হলুদ বনে বনে

 

হলুদ বনে বনে

 

 

ঘুম ভাঙলেই মনে হয় ট্রেনটা থামলো। এবার নামতে হবে। ঘর এখনো অন্ধকার। শুধু চৌখুপী দিয়ে তেড়ছা আলো এসে ঘরটাকে একটা মায়াময় আভাস দিচ্ছে সকাল হয়েছে। জানালার পাশে দুটো বিশাল চামর গাছ আছে সেখান থেকে দুটো নাম না জানা পাখি ডাকছে। দিমিতাদের বাড়িটা সাবেকি আমলের। দিমিতার দাদা বাড়িটা বানিয়েছিলেন। এখনো তেমনি আছে। টানা বারান্দা, বড় বড় থাম, লাল টকটকে মেঝে, দরোজায় উঁচু চৌকাঠ, ঘরগুলো বেঢপ বড়। দিমিতার ঘরটা সবচেয়ে দক্ষিণে।
দিমিতা বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। নেমে জানালার দিকে এগিয়ে গেলো। ঘুম ভেঙেই জানালা খুলে দেয়াটা দিমিতার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। জানালা খুলতেই দিমিতার মনটা অদ্ভূত আনন্দে ভরে যায়। দিমিতা দিনের প্রথম নিঃশ্বাসটা বুক ভরে নেয়।
ফারুক সাহেব বারান্দায় বসে তার প্রতিদিনের চা ‘ টা খাচ্ছিলেন। উঠানে পেয়ারা গাছটার কাছে টিলু তার লেজ উচু
করে পাক খাচ্ছে। ফারুক সাহেবের সেদিকে তাকিয়ে থাকতে খুব ভালোলাগছে। ভেতর থেকে দিমিতার গলা শোনা যাচ্ছে। মিশুর মাকে কি যেনো বলছে।
উঠানের কোনার এই পেয়ারা গাছটা দিমিতার মায়ের লাগানো। বেচারি গাছপালা বড় ভালোবাসতো। এ বাড়ির বেশিরভাগ গাছই তার হাতেই লাগানো। উত্তরের দিকে খাল পাড়ের ধারে লাগানো এক সারি কদম গাছ। কদম ফুল তার বড় প্রিয় ছিলো। বাড়ির পেছনের দিকের আম বাগান। এসবই দিমিতার মায়ের করা। এ বাড়ির মুখে ঢুকবার রাস্তার দুধার জুড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছ এসে শেষ হয়েছে উঠোনের মুখে। কৃষ্ণ চুড়ার দিনে রাস্তাটা ছেয়ে থাকে লাল গালিচায়।
সে এক সুন্দর দৃশ্য। গাছগুলো আছে। কিন্তু সে নেই।
মাত্র সতেরো বছর বয়সে এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসেছিলো দিমিতার মা শাহানারা ইয়াসমীন। মাত্র পাঁচ বছর। পাঁচটা বছরই ছিলো সে এ বাড়িতে। যতোদিন ছিলো বড় জুড়ে ছিলো শানু। এখনও কি নেই!
একটা বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস নেমে এলো। ফারুক সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে তার মায়ের ঘরে গেলেন। দিলারা বানু তসবি হাতে পা লম্বা করে তার খাটে বসে আছেন। চোখ বুজা। জানালা দিয়ে আসা সকালের আলোয় টুকটুকে ফর্সা দিলারা বানু তার গেয়ের সাদা শাড়ি মিলেমিশে এক অপার্থিব আবহ তৈরী হয়েছে। মাকে তার অন্য জাগতিক মানুষ মনে হচ্ছে।
ফারুক সাহেব নরম গলায় ডাকলেন – মা! দিলারা বানু হাতের তসবি থামিয়ে চোখ খুললেন। অমায়িক হাসলেন।

দিমিতা রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটালো। হাত ঘড়িটা দেখে নিলো একবার। ন টা দশ বাজছে। হেঁটে করিডোর পার করে টিচার্স রুমে গেলো।
কবির স্যার মোবাইলে ফেইসবুকিং করছেন। দিমিতাকে দেখে হাসলেন।
কেমন আছেন স্যার?
এইতো আছি আর কি। আজকের মিটিংটা কিন্তু বেশ টেনশন দিচ্ছে। ম্যানেজিং কমিটি আসলে কি চায় বলুন তো।
দিমিতা হাসলো। উত্তর দিলোনা। নিজের চেয়ারে বসলো। কবির স্যার লোকটা সুবিধার নন।পৃথিবীতে কিছু মানুষ যারা বিনা পারিশ্রমিকে বার্তাবাহকের কাজ করে। এখানকার কথা ওখানে সরিয়ে বেড়ায়।
কবির স্যার সেই বার্তাবাহক সম্প্রদায়ের একজন সম্মানিত সদস্য।
সেদিন সীমান্তা ম্যাডাম হেডস্যারকে নিয়ে কি একটা যেনো বলেছিলেন। সেটা সযত্নে কবির স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র পালের কানে পৌঁছে দিয়েছেন।

দিমিতা নিজের ফোন বের করে ফেসবুকে ঢুকলো। মেমোরিতে পাঁচবছর আগের একটা পোস্ট। “তুমি আসছো, সমস্ত ঝরা পাতা সরিয়ে “। তার তো আসার কথা ছিলো। কিন্তু সে এলো না। ঝরা পাতায় ঢেকে দিয়ে দিমিতাকে অন্তরীক্ষে মিলিয়ে গেলো। ফিরে গেলো।
অইদিনগুলো দিমিতার ঘোরের মতো ছিলো। মা হবার সৌভাগ্যে অধীর। কিন্তু আবির?

বিয়ের আগের রাতে ছোটচাচা দিমিতার ঘরে এসে দিমিতার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, দিমি ছেলেটা বড় ভালো। দেখিস তোকে ভালো রাখবে।
আবির সত্যিই বড় ভালো ছিলো। বিয়ের পর দিমিতার স্কুলের চাকরিটা নিয়ে শাশুড়ি আপত্তি তুলেছিলেন। বলেছিলেন ছেড়ে দিতে। কিন্তু আবির। আবির দিমিতাকে বলেছিলো, দিমিতা কারও কথা শুনে তোমার চাকরি ছাড়ার দরকার নেই। তোমার যদি ইচ্ছে করে তুমি ছেড়ে দেবে। যদি না করে ছাড়বেনা।
দিমিতার ইচ্ছে করেনি দিমিতা ছাড়েনি। আবিরের তোপের মুখে শাশুড়িও আর রা করেননি। আবির বলেছিলো, দিমিতা তোমার জীবনটা শুধুই তোমার। সেই জীবনে আমরা হয়তো একটা অংশ কিন্তু তোমার পুরো জীবন নই। তাই তোমার জীবনের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার শুধুই তোমার।

বিয়ের পর আবির আর দিমিতা একসাথে ঘুরতে গেলো। রমালী টি-স্টেট। আবিরের দুলাভাইয়ের সেখানে একটা বাংলো আছে। চারিদিকে চা বাগান মাঝখানে ছোট্ট বাংলো। বাংলোর রাস্তাটা মাটির। মনে হয়ে একটা নদী বাংলো থেকে নেমে হারিয়ে গেছে চা বাগানে। রমালীতে তারা প্রায় সাতদিন ছিলো। হেমন্তের মাঝামাঝি পাতাগুলো হলুদ হয়েছে কেবল। ঝরে যায়নি তখনও। আবছা কুয়াশায় মায়াময় চারপাশ। সন্ধ্যায় যখন পিনপতন নীরব চারপাশ তখন আবির আর দিমিতা বাংলোর বারান্দায় এসে বসতো। কিনু চা দিয়ে যেতো। আবির মজার মজার গল্প বলতো। দিমিতা শুধু শুনতো। তখনও জড়তা কাটেনি দিমিতার। চুপচাপ থাকতো। আর বলবার মতো অতো গল্পও ছিলোনা দিমিতার। দাদি আর ছোটচাচার বাইরের জগৎটা তার বড় ছোট।
একদিন সকালে দিমিতা আর আবির চা বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটছিলো। দিমিতা পেছন পেছন। আবির কিছুটা সামনে।
হঠাৎ আবির কিছুটা পিছিয়ে এলো। দিমিতার পাশে।
ডাকলো, দিমি?
হু।
তোমাকে একটা কথা বলবো। শুনবে?
হু। বলো।
দিমি আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি বড় ভালো মেয়ে।
বলেই দ্রুত পায়ে আবির সামনে চলে গেলো। দিমিতা থমকে রইলো।
এই সকাল, হেমন্তের শিশির ধোঁয়া সবুজ পাতাগুলো দিমিতার দিকে যেনো আনন্দে তাকিয়ে আছে। দিমিতার বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে গেলো। সুখে। বিয়ের এই একমাস বাইশদিন পর দিমিতার মনে হলো এই আত্মমগ্ন মানুষটাকে দিমিতা ভালোবেসে ফেলেছে।
মনে হলো এতোজীবন ধরে থই খোঁজা নোঙ্গরটা এবার মাটির আশ্রয় পেলো। একটা বীজ অঙ্কুরোদগমিত হয়ে সবুজ মাথাচারা দিলো।
অনেক সাগর পেরিয়ে একটা জাহাজ বন্দর পেলো।

