১.
বহুবছর পর বালক বারে ফিরেছে। একটা সময় এই বার ছিলো প্রতি দিনের গন্তব্য। কতশত বিবর্ণ বিকেল ডান কোনার টেবিলে নিদ্রাহীন রাতের কাছে খুন হয়েছে। গ্লাসের বাইরে জমে থাকা ঘামের প্রতি বিন্দুর একাকীত্ব গুনে গুনে কেটেছে সময়। চুমুকে চুমুকে জেগেছে বিষাদের ঘোর।
সব দরজা বন্ধ হয়। বারের দরজাও বন্ধ হত। শহরে মধ্যরাতের নির্জনতা ভেঙে রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে বাড়ি ফেরা। সোডিয়াম আলোয় বিষন্ন সড়ক। মাথার ভিতরে গানের আসর। নিস্পৃহ বুকের ভিতরে রামপ্রসাদ গুনগুনাতেন “মনরে কৃষি কাজ জানোনা/এমন মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা..।” সবাই কি আর সোনা হয়! আবাদ করেও কেউ কেউ পতিত জমিই রয়ে যায়।
২.
বালক বারে ঢুকে কাউন্টারে দাঁড়ায়। আধো আলো আধো অন্ধকারে ম্যানেজার বিস্ময়পূর্ণ হাসি দিয়ে উচ্ছসিত–
: আরে এতো বছর পরে তুই! এতোদিন কোথায় ছিলি?
: রুবেল ভাই, কোথাও ছিলাম না।
: হাহাহা, আবার হেয়ালিভরা কথা বলছিস! কত বছর পরে এলি বল তো?
: এগারো বছর হবে। ভাই, আমি কি কর্নার টেবিলে বসতে পারবো!
: কর্নার টেবিলের মায়া এখনো ছাড়তে পারিসনি! টানা তিন বছর প্রতিটা দিন ঐ টেবিলে বসেছিস। সবার জানা হয়ে গিয়েছিলো– কেউ বসতো না।
: আজ বসা যাবে?
: গেস্ট আছে। একটু ওয়েট কর। ব্যবস্থা করছি। (তিনি পাশে বসা ক্যাশিয়ারকে ইশারা দিলেন)। এত দিন পরে কি মনে করে এলি?
: বলতে ইচ্ছে করছে না। তোমার কাছে সিগারেট আছে!
: সিগারেট ধরলি কবে? হাতে নিয়ে বসতে দেখেছি, কখনো তো টানতে দেখিনি।
: ধরি নাই। আজ প্রবল তৃষ্ণা পাচ্ছে। ধোঁয়ার তৃষ্ণা, পানির তৃষ্ণা।
: কোনো কারণে মন খারাপ! চাপে আছিস! কষ্ট ভুলতে চাইছিস!
: মদ খেয়ে কষ্ট ভুলে কোন পাগলে!! বরঞ্চ কষ্ট আর যন্ত্রণা উপভোগ করা যায়।
: কষ্ট আর যন্ত্রণা উপভোগের জিনিস!! আর ইউ ক্রেজি!
: পুরো জীবনটাই উপভোগ্য। তীব্র কষ্ট, অসহ্য যন্ত্রণা, গভীর বিষাদও জীবনের অংশ। তারাও উপভোগ্য, তীব্রতরভাবে তাদের উপভোগ করতে হয়।
: তোর সাথে কথা বললে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। এই এগারো বছরে কি একটুও ড্রিংক করিস নাই!
: করেছি, খুব বেশী হলে সাত আটবার– কখনোই পাঁচ পেগের বেশী নয়।
: বলিস কি! এত কম! তোর লিমিট তো নয় পেগ।
: হাহাহাহাহা তোমার মনে আছে!
: হ্যা, ভুলা যায়! তুই তো ভোলার মত ক্যারেক্টার না।
: হাহাহাহা, মানুষ দিব্যি ভুলে যায়, ভুলে গেছে, ভুলে আছে।
: না রে, মানতে পারলাম না। তোকে এড়িয়ে চলা সহজ, ভোলা অসম্ভব।
: তাই! কেনো?
: যারা এড়িয়ে চলে তারাও বোঝে তুই তাদের কতটা ভালবাসিস। কতটা মায়া করিস।
: হাহাহাহা, যতই ভাবের কথা বলো আজ থেকে আমার লিমিট হলো বারো পেগ এবস্যুলেট ভদকা আর বারোটা বেনসন রেগুলার।
: হাহাহাহা আচ্ছা। প্রসঙ্গ ঘোরানোর অভ্যসটা আগের মতই আছে। আজ প্রথম তিন পেগ তোকে গিফট করলাম।
বালক বিস্ময় গোপন করে। এতো ভালোবাসা, এতো স্নেহ জমা হয়ে আছে! ওহ মাই আঈভ (আল্লাহ ঈশ্বর ভগবান)!
৩.
কর্নার টেবিল। আলো আলো অন্ধকার। খয়েরি কাঁচের বিশাল দেয়াল। এখান থেকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যভুক রাত্রি দেখা খুব প্রিয় ছিলো। বাইরে ব্যস্ত সড়ক। ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে যাচ্ছে গাড়ির সারি। আবার চলছে। সন্ধ্যায় জ্বলে উঠবে হেড লাইট– আলোর মালা।
বিয়ারের বড় গ্লাস। অর্ধেক বরফের মিহি কুঁচিতে ভরা। বাকী অর্ধেকে ভদকা আর টমেটুজুসের মিশ্রণ ঢেলে নেড়ে নেয় বালক। গ্লাসের গায়ে ঘাম জমে। ঘামের প্রতিবিন্দুতে আপন প্রতিবিম্ব। অস্পষ্ট। প্রতিটা প্রতিবিম্বই কি ভীষণ একা! নিষঙ্গ! গ্লাসের গা বেয়ে নামতে নামতে রিনরিনিয়ে ওঠে-
: কর্নার টেবিলে আবার ফিরে এলে?
: কর্নার টেবিলে ফিরিনি তো। নিজের কাছে ফিরেছি।
: এ কেমন ফেরা?
: একজন মানুষ অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে নিজের কাছে ফেরে। সরল ফেরা।
: কি জানি! এত জটিল কথা বুঝতে পারি না। তোমার ছাদে এখনো শালিখের দল দুপুরে ভাতদানা খেতে আসে?
: আসে। হররোজ আসে।
: খোঁড়া শালিখটা আসে?
: না, বহুবছর হলো আসেনা।
: আহা রে, কোথায় চলে গেছে কে জানে!
: হয়তো মানুষের মত সেও ফিরে গেছে নিজের কাছে।
: কি জানি! তুমিও আবার চলে যাবে। আর কখনোই ফিরবে না। কতদিন তোমার পথ চেয়ে ছিলাম।
: স্ট্রেঞ্জ!! আমার পথ চেয়ে ছিলে!
: বা রে! তিন বছর প্রতিটা দিন এসেছো। কতদিন পুরো বারে তুমি একা। আমি নীরবে দেখে গেছি। হঠাৎ আসা বন্ধ করে দিলে– পথ চেয়ে থাকবো না!
: আমরা সবসময় ভুল জনের জন্য পথ চেয়ে থাকি; আত্না দিয়ে ভুল জনকে ভালোবাসি। তাই বলে তুমিও!
: সে সব কথা থাক! এবার যাবার আগে বলে যেও।
: তোমাকেই বলে যাবো ‘যাই, গ্লাসের প্রিয় ঘাম’..হাহাহাহা। খুশি?
: হুম। তোমার প্রিয় একটা কবিতা শুনবে?
: প্রিয় কবিতাও মনে রেখেছো!! শোনাও তবে–
: যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে!
সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে
বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে
সমুদ্রের জলে,
নক্ষত্রের তলে!
রাত্রে, অন্ধকারে!
তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ — জানি আমি,
আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে!
৪.
চুমুকে চুমুকে গ্লাস শেষ হয়ে আসে। নতুন গ্লাস ভরে ওঠে। সিগারেটের ধোঁয়া আলো আঁধারে মিশে যায়। গ্লাসের মিহি বরফকুচি গলে যেতে যেতে ফিসফিসিয়ে বলে–
: মানুষ, তোমার কি হয়েছে?
: জানিনা, সত্যিই জানিনা।
: ইচ্ছে করে সবাই মিলে তোমাকে একদিন মাতাল বানিয়ে দেই। চিৎকার করে মন খুলে সব বলো। চারদিক লণ্ডভণ্ড করে দাও। ক্লান্ত হয়ে বাচ্চাদের মত হুহু করে কাঁদো। তারপরে বেঘোরে ঘুমোও। শান্তির ঘুম– লাশের মত।
: প্লিজ, মাতাল বানিয়ে দাও। মনসুখিয়ার কাছে যাবার আগে একবার মাতাল হতে চাই। আপদমস্তক মাতাল।
: তোমাকে মাতাল বানাবার সাধ্য কারো নেই। তুমি রক্তে মাংসে আত্নায় মনসুখিয়ায় মাতাল হয়ে আছো। মনসুখিয়ার ডাক শোনার জন্য কান পেতে আছো।
: আলো আধারির দোহাই– শুধু একবার মাতাল করে দাও। একবার ঘুমোতে দাও মৃত্যুর মত গাঢ় আর প্রত্যাখানের মত গভীর ঘুমে।
: সম্ভব নয়। তীব্র কষ্টে মাতাল হতে চাইছো মনসুখিয়ায় পৌছানোর পথ পাচ্ছো না বলে.. অভ্রজোনাক তোমায় ডাকছে না বলে। একবার ডাকলে সব ছেড়ে সবাইকে ছেড়ে ছুটে যাবে মনসুখিয়ায়, অভ্রজোনাকের কাছে।
: হবে হয়তো! অথচ দিনশেষে এ জীবন অর্থহীন আর মৃত্যুরও কোনো অজুহাত নেই, তাই না!
: হুম। গন্তব্যের পথ চেনো না। এদিকে ঘরের ঠিকানাও হারিয়ে ফেলেছো। সবাইকে কোথাও না কোথাও যেতে হয়– তুমি যে কোথায় যাবে!
উত্তর খুঁজে পাইনা। পুড়ে যেতে যেতে সিগারেটের ধোঁয়া খলবলায়-
: নিজের ভিতরে গুমরে গুমরে মরাই তোমার নিয়তি। তোমার ভবিতব্য। গোপন কান্নাই অমোঘ নিদান।
৫.
হঠাৎ কোথা হতে বহু বছর আগের দুপুরবেলার খোঁড়া শালিকটা উড়ে আসে। আলো আধারির কর্নার টেবিলে বসে। মুখোমুখি। তাকিয়ে থাকে নিস্পলক। বালকের খোঁড়ামনে দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হয়ে পাক খায়। কোনো কারণ ছাড়াই চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। কি আশ্চর্য! শালিখও কাঁদছে না কি? আহা রে!