আজ এই পৃথিবীজুড়ে বড় অসুখের সময়ে নিজের সুখ সময়ের স্মৃতিকথা বেশী বেশী মনে পড়ছে । সেই শৈশবের স্মৃতিকথা…..গ্রামীণ আবহে বেড়ে উঠা সাদামাটা দিনগুলোর কথা । ষাট-সত্তর দশকে আমাদের ছোট্ট হলধর গ্রামের হরিমন্দিরের ডাংগার বিশাল বটগাছের ঝুড়িতে দোল খাওয়া আমার কিশোরবেলার দুরন্তপনার দিনগুলোর কথা ( সেই বটগাছ এখন আর নেই – বর্তমানে সেখানে বিশাল এলাকাজুড়ে চা কারখানা স্থাপিত হয়েছে ) । ছোটবেলায় মুরব্বী/বড়ভাইদের দেয়া পাঁচ/দশ পয়সার বা সিকি-আধুলীর যে কতো কদর ছিল তা বলে বুঝাতে পারবনা । আমাদের কুঁড়ে ঘরের পিপড়ার ছিদ্র করা খুটিতে তা জমাতাম ।মনে মনে হিসেব করে রাখতাম দুই/তিন টাকা দুই তিন মাস পর জমলেই তা কেটে বের না করা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে থাকতে পারতামনা । তা বের করার সাথে সাথে আমার খেলার সাথীদের নিয়ে ছুটে যেতাম-বড় হাইওয়ে সংলগ্ন বর্তমানের পুরাতন বোর্ড বাজারের আলামুদ্দিন পাইকার চাচার মুদির দোকানে । দোকানে তেলচা কালো সুঠাম দেহের বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার এক বড় ভাইয়ার কাছে পরম স্নেহে চাহিদামতো লেমনচুজ, কাঠি চকলেট, বিভিন্ন রঙ্গীণ খেলনা – বাঁশি-লাটিমসহ ইত্যাদি কিনে দুহাত যেভাবে ভরে যেতো, তার থেকে আরো বেশী ভরতো অবচেতন মনে গভীর আনন্দ ।
আমার একমাত্র চাচাকে আমরা ডাকতাম ‘ছুর্বাজি’( ছোট আব্বাজি সংক্ষেপে ছুর্বাজি ) বলে । তিনি তখন আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বোদিনাজোতের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন । তখন সাধারণ মানুষ শিক্ষকদের সম্মোধন করতেন ‘মাষ্টার’ বা ’পন্ডিত’ বলে । চাচার নাম ছিল রফিকউদ্দিন মাষ্টার । চাচা ছিলেন একজন মজার রসিক টাইপের মানুষ ।উনার হাতের বাংলা-ইংরেজী হস্তাক্ষর ছিল অত্যন্ত সুন্দর । তিনি সুন্দর আর্টও জানতেন । তাঁর হাতে বাঁশের কলমে -কালিতে মোটা অক্ষরে মনিষিদের বাণি সমৃদ্ধ লেখা কাগজ বসার ঘরে সাজিয়ে রাখতেন ( যার দু-একটি এখনও মনে আছে, যেমন- মিথ্যা বলা মহাপাপ, শেষে হয় অনুতাপ কিংবা সদা সত্য কথা বলিবে -ইত্যাদি )। তিনি নিজে অত্যন্ত হাসি-খুশি স্বভাবের এবং মানুষকে হাসাতে পারতেন নির্দ্বিধায় । জাতীয় সংসদের সাবেক স্পীকার ও শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ছিলেন চাচার বাল্যবন্ধ্যু । সাবেক বৃটিশ আমলে জলপাইগুড়ি জেলার এতদ অঞ্চলের একমাত্র কুকুরজান মাইনর স্কুলে একসাথে কিছুদিন পড়াশুনা করেছিলেন । আমরা ছোটবেলায় দেখতাম- ঢাকা থেকে গ্রামে আসলে উনি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন । রাজ্যের গল্প শুরু হলে উনি যখন উঠে যাওয়ার জন্য তাড়া লাগাতেন, তখন তিনি বলতেন- ‘ আরে একটু দাঁড়া- তোর ভাবি চা’র ডেকচির মাড় চুয়াছে ‘ ( চা’য়ের কী কখনো মাড় গালানো হয়.. !)। এ কথা শুনে হাসির রোল পড়ে যেতো । আসলে উনার বাল্যবন্ধ্যুর এখানে’তো নাখেয়ে কখনো যাওয়ার উপায় ছিলনা । চাচার একজন শিক্ষক কলিগ ছিলেন, নাম তার কোবাদ আলী মাস্টার চাচা । উনি ছিলেন অত্যন্ত ভীড়ু তথা একটুতেই চমকে উঠা মানুষ । তখনকার দিনে শিক্ষকদের মাইনে ছিল হাতেগোণা কয়েক টাকা যা দিয়ে সংসার নির্বাহ করা কষ্টকর ছিল । তবে, গ্রামের শিক্ষকদের প্রত্যেকেরই চাষাবাদ করার মতো জমিনজিরাত ছিল যাতে অনেক শিক্ষক সকালবেলা জমিতে গায়ে খেটে তারপর স্কুলে আসতেন । স্কুলে ক্লান্ত শরীরে এসে দুই/একটি ক্লাস নেয়ার পর কোবাদ মাস্টার চাচা টেবিলে পা তুলে ঘুমিয়ে যেতেন । এই সময় স্কুলে স্কুল ইনস্পেক্টর ভিজিটে আসলে উনি অপ্রস্তুত অবস্থায় চমকে উঠতেন । মজার ব্যাপার, কিছু দুষ্ট টাইপের ছাত্র এই দুর্বলতার সুযোগটিকে মিথ্যা কথা দিয়ে মাঝে মাঝে কাজে লাগিয়ে মজা করতো । এর নেপথ্য নায়ক নাকী ছিলেন আমার চাচা । এইজন্য উনার কলিগের নাম রেখেছিলেন ‘হাকাত’ মাস্টার । পরবর্তীতে এই ‘হাকাত মাস্টার’ নাম দিয়ে পাড়ার অনেকে তাঁকে ক্ষেপিয়ে তুলতেন । এরকম একটি মজার ঘটনার কথা এই মুহুর্তে মনে পড়ছে । গ্রামের বাড়ীর গলি-আঙিনায় স্যাঁত-স্যাঁতে জায়গায় সারা বছর জুড়ে এক ধরণের কুণো ব্যাঙ দেখা যায়, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘কটরই ব্যাঙ’ । এই নামে আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামে একজন লোক সুগারমিলের ট্রাক্টর ড্রাইভার ছিলেন সংক্ষেপে নাম তার ‘কটই ড্রাইভার’ চাচা । লোকটির বোঁচা নাক, অত্যন্ত ফর্সা- ফোলা ফোলা চোখ, কোকড়ানো চুল অনেকটা চীনাদের মতো দেখতে রাগী রাগী চেহারা, অল্প বয়সে দাঁত হারানো ফোকলা মুখ ।আমরা জানিনা- কী কারণে যেন লোকটিকে এলাকার দুষ্ট ছেলেপেলেরা একটি দেশীয় ছন্দের বাংরেজী ( বাংলা-ইংরেজী ) ভাষার বাক্য ব্যবহার করে তাঁকে ক্ষেপিয়ে তুলতো । বাক্যটি হচ্ছে- ‘মাই স্যান-স্যান দ্যায়ার ম্যান, ভাংগা কান্তাই কটরই ব্যাঙ ।’ ( এটির সঠিক ভাবার্থ হলো- ভাঙ্গা উত্তপ্ত কড়াইয়ে তেল ঢাললে একধরণের স্যান স্যান শব্দ হওয়া বা তেলেবেগুন জ্বলে উঠা) । বলা বাহুল্য- এই ম্যানিংলেস বাক্যটির উদ্ভাব্ক ছিলেন নাকী আমার সেই একমাত্র রসিক চাচা ।আমরা দুষ্ট ছেলেপেলেদের দল বড় রাস্তার পাশ্বে দাড়িয়ে থাকতাম কখন ‘কটই ড্রাইভার চাচা’ ট্রাক্টর নিয়ে আসবে । আসা মাত্রই সেই বাংরেজী বাক্য ছন্দের সুরে সুরে ছুরে মারা হতো- ‘মাই স্যান-স্যান দ্যায়ার ম্যান, ভাংগা কান্তাই কটরই ব্যাঙ ।’