বাড়ি ফিরতেই উঠোনে হুসেন চাচিকে দেখা গেলো। মিশুকের মার সাথে কি নিয়ে যেনো কথা বলছেন। দিমিতা হাসিমুখে বললো, কেমন আছো চাচি? হুসেন চাচার পায়ের ফ্র্যাকচারটা সেরেছে?
পনেরোদিন তো হয়ে গেলো।কাল তো প্লাস্টার খোলার তারিখ। বাকিটা কাল এক্সরে করলে বোঝা যাবে।
তুই তো আমাদের বাড়িমুখো হোস না একদম। এই বাড়ি আর অই বাড়ি। রাস্তাটা পার হলেই যাওয়া যাস। তবুও যাস না।
একটানা কথাগুলো বলে থামলেন হুসেন চাচি।
চাচি সময় পাই না তো একদম। এই দেখো মাত্র ফিরলাম। সারাদিন স্কুল করে, খিটিমিটি করে আর কিছু ভালোলাগেনা চাচি। বলে হাসলো দিমিতা।
মারুফ ভাই কাল ফোন করেছিলেন। তোর চাচার খোঁজখবর নিলেন।
দিমিতা উত্তর না দিয়ে বললো, চা খেয়েছো চাচি?
খেয়েছি। তুইও যা কিছু খেয়ে নে। তেতে এলি। আমি যাই। ইকবালের আবার টিউটর আসার সময় হয়ে গেলো।
সুমনই তো পড়াচ্ছে ইকবালকে। দিমতা বললো।
হ্যাঁ রে। ছেলেটা ভালোই পড়ায়। বলে হুসেন চাচি হেলে দুলে বের হয়ে গেলেন।
ফুফু টেবিলে ভাত দাও। বড় খিদা লেগেছে। আমি গোসল করে আসছি। আচ্ছা বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো মিশুকের মা।

দিমিতার গলা পেয়ে টিলু এসেই দিমিতার পায়ে ঘেষাঘেষি শুরু করলো। দিমিতা টিলুকে কোলে নিয়ে দিলারা বানুর ঘরে ঢুকে গেলো।
দাদি, দুপুরে খেয়েছিলে?ওষুধ দিয়েছে ফুফু? জিজ্ঞেস করলো দিমিতা।
হ্যাঁ রে। মিশুকের মাকে বলেছিস তোকে খেতে দিতে?
ছোট চাচা কই? দেখছিনা। উত্তর না দিয়ে ফের প্রশ্ন করলো দিমিতা।
মসজিদে মিটিং আছে পাঞ্চায়েতের। কলিম এসে নিয়ে গেলো ছোটোকে। তুই যা আগে খেয়ে নে দিমি।
যাচ্ছি বলে দিমিতা নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। দিলারা বানু সেদিকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই শান্ত, ধীর মেয়েটার ভাগে আল্লাহ এতো দুঃখ রাখলেন কেন! তিনি কি পারতেন না এই মেয়েটার জন্য একটু আনন্দ রাখতে।
এই অভাব অভিযোগহীন সদা হাস্যময়ী মেয়েটাকে দেখলে কে বলবে তার জীবনে এতো অপ্রাপ্তি। এতো ব্যথা।অবাক হন তিনি। ব্যথা অপ্রাপ্তি বোধহয় মানুষকে আরও সাহসী করে।


পোস্টমাস্টার করিম শেখ ব্যাগভর্তি বাজার এনে রাখলেন রান্নাঘরে। শিরি বেগমকে বললেন এককাপ চা দাও তো আর দেখে নাও সব ঠিকঠাক আছে কিনা।
রুইমাছ এনেছি। কলিম জোর করে দিলো। মাছের চেহারাটাও ভালো তাই আর আপত্তি করলাম না। নিয়েই নিলাম। কড়া করে ভেজে বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে দোপেয়াজা করো।
আর হরেনকে বলে এসেছি দুপুর নাগাদ দইটা এসে দিয়ে যাবে।

আজ পোস্টমাস্টার করিম শেখের বড় মেয়ে ইয়াসমীনের পাকা দেখা। আজই ওরা এসে বিয়ের তারিখ দিয়ে যাবে। চিরকালের জন্য তার মেয়ে পরের ঘরে চলে যাবে। এরপর আসবে অথিতি হয়ে।
নিজের মেয়ে নিজের ঘরে অথিতি! পৃথিবীর বড় নিষ্ঠুর নিয়ম।
আবার আনন্দও হচ্ছে। মেয়ের তার বিয়ে হতে যাচ্ছে বড় ঘরে। বিয়ের পরই ছেলে বিলেত চলে যাবে। একদিন মেয়েকেও নিয়ে যাবে। মেয়ে তার কপাল করে এসেছে বলতে হয়!

সারা বাড়িতে উৎসব উৎসব সাজ। ছোট ভাইবোন গুলো এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। মা রান্নায় ব্যস্ত। বাবা অস্থির হয়ে ঘর বার কর্ছেন। ইয়াসমীন এ ঘরে একা। কয়েকদিন বাদেই সে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। অচেনা বাড়ি, অচেনা মানুষের মধ্যে থাকতে হবে ইয়াসমীনের। এও তো এক নতুন জন্ম। মেয়ে হয়ে জন্মালে বারবার জন্মাতে হয়। স্ত্রী হয়ে, মা হয়ে, শাশুড়ি হয়ে বারবার জন্মাতে হয়।

মানুষ হয়ে জন্মানো যতো সহজ ততো সহজ নয় নতুন নতুন সম্পর্কে নতুনভাবে জন্মানো।

দুপুরের দিকে ছেলেপক্ষ থেকে চারজন এলেন। ছেলের মামা, ছেলের চাচা, মসজিদের ইমাম আর ছেলের ছোটভাই। খাওয়া দাওয়ার পর তারা তারিখ ফেলে গেলেন। আগামী মাসের পনেরো তারিখ অর্থাৎ পনেরোই কার্তিক শাহানারা ইয়াসমীনের সাথে মারুফুল ইসলাম মারুফের বিয়ে।

আর মাত্র বাইশ দিন। এই বাড়িতে ইয়াসমীন। সন্ধ্যা নামছে। পাখিরা তার ঘরে ফিরছে। ইয়াসমীন তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। আকাশ লালচে হয়ে আছে। অচেনা পুরুষের কথা ভেবে তার মন উচাটন হয়ে উঠছে। শরীরে বইছে হিম স্রোত।

ফারুকের তুমুল আপত্তি তার মা শুনলেন না। মারুফের জন্য তার ওই মেয়েই পছন্দ। শান্ত ধীর মেয়েটা। চেহারায় এক অলৌকিক মায়া জড়ানো। দিলারা বানুর বড় ছেলে মারুফের জন্য অই মেয়েই পছন্দ।
তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না ছোট ছেলের কেনো এতো আপত্তি।

ফারুক কি করে বোঝাবে প্রথম দেখাতেই সে শাহানারা ইয়াসমীনকে ভালোবেসে ফেলেছে। কি করে বলবে সে কিছুতেই এটা মেনে নিতে পার্বেনা শানু তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী হতে চলেছে।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। নারকেল গাছের পাতা পিছলে ফোটাগুলো গড়িয়ে পড়ছে ঘাসে। ঘাসের গা বেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সেই জল।

ফারুকের বুকের ভেতরটা আজকাল বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। নেই নেই একটা অনুভূতি বুকের ভেতর দলা পাঁকিয়ে থাকে।
যেদিন প্রথম তারা শানুকে দেখতে গেলো শানুর মা শানুকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। হালকা নীল রঙের শাড়ি মাথায় ঘোমটা। নীল শাড়িটা যেনো একটা নদী শানু পদ্ম হয়ে দুলছে তার ভেতর।
শানু সালাম দিলো। মধুর স্বর। হাত তোলার ভঙ্গিমায় যেনো নাচের মুদ্রা।
ফারুক মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলো। আশপাশের সমস্ত কথা শব্দ তার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো।

সবার পছন্দ হলো শানুকে। শুধু ফারুক নানা বাহানা করতে লাগলো।
বললো অই মেয়ে তো কালো। ভাইজানের সাথে মানায়? সবাই বললো মেয়ের গায়ের রঙ শ্যামলা ঠিক কিন্তু চেহারাখানা বড় মিষ্টি।
ফারুক বললো, ওমন আলাভোলা মেয়ে সামলাতে পারবে সংসার?
দিলারা বানু বললেন পারার দরকার নেই। আমি তো আছি।
সবার পছন্দের মুখে ফারুকের অপছন্দ টিকলোনা। ফারুকের মনে হলো সবাই মিলে তাকে চিতায় তুলে দিচ্ছে। সে পুড়ছে দাউদাউ।
ঘুমের ভেতর ফারুকের স্বপ্নে শানু আসে। নীল রঙের শাড়ি পরে জলের কিনারে একটা একটা করে পদ্ম তুলে নিয়ে যায়।
বাড়ির রাস্তা শেষ হলে উত্তরে গ্রামের আবছা ঘরগুলোকে ফারুকের শানু মনে হয়। দূরে, থির কাঁপে। ভেতরে তোলপাড় হয়ে যায়।
নিজের ঘরের জানালার দিকে চেয়ে ফারুক অস্ফুট ডাকে শানু! শানু! সন্ধ্যায় কুপির আলোর টিমটিমে শিখাকে ডাকে শানু! শানু!

কার্তিকের খেতে তখন সবুজ মিলিয়ে হালকা খয়েরি আভা। ধানের ছড়া বাতাসে সরসর দুলে। দিলারা বানু ফারুককে ডেকে বললেন কাল দুপুরে সে যেনো হানিফ মামা, সোহাগ চাচা আর ইমাম সাহেবের সাথে ইয়াসমীনদের বাড়ি যায়। কাল মারুফের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে।

ফারুকের মাথায় আকাশ ধ্বসে পড়ে বড় বড় পাথরের টুকরোর মতোন। বুকের ভেতরের শব্দটা দ্রিম দ্রিম হাতুড়ি পেটাতে থাকে ফারুকের কানে। শানুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে! শানুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে!
ফারুক এসে দাঁড়িয়েছে খোয়াইয়ের পাড়ে। স্বপ্নে ফারুক শানুকে যে নদী থেকে পদ্ম তুলতে দেখে সেটা কি খোয়াই? খোয়াইয়ে তো পদ্ম ফোটেনা! সেই নদী কি তবে ফারুক? শানু নিজের অজান্তেই তুলে নিচ্ছে ফারুকের সব সুন্দর!
খোয়াইয়ের জলে কয়েকটা হাস সাতার কাটছে। ডুবে ডুবে অনেকদূর গিয়ে ভেসে উঠছে।
যা তার নয়, তার ছিলোনা তা হারানোর তো কিছু নেই। তবু কেনো মনে হচ্ছে সে হারিয়ে ফেলছে!

পরদিন দুপুরে ফারুকরা শানুদের বাড়ি গিয়ে বিয়ের তারিখ দিয়ে এলো। পনেরোই কার্তিক।
হেমন্তের মাঠে তখন থাকবে ফসলের উল্লাস, রাতভর্তি তারারা আকাশকে সাজাবে নিজস্ব ঢঙে। ফারুক তখন কাছেরই কোনও বনে পাতা হয়ে ঝরে যাবে,ঝরে যাবে।
শানু অন্যের হয়ে যাবে! শানু ফারুকে ভাইজানের হয়ে যাবে!

১৫ ই কার্তিক ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো মারুফ আর ইয়াসমীনের। পাঁচ গায়ের লোক খাওয়ানো হলো। গা ভর্তি গয়না দিয়ে ইয়াসমীনকে ঘরে তুললেন দিলারা বানু।
দিলারা বানু বড় অমায়িক। মায়ের মতোন আগলে নিলেন ইয়াসমীনকে।
দুপুরে সারা বাড়ি ঝিমিয়ে গেলে ইয়াসমীন দিলারা বানুর পাশে গিয়ে বসে। দিলারা বানু সুপারি কেটে কেটে গল্প করেন ছেলেবেলাকার দস্যিপনার।
এসব গল্প না শুনলে কে বুঝবে এই টুকটুকে ফর্সা গোলগাল মানুষটার এমন ডাকাবুকো শৈশব ছিলো!
এ বাড়িতে কাজের লোকগুলো পর্যন্ত ইয়াসমীনকে ভালোবাসে। কিন্তু ফারুক তাকে একদম সহ্য করতে পারেনা। দূরে দূরে থাকে। পালিয়ে বেড়ায়।
সেদিন সকালে চা খেতে ডাকলো ইয়াসমীন। ফারুক এলোনা। দিলারা বানু গিয়ে ডাকলেন। ইয়াসমীনের বড় কষ্ট হয়। কেনো ছেলেটা তাকে এমন অপছন্দ করে!

শীতকাল পেরিয়ে বাতাসে তখন বসন্তের হাওয়া। গাছেরা নতুন পোশাক পড়ে নিচ্ছে। ফুল হাসছে। পাতার ফাক দিয়ে মাঝে মাঝেই কুউউউউ ডেকে উঠছে কোকিল। অথচ ইয়াসমীনের জীবনে তখন বিচ্ছেদ বাজছে সন্তুরের করুণ সুরে। দুমাসের অন্তঃসত্ত্বা ইয়াসমীনকে রেখে মারুফ বিলেত চলে গেলো।
যাবার আগে ইয়াসমীনের মাথায় হাত রেখে শুধু বললো আসি, নিজের যত্ন নিও।
ইয়াসমীন নিঃশব্দে কেঁদে গেলো। তখনও কোকিল ডাকছে কুউউউউউউউউউউউ…..


দিমিতা ফোন হাতে নিলো। নিয়াজকে টেক্সট লিখলো, “ওষুধ খেয়েছো? “। পাঁচ মিনিট পর উত্তর এলো” খেয়েছি “।
গত তিনমাস ধরে রোজ রাত সাড়ে এগারোটায় দিমিতা নিয়াজকে টেক্সট করে। ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজলেই দিমিতার অস্থির লাগে। এই টেক্সটটা করলেই দিমিতা শান্তি পায়।
নিয়াজের অনেক ওষুধ খেতে হয়। ব্লাডসুগার, ব্লাডপ্রেসার, কলেস্টোরেল সব বাধিয়ে বসে আছে। দিনের ওষুধটা তো তার মনে থাকে। রাতেরটা মনে থাকেন। দিমিতাই মনে করিয়ে দেয়।
এই যে রোজ রাতে দিমিতা তাকে ওষুধের কথা মনে করিয়ে দেয় নিয়াজ কিন্তু কখনই প্রশ্ন করেনা তুমি রাতে খেয়েছো। মাঝে মাঝে দিমিতার বুকটা ভারী হয়ে ওঠে। পয়ত্রিশ বছর বয়সে এসেও দিমিতার কিশোরিসুলভ অভিমান হয়।
সারাদিন ব্যস্ত থাকে নিয়াজ। দিমিতা জানে। দুটো ট্রাভেল এজেন্সি, একটা রেস্টুরেন্ট নানা জায়গায় করা ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে সারাদিন নানান রকম ঝক্কি থাকে নিয়াজের। রাতে যখন দিমিতাই টেক্সট করে দুটো কথা কি দিমিতাকে জিজ্ঞেস করা যায়না!
জানালাটা বন্ধ করতে গেলো দিমিতা। তার ঘরের আলোটা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে ঢুকে গেছে ওপাশের ঝোপে।জানালার সোজাসুজি দুটো চামড় গাছের মাঝখানে একটা কুকুর বসে তাকিয়ে আছে সেই আলোর দিকে। ভালোবাসলে মানুষও কুকুর হয়ে যায়। যাকে ভালোবাসে সে তার একাকী প্রভু হয়ে যায়।
দিমিতার একা লাগছে। কাউকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। সকালের ট্রেনে নিয়াজের কাছে চলে যাওয়া যায়। গিয়ে বলা যায়,”আমি এসছি, তুমি এসো।”
দিমিতা জানালা বন্ধ করে বাতি নেভালো।ঘরে এখন শুধু অন্ধকার আর দিমিতা। বুকের সাথে বালিশটা জড়িয়ে শুয়ে পড়লো।
পাশের রুম থেকে টিভির শব্দ আসছে। দিমিতা চোখ বন্ধ করলো।

ফারুক সাহেব টিভি বন্ধ করে দিমিতার রুমের দিকে উকি দিলেন। লাইট নেভানো। দরোজা বন্ধ। মেয়েটাকে নিয়ে তার বড় চিন্তা হয়।
শানুর মৃত্যুর পর ফারুক সাহেব দিমিতাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। শানু মারা যাওয়ার সময় দিমির বয়স মাত্র চার।
একবার দিমি ফারুককে প্রশ্ন করেছিলো, ছোটচাচা সবার মা আছে, তোমার মা আছে। আমার মা নেই কেনো?
ফারুক বলেছেছিলেন, তোর আমি আছি। যার একটা বড় ছেলে থাকে তার কোনও মা থাকেনা।
দিমি আর কোনোদিন মাকে নিয়ে প্রশ্ন করেনি। বাবাকে নিয়েও না। দিমি তো তার বাবাকে কোনোদিন দেখেওনি।
ফারুক সাহেব নিজের ঘরে এলেন। চোখের ড্রপটা দিলেন। এই ড্রপটা দিলে গলা পর্যন্ত তেতো হয়ে যায়। মাঝরাতে ফারুক সাহেবের ঘুম ভেঙে গেলো। ধড়মড়িয়ে উঠলেন। ইদানীং একটা স্বপ্ন প্রায় রাতেই দেখছেন। রক্তের স্রোতের মধ্যে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তার গায়ে লেগে যাচ্ছে চাপচাপ র ক্ত। সেই রক্ত খুব সপ্রাণ। সেই রক্ত ভয়ংকর শব্দ করে হাসে।

সীমান্তাকে বেশ হাসিখুশি লাগছে। সামনেই পরীক্ষা দিমিতা প্রশ্ন সেট করছিলো। তাকালো সীমান্তার দিকে। মুচকি হেসে বললো কী ব্যাপার সীমান্তা ম্যাডাম আজ এতো হাসিখুশি। এনি গুড নিউজ।
সীমান্তা লাজুক হেসে নীচু গলায় বললো, আমার আর দিলীপের ব্যাপার্টা বাড়ি থেকে মেনে নিয়েছে। আগামী শুক্রবার দিলীপরা আমাদের বাড়ি আসছে আশির্বাদে।
কনগ্রাটস! এতো দারুণ খবর। তাহলে প্রেমই জিতলো।
সীমান্তা হাসলো। ঝলমলে অনাবিল হাসি।

