝলাম প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
শুরু থেকেই আমি চুপ এবার মিসির আলিও একটু দ্বিধায় পড়ল মনে হয়। আরেকপক্ষ সজাগ বসে আছে তো!
– দেখছিস্ দেমাগ?
– কি বল ,দাদা, ভাবি কেন তোমাকে ফেলে একা খাবে, এ তোমার ভুল ধারণা।
একটু চিন্তা করে হালিম ভাই কথাটায় সায় দিল।
– ঠিক তো, কতদিন কাজে যাই না! খাবার আসবে কিভাবে?
আবার চুপচাপ । কথাবার্তা তো ঠিকই আছে, শুধু চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল।পুরো মানুষটার ভিতরেই একটা গা গুলানো অস্বাভাবিকতা আছে। ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না।এই লোকটা সকাল বেলা কি কান্ডটা করল? মনের কথাটা মিসির আলি ঠিকই ধরল।
– দাদা তোমার পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে কে?
– হুজুর ।
– কেন?
এবার হালিম ভাই লাজুক হাসল।
– পরীর কাছে যাই তো , তাই।
– তুমি পরীর কাছে যাও?
– হ্যাঁ ।
– কি পরী? আকাশের পরী?
– হ্যাঁ ।
মিসির আলি আমার দিকে তাকাল।
– পরীর কাছে কিভাবে যাও?
দূরের আমগাছটা দেখিয়ে বলে,
– ঐ ওখানে এসে সে আমার জন্য বসে থাকে ,আমাকে ডাকে। এখানে তো সে আসতে পারে না।
– কেন?
– বাহ্ রে, এখানে হুজুর দোয়া পড়ে পানি ছিটিয়ে দিয়েছে না?
– তাও ঠিক, কি কর পরীর সাথে, কি কথা বল?
– কত কথা বলি, মনে থাকে না, তবে আমাকে সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়, ভাল ভাল খাবার খেতে দেয়।
– কি খাবার?
– ভাল ভাল খাবার । কোরমা, পোলাও, ভুনা গরুর মাংশের খিচুড়ি, দই আরো কত কি?
দরজার ওপাশ থেকে মেয়েলী কন্ঠের খিল খিল হাসি ভেসে আসল। বুঝলাম হালিম ভাইয়ের বউ? হাসি আমারও পাচ্ছে। অভদ্রতা হবে বলে দাঁতমুখ খিচিয়ে বসে আসি। কিন্তু মিসির আলি গম্ভীর। মনে হয় সে উত্তর খুঁজে ।
– কি ভাবি অমন হাস কেন? পরী পোলাও মাংস খাওয়ায় বলে হিংসে হয়?

বুঝলাম মিসির আলি তার সাথে ভাব জমাতে চায়। হয়ত তার সাথেও সে কথা বলতে চায়। কাজ হল,
– হ্যাঁ ভাই, সতীন একটা পেলাম তো তাও আবার পরী। মাঝে মাঝে শিকল খুলে দিই। ঐ ভাবে দেখতে খুব কষ্ট লাগে তো! খুব পাহারা দিয়ে রাখি, দরজার শিকল দিই, তারপরও কেমন করে ঘর থেকে বের হয়ে ঐ আম গাছের ডালে গিয়ে বসে একা একা কথা বলে। তারপর নামিয়ে আনাটা কি কষ্টের বোঝাতে পারব না। চারপাঁচ জন একসাথে উঠে গাছ থেকে নামাতে চায় কিন্তু গাছে ডালপালা এমনভাবে আকড়ে ধরে হাত পায়ের চামড়া ছিলে যায় তবু নামবে না! অমানুষিক শক্তি যেন ভর করে তখন। আজও করল। আর সাহস পাই না শিকল খুলে দিতে।

