দু’টো গলি পেরোতেই দেখি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। উঠোনে সকালের রোদে রবিঠাকুর বসে আছেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সুকুমার রায়। রবি ঠাকুর হাতির দাঁতের চিরুনি দিয়ে লেজ প্রান্তের চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলছেন,
– কেনো যে এমন লেজ গজালো, ভেবেই পাচ্ছিনা।
সুকুমার রায় বেড়াল থেকে হয়ে যাওয়া রুমালে শুকনো কপাল মুছে বললেন,
– নোবেল পুরষ্কার পেলে লেজ না হয় শিং গজাবেই গজাবে, হু।
– বলো কি সুকুমার! তাই না কি!
– লেজ বা শিংই যদি না গজালো তবে নোবেল পেয়ে লাভ কি!
– তবে তো শিং গজানোই ভালো ছিলো হে…..
সুকুমার রায় পকেটে রুমালটা ঢুকিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে বললেন-
– আপনি বিশ্বমানবতার কথা বলেন, আপনার কেনো শিং গজাবে! শিং গজাচ্ছে ইউনুসের। অতিভক্তরা মিলে আপনার লেজ গজিয়ে দিয়েছে, যে সে লেজ নয়, বাঙালি উগ্র জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন ভর্তি মায়াময় এক লেজ।
রবিঠাকুর হাতির দাঁতের চিরুনী চোখের সামনে আনতেই দেখলেন লেজের অনেকগুলো চুল তাতে জড়িয়ে আছে। তার কণ্ঠে হতাশা-
– বুঝলে সুকুমার, প্রতিদিন লেজের চুল শ্যাম্পু করছি, কন্ডিশনার মাখছি। সেদিন জেন্টস পার্লারে গিয়ে লেজের চুলে হেয়ার ট্রিটমেন্ট করালাম। রাতে লেজের চুলে নন-স্টিকি কদুর তেল মাখছি— তারপরেও চুল ঝরে যাচ্ছে—
– হায়! হায়! কবিগুরু, আপনি লেজের চুলে কদুর তেল মাখেন!!! চুল তো ঝরবেই…
কবিগুরু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
– কদুর তেলে সমস্যা কি!
– বিশ্ব মানবতার কথা বলতে বলতে স্থান-কাল-পাত্র ভেদটাও ভুলেছেন! বাংলা একাডেমি বা আনন্দ পুরস্কার পেলে জাতীয়তাবাদী লেজে কদুর তেল মাখতে হয়- দুটোই দেশি জিনিস। আর নোবেল পেলে মাখতে হয় আপেলের তেল।
– ধ্যাত! আপেলের আবার তেল হয় না কি!
– শেয়ালের তেল হয়, টিকটিকির তেল হয়, ষান্ডার তেল হয়, আর আপেলের তেল হবেনা!!
– আগে বলবে তো, কদুর তেল মেখে মেখে লেজে তো রীতিমত টাক পড়ে যাচ্ছে-
– জ্ঞানী লোকের টাক লেজেই তো পড়বে, মাথায় পড়বে না কি!
রবিঠাকুর হঠাৎ উদাস হলেন। হাতির দাঁতের চিরুনিতে আটকে থাকা লেজের চুলগুলো একটা একটা করে বিমর্ষ চিত্তে মাটিতে ফেলছেন, আর ম্যাজিকের মত প্রতিটা চুল থেকেই এক একজন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ বের হয়ে আসছে। তারা ভয়ানক ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর চেঁচিয়ে বলছে- ‘রবিঠাকুরকে নিয়ে ফাজলামি! দেখাচ্ছি মজা।’
নিজের প্রাণ বাঁচাতে রবি ঠাকুরের লেজে ছুঁয়ে বললাম,
– কবিগুরু, আমাকে বাঁচান।
রবিঠাকুর লেজ সরিয়ে নিয়ে বিরক্তির সাথে ধমকে উঠলেন,
– ধ্যত্তুরি…! নিজের লেজের ঝরে পড়া চুল দিয়ে আঁটি বাধতে পারছিনা। প্রতিটা চুল ঝরতে না ঝরতেই এক একটা বিশাল রবীন্দ্র গবেষক ও রবীন্দ্রপ্রেমী জন্মে যাচ্ছে, এই চিন্তায় বাঁচছি না।’
রবীন্দ্রপ্রেমীরা ততোধিক আক্রোশে আমাকে ঘিরে ধরতেই প্রাণপণে আবার তার লেজে পড়ে বললাম,
– কবিগুরু, আমাকে বাঁচান, প্লিজ ওদের থামান।
রবিঠাকুর অসহায় কণ্ঠে বললেন,
– ওরে টুটটুটটুট, ওরা কি আর আমার কথা শুনে!! ওরা এখন আমার থেকেও বড় রবীন্দ্রনাথ। এত কিছু জানিস এটা জানিস না…!! ওরা আমার ভাষার ওপরেও পাহারাদারি শুরু করেছে, ওদের অথবা তোকে যে মনখুলে একটু গালিটালি দিবো সে স্বাধীনতাও নেই, টুটটুট.. টুটটুট.. টুটটুট বলে মনের ভাব প্রকাশ করতে হচ্ছে।
হট্টগোল শুরু হতেই আপেলের তেল আনার বাহানা দিয়ে সুকুমার রায় সটকে পড়েছিলেন। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ আর প্রেমীরা আমার উপর ঝাপিয়ে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো। ঘড়িতে দেখলাম রাত সাড়ে তিনটা বাজে—শেষ রাতের স্বপ্ন না কি সত্য হয়! খুব ভয়ে ভয়ে আছি।