বর্ষাকাল, শ্রাবণ মাস। প্রায় সারাদিন প্রবল বর্ষণ। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বৃষ্টি থেমে গেছে। নীল আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘের ভেলা। তার নিচে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে তুর্ণা। কানায় কানায় পূর্ণ সে। দুকূল ছাপিয়ে যায় যায়। পাশ দিয়ে পিচঢালা পথ। রাস্তা আর তুর্ণার মধ্য দিয়ে নারিকেল গাছের দীর্ঘ সারি। তুর্ণার বুকে তাদের স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি। বাতাসে পাতাগুলো দোল খাচ্ছে অবিরত। পশ্চিমাকাশে গোধূলির আভা পরিস্ফুট। লোকালয় পেরিয়ে তুর্ণার তীর বেয়ে হেটে চলেছে চয়নিকা। পরনে দুগ্ধসফেদ শাড়ি, দুহাতে নীল চুড়ির শোভা, পায়ে পাতলা চটি, দীঘল চুল উড়ছে গাছের পাতার সাথে পাল্লা দিয়ে। প্রফুল্ল বদনে মিষ্টি হাসি তার; অসংখ্য মধুর কল্পনা হাসি হয়ে শেফালির ন্যায় ঝরে পড়ছে। এদিকে বসুন্ধরা ছুটে চলেছে রাত্রির পানে। পাখির কুজন গেছে থেমে, নীড়ে ফিরছে তারা দলসমেত। গরুর পাল সারিবদ্ধভাবে লোকালয়ের দিকে ধাবমান। পশ্চিমাকাশজুড়ে থরে থরে নীল, সিঁদুর, কালো ও হলদে রঙের আভা। আঁধারের পর্দা নেমে যাচ্ছে পৃথিবীর উপর।চারিদিকে থৈ থৈ করছে জল। বহমান তুর্ণার কুলকুল ধ্বনির স্নিগ্ধ পটভূমিতে মন্দবায়ুর সাথে ভেসে আসছে ব্যাঙের ডাক।
মহাবিশ্বের পটে চয়নিকা ও আঁধার যুগপৎ পথ চলছে। চয়নিকা এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে, আঁধার আসছে পৃথিবীর দিকে। একসময় পথ চলা শেষ হয় চয়নিকার, হয় না আঁধারের। পরপর ঘন হতে থাকে অন্ধকার। এদিকে মধ্য গগনে জেগে উঠেছে ৬ষ্ঠ কলার চন্দ্র; আরক্তিম পশ্চিমাকাশের নয়নাভিরাম রূপ এখনো দৃশ্যমান। কিছুদূর পরেই মোহনা, চয়নিকার গন্তব্যস্থল; তিনটি নদী যেখানে মিশে একাকার।
গোধুলি পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে বেশ আগেই। পৌঁছে গেছে চয়নিকা। কোথাও কেউ নেই। কই! সে তো আসেনি। সন্ধ্যা নামার পূর্বেই তার আসার কথা। অপেক্ষার অনলে নিজেকে খাটি করার কথা। অথচ…..!
সময় যাওয়ার সাথে সাথে চয়নিকার কপালে ভেসে উঠছে দুশ্চিন্তার রেখা ঠিক পশ্চিমাকাশে জেগে থাকা রেখাগুলোর মতো। ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে হৃদস্পন্দন।রাতের সহজাত নীরবতার কারণে মোহনার দ্রোহ পরপর স্পষ্ট হচ্ছে। কখনো কখনো শোনা যাচ্ছে গর্জনের শব্দ। আর এটার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে চয়নিকার মানস নদীতে। ঘাটে খেয়া নেই, নেই মানবিক কোলাহল। পরবর্তী খেয়ায় আসবে সে— এই বিশ্বাসের উপর ভর করে নিজের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে চয়নিকা। শতশত প্রশ্ন তার মন–মস্তিস্ককে নাজেহাল করে তুলছে। খেয়াঘাটে দণ্ডায়মান নভবিস্তৃত বটবৃক্ষের নিচে বসে দিগন্তপানে চেয়ে আছে আহত প্রেমিকা। অস্ফুট জোছনায় মোহনার তীরে বসে থাকা শুভ্র শাড়ি পরা চয়নিকা যেন বিশাল কৃষ্ণপর্বতের বুকে একখণ্ড অক্ষয় তুষার। চিরন্তনী রাধা মরমের মধ্যে বাজিয়ে চলেছে বীণ। আহা! কী অদ্ভুত করুণ সুর।
রাত গভীর হচ্ছে। ফিরে যাওয়ার পথ নেই চয়নিকার। ওপার থেকে খেয়া নৌকার আগমনের আভাসও মিলছে না। চোখের জল শেষ; অধিক শোকে সে পাথর। পূর্ণ জোয়ার; জোরে বইছে বাতাস। বড় বড় ঢেউ এসে বাড়ি খাচ্ছে কূলে। ছিটকে পড়ছে পানি। মাঝে মধ্যে তারা চয়নিকার দেহ চুম্বনের চেষ্টা করছে। ফলে প্রায় ভিজে গেছে সে। এ ব্যাপারে সে আজ একদম উদাসীন। আহা! কত দিন নদীর তটরেখায় বসে ঊর্মিমালার এ চুম্বন পাওয়ার আশায় কেটেছে তার, অথচ আজ যখন জোছনাসিক্ত জলকনাগুলো তাকে চুম্বনের চেষ্টায় উন্মাদ তখন চয়নিকা উদাসীন। সত্যই বিশাল এ পৃথিবীর পথে পথে চাওয়া-না পাওয়া, পাওয়া-না চাওয়ার খেলা ঘটে চলেছে অবিরাম!
হঠাৎ একটা আলোর দেখা মেলে। কূল ঘেষে এগিয়ে আসছে ট্রলারটি। যত নিকটে আসছে ততই ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ আর চয়নিকার বক্ষের স্পন্দন বেড়েই চলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ট্রলারটি কূল ঘেষে চলে গেল তার গন্তব্যের পানে। পরিস্থিতি তাকে এতটাই বিমূঢ় করে দিয়েছে যে মৃত্যুর কথাও সে ভাবতে ভুলে গেছে। তাতে কি! অপেক্ষার যন্ত্রণা মৃত্যুর চেয়ে কম কীসে?
মাঝে মধ্যে কেঁপে উঠছে চয়নিকা। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দুমড়ে গেছে সে। আহা! এ কি অদ্ভুত অসহায়ত্ব। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ধরে গড়ে তোলা স্বপ্ন, ঘাত-প্রতিঘাতের নির্মম কষাঘাতে টিকিয়ে রাখা আশা, তিলে তিলে গড়ে তোলা শৈল্পিক বাসনা সবকিছুই ভেঙে যাবে! কে জানতো, এক স্বপ্নিল বিকেল পেরিয়ে ভয়ংকর এই দুঃস্বপ্নের সন্ধ্যা আসবে! সমগ্র জীবন কি এই বর্বর সন্ধ্যার জন্যই তৈরি হয়েছে? কালের গহবরে কোথায় লুকিয়ে ছিল এই সন্ধ্যা রজনী? মুহূর্তেই পুঞ্জিভূত স্পর্শগুলো কেনই-বা অস্পর্শের বর্ষা দিয়ে আঘাত করছে অবিরত?
বিশাল এই মোহনার তীর যেন মৃত্যুপল্লী। এতসব ভাবনা থেকে মাথা তুলে তাকাতেই চোখে পড়ে মিটমিট জ্বলতে থাকা লাল আলো। ঐ যে ওটাতেই আসছে বিজন। নিশ্চয় আসছে। বিজন না এসে পারে না। মিথ্যা হতে পারে না আমার অজস্র বছরের ভালোবাসা। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যা চূড়ান্তের মোহনায় এসে দাঁড়িয়েছে তা শেষ হতে পারে না, মৃত্যু নেই তার— ভাবছে চয়নিকা। ধীরে ধীরে কাছে আসে খেয়া। চাঁদের আলোয় আবছা দেখা যায় নৌকা। আরো কাছে আসতেই তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে চয়নিকা। একজন মাত্র মানুষের অবয়ব দেখা যায় নৌকার উপর, একটামাত্র পুরুষ, যার হাতে বৈঠা…….