‘গল্প লেখা মোটেও কঠিন নয়, পুরস্কারের জন্য গল্প লেখা আরও সহজ। কলম আর এ ফোর সাইজের দুটো কাগজ নাও, ফরমুলা শিখিয়ে দিচ্ছি’ বলে নোমান থামে, প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়, লম্বা একটা টান দিয়ে মাছের খাবি খাওয়ার মত করে ধোঁয়া ছেড়ে হাওয়ায় রিং বানানোর চেষ্টা করে । টেবিলের অপর পাশে বসে আছে নবীন লেখিকা হেনা মুস্তারি, সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে নোমানকে দেখছে, মনে মনে বলছে — ‘গল্প লেখা যদি এতই সহজ তবে আপনি লিখেন না কেনো!’
হেনার মনের ভাব টের পায় নোমান, নিজেই একটা কাগজ সামনে টেনে নেয়, কলম দিয়ে দাগ কাটতে কাটতে বলে,
— এ গল্পটা রেজাউলের পরিবারের গল্প। পরিবারের কর্তা রেজাউল দরিদ্র হলে নামের শেষে মিয়া এবং ডাক নাম রেউজ্জা’ করে দিলেই হত। কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে রেজাউল দরিদ্র নয়, উচ্চবিত্ত শ্রেণির শহুরে মানুষ। তাই তার নাম হবে ‘রেজাউল করিম’। এদেশে বিত্তবান মানেই প্রভাবশালী, প্রভাবের ভাব ফুটাতে নামের শেষে পদবী ‘চৌধুরী’ বা ‘খান’ যোগ করা প্রয়োজন। রেজাউল করিমের সাথে চৌধুরী পদবীটা মানায়, ওটাই থাক। অবশ্য রেজাউলকে আরও বিশেষ করে তুলতে চাইলে নামের আগে ‘খান মোহম্মদ’ যোগ করা যায়।
হেনা মুস্তারি গল্প লেখার ফরমুলা শুনছে। এ ফরমুলা জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার তরুণ সাহিত্য সম্পাদক নোমানের রসিকতা কি না বুঝতে না পারলেও শুনতে ভালোই লাগছে। হেনা জানতে চায়,
— তবে কি গল্পের পরিবারের কর্তার নাম খান মোহম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী?
— না, না, তা নয়। গল্পে রেজাউল করিমকে দিয়ে কিছু অনৈতিক কাজ করানো হবে। তাই নামের আগে মোহম্মদ যোগ করা ঠিক হবে না।
— সে কি! কেনো! আমাদের দেশে অধিকাংশ পুরুষের নাম শুরু হয় মোহম্মদ দিয়ে, এ প্রথা যতটা না ধর্মীয় তার চাইতে বেশী কালচার। রেজাউলের নামের আগে মোহম্মদ থাকলে সমস্যা কি!
নোমানের মুখে হাসির রেখা, এলোমেলো চুলে আঙুল চালায়, তর্জনী দিয়ে চাঁদি চুলকায়, হাসিটাকে সামান্য বিস্তৃত করে বলে,
— কালচারের অংশ! কিন্তু কালচারের পাহারাদার আমাদের ক’জন প্রধান বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি কর্মী আর সাহিত্যিকদের নামের আগে মোহম্মদ আছে! নামের আগে সৈয়দ বা আল ব্যবহারে আপত্তি নেই, নামের শেষে আহমেদ, ওসমান, রহমান ব্যবহারেও আপত্তি নেই, প্রথা মেনে নামের শুরুতে মোহম্মদ শব্দের ব্যবহার তেমন কই! সবাই তো আর প্রথাবিরোধী লেখক নন। এদের গল্প উপন্যাসের চরিত্রগুলোর অবস্থা অনেকাংশে একই রকম। রাজনীতিকদের নামের শুরুতেও মোহম্মদের ব্যবহার খুব কম।
— এটা উনাদের ইচ্ছাকৃত নয়, উনাদের নাম যেমন রাখা হয়েছে, তেমনই তো থাকবে।
— হেনা, উনাদের এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্র দেখার ইচ্ছে হয়, সাহিত্য করতে এসে রইসুদ্দীনও এদেশে রইসু হয়ে যায়।
হেনা প্রতিবাদ করে ওঠে,
— ভাইয়া, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করবেন না, উনি আমার খুউউউব প্রিয় লেখক ও বুদ্ধজীবী।
— আমিও উনার বিশেষ ভক্ত। কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছি না, সমষ্টিগত প্রবণতাকে বুঝাচ্ছি।
হেনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়, বুঝতে চেষ্টা করে নোমান সত্য বলছে কি না। যুক্তি দিয়ে নোমানকে পরাভূত করতে চায়,
— আশ্চর্যকথা! গল্পের কোনো চরিত্র অনৈতিক কাজ করলে তার নামের শুরুতে ‘মোহম্মদ’ ব্যবহার করা যাবে না!