তার কন্ঠের হতাশা স্পষ্ট ধরা পড়ে। মুখ দিয়ে সহসা কথা বের হয় না। হালিম ভাই বলে,
– দেখছস্, নিজে কিছু খাওয়াতে পারে না তাই পরী খাওয়ায় বলে হিংসা। আমাকে গাছে উঠতে দেয় না।
– তা তো ঠিক , হালিম ভাই । তো পরীর সাথে যেখানে ঘুরতে যাও সেখানে আর কে থাকে?
– আর কেউ তো থাকে না! শুধু আমরা দুজন।
– যেখানে ঘুরতে যাও জায়গাটা কেমন?
– একটা জঙ্গল। মাঝখানে সুন্দর একটা ঘর আর একটা পুকুর। আমরা সেখানে গোসল করি। সাঁতার কাটি। আমি তাকে সাঁতার শিখাই। উড়তে জানলে কি হয় সাঁতার জানে না, হা- হা-হা। (হাসিটা কি বিভৎস।)
ওপাশ থেকে আবার খিল খিল হাসির শব্দ শোনা গেল কিন্তু হালিম ভাইয়ের গালিতে থেমে গেল।

হালিম ভাইয়ের বিকট অমানুষিক হাসি থামার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তারপর মিসির আলি জানতে চায়,

– পরী তো আগুন ভয় পায়। রান্না কি তুমি কর?
– আরে না, সে যাদু জানে, চোখের পলকেই যেকোন খাবার হাজির করে। আমাকে সে কোন কষ্ট দেয় না। সারাক্ষন আমার সেবা করে।
– পরী দেখতে কেমন?
– সুন্দর, খুব সুন্দর, সিনেমার নায়িকারা পাত্তা পাবে না!
হালিম ভাইয়ের চোখ মুখ উদ্ভাসিত। মিসির আলি এবার যা বলল তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তত ছিলাম না।
– আচ্ছা, হালিম ভাই, তোমরা তো অনেকটা সময় একসাথে কাটাও, তোমাদের মাঝে ইয়ে হয় না?
– কি?
– ঐ জামাই বউয়ের মধ্যে যা হয় আর কি?
হালিম ভাই মনে হয় না একটু লজ্জ্বা পেল বরং মনে হল তার মুখে একটা রাগী ভাব উঁকি দিয়ে মিলিয়ে গেল।
– না।
– কেন?
– বিয়ের আগে ওসব হারাম , পরী বলে।
– তাহলে বিয়ে করে ফেল না কেন?
– ও বলেছে সতীন রেখে সে বিয়ে করবে না।
– তাহলে উপায়?
– তাইতো সারাক্ষন ভাবি । পরী অবশ্য উপায় নিশ্চয়ই একটা বের করবে। অনেক বুদ্ধি।

একটু চুপ থেকে আবার বলতে লাগল, পরীকে বিয়ে করলে জীবনে কোন কষ্ট থাকবে না। শুধু আমরা দুজন। পৃথিবীর কোন কষ্ট আমাদের স্পর্শ করবে না। শুধু শান্তি আর শান্তি। হালিম ভাই আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগল।
বলতে বলতে হালিম ভাই তার বাচ্চাটার দিকে তাকাচ্ছিল। তার চেহারায় কেমন যেন অস্বস্থি। একদিকে বৌ-বাচ্চা, অন্যদিকে পরী।
মিসির আলির তথ্য সংগ্রহ মনে হয় আপাতত শেষ। আড়ালে থাকা ভাবি আর সামনে বসা হালিম ভাই দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে মিসির আলির বাসায় ফিরলাম। ফ্লাক্সটা ভালই ছিল। চা এখনও গরম।