এর মধ্যেই দিমিতার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনে ভাসছে বাবা। বাবা!
দিমিতা ফোন তুললো, হ্যালো বাবা? কেমন আছো?
আছি ভালো। তোরা কেমন আছিস?
আচ্ছা শোন ফারুককে ফোনে পাচ্ছিলাম না। ওকে একটু বলিস আমাকে ফোন দিতে। মা ভালো আছেন?
একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন মারুফ সাহেব।
আছেন ভালো দাদি। ফিজিও চলছে।
আচ্ছা বাবা আমি এখন স্কুলে। ফিরে ছোটচাচাকে বলবো ।
ঠিক আছে রে মা। রাখি। তুই ভালো থাকিস।
ওপাশে ফোন রাখার শব্দ হলো। দিমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই মানুষটা যাকে সে আজ অব্দি সামনাসামনি দেখেনি, দুরাভাসে সামান্যতম কথা হয় তাকে সে বাবা ডাকে। অথচ যে মানুষটা তাকে বাবা মার স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছে তাকে সে ছোটচাচা বলে ডাকে।

প্রশ্নপত্রের সেটটা হেডস্যারের কাছে জমা দিয়ে স্কুল থেকে বের হলো দিমিতা। মফস্বলের দুপুরগুলো ঢুলতে থাকে। মনে হয় হাজার পথ হাঁটার ক্লান্তি দুপুরের। স্কুলের উল্টোদিকে একটা শিরিষ গাছ। তার তলায় চায়ের দোকানে দু তিনজন কাস্টমার যেনো এই ঢুলুনিতে মৃদু ধাক্কার মতো। তারা চা খেতে খেতে উচ্চগ্রাম কথা বলছে। শিরিষ গাছ থেকে একটা দুটো পাতা ঝর্ছে।

ভর দুপুর মাথায় নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো দিমিতা। অন্যদিন তো স্কুল থেকে ফিরতে বিকেল হয়। খেয়েদেয়ে এসে শুলো দাদির ঘরে। বাড়িতে থাকলে দুপুরটা দিমিতার এই ঘরেই কাটে।
বয়স যখন আট তখন দিমিতার দাদি এ বাড়িতে বউ হয়ে আসেন। তাও আবার বড় বউ। দিমিতার দাদারা চার ভাই ছিলেন। দুপুর যখন ঢলতে থাকতো আলস্যে আট বছর বয়সী বড় বউ তখন গ্রামের ছেলেমেয়েদের সাথে পুবের মাঠে গোল্লাছুট খেলতেন। এ নিয়ে শাশুড়ির নানা গঞ্জনা তাকে শুনতে হতো। কিন্তু বড় বউ দমে যাওয়ার মেয়েটি তো ছিলেন না। তার দস্যিপনা জারিই রইলো। একবার তেতুল গাছে চড়ে ধরা পড়ে গেলেন শ্বশুরের হাতে। শশুর মজা করে বললেন আমার বাদর বউ। ব্যস। সেই লজ্জায় দিলারা বানুর সব দস্যিপনা গেলো ঘুচে। তিনি খেলাধুলা ছেড়ে হলেন গৃহিণী। আর সে সময় দিমিতার দাদা উঠে পড়ে লাগলেন দিলারা বানুকে অক্ষর জ্ঞান দিতে। দিলারা বানু শিখেও গেলেন পড়া সংগে সামান্য লেখাও।
দিমিতা দাদির গা ঘেষে জড়িয়ে শুয়ে আছে। দিলারা বানু তার বুড়ো হাতদুটো দিয়ে দিমিতার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।
দিলারা বানু বললেন, দিমি তোর একা লাগেনা। এভাবে আর কতোদিন থাকবি দিদিভাই।
দিমিতা উত্তর দিলোনা। শুধ মনে মনে বললো আমরা সবাই একা দাদি। অনেকের মধ্যে থেকেও একা। এই যে আমি তোমাকে জড়িয়ে আছি তাও তুমি একা। আমি একা। মানুষ শুধু মানুষের একাকিত্বই হতে পারে।
ফারুক সাহেব ঢুকলেন ঘরে। কি গল্প হচ্ছে দুজনের এতো। হেসে বললেন।
দিমিতা বললো, বলতেই ভুলে গেছিলাম তোমাদের। বাবা ফোন করেছিলো সকালে। তুমি একটা ফোন করে দিও।
হঠাৎ করেই ঘর নীরব হয়ে গেলো। তিনজনের কেউ কোনও কথাই বললোনা। যেনো অমোঘ নীরবতা চলছে এ ঘরে। দিমিতাই নীরবতা ভাঙলো, চা খাবে ছোটচাচা?
একগ্লাস পানি দেতো দিমি, দিলারা বানু বললেন। দিলারা বানুকে পানি দিয়ে দিমিতা চা বানাতে গেলো।
দিমিতার হাতের চা পছন্দের ছিলো আবিরের। রমালী থেকে ফিরে অন্য এক জীবন পেয়েছিলো দিমিতা। যে জীবনে প্রেম ছিলো, ভালোবাসা ছিলো। যে জীবনে আবিরকে আকাশ করে উড়ছিলো দিমতা।
উদার উন্মুক্ত মানুষ ছিলো আবির। সবসময় দিমিতাকে সাপোর্ট করেছে সব ব্যাপারে। স্বামী স্ত্রীর চেয়ে তারা তো বন্ধুই ছিলো বেশী।
শাশুড়ি যখন নাতি নাতনীর কথা বলে বলে দিমিতার মাথা খাচ্ছিলেন তখন আবিরই তার মাকে বুঝিয়েছে। অথচ আবির বিয়ের এক বছরের মাথায় সন্তান চেয়েছিলো। দিমিতা বলেছিলো সন্তানের জন্য সে এখনো তৈরি নয়। আরেকটু সময় চাই। আবির দিমিতাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো তুমি যা চাও তাই হবে।

বিকেলটা পরে আসছে। দিমিতা চায়ের কাপ হাতে ছাদে এলো। রাস্তার শেষ মাথায় সূর্যট লাল টিপের মতো ঝুলে আছে। টিলু লেজ উঁচু করে রেলিং ধরে হাঁটছে। দিমিতা টিলুর গায়ে হাত রাখলো।

 

মারুফ সব চিঠিই তার মাকে লেখে, চিঠির এককোণে থাকে ইয়াসমীন। যেখানে লেখে ইয়াসমীনের শরীর কেমন আছে জানিও, তাকে বলিও নিজের যত্ন নিতে।

বাড়িটায় ইয়াসমীনকে ঘিরে থাকে থমথমে শূণ্যতা। দিলারা বানু, ফারুক, দুটো কাজের লোক নিয়েই এ সংসার। এ সংসারে বৌয়ের পা ফুলে গেছে বলে শশুড়ি রোজ তেল গরম করে মালিশ করে দিয়ে যান। এ সংসারে দেবর কদম গাছ প্রিয় বলে একগাদা কদমগাছ দিয়ে ছেয়ে দেয় খাল পাড়।কোথাও কমতি নেই কোনো। এ সংসারে সব তার।
তবু ইয়াসমীনের মনে হয় যেনো কিছুই তার নয়।ে যনো সব ভ্রম, একটা মাটির ব্যাংক ভেঙে যাবে যেকোনো দিন।

সেই আশ্বিনে বাইরে যখন তুমুল বৃষ্টি, থেমে থেমে গর্জাচ্ছে অসময়ের মেঘ। ইয়াসমীনের কোল জুড়ে ফুটলো তখন এক আশ্চর্য ফুল। দিমিতা। সেদিন আঁতুড়ঘরে সেই বৃষ্টির সাথে ছন্দ মিলিয়ে কেঁদে উঠলো দিমিতা। মেঘে মেঘে বাজতে লাগলো পৃথিবীতে তার আগমন ধ্বনি।

ছোট্ট কাথার পুটলিতে মোড়ানো দিমিতাকে ফারুক যখন কোলে নিলো তার শরীর কাঁপছে।ফারুকের ভয়ার্ত হাতে পুটলিটা নড়ে উঠলো। মনে হলো দিমিতা তার বুকে মাথা ঘষে ঘষে আদর করে দিলো। ফারুক নিজের ভেতর বিহবলতা টের পেলো। পিতৃসুলভ স্নেহে ছেয়ে গেলো তাকে।

মারুফকে চিঠিতে জানানো হলো তার ফুটফুটে কন্যাসন্তানের কথা যার নাম রাখা হয়েছে রওনক জাহান দিমিতা।
দিমিতার জন্মের পর ইয়াসমীনের সাথে ফারুকের সম্পর্কটা কিছুটা স্বাভাবিক হলেও একটা দূরত্ব থেকে গেছে। যেটা ইয়াসমীন টের পায়।
দিমিতার জন্যেই সে ইয়াসমীনের সাথে কথা বলে। এর বাইরে আগের মতোই আচরণ। ইয়াসমীন একদিন প্রশ্ন করেই বসলো, তুমি আমাকে অপছন্দ করো কেনো ছোটো।
তোমাকে অপছন্দ করবো আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা বলো তো, বলে হেসে হেসে দিমিতাকে কোলে নিয়ে সরে গেছিলো ফারুক।

দিমিতার বয়স প্রায় দুই এর কাছাকাছি। টুকটুক করে হাটা শিখে গেছে। আধো আধো বোলে বলতে শুরু করেছে। দিলারা বানু চিঠিতে বহুবার লিখেছেন মারুফ যেনো একবার দেশে আসে। নিয়মিত চিঠি লিখলেও দেশে আসার ব্যাপারে চিঠিতে প্রায় কিছুই লিখতো না মারুফ।

এক দুপুরে যখন সারা বাড়ি ঝিমুচ্ছিলো ডাকপিয়নের বেল বেজে উঠলো চেনা ভঙ্গিতে। দ্রুত পায়ে চিঠি নিতে এগিয়ে গেলেন দিলারা বানু, চিরচেনা ভঙ্গিতে ইয়াসমীনও এসে দাড়ালো। চিঠি খুলে দিলারা বানুর ফর্সা মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। যেনো কেউ ঠেলে তাকে বসিয়ে দিলো চেয়ারে। ধপ করে বসে পড়লেন।
ইয়াসমীন আতংকিত হাতে চিঠিটা নিলো। পড়া শেষে দিলারা বানুকে ফিরিয়ে দিলো। তার মনে হলো মাটির ব্যাংকটা ভেঙে গেলো। দিমিতা ঘুমোচ্ছে। ইয়াসমীন খাটের কোনে গিয়ে বসলো। প্রবল তৃষ্ণায় তার ছাতি ফেটে যাচ্ছে।

বাড়ি ফিরতেই দিলারা বানু চিঠিটা ফারুককে দিলেন। চিঠিটা শেষ করেই প্রায় দৌড়ে এসে দাঁড়ালো ইয়াসমীনের দরজায়।
ইয়াসমীন দরোজার দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছেনা। সেই বসে থাকার ভঙ্গি পাথুরে।
ফারুক পেছন থেকে ইয়াসমীনের কাঁধে হাত রাখলো।ডাকলো শানু! ইয়াসমীন তাকালো, দৃষ্টিতে ঝড়ো হাওয়া। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। যেনো ঢেউ, আছড়ে আছড়ে ভেঙে ফেলতে চাইছে তাকে। ফারুক ক্ষীণস্বরে বললো আমি আছি শানু। আমি আছি।
হঠাৎই সারা ঘর ঠান্ডা হয়ে গেলো। এক মুহূর্ত। শানু আছড়ে পড়লো বুকে। সাতার না জানা মানুষের মতো আঁকড়ে ধরলো।

করিম শেখ মেয়েকে নিয়ে যেতে এলেন। দিলারা বানুও না করতে পারলেন না। না করবার আর কোনও জোর তো তার নেই। ইয়াসমীন যদি তার বাবার বাড়ি যেতে চায় যাক, সে সিদ্ধান্ত তিনি ইয়াসমীনের উপর ছেড়ে দিলেন। তার ছেলে বিলেতে আবার বিয়ে করেছে। সে আর ফিরবেনা জানিয়েছে। কোন জোরে তিনি ইয়াসমীনকে তার কাছে রাখতে চাইবেন। যে ছেলের জন্য তিনি ইয়াসমীনকে নিয়ে এসেছিলেন সেই ছেলেই নিজেকে উপড়ে নিয়েছে তাদের থেকে।

করিম শেখ একাই ফিরে গেলেন। ইয়াসমীন সাথে এলোনা। ইয়াসমীন সে বাড়িতেই থেকে গেলো।
এবার পুত্রবধূ হয়ে নয় দিলারা বানুর কন্যা হয়ে।

 

 

মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন “মানুষ বেঁচে থাকলে পাল্টায়, মরে গেলে পঁচে যায়। বেঁচে থাকা মানুষকে প্রতিনিয়ত বদলে যায়। সেই বদলের ভেতর দিয়ে যেতে গিয়ে কতো সম্পর্ক পাল্টে যায়। খুব চেনা মানুষটাও সামান্য পরিচিতর মতোন হয়ে যায়।
দিমিতাও টের পাচ্ছিলো আবির একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে। সে বদলটা খালি চোখে ধরা যাচ্ছেনা। মানুষের মনের ভেতর একটা রাডার থাকে। সেই রাডারটা এ বদল ধরতে পারে। কিন্তু বোঝাতে পারেনা।
দিমিতা আবিরকে প্রশ্ন করেছিলো। আবির বলেছে ব্যাংকে কাজের চাপ, ক্লায়েন্ট নিয়ে ঝামেলা, টার্গেট রিচ করা যাচ্ছেনা ইত্যাদি। দিমিতা আর এগোয়নি। ভেবেছে হবে হয়তো কাজের চাপ, যা ভাবছে মনের ভুল।
এসব ভাবনা আর উদ্দেশ্যেহীন আশঙ্কার মধ্যেই সে নিজের শরীরে আরেকজনের উপস্থিতি টের পেলো। নিজেই একবার টেস্ট করে নিলো। পজিটিভ! দিমিতার সারা শরীর আনন্দে প্রজাপতির মতো উড়তে লাগলো। এক্ষুনি সবাইকে বলবে? নাকি ক্লিনিকাল টেস্ট করিয়ে শিওর হয়ে নেবে?
তারপর ভাবল নাহ! ক্লিনিকাল টেস্ট করিয়ে কনফার্ম হয়ে জানাবে।
স্কুল থেকে বেরিয়ে দিমিতা সোজা ক্লিনিক গেলো। ডাক্তার শারমীনের রুমে সুন্দর সুন্দর বাচ্চাদের ছবি। শারমীন রিপোর্টা দেখে দিমিতার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন রওনক জাহান রেজাল্ট পজিটিভ। সামনের দুটো মাস সাবধানে থাকবেন। আমি নেক্সট ফলোয়াপের তারিখটা প্রেসক্রিপশনে দিয়ে দিচ্ছি।

কনগ্রাটস দিমিতা নিজেকে নিজেই বললো দিমিতা।
ক্লিনিক থেকে বর হয়েই আবিরকে ফোন দিলো । প্রথমবার ফোন বেজে গেলো। দ্বিতীয়বার ফোন তুললো আবির।
হ্যালো। একটা কথা বলার ছিলো। আজ কি বাসায় একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে?
আমারও তোমার সাথে জরুরী কথা ছিলো দিমিতা। ভাবছিলাম আজই বলবো।
তাহলে বাসায় ফেরো। কথা হবে। রাখছি।
হুম বলে লাইন কেটে দিলো আবির।

ফোন ছেড়ে দিয়ে দিমিতা রিকশা নিলো। ছোটচাচাকে জানাবে? দাদিকে? আবিরের মাকে? কাকে জানাবে আগে। তারপর ভাবলো নাহ আগে আবিরকেই জানাবে তারপর বাকি সবাইকে।
দিমিতা চোখ মুচছে। দিমিতার মা মারা গিয়েছিলেন যখন, তখন দিমিতা চার ছুঁইছুঁই। আজ দিমিতা নিজেই মা হতে যাচ্ছে। আজ থেকে দিমিতাও মা।

আবির কথা রেখেছে। রাত করেনি। সন্ধ্যানাগাদই ফিরেছে। এখন বারান্দায় বসে আছে। একটু আগেই গোসল করেছে তাকে সতেজ দেখাচ্ছে। অডিউরের ঘ্রাণ চারপাশ ম ম করছে।
দিমিতাও এসে বসলো বারান্দায়। তুমি কি জরুরী কথা বলবে বলছিলে বলো। আগে তুমি বলো, আবির বললো।
নাহ তুমিই বলো। আমারটা অতো জরুরী কিছু নয় বলে দিমিতা অনাবিল হাসলো। তার কথাটা শুনেই কেমন চমকে যাবে আবির এই ভেবে।
দিমি
হু
আমাকে তুমি ভুল বোঝনা প্লীজ।
এভাবে বলছো কেনো?
দিমি, আমি আর তোমাকে ভালোবাসিনা। আমি আর একসাথে থাকতে চাইছিনা।
দিমিতা একগাল হাসলো। প্লীজ রসিকতা করোনা আবির। তোমার এই ট্রিক পুরোনো হয়ে গেছে। আগেও বলেছো এমন।
আবির দিমিতার চোখে সরাসরি চোখ রাখলো। সেই চোখে দৃঢ়তা, কোনও কপটতার আভাস নেই। দিমিতা কোনও কথা বলতে পারলোনা। তার গলায় একটা যন্ত্রণা ঢেলা পাকাতে শুরু করলো।
নিজেকে তবু শক্ত করে নিজের সব শক্তি ক্ষয় করে দিমিতা শুধু বলতে পারলো কি এমন হয়েছে আবির? তুমি এতোবড় একটা কথা বলছো।
দিমি, জরুরী না সম্পর্কে কিছু হলেই শুধু ছেড়ে যেতে হবে। ভালোবাসা না থাকাটা কি কিছু হওয়া না। কাল ছিলো আজ নেই। ভালোবাসাহীন একসাথে থাকাটা যন্ত্রণার ।আমি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাই।
দিমিতা কিছুই বললোনা।দুজনের কেউ নড়লোনা শুধু সন্ধ্যাটা তাদের মাঝখানে ভেঙে চুরচুর হয়ে গেলো।

স্যুটকেস গুলো আবিরই তুলে দিলো সিএনজিতে। দিমিতা শাশুড়ির পা ছুঁয়ে সালাম করলো। তিনি দিমিতাকে জড়িয়ে ধরলেন। এই কটা দিন দিমিতা শেষ চেষ্টাটা করেছে। কিন্তু আবিরের উদাসীনতা স্পষ্ট হয়েছে। নাহ, আবির কোনও দুর্ব্যবহার করেনি। শুধু নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। দিমিতা বারবার টের পেয়েছে এখানে আর কিছু নেই।
বের হয়ে যাবার সময় দিমিতা আবিরের হাতটা শেষবার ধরলো।নরম করে বললো নিজের যত্ন নিও, ভালো থেকো।

সিএনজি চলছে দিমিতাকে নিয়ে। একা অনন্ত পথের দিকে। এতো বাতাস তবু নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আবির এখনও জানেনা সে বাবা হতে চলেছে। ইচ্ছে করেই জানায়নি। যাকে ভালোবাসা দিয়ে বাধা গেলোনা তাকে সে দায়িত্ব দিয়ে বাঁধতে চায়না দিমিতা। ভালোবাসা উড়ুক মুক্ত আকাশে। খাঁচার ব্যথা নাহয় খাঁচারই থাক।

গাছ থেকে তুলে নেয়া ফুল যেমন সময়ের সাথে সাথে মুষড়ে যেতে থাকে দিলারা বানুর চোখের সামনে তার নাতনীকে মুষড়ে যেতে দেখছেন। ফারুক সাহেব আবিরের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন। দিমিতা বলেছে, ছোটচাচা যে ভালোবাসেনা তাকে ফিরে পেয়ে কি লাভ।
তুমি বললে আবির শুনবে।ফিরিয়ে নিতে চাইবে। কিন্তু আমাকে সে ভালোবাসবেনা আর।যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে আমি ফিরতে চাইনা।
ফারুক সাহেব কথা বাড়াননি। মেনে নিয়েছেন।

দিমিতা তার মায়ের লাগানো গাছগুলোর নীচে দঁড়ায়। গাছগুলো বাতাসে দোলে। সে ফিসফিস করে, আমার খুব যন্ত্রণা হয় মা।তুমি কোথায়?

দিলারা বানু টের পান নাতনীর সন্তানসম্ভাবনাকে। তার ভয় হতে থাকে।

ঘুমহীন রার্তগুলো দিমিতাকে বসিয়ে রাখে রাতের পর রাত। নিঃসঙ্গতা রাত হয়ে হামলে পরে তার উপর।
সেদিন মাঝরাতে তলপেটে বাঘের থাবার মতো খামচি দিয়ে ধরে ব্যথা। ছিড়ে খুড়ে ফেলতে চায় দিমতাকে। দিমিতার চিৎকারে যখন ফারুক সাহেব আর দিলারা বানু এলেন তখন দিমিতার পা গড়িয়ে রক্তের স্রোতে ভাসছে ঘরের মেঝে।
বহুবছর আগেও এই মেঝে ভেসেছে রক্তের স্রোতে। আজ আবার।
ফারুক সাহেবের কলিজা কেপে উঠলো। দিমিতাকে হারাতে চান না তিনি। কিছুতেই না।

দিমিতাকে দুদিন পর হাসপাতাল ডিসচার্জ দিলো। অতিরিক্ত স্ট্রেসই মিসক্যারেজের কারণ। দিমিতা যেনো পাথরের মূর্তি হয়ে গেলো।কোনও কথা বলছেনা। শুনে যাচ্ছে।স্কুল থেকে দুমাসের মেডিকেল লিভ দেয়া হলো।

একদিন আবির এলো দিমিতাকে দেখতে। আবির শুধু বলেই গেলো, দিমিতা একটা শব্দও করলোনা। হাতটা ধরলো, দিমিতা একটু চমকালো, আবিরের দিকে তাকালো। দিমিতার দু চোখে বৃষ্টি নামলো।

একটু একটু রাত যেমন সকালের দিকে এগোয় দিমিতাও এগোতে থাকলো স্বাভাবিকতার দিকে। শোক কেটে গেলে মানুষকে নিঃসঙ্গতা চেপে বসে। দিমিতারও শোক কেটে গিয়ে নিঃসঙ্গতা হাতছানি দিচ্ছে।
তখনই পরিচয় হলো নিয়াজের সাথে। এই এতোদিন আত্মীয়স্বজন বন্ধু যারাই দিমিতাকে স্বান্তনা দিতে এসেছেন সকলেই আবিরকে দোষী করেছেন। সকলেই বলেছেন সব দোষ আবিরের। শুধুমাত্র নিয়াজ সব শুনে বলেছিলো, তুমি তাকে ভালোবাসো সেটা তোমার সমস্যা। যে তোমাকে আর ভালোবাসেনা সে কেনো তোমার ভালোবাসার দায় নেবে! আর তুমি ভালোবাসো বলে সে অপরাধী কেনো হবে! সে তোমাকে ঠকায়নি, সত্য বলেছে। সে অপরাধী নয়। তুমি নিজেকে সামলাও। চেষ্টা করো যেটুকু ভালো তুমি তাকে বাসো তা যেনো তোমাকে আর আঘাত করতে না পারে।
সত্যিই ত! আবির তাকে ঠকায়নি। কথা দিয়েও আঘাত করেনি। শুধু তার ভালোবাসাটা ফুরিয়ে গেছিলো। ফুরিয় যাওয়াটাই অকপটে জানিয়েছিলো সে।

নিয়াজের সাথে দিমিতার পরিচয় হয়েছিলো ফেসবুকে। প্রথমে টুকটাক আলাপ তারপর ফোন নাম্বার আদান প্রদান।
সেই চরম দুর্ভোগের সময়ে নিয়াজ জল হয়ে সতেজ করে তুলছিলো দিমিতাকে। ধ্বংসাবশেষের ফাটলে উকি দেয়া সবুজ তৃণের মতো উকি দিচ্ছিলো কেবল দিমিতা। তখন নিয়াজ তাকে তার শহরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। দিমিতার তখন মানসিক অবস্থা এতো নাজুক ছিলো যে দিমিতা পরিত্রাণ খুঁজছিলো। চারপাশ থেকে, পরিচিত মানুষ থেকে।
এক সকালে দিমিতা চেপে বসেছিলো ট্রেনে। চলে গেছিলো নিয়াজের কাছে।

দিলারা বানুর চোখ এড়ায় না ইয়াসমীন আর ফারুকের হঠাৎ দূরত্ব কমে যাওয়া। একটা আশঙ্কাকে তিনি উড়িয়ে দিতে চান তার ভ্রম বলে।
দিমিতার তিন বছর পূরণ হলো। বেশ ছুটাছুটি শিখে গেছে। কথাও বলছে ভাঙা ভাঙা বাক্যে। শিশুদের এই সময়টা সবচেয়ে সুন্দর।

সেদিন মারুফের চিঠিটা ইয়াসমীনকে ভেঙে ফেলেছিলো মাটির বাসনের মতো। সেদিন আরও একটা সত্য জেনেছিলো ইয়াসমীন। জেনেছিলো, ফারুক তাকে কোনোদিন অপছন্দ করেনি। ভালোবেসেছিলো। ভালোবেসেছিলো বলেই পালিয়ে বেরিয়েছিলো। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের দুঃখ ইয়াসমীনের ধুয়ে মুছে গেছিলো এটা জেনে ফারুক তাকে ভালোবেসেছে সেই প্রথমদিন থেকে।
পরমুহূর্তেই পাপবোধ জেগে উঠেছে। কিন্তু ভালোবাসা কি অবরোধ মানে? রাধা পারেননি কৃষ্ণকে উপেক্ষা করতে। ইয়াসমীন কি করে পারবে?

ইয়াসমীনও পারেনি। ভেসে গেছে ফারুকের শানু হয়ে। তাদের দিনগুলো পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে কেটে যাচ্ছিলো।
শুধু ফারুকের বুকে একটা ছোট্ট পাথর বেজে ওঠলো যখন দিলারা বানু চাইলেন ছেলেকে বিয়ে দিতে। কিন্তু সে তো কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না। দিনগুলো যখন এমন যুদ্ধ যুদ্ধ সাজে তখনই দামামার মতো বাজলো দুঃসংবাদ।
চৈত্রের দুপুর। চারদিক খা খা করা রোদ। ঘরের কোণে ডাহুক ডেকে যাচ্ছে অলুক্ষণে স্বরে। দিলারা বানু টের পেলেন ইয়াসমীন সন্তানসম্ভবা । তার মাথায় ভেঙে পড়া আকাশও চৌচির হয়ে গেলো। খসখসে স্বরে জিজ্ঞেস করলেন ক’মাস?
ইয়াসমিন শান্ত স্বরে বললো তিনমাস। তার স্বর একটুও কেঁপে গেলো না।
দিলারা বানুর রোষ আছড়ে পড়লো ফারুকের উপর। ফারুক মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। লোক জানাজানির ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন দিলারা বানু।

সেই দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে তিনি বের হয়ে গেলেন। কড়া রোদ, রাস্তাঘাট খা খা করছে মানুষহীন। উত্তরের তিলাইজুড়া গ্রামের পর সুন্দরদহ। সুন্দরদহের খোয়াইপাড়ে আস্তানা গাড়ে বেদেরা। এখন তারাই পারে দিলারা বানুকে এ বিপদ থেকে বাঁচাতে।

দুটো মেয়ে উকুন বাচছে। উদোম গায়ে ছেলেমেয়েগুলো ধুলো মেখে ছুটছে এদিক ওদিক। নৌকায় কয়েকটা লোক বসে হুক্কা টানছে। ইয়াসমীনের বয়সী একটা মেয়ে এগিয়ে এলো বাচ্চা কাখে নিয়ে। কি চাস গো মা?
তোমাদের বৈদ্য কোথায় গো। আমার তার সাথে দরকার। মেয়েটা তাকে একটা খুপড়ি মতো ঘরে নিয়ে গেলো।
দিলারা বানু আকুল হয়ে কাঁদছেন। বৈদ্য বলছে দেখ মা আমি প্রাণ বাচাই, লই না। এই কাম আমি পারবো না।
দিলারা বানু হাতজোড় করলেন। আমার মেয়েটাকে বাঁচাও বাবা। তার কপালে কলংক লাগুক আমি চাই না।
তার কাকুতি মিনতিতে বৈদ্য একটা জড়িবুটির পুটলি দিলো। বললো, আল্লা করুক তোর মাইয়াটা সেরে উঠুক।
দিলারা বানু দুটো পয়সা দিতে চাইলেন। বৈদ্য নিলো না।

ইয়াসমীনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখ মেলে তাকাতেও যেনো তার কষ্ট হচ্ছে। দিলারা বানু মাথার পাশে বসে কাঁদছেন। দিমিতা এ ঘরে এসে বারবার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলছে মা ওঠো। মা ওঠো। ফারুক বিমুঢ় বসে আছে বারান্দায়। শানুকে সে মেরে ফেলছে। তার চোখের সামনে শানু মরে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে।
আজ বাদ জোহর ইয়াসমীনের জানাজা। ইয়াসমীনের মা শিরি বেগম ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। দিলারা বানু পাথরের মতো বসে আছেন।
খাটিয়ায় কাধ দিয়েছেন করিম শেখ, ফারুক।
“এতোটুকু তারে ঘরে এনেছিনুু ” সেই শাহানারা ইয়াসমীন এ বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে বাবার কাঁধে চড়ে। শানু এ পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে ফারুকের কাধে ভর দিয়ে। চলে যাচ্ছে সব হিসাব নিকাশের উর্ধ্বে। নিশ্চিত গন্তব্যের দিকে।

দিমিতা সেবার তিনদিন নিয়াজের ফ্ল্যাটে ছিলো। একা ফ্ল্যাটে দিমিতার বুক ঢিবঢিব করছিলো। মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে এভাবে বেমক্কা চলে আসায় নিজেকেই বোকা মনে হচ্ছিলো। কিন্তু সময় যতো গড়ালো দিমিতা বুঝতে পারছিলো মানুষটা সেরকম যার উপর ভরসা করা যায়।
দিমিতা যখন তার ফিরে যাওয়া সন্তানের কথা বলছিলো নিয়াজ তার মাথায় হাত রেখেছিলো। নিয়াজের সেই স্পর্শে নির্ভরতা ছিলো। ভরসা ছিলো।সেই স্পর্শ বলছিলো ভয় নেই, এখানে তুমি নিরাপদ।

নিয়াজ ভীষণ গানপাগল মানুষ। ভালো সেতার বাজায়। সঙ্গীত তার কাছে প্রার্থনা,মুক্ত হবার সাধনা। যা শরীর থেকে ক্লান্তি সরিয়ে মনকে নির্ভার করে। সে নিজেও সেতার বাজায়। সেইদিন রাতে রাতে নিয়াজ যখন সেতারে রাগ মল্লার বাজাচ্ছিল দিমিতা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো। চোখ বন্ধ নিয়াজের হাত তন্ত্রীতে,মেজরাফের উঠানামায় ঘর ঠিকড়ে পড়ছে মুর্ছনা। মানুষ এতোটাও বিভোর হতে পারে! মনে হচ্ছিলো সে কোনও জাগতিক মানুষ নয়, সে একটা আলো। সে একটা মুর্ছনা। যে মুর্ছনায় মানুষের হৃদয় প্রশমিত হয়।
নিয়াজ সত্যিই অন্য জাগতিক।

পঞ্চাশের কাছাকাছি নিয়াজ বিয়ে করেনি। একাই থাকে। মা ছিলেন মারা গেছে বছর চারেক।
দিমিতার খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো কেনো বিয়ে করেনি সে।কেউ কি ছিলো তার জীবনে যার জন্য অপেক্ষা করে কাটিয়ে দিলো নিয়াজ। পর মুহুর্তেই মনে হলো কি হবে জেনে? যতো জানা ততোই তো দুঃখ বাড়ানো।

ফিরে আসার দিন ট্রেনটা তখন প্লাটফর্মে। উৎসুক যাত্রীর ভিড়, হকারের এলোপাথারি ছুটোছুটি, দু একটা ভিক্ষুকের হাত পাতার অবসরে দিমিতা নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো , আমি কি তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি ?
শিশুর মতো হেসে দুহাত বাড়িয়ে নিয়াজ বলেছিলো পুরো হাতটাই ধরতে পারো।
হাতটা ছুতেই দিমিতার মনে হলো একটা নদী কলকল বইতে শুরু করলো। এ অনুভূতি তো তার চেনা। রমালীতে সেই সকালে ঠিক এমনটাই হয়েছিলো। সেদিন
একটা নদী বয়ে গিয়েছিলো। আজ আবার বইছে। কিন্তু সে তো এমন নদী আর চায়নি!
অসুখ সারাতে এসে আবার নতুন এক অসুখ বাধিয়ে যাচ্ছে। যার কোনও নিরাময় নেই।

সেই ফেরার তিনমাসের মাথায় নিয়াজের কাছে আবার ছুটে আসতে হয়েছিলো দিমিতাকে। বাড়ি ফিরে নিজেকে দিমিতা শক্ত করে বাধতে চেয়েছিলো।কিছুতেই ভালোবাসা যাবেনা নিয়াজকে এমন েচেষ্টাই করেছে। লাভ হয়নি। খেয়াল করেছিলো নিয়াজের সাথে কথা হলেই সে ভালো থাকছে। কথা না হলে তার চারপাশ বালির ঘরের মতো হরহর ধ্বসে যাচ্ছে।
যখন কেউ ভালোবাসেনা আর সেটা জানা যায় তখন তাকে ভালোবাসা থেকে নিজেকে বিরত করা সহজ। কিন্তু কেউ ভালোবাসে কিনা এই সংশয়ে তাকে ভালোবাসা থেকে বিরত থাকা কঠিন। কেউ অবহেলা করলে দূরে যাওয়া যায় কিন্তু প্রশ্রয় দিলে দূরে যাওয়া যায় না। দিমিতাও পারলোনা।

এবার যখন দিমিতা নিয়াজের কাছে গেলো ঘরে ঢুকেই নিয়াজকে জড়িয়ে ধরেছিলো, তার হাসিটা নিজের ঠোঁটের মধ্যে গলিয়ে নিয়েছিলো। নিয়াজ বাধা দেয়নি। শুধু উত্তাল ঢেউ হয়ে বয়ে গিয়েছিলো দুজনে।
দিমিতা যা মুখে বলতে পারেনি দিমিতার শরীর তা বলে ফেলেছিলো। নিয়াজ কি বুঝেছিলো?
এরপর এই পাঁচবছরে যখনই দিমিতা পিষ্ট হয়েছে, অস্থির হয়েছে তখনই আশ্রয় হয়েছে নিয়াজ। বুক দিয়ে আগলে নিয়েছে তাকে।
অথচ বলেনি ভালোবাসি। বলেনি তোমাকে চাই। অব্যক্ত এক টান তাদের ধরে রেখেছে একটা সুতোর দুপাশে।
কখনও কখনও দিমিতার বলতে ইচ্ছে করেছে, জানাতে ইচ্ছে করেছে ভালোবাসার কথা। বলতে পারেনি।
মনে হয়েছে যদি নিয়াজ ফিরিয়ে দেয়! তখন কি হবে। নিয়াজকে হারাতে চায়না সে। তারচেয়ে চলুক না যেমন চলছে।

আজ নিয়াজের ফলোয়াপের তারিখ। সকালেই যাবার কথা ডাক্তারের কাছে। দুপুরে ফোন দিলো দিমিতা।
ফোন ধরেই নিয়াজ প্রশ্ন করলো তুমি আসছো কবে?
দিমিতা ফোন করলেই নিয়াজ এই প্রশ্নটা প্রথমে করে। দিমিতা উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, ডাক্তার কি বললো?
সেই পুরোনো কাসুন্দি। শুধু কোলেস্টেরল এর ওষুধটা বন্ধ করে দিয়েছে বলেছে আপাতত আমি ঠিকঠাক আছি।
নিজের ঠিকঠাক খেয়াল রেখো। আমার ক্লাস আছে এখন রাখছি বলে নিয়াজের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন রেখে দিলো দিমিতা।

তুমি আসছো কবে? এই প্রশ্নটা দিমিতাকে প্রাণ দেয়। মনে হয় কেউ একজন আছে যে তার আসার অপেক্ষা করে। এইটুকু স্বান্তনাই নিদারুণ এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা স্বচ্ছল করে। ভালো রাখে, বাঁচিয়ে রাখে।


দিলারা বানুর শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। কালই একবার ডাক্তার দেখে গেছে। আগে তাও একটু নিজে নিজে হাঁটতেন এখন সেটাও বন্ধ।
দিমিতা তার ঘরে খাতা কাটছিলো এমন সময় ফারুক সাহেব এলেন তার ঘরে। মেয়েটা হুবহু তার মায়ের মতো হয়েছে। এ যেনো শানুই বসে আছে।
কাল তুই ঢাকায় যাচ্ছিস? প্রশ্ন করলেন ফারুক সাহেব।
হ্যাঁ ছোটচাচা। আমার একটা কাজ আছে। না গেলে হবেনা।
ফারুক সাহেব খাটের পাশে বসলেন, খুব সরল গলায় বললেন দিমি তুই কি বাকিটা জীবন একাই থাকবি।
দিমিতা খাতা থেকে মুখ তুললো, আমি তো একা থাকতে চাইনি ছোটচাচা। এই ব্রহ্মান্ডই আমার ভাগ্যে একাকিত্ব লিখে রেখেছে।যাকে চেয়েছি সেই নক্ষত্র হয়ে গেছে। নক্ষত্র শুধু দেখা যায়। ছোঁয়া যায়না। মনে মনে বললো দিমিতা। মুখে বললো, একা কোথায় ছোটচাচা! তুমি আছো, দাদি আছে।
একা থাকা বড় যন্ত্রণার রে দিমি। কথা বলারও তো একজন মানুষ চাই। আমি, মা আমরা কেউই তো থাকবোনা। তখন? দিমিতা উত্তর করলোনা। শুধু জানালা পেরিয়ে তার চোখ চলে গেলো বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকারে।
সেই অন্ধকারের মতোনই যেনো দিমিতার সমস্ত জীবনটা অন্ধকার।
দিমিতারও ইদানীং বারবার মনে হয় তার কাউকে একটা চাই। অতিথির মতোন না পরিবারের মতোন। কিন্তু কাকে? নিয়াজকে?

পরদিন সকালের ট্রেনে দিমিতা চলে গেলো ঢাকায়।
এবার নিয়াজের সাথে তার সরাসরি কথা হওয়া দরকার। এবার লুকোচুরি শেষ হওয়া দরকার।

নিয়াজ তার ঘরে বসে ল্যাপটপে কি যেনো কাজ করছিলো। দিমিতা কফি বানিয়ে পাশে এসে বসলো। এ বাসায় এলে তার সংসার সংসার অনুভূতি হয়। আবিরের সাথে তার যে সংসার ছিলো সেই সংসারটা আবিরের মা ‘ ই আগলে ছিলেন। সেখানে দিমিতার সাংসারিক দায়িত্ব তো ছিলো কিন্তু সংসারটা তার শাশুড়িরই ছিলো। পছন্দ অপছন্দ সব তারই ছিলো। কিন্তু নিয়াজের এই ফ্ল্যাটটায় দিমিতারই কর্তৃত্ব। গত পাঁচ বছরে এই ফ্লাটের জন্য কেনা অনেককিছুই দিমিতার পছন্দে । নিয়াজ ঘরের জন্য যখনই যা কিনেছে দিমিতা এলে তাকে সংগে নিয়ে কিনেছে।
ঘরটা ভালো করে দেখে নিলো দিমিতা যেনো প্রথম দেখছে। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো। আজকে যেভাবেই হোক নিয়াজের সাথে কথা বলতে হবে।
নিয়াজ কফিতে চুমুক দিলো, দিমিতার হাতে টোকা দিয়ে বললো কিছু ভাবছো?
তুমি কি সারাজীবন একাই থাকবে, বললো দিমিতা। এমন আচমকা প্রশ্নে নিয়াজ থমকালো। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো। আমার আর জীবন কোথায়, আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি!
দিমিতা সরাসরি তাকিয়ে বললো, নিয়াজ তোমার আর জীবন কোথায় আমি জানিনা, জানতেও চাইনা তুমি কতোটা বুড়ো হয়ে গেছো। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই নিয়াজ। আমরা কি বিয়ে করতে পারিনা।
নিয়াজ কফির মগটা নামিয়ে রাখলো পাশের টেবিলে। দিমিতার দুটো হাত ধরলো। দিমিতা আমি তোমাকে পছন্দ করি। শুধু যে পছন্দ করি তা না ভালোওবাসি। কিন্তু দিমিতা ,আমি সম্পর্ক ভয় পাই। আমার ভয় হয় কমিটমেন্টে। জীবনের এতোগুলো বছর কাটিয়ে আমি এই ভয় থেকে বের হতে পারেনি। যখন তোমার সাথে পরিচয়ের পর আমি অসংখ্যবার এ নিয়ে ভেবেছি। কিন্তু পরিণতির কথা ভেবে উঠতে পারিনি। আমার ভয় কিন্তু কিসের ভয় আমি জানিনা। তুমি কি আমাকে ভুল বুঝছো দিমিতা?
দিমিতা হাতটা আরেকটু জোরে চেপে ধরলো নিয়াজের, স্বাভাবিক গলায় বললো, না, আমি জানি চাইলেই সব পাওয়া যায়না হয়তো তুমিও আমার না পাওয়ার তালিকায় যুক্ত হলে।
কথা শেষ করবার আগেই ফোন বেজে উঠলো দিমিতার। ওপাশ থেকে ফারুক সাহেবের কাঁপা গলা। দিমিতাকে এখনই ফিরতে হবে।দিলারা বানু ! দিলারা বানু!
নিয়াজ দিমিতাকে নিয়ে রওনা হলো। দিমিতা কাঁদছেনা। শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ি ছুটছে তীব্র গতিতে


সারাদিন ধরে বাড়িতে প্রচুর লোক। আজ কুলখানি দিলারা বানুর। আত্মীয়স্বজন, গ্রামের লোক গিজগিজ। সবার হাসিমুখ, যেনো একটা উৎসবের উপলক্ষ্য।
নিয়াজ সমস্ত তদারকি করছে। গত তিনদিন ধরে ফারুক সাহেব, দিমিতাকে সামলানোর সাথে সাথে সমস্ত কিছু সেই সামলেছে।
আজ আবিরও এসেছিলো।দিলারা বানুর মৃত্যুর দিনও এসেছিলো। সেদিন কথা হয়নি আজ যাবার আগে দিমিতার সাথেও দেখা করে গেছে। আবিরের আচরণে কোনও আড়ষ্টতা নেই, সহজ সাবলীল। যেনো কিছু হয়নি।যেনো দিমিতা কোনোদিন আবিরের স্ত্রী ছিলোনা। যেনো তারা বন্ধু। বহুদিন দেখা না হওয়া বন্ধু। কিন্তু দিমিতা সহজ হতে পারেনি। আড়ষ্টতা ঠিকড়ে বেরিয়ে আসছিলো। বেলা যতো গড়াচ্ছে বাড়িটা ফাকা হতে শুরু করেছে। বিকেল হতে হতে বাড়িটা পুরো খালি হয়ে গেলো। উঠোনে এককোণে এটোকাটায় জড়ো হওয়া কয়েকটা কুকুর ছাড়াও খা খা বড়িটাকে ঘিরে পাক খেতে লাগলো কয়েকটা চিল।
সন্ধ্যায় নিয়াজও ফিরে গেলো। যাবার আগে দিমিতা নিয়াজের কাছে গেলো, এখুনি বেরুচ্ছো?
নিয়াজ, বললো হ্যাঁ। এখনই বেরুচ্ছি দিমি। তুমি ছোটচাচার দিকে খেয়াল করো। যেভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি!
দিমিতা চমকালো, এই প্রথম নিয়াজ দিমিতাকে দিমি বলে ডাকলো। কেনো? ফিরিয়ে দিয়ে এতো কাছে টেনে নেয়া কেনো?
নিয়াজ চলে গেলো।রহস্যের অমীমাংসিত অধ্যায় অথবা উত্তর খুঁজে না পাওয়া ধাধায় দিমিতাকে রেখে।কারও জন্য থেমে না থাকা পৃথিবীতে তখন সন্ধ্যা নামছিলো আকাশজুড়ে। একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল দিমিতার ঘর।

মিশুকের মায়ের ডাকাডাকিতেও ফারুক সাহেব খেতে এলেন না। দিমিতাই খাবার নিয়ে গেলো ফারুক সাহেবের ঘরে । দিমিতা প্লেটটা রখলো টুলে। আলতো সুরে ডাকলো ছোটচাচা খেয়ে নাও। ফারুক সাহেব চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন।
দিমিতা সেদিকে তাকিয়ে রইলো। ছোটচাচাকে শিশুর মতো লাগছে। দিমিতা তার পিঠে হাত রাখলো।
ফারুক সাহেব চোখ খুললেন। দিমিতার মাথায় হাত রাখলেন।
দিমিতা মুখ তুললো, তুমি মাকে খুব ভালোবাসতে চাচা? ফারুক সাহেব ঝটকা লাগার মতো হাত সরিয়ে নিলেন। বিস্ফোরিত চোখে দিমিতার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
দিমিতা স্পষ্ট স্বরে বললো, তুমি কেনো মাকে বিয়ে করলেনা ছোটচাচা? কেনো করলেনা?
ফারুক সাহেব ফ্যালফ্যাল চোখে দিমিতার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেনো সমস্ত কথা থেমে গেলো।তক্ষকের ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে। দুটো প্রজন্ম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। একইরকম নিয়তি নিয়ে থেমে আছে। শুধু সময় বইছে কলকল…….

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত