– হেডস্যার বেটেখাটো মানুষ বলেই যে বেশ রসিক এমনটা না আবুবর সাহেব। খুব চালাক, একটা গল্পবাজ লোক তিনি। লোকটা আগে থেকেই এমন। সবাই এমন পারে না রে ভাই! ইট’স আ ন্যাচারাল গুণ।
আবুবর সাহেব কিছু বললেন না। শুধু ফিরে তাকালেন তাহের স্যারের দিকে।
– বিশ্বাস হচ্ছে না? জোকার একটা পাক্কা হারামজাদা মানুষ, সবাইকে কেমন কৌশলে বান্ধি ফেলাইছেন, তা-ও বোঝেন না?
– বুঝলে কি আর বোকা থাকি স্যার?
– বুঝবেন বুঝবেন। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন তারেক স্যার, দুদিন পরে যখন গোটা স্কুলটাই ভুঁড়ির ভেতরে গিলে ফেলবে, তখন বুঝবেন।
কথা বলতে বলতে তাঁরা স্কুলের দিকে আসছিলেন। তারেক স্যার আবুবর সাহেবের থেকে বছর আটেক বড়। অতি উৎসাহী, চুলে পাক ধরা লম্বা শ্যামলা মানুষটা বেপরোয়া ভাব নিয়ে থাকেন খানিকটা। হঠাৎ গরম হন না। কিন্তু গরম হলে বকবক করতে থাকেন নিজের মতামত জাহির করার জন্য। অন্যরা তাঁর কথা শুনুক না শুনুক, তাঁকে মানুক না মানুক, তবু তিনি কথা কইতে কইতে কান ঝালাপালা করে ছাড়েন।
প্রধান শিক্ষকের পরে তারেক স্যারই হলেন একমাত্র বয়স্ক স্যার। তিনি হেডস্যারের সাথে আটাশ বছর শিক্ষকতায় আছেন। সেই ঢুকেছেন পঁচিশ বছর বয়সে। আর কত! ইদানীং বেশি কথা বলার কারণে সবাই তাঁকে এড়িয়ে যান। বিষয়টা তিনি যে বোঝেন না তেমনও না। তার পরও তিনি স্কুলের নাড়ি-নক্ষত্র উত্থান-পতন শোনান জনে জনে।
তবে মানুষটা প্রাণখোলা। যখন মনে ফুর্তি থাকে, তখন খুব জোরে হা হা হা করে গগনফাটা হাসি দিয়ে গল্পে মজে থাকেন। সবাই মুখ ঘুরিয়ে স্যারের হাসির সাথে তাল মিলিয়ে হাসে তখন। এর পরেই খালি মাঠের ওপরে বাঁশের ছোট চেলাঘর কিভাবে মাহিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়টা তৈরি হলো, কত পরিশ্রম করতে হয়েছে দিনরাত তার ফিরিস্তি তোলেন। হেডস্যার লুটপাট করে গোটা স্কুলটা গিলে খাচ্ছেন। একা। এ কারণে নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন তারেক স্যার। নিজের হাতে গড়া এই স্কুলটার এমন অধঃপতন তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তাই তিনি সবাইকে একই গল্প শোনান, প্রতিবাদ করেন, বলেন বিস্তারিত করে কী থেকে কী হচ্ছে স্কুলটার।
তিনি আবুবর সাহেবকে পেয়ে যখন সেসব বলা শুরু করলেন, তখন অফিসের মুখের সামনেই দাঁড়িয়ে প্রধান শিক্ষক। তাই আবুবর সাহেব বিষয়বস্তু ঘোরানোর চেষ্টা করলেন। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আপনি যা-ই বলেন স্যার, উনার ভুঁড়িটা কিন্তু দারুণ।
– একটা মারাত্মক কথা কইলেন আবুবর সাহেব। তারেক স্যার হা হা করে হেসে উঠলেন। বেশ মজাই পেলেন যেন। বললেন, কেমন বাঁকা হয়া হাঁটে, দেখেছেন না? পেছন দিকে বাঁকা হয়, হা হা হা, এমন ভাবে হাটে, যেন প্যাট হইছে।
‘প্যাট হওয়া’ মানে গর্ভবতী হওয়া, আবুবর সাহেব হেসে ফেললেন।
তারেক স্যার হাসি থামিয়ে বললেন, আমার মনে হয়, এর মধ্যেও কোনো চালাকি আছে আবুবর স্যার! থাকতেও পারে কিন্তু! শুধু কি ভুঁড়ির কারণে বাঁকা হয়া হাঁটেন? তাঁর সব জায়গায় যেমন পলিটিকস! দেখবেন ওখানেও স্কুল পলিটিকস আছে।
এবার না হেসে পারলেন না আবুবর সাহেব। সাংঘাতিক তো। ভুঁড়ির মধ্যে স্কুল পলিটিকস?
– তিনি তো আপনার প্রাণের মানুষ স্যার, আপনার চোখে কি আর উনার দোষ ধরা পড়বে?
– যেটা ভাবছেন, সে রকম না আমি তারেক স্যার।
তারেক স্যার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দেখতে পেলেন, হেডস্যার স্কুলের অফিস বারান্দায় তাঁর মস্ত ভুঁড়ি চাড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকিয়ে আছেন তাঁদের দিকে। তারেক স্যার ইশারা করলেন, দেখেন কেমন পোয়াতি মাইয়া ঘনঘন প্যান্ট টানছে !
আবুবর সাহেব দেখলেন হেডস্যার মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক হাঁটছেন আর টেনে তুলছেন পরনের প্যান্ট। প্যান্টটা খুলে যাওয়ার কথা নয়, কিন্তু হঠাৎ খুলে গেলে বেইজ্জতি অবস্থা হবে, চওড়া মুখঅলা ঢোলমতো প্যান্ট যাতে খুলে না যায় সেজন্য ঘাড়ের সাথে বেল্ট লাগিয়েছেন, কটকটে লাল ফিতার বেল্ট পিঠের দিকে ক্রস করা। তার পরও তিনি মাঝেমধ্যে প্যান্ট টানছেন। এই প্যান্ট টানাটা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
তারেক স্যারের কথায় সত্যিই পোয়াতি মাইয়া মনে হচ্ছে আবুবর সাহেবের। মনে হচ্ছে সাত মাসের গর্ভবতী। তবে ততটা বেমানান দেখাচ্ছে না। যদিও বেটেখাটো মানুষের মস্ত ভুঁড়ি বেমানান হয়, গোপাল ভাঁড় গোপাল ভাঁড় লাগে, তবু হেডস্যারের ভুঁড়িটা বেশ মানানসই। সেই ভুঁড়িকে ঢেকে রেখেছেন ইন করা সাদা চেকের শার্ট দিয়ে। তিনি ভুঁড়িতে আদর করে হাত বোলাচ্ছেন আর সুতায় বাঁধা চশমা নাকের ডগায় বসিয়ে গোটা স্কুলটা দেখছেন। সেটা দেখে তারেক স্যার আবার ফিসফিস করে বললেন, কিভাবে পাকড়ে ধরে প্যান্ট টানছে দেখেন! স্কুলের ইজ্জত মেরে গাঙ করে দিলেও ইজ্জত যায় না, মাগার ইজ্জত যাবে প্যান্ট খুলে গেলে।
আবুবর সাহেব মুখ চিপে হাসি থামিয়েছেন। খুব কষ্ট হচ্ছে হাসি থামাতে।
হেডস্যার বারান্দা থেকে নাক উঁচু করে তাকিয়ে উচ্চ স্বরে বললেন,
– আরেব বাব, ‘মাকড়সা গবেষক’ আর ‘ওয়াজ মাস্টার’ মিলে কী করেন?
– তেমন কিছু না। দূর থেকেই তারেক স্যার উত্তর দিলেন। কনুই দিয়ে আবুবর সাহেবকে গুঁতো মেরে মৃদু স্বরে বললেন, দেখছেন কী বলল আপনাকে, ‘মাকড়সা গবেষক’! হা হা হা।
– আর আপনি ‘ওয়াজ মাস্টার’।
– আমারটা পুরানা কথা। আপনারটা নতুন।
ঠিকই বলেছেন তারেক স্যার, তাঁর নামটা পুরানা হয়েছে। বরং আবুবর সাহেবের নামটা নতুন দেয়া হয়েছে ‘মাকড়সা গবেষক’। নামটা শুনে মন খারাপ করলেন না আবুবর সাহেব। স্যারের এমনই অভ্যাস। তাছাড়া স্যারের একটা পাওয়ার আছে ওপরমহলে। শিক্ষামন্ত্রী নাকি শ্বশুরপক্ষের কাছের মানুষ। তাই স্যারের এমন অভ্যাসটা বিনোদনে পরিনত হয়েছে। শুধু একজন ছাড়া সবাই মেনে নেয় এমন বিনোদন। হেডস্যার যে শুধু তাঁকেই এমন নামে বলেন তা নয়, ওয়াজ করে বেড়ান বলে তারেক স্যারের নাম রেখেছেন ‘ওয়াজ মাস্টার’। বিয়ের ঘটকালি করেন বলে কাজি স্যারের নাম রেখেছেন ‘কবুল মাস্টার’। এমনকি পাতলা গোছের ফারিহা ম্যাডামকে বলেছিলেন ‘শুঁটকি ম্যাডাম’। ‘শুঁটকি ম্যাডাম’ বলায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন ফারিহা ম্যাডাম। ম্যাডাম হইচই করে প্রতিবাদ করেছিলেন। স্যার ব্যাপারটা অনেক কষ্টে সামলে নেন। তখন থেকে এভাবে বিকৃত নামে ডাকা বন্ধ থাকে কিছুদিন। এখন আবার ডাকা শুরু করেছেন।
কথায় বলে না, কুকুরের ল্যাজ সোজা হয় না, হেডস্যারেরও ল্যাজ সোজা হবে না, যতই ঘি ঢালেন। তারেক স্যার বলেন। সাথে আরো কিছু যুক্ত করে দেন। বলেন, এই যে বিকৃত নামে ডাকা, এটাও পলিটিকস। এর প্রতিবাদ পলিটিকস দিয়েই করতে হবে। সেই পলিটিকসের প্রতিবাদ হিসেবে তারেক স্যার হেডস্যারের নাম দিয়েছেন ‘নরখাদক মাকড়সা’।
শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ
৮. আবুবর- কোনোকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই
৭. মাকড়সার জালে অনাথের হাসি
৬. অবৈধনামা