মিসির আলির কাছে জিজ্ঞেস করি ,
– কি রে কি বুঝলি?
– বোঝার কি আছে?
– মানে?
– হালিম ভাই মানসিক ভাবে অসুস্থ এই তো!
– পরীর ব্যাপার টা?
– নিজের কল্পনা। হ্যালুসিনেশন। পরী তাকে কি খাইয়েছে একটু চিন্তা কর। যে খাবার গুলো হালিম ভাই জীবনে একবার না একবার খেয়েছে সেগুলোই। পরীর রাজ্যের কোন খাবার কি ছিল?
– কিন্তু ঐ হালকা শরীর নিয়ে গাছে উঠা?
– মনের জোরে সব করা যায়।
– হালিম ভাইয়ের ভবিষ্যত কি?
– ঐটায় ভাবনার বিষয়। উনার দরকার মেডিকেল ট্রিটমেন্ট কিন্তু নিবে না হুজুর বৈদ্যে আস্থা। আবার ডাক্তারী ট্রিটমেন্টের খরচ নেহাত কম নয় এ ধরণের রোগীর ক্ষেত্রে।
– তাহলে কি হবে?
– শোন এরা গরীব। এদের কাজ করে খেতে হয়। মানসিক রোগ নিয়ে বিলাসীতা সাজে না। মোটামুটি একটু ভাল হলে কাজ শুরু করে দিবে তারপর আধা মানুষ- সিকি মানুষ হিসেবে জীবনটা শেষ করবে। একদম পাগল যে কেউ হয়ে যায় না তা বলছি না।
– আমাদের কি কিছু করার নেই?
– থাকত যদি পকেটে অনেক পয়সা থাকত। এত ভাবছিস কেন? শহরে প্রতিদিন গাড়ির নিচে পড়ে কত মানুষ মারা যায় না? মিসির আলি বোধহয় ক্ষেপে আছে। নাহলে এভাবে বলত না।

দুজনে চুপচাপ বসে আছি। মনটা খারাপ হয়ে আছে। যুক্তির মানুষ মিসির আলিরও। মিসির আলি গম্ভীর। হঠাৎ মুখ তুলে বলল, হালিম ভাই আসলে আর সহ্য করতে পারছে না। সে মুক্তি চায়। এই পারিপার্শ্বিকতা আর মেনে নিতে পারছে না। ক্ষুধার কষ্ট? পরীতেই সমাধান। আর এধরনের মানসিক রোগীর সাথে সমাজের ব্যাবহার ভাল নয়, তাই শুধু পরী আর সে ছাড়া কেউ থাকবে না, পরীতেই সমাধান, পরিশ্রমে পরিশ্রমে শরীর নষ্ট হয়ে গেছে, পরীতেই সমাধান । এক পরী দিয়েই জীবনের সব সমস্যার সমাধান করতে চায় । মনের গোপন বাসনা পরীতে ভর করেছে । আচ্ছা, পরী নিয়ে হালিম ভাই যা বলেছে সব মনে আছে?
– কোনটার কথা বলছিস?
– পরীকে বিয়ে করতে হলে তাকে যা করতে হবে, যেটা পরী বলে দিবে!
– বলেছিল তো, তাতে কি?
– ওখানে ভয় লাগছে । শুধু পরীর সাথে একা সুখের জীবন কাটাতে পেছনের সব বন্ধন কাটাতে হবে। মানে বুঝতে পারছিস!
– তুই শুধু শুধু ভাবছিস।
– মাথার ঠিক নাই, কখন কি করে বসে!
– অত ভাবিস না তো সব ঠিক হয়ে যাবে!
– তাই যেন হয়!

গ্রাম থেকে চলে আসার কয়েকদিন পর সব ভুলে গেলাম। মিসির আলির সাথে কয়েকবারই দেখা হয়েছে। হালিম ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করার চিন্তা মাথায়ও আসে নি। সে প্রচন্ড ব্যস্ত মানুষ, প্রচুর পড়ে, পড়ার জন্য দরকার বই, বই কিনতে লাগে টাকা, টাকার জন্য টিয়্যুশনি ।

একদিন বাসে করে যাচ্ছি। পাশে বসা ভদ্রলোক পত্রিকা পড়ছে একমনে। পত্রিকায় এমনভাবে কি পড়ছে আগ্রহী হয়ে দেখলাম “আগুনে পুড়ে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু” শিরোনামের একটা খবর মনযোগ দিয়ে পড়ছেন। হায়! মানুষ পড়ার জিনিস আর খুঁজে পায় না! ভাবতে ভাবতে আবার ওদিকে চোখ গেল, গ্রামের নাম পরিচিত, হ্যাঁ, মিসির আলির গ্রাম তো! আর পরিবারটা হালিম ভাইয়ের পরিবার! স্তব্দ হয়ে গেলাম!।হায়!
পরীর কাছে হালিম ভাই এভাবেই পৌঁছাল!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত