জীয়নকাঠি/কাজী লাবণ্য
ট্রলিবক্সটা টানতে টানতে একে একে নম্বর গুলো পার হতে থাকে নীলু। অপ্রশস্ত করিডোর, যাত্রীরা এদিক কাঁত, ওদিক চিত হয়ে আসা যাওয়া করছে। মাঝামাঝি অবস্থানে এসে সে দাঁডিয়ে পড়ল। নিশ্চিত হতে হাতের টিকিটের সাথে মিলিয়ে নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে হাঁফ ছাড়ল। যাক নিশ্চিত। আসার সময় বড্ড তাড়াহুড়ো হয়েছে। ট্রেন পাওয়া নিয়ে মনে সংশয় ছিল। ভাগ্যিস পথে অতটা জ্যাম ছিল না। এখন বই পড়ে, গান শুনে, লম্বা একটা ঘুম। ঘুম থেকে জাগলেই বাড়ি। প্রিয় বাড়ি। জানালার পর্দা টানা ছিল সরিয়ে দিল। পুরু গ্লাসের বাইরে ষ্টেশনের আলো আধারি। জলেরবোতল, বুকমার্ক দেয়া বই, মোবাইল ফোন, বের করে টেবিলে রাখল। বক্স খুলে উপরে রাখা চাদর দুটো বের করে একটা বিছিয়ে নিল আর একটা রাখল গায়ে দেবে বলে। এদের দেয়া চাদর, গায়ে দিতে ইচ্ছে করে না। বালিশের উপর একটা তোয়ালে বা ওড়না বিছিয়ে নেয়। দরজায় নক। খুললে,
-ম্যাডাম, কিছু লাগবে? চা কিংবা অন্যকিছু?
-না, কিছু লাগবে না। লাগলে ডাক দিয়েন ম্যাডাম। এমন সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠল। দীপু। ট্রেনে উঠেছে কিনা সব ঠিকঠাক কিনা শুনে নিল।
দরজা লক করে, এদের সাউন্ডবক্সের সুইচ, মাঝের লাইট অফ করে, মাথার কাছের রিডিং লাইটটা অন করে যেই না ঘুরেছে, ট্রেন দুলে উঠল। দুলে ওঠা মাত্রই নীলুর পায়ের নিচে ভূমিকম্প, মাথায় বজ্রপাত।
রাতের এই ট্রেনে নীলু প্রায় চিটাগাং থেকে ঢাকায় আসে। ৫/৬ দিন পর আবার ওই একই ট্রেনে চিটাগাং ফিরে যায়। মেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই এই যাওয়া আসা। মেয়ের জন্য মাসে একবার করে আসতেই হয়। গত এক বছর ধরে এরকমটাই হয়ে আসছে। অবশ্য মাঝে দু’একবার ওর বাবা এসেছিল। প্রচুর রান্নাকরা খাবার, ওর লন্ড্রিকরা কাপড়চোপড়, দরকারী টুকিটাকি জিনিস, মাসের টাকা ইত্যাদি দিয়ে ওর কাছে ক’টাদিন কাটিয়ে ফিরে যায় সে। প্রথমদিকে প্রতিমাসে আসা লাগত, আজকাল মেয়ে বলে,
-মা, আমি এখন সব পারি। তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। তুমি কেবল মাঝেমাঝে আসবে। কিন্তু একমাস পার হলেই ফোনে আহ্লাদ, আবদার শুরু হয়ে যায়। তবে এখন দু/তিন মাসে একবার করে আসে। মেয়ের কাছে যাবার আগে বাসার সব গুছিয়ে, বাপ ছেলের খাবার দাবার রেখে, জরি খালাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে যেতে হয়। ছেলেও তেমন আপত্তি করে না। বরং বলে,
-মাম্মা, তুমি গেলে আপুনির ভালো লাগে। তুমি যাও। দাদুন, জরি নানি তো আছেই তাছাড়া বাবা আছে। আবার বড় মানুষের মত গম্ভীর মুখ করে বলে,
-তুমি কোনো চিন্তা কর না। আমি সব সামলে নিতে পারি। আসলকথা, মা না থাকলে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়া যায়। দুধ না খেলেও হয়। ভাত বা সবজি খাবার প্রশ্নই আসে না, যত খুশি ফাস্ট ফুড, যতখুশি কার্টুন, যতক্ষণ খুশি গেইম…
