ওই যে কঠিন আবরণ তোমার চারদিকে তৈরি করে রেখেছ। বর্ম করে নিজেকে আড়াল করো সেই বর্ম তো সবার থেকে দূরে থাকার জন্য। কিন্তু আমার সাথে কেন এমন? আমি কী আর সবাই?
মনে মনে ভাবে তুলি।
আড় চোখে দেখে পাশে বসা মুরাদকে।
তারপর চোখ নামিয়ে নিজের আঙুলের নোখে তাকায়। ছোট্ট একটা নিশ্বাস বের হয়ে আসে।
তার ভাবনা আবার খেই ধরে –
আমি ঠিক মতো কথা বলতে পারি না বলে তুমিও কি বলবে না? তুমি বলো কাছে আছি, পাশে থাকব। অথচ তোমার আমার দূরত্ব এখন কম করে হলেও একফিট! একটা রিকশায় পাশাপাশি দু’জন মানুষ বসা। তারা মোটা না রোগাও না। তাহলে এতোখানি জায়গা আসে কোত্থেকে? কেন কাঁধের সাথে কাঁধের স্পর্শ নেই? কেন কারো আঙুল কাউকে ছুঁচ্ছে না? ঘাড় ঘুরিয়ে এমন উদাস ভাবে থাকা কেন?
কথাগুলো অনুচ্চারিত তবুও একটা ঢোক গেলে তুলি। গলার কাছটা ব্যথা করে। কিশোরীর মতো কান্না পেলেও কাঁদার কোনো প্রশ্নই আসে না। রিক্সার হুডটা পর্যন্ত তুললনা মুরাদ।
এই শহরে কোনো প্রেমিক প্রেমিকা হুড খুলে বিকেল চারটার রোদে ঘোরে? তুলির জানা মতে না।
মুখের মাস্কটাও খুলছে না মুরাদ!
অথচ তার দেয়া ল্যাপটপ নিয়ে ফিরছে তুলি। কিছুদিন আগে তুলির ল্যাপটপ চুরি গেছে। খালার বাসা থেকে বাড়ি ফিরছিল। বাস থেকে নামার সময় ব্যাগ কেটে কেউ ল্যাপটপ লোপাট করে দিছে। সেটা ছিলো ভাইয়ের ব্যাবহার করা ল্যাপটপ। তাতেই কাজ চালিয়ে নিচ্ছিল। নতুন ল্যাপটপ কেনার অবস্থা নেই এখন। বাড়ি থেকে ম্যানেজ করে বিশ হাজার টাকা এনেছিল। সেকেন্ড হ্যান্ড একটা কিনে নেবে।
মুরাদ বলল এলিফ্যান্ট রোড আসো দেখি কী পাওয়া যায়। নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে ব্রান্ড নিউ ল্যাপটপ কিনে দিল তুলিকে। লেটেস্ট ইলাস্ট্রেশন। কত গীগা কতো র্যাম। কত দাম। ওয়ারেনটি। সব ফয়সালা করছিল যখন মুরাদ তখন তুলি শুকনা মুখে তাকিয়ে আছে। সে বারবার মুরাদকে বলেছে সেকেন্ডহ্যান্ড নিতে হবে তার। সব কেচে কুচে পঁচিশ হাজার হবে তুলির কাছে। তাহলে অর্ধেক দাম কী তুলি দেবে? কী করতে চায় মুরাদ কিছু বুঝছে না সে।
টাকা বের করতে নিল ব্যাগ থেকে। কিন্তু মুরাদের দিকে তাকিয়ে বুঝল সে ব্যাপারটা পছন্দ করছে না।
দোকানীর থেকে ক্যাশম্যামোটা ব্যাগের পকেটে রাখতে রাখতে তুলি ভেতরে ভেতরে চুপসে যেতে থাকল। খালা দাম জিজ্ঞেস করবে। ভাইয়া ক্যাশম্যামো চাইবে। কত ঝামেলা হতে পারে!
তুলি আর মুরাদের প্রেমের বয়স সাড়ে চার মাস। চেনাশুনা আরো বছর খানেক আগে থেকে। খালাতো বোনের দূর সম্পর্কের দেবর। বিয়ে বাড়িতে তেমন পরিচয় হয়নি। একদিন ভার্সিটি যাবার পথে বাসে কন্ডাকটর খুচরা টাকা নিয়ে খুব ঝামেলা করেছিল তখন মুরাদ মধ্যস্ততা করে। তার অফিস ওই এলাকায়। আরো কয়েকদিন দেখা হলো। ফোন নাম্বার আদান-প্রদান হলো। ঠিক সেভাবে কেউই প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি। তুলির ইচ্ছা হয় না নাটকীয় কিছু ঘটুক।
এর মধ্যে এতোগুলা টাকার গিফট নেয়া কী ঠিক হলো। যদি এই সম্পর্ক না টেকে। তুলির প্রেম ভাগ্য খুবই মন্দ। এই প্রথম সে দামী গিফট পেয়েছে তা নয়। নিয়েছে এই প্রথম।
ভার্সিটিতে থার্ড সেমিস্টারের পর পিকনিকে গিয়ে এক সচিব পুত্র তুলিকে ডায়মন্ড রিং দিয়ে প্রোপোজ করতে চেয়েছিল। ব্যাপারটায় খুশি হওয়াতো দূরের কথা পুরোপুরি ভচকে গিয়েছিল তুলি।
আংটি টি দেখে প্রথমেই তার মনে হয়েছে যদি এই আংটির জন্য পুলিশ কেস হয়! এমন উদ্ভট ভাবনা মনেহয় কেবল ওর মাথাতেই আসে! ছেলেটাকে ছাড়ানো খুব সোজা ছিল না। প্রায়ই প্রায়ই পার্টি দিত তুলির নাম করে। সবাই খেতো আর মজা নিতো। দুই একজন বলত রাজি হচ্ছ না কেন? ছেলেটা তো সহজ সরল ভালো। সেটা তুলি যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল। বাপের দুই নম্বরি টাকা ওড়ালে সবাই ভালো হয়। তুলি রাজি হলে কাজি অফিসে নিয়ে বিয়ে করে বাড়িতে তুলবে সে এমন ঘোষণাও দিয়েছিল।
তুলি জানে তারপর সচিবের বউয়ের চাকরানী হয়ে থাকতে হবে তাকে। এইসব টাকা ওয়ালাদের ছায়া থেকেও দূরে থাকতে চায় তুলি।
জীবনে কারো কাছ থেকে কিছু নেয়নি– আজ সেই অহংবোধটা শেষ হওয়ায় তুলি খুব দোটানায় ভুগছে। ভালোও লাগছে। কিন্তু মুরাদের এমন গম্ভীর মুখ খুব অস্বস্তি দিচ্ছে।
মুরাদের সাথে সম্পর্কের শুরু থেকে সিরিয়াস তুলি। একটা ফোন মিস করে না। নিয়ম করে মেসেজ দেয়। খেয়েছে, ঘুমিয়েছে কিনা জানতে চায়। এসব কাজে অনভ্যস্ত তুলি নিজের উপর অবাক হয়।
কিন্তু মুরাদ এমন উদাস কেন গিফট দিয়ে। এতোগুলা টাকা খরচ হয়ে যাওয়াতে ওর সমস্যা হবে নিশ্চয়ই এই বাজারে। তাই নিয়েই কী ভাবছে? এমন করে চুপ থাকাটা খুব অপমান জনক।
এই চার মাসে তারা দেখা করেছে পার্কে, রেস্টুরেন্টে, মাঝে মাঝে বাসে করে ঢাকার বাইরে গেছে। আবার ফিরতি বাসে ফিরেছে। খালার বাসায় থেকে তুলি পড়াশোনা করে। খুব নিয়ম মেনে চলতে হয়। খালা খালু দুজনেই খুব কড়া। যত্নের কোনো ত্রুটি নেই। ভালো ছাত্রী বলে তারা বাসায় রাখছেন এই কথা সরাসরিই বলেন। সুতরাং খুব হিসেব করে তারা দেখা করে। কখনো এক ঘন্টার উপরে তো নয়ই।
জোর করার স্বভাব মুরাদের ভেতর একদম নেই। কোনোদিন রুম ডেটে ডাকেনি। যেটা এখনকার প্রেমে একেবারে অভাবনীয়। খুবই স্মুথ গোয়িং ছেলে।সাথে সাথে একটি কথা মাথায় উঁকি দেয় তুলির, মুরাদ কি এই গিফট দিয়ে তাকে রুম ডেটের অফার দেবে? কী করবে তুলি? ভালোবাসে দুজন দুজনকে সন্দেহ নেই। কিন্তু এমন কোনো প্রস্তাবে সে রাজি হবে না। প্রয়োজনে টিউশানি করে টাকা জমিয়ে মুরাদের টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। যে একটা জিনিস দিয়ে মুখ শুকনা করে ঘাড় ঘুরিয়ে রাখে তার সাথে…
এতোক্ষণ পর মুরাদের কণ্ঠ শুনে চমকে ওঠে তুলি। তারপর খুশি খুশি গলা উঁচিয়ে বলে, এই মামা আপনার রিকশায় হুড লাগেনা ক্যান? রিকশা থামান, তারপর ঠিক মতো হুড লাগান।
রিকশাওয়ালা মামা হাসি মুখে রিকাশার হুড লাগিয়ে বলে, কই যাইবেন কইলেন না তো মামা?
বলতেছি মামা আপনি চলতে থাকেন।
তুলি বিস্ময় নিয়ে মুরাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুরাদ এক হাতে ল্যাপটপের বাক্স ধরে অন্য হাতে তুলির কোমরের কাছে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। তারপর তুলির কাঁদোকাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে, নিশ্চয়ই অনেক কিছু ভাইবা ফেলছ এতোক্ষনে। আরে তখন সিগনালে আমার বড় ভাই ছিল আমাদের সামনের হোন্ডায়। ওই লাল হেলমেট। খেয়াল করো নাই? আল্লাহ জানে দেখছে কিনা।
এবার তুলি চমকে ওঠে, ধরো যদি দেখে থাকেন।
দেখে থাকলে বলবো, হ্যা প্রেম করছি। বিয়ে দিয়ে দেন। ঠিক হবে না?
তুলির আরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মুরাদ গাল টিপে দেয়।