— যাবে না কেনো, অবশ্যই যাবে। তবে পুরস্কারের জন্য লেখা গল্পতে ব্যবহার না করাই ভালো। ব্যবহার করলে উগ্র ইসলামিস্টদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, তাদের বক্তব্য হবে মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্য রেজাউলের নামের আগে মোহম্মদ যোগ করা হয়েছে। ইসলামফোবিকরা বলবে, নায়ক মুসলিম বলেই অনৈতিক কাজ করছে, মুসলমান মানেই দুষ্টু। দুই পক্ষের কোনো পক্ষকেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেওয়া যাবে না, এমন বিতর্কে পরিচিতি বাড়বে কিন্তু পুরস্কার সুদূরপরাহত।
হেনার কণ্ঠে দ্বিধা,
— এমনিতে তো গল্পের তেমন পাঠক নেই। এ গল্প কি অনেকে পড়বে?
নোমানের স্বরে দৃঢ়তা,
— প্রথমে এ গল্প খুব বেশী পাঠক পড়বে না, সাহিত্য পুরস্কার পেলে অনেকেই পড়বে। গল্প পড়ে তোমার ভক্তরা বলবে ‘অসাধারণ, বাংলা সাহিত্যে এমন গল্প লেখা হয়নি’, প্রতিদ্বন্দ্বীরা বলবে ‘অতি দুর্বল গল্প, এ গল্প পুরস্কার পায় কি করে?’ আর একদল সমালোচক এক জীবনে সঞ্চিত সমস্ত বিরক্তি চেহারায় ফুটিয়ে তুলে প্রশ্ন করবে, ‘এ গল্পে গল্পটা কই?’
— আচ্ছা, বুঝলাম।
— মন দিয়ে ফরমুলার বাকী অংশটা শোনো, গল্পটা রেজাউল করিম চৌধুরীর পরিবারকে ঘিরে। রেজাউলের বয়স সাকুল্যে পঞ্চাশ বছর। এ বয়সেও বলশালী শরীর। নাকের নিচে কলপ দেওয়া পুরু গোঁফ, তার ব্যক্তিত্ব ফোঁটাতে গল্পে গোঁফের ডিটেইলস জরুরী, সাথে মোটা ভ্রু’র ডিটেলস। স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে বিত্তবান ও প্রভাবশালী রেজাউলের সংসার। স্ত্রী চির রুগ্ন এবং প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকে, তবে স্বামীর সুকর্ম ও অপকর্ম সবকিছু তার কানে আসে। স্বামীর সুকর্মে আনন্দিত হয়, অপকর্মে ভয়াবহ সব অভিশাপ দেয়।
হেনার নারীবাদী মন বুঝতে চেষ্টা করে রেজাউল করিমের স্ত্রীকেই কেনো রুগ্ন হতে হবে! বলশালী স্বামীর চির রুগ্ন স্ত্রী কি আধিপত্যবাদী সবলের সাথে নিরুপায় দুর্বলের সহাবস্থানের প্রতীক! অথবা স্ত্রীকে রুগ্ন দেখানো কি প্রকৃতপক্ষে নারীকে দুর্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পুরুষতান্ত্রিক আচরণ! হেনা প্রশ্ন করে,
— স্ত্রীকেই কেনো রুগ্ন দেখাতে হবে?
— এ প্রশ্নের উত্তর তো খুবই সহজ, রুগ্ন স্ত্রীর কাছে ক্ষমতাবান সবল স্বামীর অপকর্ম গোপন থাকছে না। সে সবসময় স্বামীর অপকর্মের প্রতিবাদ করছে, বিদ্রোহ করছে। কিন্তু স্বামী মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। এ যে আমাদের সোসাইটির প্রতীক, রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের সাথে সাধারণ নাগরিকের সম্পর্কের ঘরোয়া সংস্করণ।
— বুঝতে পারছি।
— ইজমের দায় মেটাতে গল্পে যৌনতা আর নীতিহীনতা মানে মানব চরিত্রের অন্ধাকার দিকের কিছু ছিটেফোঁটা মেশাতে হবে, তা না হলে বোদ্ধারা নাক কুঁচকে বলবে গল্পের মধ্যে পোস্ট মর্ডানিজম বা উত্তর আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। গল্পে যৌনতার প্রয়োজনে রেজাউলের সংসারে দূর সম্পর্কের এক শালীকে আশ্রয় দাও, ধরা যাক তার নাম ফারজানা। ২৫ বছরের চোখ ধাঁধানো সুন্দরী শালীকে দেখলে রেজাউলের শরীর জেগে ওঠে। স্ত্রীর তীক্ষ্ম নজরদারির জন্য জাগ্রত শরীর বেশীদূর অগ্রসর হতে পারে না। গল্পের এ পর্যায়টাতে একটু ইয়োইয়ো খেলবে, রেজাউল এই বুঝি ঝাপিয়ে পড়ে, এই বুঝি ঝাপিয়ে পড়ে পরিস্থিতি তৈরী করবে।
হেনা শব্দ করে হেসে ওঠে। পত্রিকা অফিসে দুপুরের ব্যস্ততায় সুর তুলে যায় হাসি। আশপাশের ডেস্ক থেকে দুই তিনজন চোখ তুলে তাকায়। অফিস বয় টেবিলে দুই কাপ রঙ চা আর প্লেটে চারটা বিস্কিট রেখে যায়, হেনা নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি থামায়,
— শেষ পর্যন্ত ঝাপিয়ে পড়বে না!
— পড়বে তো অবশ্যই। তবে ঝাপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত পাঠককে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ অস্থিরতার মধ্যে রাখতে হবে। গল্পে কমপক্ষে একটা দরিদ্র চরিত্র থাকতে হয়, আপাতত আশ্রিত ফারজানা ওই দরিদ্র চরিত্র। এক রাতে রেজাউল পেছন থেকে তাকে ঝাপটে ধরবে বা শাড়ির আঁচল ধরে টান দিবে — এ দু’টো আচরণেই বুনো দস্যুতা আছে, পাঠকের অবদমিত যৌন আকাঙ্ক্ষা দোলায়িত করার স্পন্দন আছে। আর সুরিয়ালিস্টিক করে উপস্থাপন করতে চাইলে এভাবে লিখতে পারো— ফারজানার বুকের ওপর কিছু একটা চেপে বসেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট প্রচণ্ড হচ্ছে, বুঝতে পারছে না ও স্বপ্ন দেখছে না জেগে আছে। ঠোঁটে কামড়ের চাপ বাড়তেই তীব্র ব্যথা আর সিগারেটের উৎকট গন্ধটা একসাথে পায়, হাঁসফাঁস করতে করতে ঘরের হালকা আলোয় চোখ মেলে তাকাতেই দেখে ক’সেন্টিমিটার দূরে রেজাউল, না রেজাউল নয়, মাকড়সার বড় বড় চোখ। ওর বুকে লোমশ বিশাল মাকড়সাটা চেপে বসছে, বড় বড় লোমশ পা গুলো শরীরে কিলবিল করছে। মাকড়সার বিষাক্ত লালায় ভরে যাচ্ছে শরীর। ফারজানা হিস্টিরিয়ার রোগীর মত কাঁপছে।
নোমানের বর্ণনায় হেনার শরীর শিরশিরিয়ে ওঠে। ও মাকড়সা খুব ভয় পায়। ওর মনে হচ্ছে চেয়ার বা টেবিলের নিচে একটা মাকড়সা ওত পেতে আছে। সুযোগ পেলেই শরীর বেয়ে উঠতে শুরু করবে। চারদিকের দেয়ালে মাকড়সা আছে কি না দেখে নোমানের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়, এক মুহুর্তেরও কম সময়ের মধ্যে নোমান চোখ ফিরিয়ে নিলেও হেনা বুঝতে পারে নোমান ওর বুকের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ওর কাছে নোমানের চোখ দু’টোকে ক’মুহুর্ত মৃত মাছের চোখের মত লাগে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নোমান বলে,
— গল্পের মধ্যে একটু মুক্তিযুদ্ধ মেশাতে হবে। আমাদের দেশে ওটাই ভালো গল্প যার মধ্যে প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে দারিদ্র অথবা মুক্তিযুদ্ধ রয়েছে। তুমি রেজাউল করিম খানকে শান্তি কমিটির সদস্য বানিয়ে দাও, স্বাধীনতার পর রঙ বদলে সে আরও ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হয়েছে।
নোমান সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি আঁকছে আর বলে যাচ্ছে,
— কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে হেনা। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে অল্প সংখ্যক মানুষ। তাদের শক্তির উৎস ছিলো পাকবাহিনী। স্বাধীনতা অর্জনের পর পর এদের একটা অংশ রাতারাতি সিক্সটিনথ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়। বড় অংশটা পরাজয় মেনে সাধারণ মানুষের স্রোতে মিশে যায়। আকারে ছোট আরেকটা অংশ যে রাজনৈতিক স্ট্যান্ড থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলো, ওই স্ট্যান্ড থেকে প্রকাশ্যে গোপনে রাজনীতিটা চালু রাখলো। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও তাদের প্রকট উপস্থিতি দেখানো হলে মোটেও প্রশ্ন তোলা যাবে না — তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কেনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেছে? এ প্রশ্নও তোলা যাবে না, স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প সংস্কৃতিসহ সব কিছুর বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ তো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির হাতেই ছিলো, তারা কেনো এদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হলো।
হেনা বিষ্ময় গোপন করে না,
— সত্যি, এ প্রশ্নগুলো মনে আসছিলো। তবে দুটো বিষয় একটু পরিস্কার করেন- সিক্সটিন্থ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা কি? রেজাউলের বয়স পঞ্চাশ বছর, স্বাধীনতার বয়স পঞ্চাশ বছর, রেজাউল শান্তি কমিটির সদস্য হয় কিভাবে?
নোমান নতুন একটা সিগারেট ধরায়, বয়কে আরেক কাপ চা দিতে বলে। মন দিয়ে হেনাকে দেখে— হেনার বয়স কত আর হবে চব্বিশ বা পঁচিশ বছর। অথচ চোখে কিশোরীর উচ্ছসিত সরলতা। কাঁধ ছোঁয়া কুচকুচে কালো কোকড়া চুল, গোল মুখে চাপা নাক আর ফোলা গালের জন্য চোখের সরলতা পুরো মুখায়বে সংক্রমিত হয়েছে। কলাপাতা পাড়ের মাখন রঙা মনিপুরী শাড়িতে শ্যামলা হেনাকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, বহু রঙা পালকে আবৃত কৌতূহলী এক ফিঞ্চ পাখি বসে আছে মুখোমুখি। নোমান নরম স্বরে বলে,
— একদল মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলো বা সম্মুখ সমরে অংশ নেয়নি বা কোনো পক্ষেই ছিলো না, ১৬ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ধারণ করে, এরাই সিক্সটিনথ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা। তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ, মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর বয়সে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করা সার্টিফিকেটধারী চল্লিশ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া গেলে পঞ্চাশ বছর বয়সী শান্তি কমিটির সদস্য থাকবে না কেনো!
নোমানের তীর্যক বক্তব্যে হেনা আমোদ বোধ করে,
— মানলাম রেজাউল শান্তি কমিটির সদস্য ছিলো। গল্প কি এখানেই শেষ! মানে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বয়স, কিন্তু এখনও সব অপকর্ম স্বাধীনতাবিরোধীরাই করে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা সর্বশক্তি দিয়ে অল্প কিছু স্বাধীনতা বিরোধীকে সামলাতে পারছে না, যুদ্ধ করেই যাচ্ছে যুদ্ধ করেই যাচ্ছে যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। মানে মুক্তিযুদ্ধ চলছেই।
— মুক্তিযুদ্ধ একটা চলমান বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ চলতেই থাকবে। কিন্তু এখানে গল্প থামালে বিদগ্ধ পাঠকরা বলবে, টুইস্ট কই! গল্পে টুইস্ট নেই কেনো!
— সত্যিই তো, এ গল্পে টুইস্ট কই?
নোমান মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
— গল্পে টুইস্টের যোগান দিবে রেজাউলের দুই ছেলে। রেজাউল অতি বদ লোক, সে অপরাধের শাস্তি পায়নি, কিন্তু প্রকৃতি চরম প্রতিশোধ নিবে। তুমি তার সবচে প্রিয় সন্তানটাকে হঠাৎ পাগল বানিয়ে দিবে, বদ্ধ পাগল।
— কি বলছেন এসব! প্রকৃতি কি এভাবে প্রতিশোধ নেয়, নোমান ভাই?
— না, নেয় না। প্রকৃতি বা আমাদের সৃষ্টিকর্তা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা সদা বিরক্ত এবং প্রতিশোধ পরায়ণ রগচটা সাইকো নন। পরম মমতায় যে বা যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সে বা তিনি এতটা উন্মাদ নন যে একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দিবেন।
হেনা চমকে ওঠে,
— এমন করে বলবেন না, বিপদে পড়ে যাবেন। টুইস্ট’টা বলেন?
— প্রথম টুইস্ট রেজাউলের এক সন্তানের পাগল হয়ে যাওয়া। তবে বড় টুইস্টটা দ্বিতীয় ছেলেকে দিয়ে দেখাবে। রেজাউলের দূর সম্পর্কের আশ্রিত শালী ফারজানা এবং দ্বিতীয় ছেলে সমবয়সী, দু’জনের গভীর প্রেম।
— বলেন কি! এ তো মারাত্মক টুইস্ট।
— শুধু টুইস্ট’ই দেখলে, হেনা! এর মধ্যে ট্যাবু ভাঙা আছে, মানব মানবীর দুর্নিবার প্রেম আছে। গল্পের এ পর্যায়ে তুমি রেজাউলের প্রতি ঘৃণাটা গাঢ় করে দিতে পারো— রেজাউল যখন জেনে যায় ছেলের সাথে ফারজানার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে, তখনই ফারজানার শরীরের প্রতি তার লোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।
গল্পের ফরমুলা হেনার পছন্দ হয়েছে, নিখিলবঙ্গ প্রগতিশীল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য গল্প পাঠানোর শেষ তারিখ আগামী মাসের ২২তারিখ, হাতে প্রায় মাস খানেক সময় রয়েছে। গল্পটা নামিয়ে ফেলা যাবে। হেনা জানতে চায়,
— গল্পের শেষটা কি হবে?
— ফারজানা, রেজাউল বা রেজাউলের দ্বিতীয় ছেলে— এদের যে কোনো একজনকে খুন করে গল্পটা শেষ করা যায়, কিন্তু আরও কিছু অতি জরুরী উপাদান বাকী রয়ে গেছে।
— কি উপাদান?
— সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, দারিদ্রের কষাঘাত, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন।
আকাশ থেকে পড়ার দশা হেনার,
— এক গল্পে এতকিছু! কিভাবে সম্ভব!
— খুব সহজেই সম্ভব। বাবার কু-কর্মের কথা জেনে ফারজানাকে নিয়ে রেজাউলের ছেলে পালাবে। বাস ছুটছে। রেজাউলের ছেলের মনে হবে গত সরকারের আমলে একবার এ রাস্তা দিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলো। ভাঙা রাস্তায় অনবরত ঝাঁকির কারনে পেট ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো। এখন কোনো ঝাঁকি নেই, রাস্তাগুলো যেনো মাখন দিয়ে তৈরী। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বাস পদ্মা সেতুতে উঠবে। এই সেতুটার বিরুদ্ধে কত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে হলো, সব ষড়যন্ত্র নস্যাত করে প্রধানমন্ত্রী সেতুটা তৈরী করে দিলেন। রেজাউলের ছেলে ফারজানার ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাসের জানালা দিয়ে তারা ভরা আকাশ দেখবে, সে জানে তারার ভিড়ে জেগে আছে স্যাটেলাইট, সে স্যাটেলাইট কি জানে পৃথিবীর সবচে রূপবতী মেয়েটা তার পাশে বসে আছে। বাস পদ্মা সেতু পাড়ি দিচ্ছে, পদ্মার স্রোতে আলোর নান্দনিক খেলা। কাঁধে মাথা রেখে ঘুমের গভীর সমুদ্রে সাবমেরিনের মত ডুব সাতার দিচ্ছে ফারজানা, বাসের স্পিকারে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা গাইছেন ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাক না।’
হেনার মনে প্রশ্ন জাগে — নোমান কি রসিকতা করছে! কিন্তু চেহারা দেখে আর কণ্ঠস্বর শুনে তা মনে হচ্ছে না। নোমান এশট্রেতে ঘষে সিগারেটের আগুন নেভায়, ফিল্টারটা ভিতরে ফেলে বলে,
— অসাম্প্রদায়িক চেতনার অংশ হিসেবে রেজাউলের ছেলে এক হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিবে। বন্ধুটি ওদের সেবাযত্মের চূড়ান্ত করবে। কাজী ডেকে বিয়ে পড়াবে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী মিলে নফল নামাজ আদায় করবে, হিন্দু বন্ধুটি ওই সময় ঘরে দেব-দেবীর মূর্তি ও ছবিগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিবে, যাতে নামাজ আদায়ে সমস্যা না হয়।
— বাহ! বাহ! বেশ বলেছেন। পরের অংশটা মনে হয় ধরতে পারছি। এ সংবাদ রেজাউলের কানে পৌছাবে, রেজাউল ছেলেকে শায়েস্তা করতে হিন্দু পাড়ায় আক্রমণ চালাবে। ঘটনা গড়াবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়। এই তো?
— ঠিক তাই। হামলার পাশাপাশি অভাবগ্রস্ত হিন্দু মুসলমানদের ফোকাস করে গল্পে দারিদ্রের কষ্টের ছবি আঁকবে। তবে দারিদ্রের কারণ বা রেজাউলের ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। রেজাউল এমনি এমনি ক্ষমতাবান, ক্ষমতাসীন কারো মমতার ছায়া তার ওপর নেই, থাকলেও তা বিরোধী দলের।
— নোমান ভাই, তাই হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষণ কি সত্যিই এই গল্পে প্রাসঙ্গিক? গল্পের প্রয়োজনে ব্যবহার হবে!
নোমান হাই তুলে, মোবাইল অন করে সময় দেখে, সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলে,
— পুরস্কারের জন্য গল্প লেখা হচ্ছে— এ গল্পে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থাকবে না! গল্পের প্রয়োজনেই তো সবকিছু আসছে, ভাষণও আসবে। হিন্দু পাড়ায় হামলার পর হিন্দু এবং মুসলিম প্রতিবেশীরা মিলে হামলাকারীদের প্রতিরোধ করবে। প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিবে রেজাউলের ছেলে, তার মনে বেজে চলবে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত কণ্ঠের ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
— গল্পের শেষটা কি হবে?
— গল্পটা বেশ ক’ভাবে শেষ করা যেতে পারে, যেমন রেজাউলের ইন্ধনে সংঘটিত হামলায় ছেলে মারা যাবে, ফারজানাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। অথবা, রেজাউলকে বিষ খাইয়ে হত্যা করে আত্মঘাতী হবে স্ত্রী। আরও ভয়াবহও শেষ হতে পারে, রেজাউলের ছেলে মারা যাবে, ফারজানার গর্ভে বেড়ে উঠবে রেজাউলের সন্তান।
হেনা বলার মত কোনো কথা খুঁজে পায় না, নোমান তাকে উদ্ধার করে,
— গল্পের ঝোপ বুঝে সীমিত পরিমাণে কাফকা, মারকেজ আর চমেস্কির কোপ মারতে হবে। তুমি আগে গল্পটা লিখে ফেলো, তারপর ঝোপ বুঝে বুঝে লাগসই কোপ মারা যাবে।
হেনা হ্যা সূচক মাথা নাড়ে, আগ্রহ ভরে জানতে চায়,
— আচ্ছা, রেজাউলের ছেলে মানে দ্বিতীয় ছেলের নাম কি দিবো? আর, নোমান ভাই, গল্পটা আপনি লিখছেন না কেনো?
কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবে নোমান, চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলে রাখে, হেনার চোখে তাকিয়ে বলে,
— দ্বিতীয় ছেলের নাম দিও নোমান, নোমান করিম। আর রেজাউলের ছেলেদের এমন গল্প লিখতে নেই।
নোমানের এ কথা কি শুধুই টুইস্ট! ইংগিতপূর্ণ রসিকতা! অথবা নিরেট বাস্তবতা— হেনা একই সাথে বিভ্রান্ত, বিস্মিত এবং আশ্চর্যান্বিত। টেবিলের অপরপাশে এ ফোর সাইজের সাদা কাগজের এক পিঠে আঁকিবুঁকি শেষে অপর পিঠে আঁকিবুঁকি কাটছে জনপ্রিয় দৈনিকের তরুণ সাহিত্য সম্পাদক নোমান করিম।