নীলু যে কদিন থাকে না দীপু ছেলের দেখাশোনা, স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা ঠিকঠাক মতো করে। কিন্তু নীলু উপস্থিত থাকলেই সে দিনদুনিয়া সব ভুলে যায়। আসার দিন বাবা ছেলে দুজনেই এসে ট্রেনে তুলে দেয়। দীপু কেবিনে উঠে ব্যাগ, লাগেজ সব গুছিয়ে জিনিসপত্র ঠিকঠাক করে, নীলুর বিছানা বিছিয়ে দিয়ে তারপর নেমে যায়। আসার দিন ছোটবড় অনেক লাগেজ থাকে, মেয়ের জন্য। ট্রেন না ছাড়া পর্যন্ত ওরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলে। নীলু বলে
-রাত অনেক হয়ে গেল, তোমরা বাসায় চলে যাও। এইতো ট্রেন ছাড়বে। থাকার দরকার কি? ওরা থাকলে আবার ভালোও লাগে। ট্রেন নড়ে উঠলেই ওরা হাত ধরে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করে। গ্লাসের ভেতর দিয়ে সে অপলক তাকিয়ে থাকে, বড় ছোট ছায়ামূর্তি দুটি মিলিয়ে যায়। মায়ায় ভরে ওঠে মন, চোখ। ততক্ষণে ট্রেন গতি তুলে ফেলে। মাত্র তো কটা দিন, তারপরও একটা লম্বা শ্বাস মিলিয়ে যায় ট্রেনের গতির সাথে।
(২)
ঘুরে হাত বাড়িয়ে উপরের বার্থের কিনারা ধরে নিজেকে থির রাখার চেষ্টা করতে করতেই, যান্ত্রিক শব্দ, যান্ত্রিক গতি, দুলুনি বাড়তে লাগল। নীলুর মাথায় সাত আসমান ভেঙে পড়ল। এটা কি হল! এত বড় ভুল কিভাবে করল সে! দ্রুত হাতে জানালার পর্দা টেনে দিল। একলাফে দরজার কাছে গিয়ে সিটকিনিতে হাত দিয়ে আবার হাত সরিয়ে নিল। সে চেষ্টা করে স্থির হতে, পারে না। একটা প্রলম্বিত সুনামির আলোড়ন হুহু করে ঢুকে যাচ্ছে মাথার ভেতর। নিজেকে ভারসাম্যহীন অদ্ভুত কোন জীব মনে হচ্ছে।
ছোট্ট কেবিনের মধ্যে উম্মাদের মত ছোটাছুটি, লাফালাফি করতে লাগল নীলু। কয়েকবার দরজা খোলার জন্য হাত বাড়িয়ে আবার চেষ্টা করে নিজেকে সরিয়ে নেয়। সে একবার ট্রেনের চেন টানার চেষ্টা করে বিফল হলে একলাফে সিটকিনি খুলে বাইরে চলে যায়। পায়ের নিচে মাটি নেই, অথৈ সমুদ্র। উত্থুঙ্গ ঢেউয়ের মাথায় পা ফেলে ফেলে ছুটতে থাকে। উঁচু ঢেউয়ের সুড়ঙ্গের ভেতরে সে ভেসে যেতে থাকে এ মাথা থেকে ও মাথা। দুপাশের ভারি দরজা আটকানো। তীব্র গতিতে ট্রেন ছুটে চলেছে। নীলুর মাথার ভেতরটা তার চেয়ে তীব্রতর গতিতে তাণ্ডব বইয়ে দিচ্ছে। উদ্ধত, দূর্বিনীত। করিডোরের সব জানালা মজবুত গ্লাসে আটকানো। সে পাগলের মত ছুটে যায় করিডোরের একদিকে, ওদিকে গেলে খোলা জানালা পাওয়া যাবে। সে আর পারছে না, জানালা দিয়ে লাফ না দিলে তার মুক্তি নেই। ওর দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। হা করে বাতাস টানছে। শরীর কাঁপছে, হাত পা কিছুই ওর নিয়ন্ত্রণে নেই। এসির শীতলতার মধ্যেও ও ঘামে ভিজে জবজবা। করিডোরের শেষ মাথায় গিয়ে হাতলে হাত দেয়া মাত্র ওদিক থেকে ভারি দরজা খুলে কেউ একজন প্রবেশ করে। অপ্রশস্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে নীলু হাঁ করে হাফাতে থাকে। চেতন অচেতনের মধ্যে দুলতে থাকে। হিস্ট্রিয়ার মত হয়ে যায়। হারাক চেতনা হারিয়ে যাক। সবকিছু বোধের উর্ধে চলে যাক। তাহলে যদি শান্তি আসে!
-কি ব্যাপার? আরে! কি হয়েছে! আপনি কি অসুস্থ? একি! একি! ততক্ষণে নীলু ভদ্রলোকের উপরে নেতিয়ে পড়তে পড়তে গুঙিয়ে বলে,
-আমাকে বাঁচান। প্লিজ, আমাকে একটু সাহায্য করুন…ভদ্রলোক নীলুর হাত ধরে। অথৈ সমুদ্রে মানুষ খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায় আর এতো জলজ্যান্ত একজন মানুষ। নীলু আঁকড়ে ধরে কেবিনে আসে। সিটের উপর বিছানা পাতা, বালিশ রেডি, উনি নিলুকে শুইয়ে দিতে যান। কিন্তু মুহুর্তেই নীলু লাফ দিয়ে ওঠে। ছুটতে চায়। উনি ধরে ফেলেন। নীলু এবারে কায়ক্লেশে বলে ওঠে,
-আমাকে একটু ধরে রাখুন।
-নিশ্চয়ই। আমি ধরে আছি। প্লিজ একটু শান্ত হোন, একটু পানি খাবেন? খেয়ে নিন না। এবারে বলুন তো আপনার সমস্যা কি? কী অসুবিধা হচ্ছে আপনার?
-বলছি, বলছি… কিন্তু নীলুর শরীর যেন স্থির থাকছে না। কেবল ছুটতে চাচ্ছে। পুরো শরীর ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে উঠছে। আবার সে গোঙাতে গোঙাতে বলল
-আমাকে একটু ধরে রাখুন। নাহলে আমি ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়তে পারি। নিজের মাথা ফাটিয়ে ফেলতে পারি। শুনে ভদ্রলোকের চোখ ছানাবড়া। সে দুহাতে নীলুর দুবাহু শক্তভাবে ধরে রাখে, আর বলতে থাকে,
-না, আপনি লাফ দিবেন না। এই যে আমি ধরে আছি। শান্ত হোন। প্লিজ শান্ত হোন। চুপ করে চোখ বন্ধ করে থাকুন
-না! না! চুপ থাকবেন না, প্লিজ আপনি কথা বলুন আমার সাথে।
-ও আচ্ছা। আচ্ছা। শুনুন আমি একজন ডাঃ। আমার নাম সমীর। আপনার কোন অসুবিধা নেই। আপনি চাইলে আমি ট্রেন থামাতে পারি, কিন্তু তাতে কি আপনার সুরাহা হবে? এইযে ট্রেনে চলেছেন আপনি কি জানেন, ট্রেন শব্দটি প্রাচীন ফরাসী শব্দ ‘ট্রাহিনার’ থেকে এসেছে যার অর্থ টানা বা টানিয়া আনা।
আচ্ছা, আপনার সমস্যার কথা খুলে বলুনতো। কি হয়েছে? সম্ভবত আপনি একাই ট্রাভেল করছেন। ওঠার সময় দেখেছি। আপনি যদি সিক হন একা একা ট্রাভেল করছেন কেন? সঙ্গে কেউ নেই কেন? যেহেতু বাড়ির লোক আপনাকে একা ছেড়েছে, তারমানে আপনি একজন সুস্থ মানুষ। কেন এরকম করছেন? জানেন মানুষ দেখলে আপনাকে পাগল বলবে। আসলেই কি আপনি পাগল? মানসিক রোগী? এ্যা? আজ যদি আপনাকে আমি না ধরতাম আপনি তো সত্যি সত্যিই ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়তেন। কথা বলতে বলতে এবারে ভদ্রলোক নীলুকে শুইয়ে দিতে গেলে…
-না, না, আমি শোব না। শুলে সমস্যা বেড়ে যাবে। সমীর কপাল কুঁচকে মনে মনে একটু ভেবে নিল।
-ওকে। বসে থাকুন। কি করলে আপনার ভালো লাগবে বলুন তো
-আপনি কথা বলুন। পি-প্লিজ আমাকে ব্যস্ত রাখুন। আমার এক ধরনের ‘ফো- ফোবিয়া’ আছে। ধীরে ধীরে হয়ত ঠিক হয়ে আসবে, তবে সময় লাগবে। কিন্তু আপনি চুপ থাকবেন না। তোতলাতে তোতলাতে কোনরকমে সে কথাগুলো বলে।
-কথা বলব! কিন্তু কি কথা বলব বলুনতো?
-যা খুশি বলুন। কে-কেবল আমাকে ব্যস্ত রাখুন।
-আপনার প্রিয় লেখক বুঝি সুনীল? মার্গারিটকে আপনার কেমন লাগে? ফরাসী দেশের পোয়াতিয়ে অঞ্চলের একটি গ্রামের নাম লুদাঁ। সেই গ্রামের মেয়ে মার্গারিট ম্যাতিউ। শোনেন, মার্গারিট ছিল জীবনশক্তিতে একেবারে ভরপুর। ছোটখাট সব ব্যাপারে সে বিস্মিত হত। আর হ্যাঁ সে একাই ট্রাভেল করত, কোন সমস্যা ছাড়াই। তার একজন মজার কবির একটি মজার কবিতা শুনবেন? কি, শুনবেন নাকি? নীলুর শরীর ঝাঁকুনি দিচ্ছে তার মধ্যেই সামান্য মাথা নাড়ে, শুনবে।
-শুনুন, কবি হ্রোবেয়ার দেনোর নাম শুনেছেন? তাঁর খুব মজার একটি কবিতা আছে
“ক্যাপটেন জোনাথন আঠেরো বছর বয়সে
দূর প্রাচ্যের এক দ্বীপে ধরলেন এক পেলিক্যান
জোনাথনের সেই পেলিক্যান একদিন সকালে
ডিম পাড়লো একটা ধপধপে সাদা, এবং কী আশ্চর্য
তার থেকে বেরিয়ে এলো ঠিক আগেরটার মতন এক পেলিক্যান
এই দ্বিতীয় পেলিক্যানটাও যথাসময়ে
একটি সাদা ডিম পাড়লো, এবং তার থেকে
অবধারিত ভাবেই এলো আরেকটি, এবং এইরকম চলতেই থাকলো…
এরপর কি বলুন তো, নীলু চুপ করে থাকে।
-উঁহু, চুপ থাকলে চলবে না। উত্তর দিন। সে বহু চেষ্টা করে উত্তর দেয়
-এই ব্যাপারটা চলতে পারে বহুকাল ধরেই
যদি না কেউ মাঝপথে একটা ওমলেট বানিয়ে নেয়। সমীর হেসে ওঠে।
-এই তো, চমৎকার বলেছেন। আচ্ছা আপনি কি জানেন, আপনি মার্গারিটের মত সুন্দর। কিংবা তারচেয়েও বেশি।
-ধুর! আপনি যে কি সব বলছেন! সমির দেখল সামান্য হলেও সে স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলতে পারল।
-আরে, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি! চলুন আমার সাথে
-কোথায়?
-এই ফাস্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টের পাশে একটি সুলভ শ্রেনীর মস্ত বড় বগি আছে। সেখানে প্রচুর মানুষ, কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কেউ খাচ্ছে, কেউ পড়ছে, কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ গাইছে, কেউ তুমুল রাজনীতি করছে। আমিও জানালায় দাঁড়িয়ে বিড়ি টেনেছিলাম, এবং ফেরার সময় দেখি একটি মেয়ে আতংকে অস্থির হয়ে পাগলের মত করছে। আপনাকে দেখিয়ে আমি সবার উদ্দেশে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করব, ভাইয়েরা দেখুন তো… আচ্ছা আপনার নাম যেন কি?
-নীলু।
-দেখুন তো নীলু কি সুনীলের মার্গারিট এর চেয়ে সুন্দর নয়? নীলু এবারে খানিকটা হেসে ফেলে। সমীর হঠাত গম্ভীর হয়ে নীলুর দিকে তাকিয়ে থাকে, স্থির। -আরে বাবা, জোরে হাসুন। আর উঠুন উঠুন, চলুন ওখানে যাই… তবে একটা হ্যান্ড মাইক হলে দারুণ হত।
এবারে নীলু কিছুটা সহজ হয়, আর হেসে ফেলে। সমীর নীলুকে বসিয়ে দিয়ে নিজে একটু সরে সুস্থির হয়ে বসে। এভাবে আরো অনেক সময় ধরে সমীর বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে বলে নীলুকে সহজ করার চেষ্টা করে যেতে থাকে। নীলুও সমীরকে, আদতে নিজেকে প্রাণপণে সহযোগিতা করে।
রাত গভীর থেকে গভীরের দিকে হাঁটতে থাকে। নীলু এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। সমীর বলে জাস্ট এক মিনিট আমি আসছি। এবারে নীলু ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়। সমীর উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়াতে গিয়ে দেখে কেবিনের উডেন কালার মেঝেতে নীলুর ওড়নাটা সাপের মত একেবেকে পড়ে আছে। তুলে সে নীলুর হাতে দিয়ে বেরিয়ে যায়। নীলু গভীর উদ্বেগে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। সমীর ফিরবে তো!
কিছুক্ষণ আগে একবার সমীর বলেছিল,
-যাক বাবা। যে ভয় দেখালেন! আচ্ছা আমি কি এবারে যেতে পারি?
নীলু আঁতকে ওঠে দ্রুত হাত বাড়িয়ে খামচে ধরেছিল সমীরের শার্ট।
-আচ্ছা, আচ্ছা যাচ্ছি না।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই সমীর চলে আসে। হাতে একটি ফ্লাস্ক আর কিছু স্নাক্স নিয়ে। সিটের উপর স্নাক্সগুলো রেখে টেবিলে দুটো কাপে চা ঢালে। একটা কাপ নীলুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজেরটা নিয়ে সিটের একদিকে পা তুলে বাবু হয়ে বসে।
-নিন, চা টা খান আর গল্প করুন। রাত তিনটে পার হয়ে গেছে। এই পাশের কেবিনটাই আমার। আমার ল্যাপটপটা বাইরে ছিল সেটা ঢুকিয়ে রেখে এলাম। এখন বলুনতো আর কোন সমস্যা আছে? আর ভয় করছে? এখন ভালো ফিল করছেন?
-হ্যাঁ। শুনুন, আপনি তো বুঝবেন, আমার একধরনের ফোবিয়া আছে। গাড়িতে ওঠার আগে ডাক্তারের পরামর্শ মত আমি ট্যাবলেট খেয়ে উঠি। তখন আর সমস্যা হয়না। আজ এমন তাড়াহুড়ো ছিল, খেতে ভুলে গিয়েছি। আমি কখনও এমন ভুল করিনা। এনিয়ে আমি অনেক ভুগেছি…
-দাঁড়ান, দাঁড়ান শুরুতে বলেছিলাম আমি একজন ডাঃ, ওটা ঠিক নয়। আপনাকে সাহস দেবার জন্য বলেছিলাম। আসলে আমি ট্রেন লাইনের একজন মিস্ত্রি। ট্রেনের কাজে চিটাগাং যাচ্ছি। আমার নাম সমীর। নীলু সামান্য অবাক তাকিয়ে রইল।
-আসলে আমার এই সমস্যার কারণে আগে কোনদিন একা একা জার্ণি করতাম না। আজকাল ওই ওষুধ খেয়ে করি। তাছাড়া সারাজীবন কেউ আমাকে পাহারা দেবে তা কি সম্ভব বলেন!
-এটা কি আপনার ছোটবেলা থেকেই ছিল?
-না, আমি যখন প্রথম কনসিভ করি, তখন অসুস্থ ছিলাম। প্রতি মুহূর্তে ভয় ছিল আমার মিসক্যারেজ হয়ে যাবে। অতি সাবধানে থাকতে হত। প্রবল আতংকে অস্থির থাকতাম, এই বুঝি আমার সন্তানকে হারিয়ে ফেলি! মিসক্যারেজ হয়নি কিন্তু সেই আতংকটা আমার মাঝে এভাবেই রয়ে যায়। সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো হয়েছে, বলেছে খুব ঘন ঘন জার্ণি করতে। মনোযোগ অন্যদিকে রাখতে, জানালার পাশে না বসতে, কারন এরকম ‘প্যানিক এটাক’ হলে কেউ কেউ লাফ দিয়ে পড়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায়। প্রেগন্যান্সির সময় নাকি কারো কারো এমন হয় আবার সেরেও যায়। কিন্তু আমারটা সারল না।
পরে মেডিসিন দেন, বলেন জার্ণির আগে সেটা খেয়ে নিলে আর সমস্যা হবে না। এভাবেই চলছিল…
(৩)
সমীর বুঝে যায় আজ আর ঘুম টুম হবে না। তাছাড়া ও চলে গেলে আবার যদি সে অমন উম্মাদের মত হয়ে যায়। বেচারা…
-আচ্ছা, এখন কি ভালো লাগছে? এখনও কি জানালা দিয়ে লাফ দিতে ইচ্ছে করছে?
-আপনি আর আমাকে লজ্জা দিবেন না। আমি নিজেই বুঝি এটা কী পরিমান পাগলামী! কিন্তু সেই মুহূর্তে কী হয় আমি জানি না। দীপু মানে আমার হাজবেন্ড কেবল জানে। আমি নিজের সকল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। নীলুর মুখটা ভীষণ করুণ দেখায়। সমীরের মায়া লাগে। জগতে মানুষের কত যে বিচিত্র সমস্যা।
-হ্যাঁ আমি দেখেছি সে ভয়ংকর এবং অসহায় রূপ। আচ্ছা আপনার বাড়ির মানুষ মানে হাজবেন্ড একা ছাড়লেন কেন? এমন মানুষকে একা ছাড়তে হয়! স্ট্রেঞ্জ! জানেন আমার বউ হলে একা ছাড়তাম না। শুনে নীলু হেসে ফেলে। স্বাভাবিক, আনন্দময় হাসি।
-দীর্ঘদিন ধরে এমন হলে তখন প্রয়োজন কথা বলে, বুঝলেন মিস্ত্রি মশাই। এরপর সব খুলে বলে। বলে ওর মেয়ের জন্য প্রায় ওকে ঢাকায় আসতে হয়। বিজনেস নিয়ে দীপুকে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। তাছাড়া মেয়েটা চায় মা আসুক। মা গেলে সে খুব খুশি হয়।
-দাঁড়ান, দাঁড়ান আপনার মেয়ে মেডিকেলে পড়ে না আপনি নিজে পড়েন? প্যানিক এটাকের পরে সম্ভবত ভুল বকছেন। এবারে নীলু খিলখিল করে হেসে ওঠে। কী প্রাণবন্ত সে হাসি! সমীরের চোখের রেটিনায় কিংবা মস্তিষ্কে গেঁথে যায় এ অমলিন দৃশ্য।
-কিছুমাত্র ভুল বলছি না। জানি আমাকে চাঙ্গা করতে আপনি এসব বলছেন। তবে মা মেয়ে একত্রে বেরুলে অনেকেই দুবোন বলে, আমরা সেটা খুব এঞ্জয় করি। মেয়ের বাবা এ নিয়ে খুব হল্লা করে। আপনি বুঝি সুনীলের বই খুব পড়েন? মার্গারিট আপনার প্রিয়? সবকিছু চমৎকার মনে রেখেছেন।
-আরে! আপনি বললেন কথা বলতে। হঠাত কি কথা বলি! এমনিতে আমি স্বল্পভাষী মানুষ। আপনার টেবিলের উপর বইটা দেখলাম, সেটা নিয়ে বললাম। তবে হ্যাঁ এটি আমি একাধিকবার পড়েছি। ভালো লাগে। আচ্ছা, আপনি সাউন্ডবক্সের সুইচ অফ রেখেছেন কেন? গান শুনবেন না? আপনি কি ধরনের গান বেশি শোনেন?
তারা দুজনে গল্পে মেতে ওঠে। সমীর একজন ইঞ্জিনিয়ার হলেও গল্প উপন্যাস পড়ুয়া আর নীলু তো বইয়ের পোকা। নীলুর মেয়েটাও বইয়ের আরেক পোকা।
দুজনে মন খুলে গল্প করে। নীলুর এতটুকু অস্বস্তি কিংবা দ্বিধা হয় না। একবারো মনে হয়না, সামনে বসা মানুষটি অস্বাভাবিক হতে পারে। ওর জন্য ভয়ংকর হতে পারে যেটা আজকাল হয়ে থাকে। খবরের কাগজ, টিভি নিউজ, ফেসবুকে এসব অনাকাংখিত খবরে ঠাসা। বরং নীলুর ভালো লাগে যে সে সুস্থ অনুভব করছে। ওষুধ না খেয়েও এই প্রথম উদ্দাম গতিময় ট্রেনে অন্য দশজন যাত্রীর মত বসে আছে। মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক তাণ্ডবলীলা শান্ত হয়েছে, সুস্থ হয়েছে। ফিরে এসেছে নিয়ন্ত্রণ, ফিরে এসেছে স্বাভাবিকতা। ধীরে ধীরে মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠছে। ভালোলালাগার সুষমায় ভরে যাচ্ছে শরীর মন, ভেসে যাচ্ছে কেবিনের চৌহদ্দি। এখন ও সুস্থ। দূর আকাশে উড়ে যাওয়া বকের ডানায় লুকিয়ে ছিল সুস্থতার এই শুভ্র রঙ। আজ সমুদ্রপাড়ের নির্মল বাতাসে উড়ে এলো সেই চেনা রঙ। ঠিক যেন শৈশব, কৈশোরের হারিয়ে যাওয়া রঙ তুলির মুহূর্তগুলো। ক্যানভাস আজ কেবিন। এ ক্যানভাস সোনা রঙে আঁকা থাকুক আপন প্রাণের অতল গহীনে। অনাবিলতা ফিরে পাওয়ার আনন্দ উদ্বেলিত হয়ে উঠতে চাইছে সে।
সমীর ওর মোবাইল সেটে গান চালু করেছে। দুজনে গান শুনছে। এর আগে নীলুকে বলেছিল
-আপনি যেসব গান শোনেন, সেগুলো বাজান শুনি।
-আমি সব ধরনের গান শুনি। জানেন আমি নিজেও সারাদিন বাসায় গান গাই, বেসুরো গান। আমার বাচ্চারা, দীপু মাঝে মাঝে আমাকে পাগল বলে। বলতে বলতে নীলু মোবাইলে গান খুজতেছিল সমীর হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে নেয়।
-কি হল? গান বাজাব না? শুনবেন না?
-শুনব। অবশ্যই গান শুনব। তবে ফোন সেটে নয় আপনার কন্ঠে।
-আমি! আমি গান গাইব? আচ্ছা ঠিকাছে গাইছি- নীলু গাইতে থাকে
“আনন্দধারা বহিছে ভুবনে
দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে
পান করে রবি শশী অঞ্জলি ভরিয়া”-
-প্লিজ, আরেকটা। সত্যি সত্যি নীলু আরেকটা গান ধরে। এভাবে পরপর সে কয়েকটা গান আধখানা বা সিকিখানা গায়। আজ যেন নীলুকে গান, কথা, হাসিতে পেয়েছে। সাবলীল, সতস্ফুর্ত। গান শেষে অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে আসে। কেউ কোন কথা বলে না। ঝাঁকি দিতে দিতে, দুলতে দুলতে বিশালাকার যন্ত্রদানব ছুটে চলে গন্তব্যের উদ্দেশে। রাত এগিয়ে চলে ভোরের উদ্দেশে। দুজন মানুষ এগিয়ে চলে সুস্থতার উদ্দেশে।
-আপনার সংসার, সন্তান, স্বামী নিয়ে কিছু বলবেন না? হঠাত বলে ওঠে সমীর
-এ্যা? দেখুন খুব আলাদাভাবে বলার তেমন কিছু নেই। আমাদের মাঝের সম্পর্কগুলো খুব সহজ, আর স্বাভাবিক। দীপু ওর বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকে কিন্তু আমাদের প্রতি ওর ভালোবাসা কিংবা যত্নের কোন অভাব আমি দেখিনি। একইরকমভাবে ওরাই আমার ভুবন।
কিছু মতান্তর, কিছু অভিযোগ, অনুযোগ তো থাকেই। সেসবও তেমন কিছু নয়। তাছাড়া সবাই তো ব্যস্ত থাকি। আমার শাশুড়িও আছেন, তিনি থাকেন দোতলায় আমরা তিনতলায়। কিছু অবসর পেলেই দীপু সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার প্লান করে। সব সময় হয়ে উঠে না, তবে পতেঙ্গা বা আশেপাশে আমরা প্রায়ই যাই।
এইযে সবকিছু সহজ তার মূলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর বিশ্বাস। আমরা কখনই কেউ কাউকে ছোট করে দেখি না, অবিশ্বাস করি না, ব্যস।
-আজকাল তো অসহজ, অসুখী মানুষের গল্পে ভরে যাচ্ছে পৃথিবী। আপনাদের সহজ সুখের কথা শুনে ভালো লাগল নীলু।
-জানি না। এতসব ভাবার মত সময় কোথায় বলুন? তবে এটুকু বলতে পারি ভালো আছি।
-জানেন নীলু, আমি দেশে আছি আর মাত্র মাস খানিক। এরপর চলে যাচ্ছি। নীলু সুধায়,
-কোথায় যাবেন? কোন দেশে? দেশ বুঝি আর ধরে রাখতে পারল না!
-ঠিক ধরেছেন। আমি কানাডা চলে চলে যাচ্ছি। খুব আশা, স্বপ্ন নিয়ে বিসিএস দিয়ে রেলে ঢুকেছিলাম। টিকতে পারলাম না।
শোনেন, আমরা পাহাড়তলী ক্রস করছি। আর অল্প কিছুক্ষণ পরেই চিটাগাং স্টেশন। আপনি চলে যাবেন আপনার পথে, আমি আমার। কেউ কি নিতে আসবে? সমীরের কন্ঠ যেন ম্রিয়মাণ।
-হ্যাঁ, দীপু নিতে আসবে। ভোরের ঘুম ওর বড় প্রিয় তারপরও সে সবসময় আমাকে নিতে আসে। পুরনো, বিশ্বস্ত ড্রাইভার, কেবল তাকে পাঠালেই হয়। কিন্তু সে এটা নিয়মিত করে। জানেন সমীর, জীবনের এই টুকরো টাকরা ব্যাপারগুলি জীবনকে বেগবান করে, জীবনকে শুকিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।
বাইরে ভোর হয়ে আসছে, যেন নুতন ভোর, যেন কুসুম কোমল ভোর। ট্রেন চিটাগাং স্টেশনে ঢুকছে…
-নীলু, ভালো থাকবেন। এরপর থেকে আপনি কিন্তু একদম সুস্থ। আর এরকমটি করবেন না। লাফ দেয়া কিংবা মাথা ফাটানোর কথা চিন্তাতেও আনবেন না। অনেক ভালো থাকবেন। আর আমার ওই কথাটা বিলক্ষণ মিথ্যে নয়…
-কোন কথাটা!
-বললাম না আপনি মার্গারিটের চেয়েও সুন্দর। আসলেই তাই। সব সময় এমন সুন্দর থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। নির্মল সহজ মনটাকে ধরে রাখবেন, যখন কিনা পৃথিবী থেকে সহজিয়া ব্যাপারটা হারিয়ে যাচ্ছে। এ রাতটির কথা আমি কোনদিন ভুলবা না নীলু।
নীলু কিছুটা সময় নেয়। ট্রেনে ওঠার পর যখন ও বুঝতে পারল ট্যাবলেট খায়নি তখন থেকে আরম্ভ করে বাকি রাতের কথা ওর মানশপটে ভেসে ওঠে। মনটা কৃতজ্ঞতা বা নাম নাজানা এক ধরনের অনুভূতিতে আপ্লুত হতে চায় তবুও ও খুব স্বাভাবিকভাবেই বলে ওঠে-
-জানি না কি বলব। আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছিনা সমীর, আপনিও ভালো থাকবেন, খুব ভালো থাকবেন। এমনই হৃদয়বান থাকবেন, আর আনন্দে বাঁচবেন।
রচনাকাল- ২০-৮-২০২০
একজন মায়াবৃক্ষ বই থেকে।