- আর যায় কোথায়, ‘কটই ড্রাইভার চাচা’ ট্রাক্টর রাস্তার পাশ্বে দাড় করিয়ে দুষ্ট ছেলেপেলের দৌড় দিয়ে তাড়া করতো । কিন্তু কাউকে হাতের নাগালে না পেয়ে চিৎকার দিয়ে অশ্লীল গালি বাক্যবানে সবার মজা আরো বৃদ্ধি পেতো ।আমার বাবাকে আমরা বলতাম আব্বা । তিনিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন । আব্বা আর চাচা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো ভাই । শৈশবে আমরা দেখেছি, আব্বা চাচাকে ছাড়া একা কোন কিছুই ভোগ করেন নাই । পৈত্রিক সম্পত্তির বাইরেও জমি ক্রয় থেকে শুরু করে বাজারের বড় মাছটিও ফিফটি ফিফটি ভাগে চাচাকে সাথে নিয়ে কিনেছেন । আমাদের শোওয়ার ঘরটিও ছিল চাচার ঘরের লাগোয়া । শৈশবে হঠাৎ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে কাণের কাছে শুনতে পেতাম দুই-ভাইয়ের দুই চৌকিতে শোয়া অবস্থায় রাজ্যের গল্প যা অর্ধ শতাব্দী সময় পেড়িয়ে আজোও কাণে বাঁজে । সেই চাচার অকাল মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ ছিল তিনি ছিলেন ‘চেইন স্মোকার’ । সেই সময় তাঁর খাওয়া বক মার্কা সিগারেট এর খালি বাক্স দিয়ে ট্রেন বানানোসহ বিভিন্ন খেলনার উপকরণ শৈশবে খেলার ভীন্নরকম আমেজ সৃস্টি করতো যা এখন স্বপ্নের মতোই মনে হয় । সেই চাচার মৃত্যুর দিনক্ষণটি স্পষ্ট মনে আছে । চাচার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন চয়ান মাষ্টার ওরফে চয়ান ডাক্তার । গ্রাম্য ডাক্তার হিসেবে নামডাক ভালো ছিল কারণ সেই সময়ে অবিশ্বাস্যভাবে উনার সংগ্রহে থাকতো মানুষের জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন সিলিন্ডার ।আমার চাচার ছিল মরণব্যাধি হাঁপানী রোগ ।শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে মাঝে মাঝে উনি সেই অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করতেন । সেইসময় উনিশশো একাত্তর সালে উত্তাল মার্চ মাসে কিংকর্তব্যবিমুঢ় মানুষের অস্থীর সময়ে চাচার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে অক্সিজেন সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হয়ে যাওয়ায় তা আর যোগাড় করা সম্ভবপর হয়নি বিধায় মুহুর্তেই চাচা তখন মাত্র ৪৫/৪৬ বছর বয়সে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন । আজ করোনার এই অস্থীর সময়ে অক্সিজেন সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হয়ে যাওয়ায় যে কতো অকাল মৃত্যু সংঘটিত হচ্ছে তা কে জানে !
(**) লেখকের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে।