কুরবানি

রাত দশটা বেজে পনেরো মিনিট। ঢাকার রাস্তায় রাতের একটা কৃত্রিম সৌন্দর্য আছে। সোডিয়াম লাইটের আলোতে শহরটাকে কেমন ভূতুরে মনে হয়। তবে কোলাহলমূখর।
 
দীপ্তি বলল ব্রেড আর মশার কয়েল আনতে হবে। রাতের শহরে আমার মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াতে বেশ লাগে। বাসা থেকে নামলেই পাশে দোকান কিন্তু আমার যেহেতু ঘুরে বেড়ানোর শখ তাই একটু দূরের দোকানে গেলাম। ফুসকার দোকানগুলোতে অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি ভিড়। আবার এদিকে খবরে শুনছি করোনা বাড়ছে হু হু করে। ঘরে ঘরে কম বেশি অনেকেই অসুস্থ। ফাস্ট ফুডের দোকানগুলোতে আড্ডা আর খাওয়া চলছে। এদের বেশিরভাগ বয়সে তরুণ।
 
হাতে ব্রেড নিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছি। হঠাৎ কে যেন ভাই! ভাই! বলে উঠল। ভাই তো কত লোকেই হতে পারে। তাই আমি হাঁটতেই লাগলাম। পেছন থেকে এবার কে যেন আমার কাঁধ স্পর্শ করল। বলল ভাই! স্পর্শটা কেমন যেন, চমকে যাওয়ার মতো। পেছন ফিরে দেখতে যাবো এমন সময় সামনে আরো একজন পথ রোধ করে দাঁড়ালো। হঠাৎ করে ছিনতাইকারীর কথাই মনে আসল। এতদিন আক্ষেপ/গর্ব করে বলে বেড়াতাম এতদিন ধরে শহরে বাস করছি। এত রাত-বিরাতে চলি ফিরি কিন্তু কখনো কোনোদিন ছিনতাইকারীর দেখা পেলাম না। অথবা ছিনতাইকারী ভাইয়াদেরও চোখে পড়লাম না। দীপ্তি শুনে বলত সুখে থাকলে ভূতে কিলায় না! আমি বলতাম নাহ! ভূত কেন কিলাইতে যাবে। ভূত হল খামচায়। তাহলে এতদিনের সেই আক্ষেপ কি আজ মিটে গেল!
 
রাস্তায় এখনো অনেক লোকের আনাগোনা। ছিনতাই হয় সাধারণত নির্জন রাস্তায়। এখানে ছিনতাইকারী পালাতে গেলে পাব্লিকের কিল এক্টাও মাটিতে পড়বে না। ছিনতাইকারীদের সেইফ এক্সিটের একটা ব্যাপার সব সময় প্রায়োরিটি লিস্টে থাকে বলে জানি। আমি পরিস্থিতি চট করে বুঝে নিতেই দেখলাম পেছন থেকে ডাকছে উস্কুখুস্কু চান মিয়াঁ আর সামনে থেকে পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে রেজাউল মিস্তিরি। লম্বা সালাম দিয়ে পান খাওয়া মুখ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চান মিয়াঁ বলল ভাই আমরা আপনার বাসায়ই যাচ্ছিলাম আর আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল।
 
বলতে চাইলাম দেখা হয়ে গেলে মানুষকে এভাবে ঘিরে ধরে? আমি কি সেলিব্রিটি? পরে ভাবলাম আমাদের দেশে চান মিয়াঁ আর রেজাউল মিয়ারা এরকমই আন্তরিক হয়।
 
আমি ওদের নিয়ে পাশের গলির মুখে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ালাম। মনে পড়ল আমিই চান মিয়াকে ফোন করেছিলাম একটা কাজের ব্যাপারে।
 
ফুটপাত দিয়ে অসংখ্য মানুষ যাচ্ছিল। বেশিরভাগ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। বাড়িওয়ালার ছেলে আমাকে দেখে দূর থেকে সালাম দিল। বুঝলাম মাস্ক পরা থাকলেও চেনা মানুষকে চিনতে অসুবিধা হয় না। আবার অচেনা অদেখা মানুষের মুখে মাস্ক থাকলে লোকটি আসলেই দেখতে কেমন এটা বুঝা যায় না। তাঁর মানে মানুষের ঠোঁট, চিবুক ও নাক এই তিন অংশ এবং তাঁর অভিব্যক্তি জুড়ে মানুষের আসল চেহারাটা লুকিয়ে থাকে।
 
ফুটপাতের অসংখ্য মানুষের ঢলে এবার আরেকটি পরিচিত মুখ সেলিম ভাইকে দেখলাম। কিন্তু সেই পরিচিত মুখটি আমাকে দেখেও না দেখার ভাণ করে পাশের গলিতে ঢুকে গেল। বুঝাই যাচ্ছিল তিনি অফিস থেকে ফিরেছেন। কিন্তু তিনি তো এখানে থাকেন না। তাঁর ওয়াইফ বাচ্চা সবার সাথেই আমাদের ফ্যামিলিগতভাবেই পরিচিতি রয়েছে। তবে কি বাসা চেঞ্জ করলেন?
 
সেলিম ভাই ব্যাংকার। ব্যাংকারদের অফিস থেকে ফিরতে এক্টু দেরিই হয়।
 
আমি বাসায় গিয়ে দীপ্তিকে বললাম শুনছ!
 
কী?
 
সেলিম ভাইয়েরা পাঁচ নাম্বার রোডে চলে এসেছেন দেখলাম।
 
মানে?
 
মানে আর কি! উনারা মনে হয় বাসা চেঞ্জ করেছেন।
 
কে বলল?
 
আমি বললাম।
 
যা জানো না তাই নিয়ে কথা বলো না।
 
কী জানিনা।
 
কালকেই ভাবীর সাথে কথা হলো। বাসা চেঞ্জ করলে জানতাম না?
 
হুম তা ঠিক। তাহলে উনাকে যে দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে ফিরছেন।
 
ঠিকই দেখেছ।
 
তাহলে?
 
তাহলে আর কি! ওটাও উনারই বাসা।
 
মানে দুইটা বাসা?
 
হ্যাঁ দুইটা বাসাই উনার। একটাতে উনার বউ আর ছেলে থাকে। আরেকটাতে গার্ল ফ্রেন্ড থাকে।
 
আমার মুখ হা হয়ে গেল।
 
দীপ্তি রাগের সুরে বলল ওরকম হা হয়ে আছো কেন। মাছি ঢুকবে। আম কাঁঠালের দিন। অনেক মাছি চারপাশে।
 
তুমি কি ঠিক জানো?
 
জানি সবই। এরকম শয়তান লোকের দুইটা বাসাই থাকে।
 
কী বল! এত সুন্দর, হ্যান্ডসাম, ব্যাংকার সেলিম ভাইকে তুমি শয়তান বলছ!
 
বলবো না? আমি সব জানি। উনার ওয়াইফ সব বলেছে। এর আগেও ধরা খাইসে পাশের বিল্ডিং এর নন্দিতার সাথে। এখন নিশ্চয়ই আবার আরেকজন জুটাইছে।
 
সেলিম ভাইকে আমার মনে আছে তিনি অনেক গুছানো টাইপের মানুষ। একবার আমরা একসাথে গরু কুরবানি দিয়েছিলাম। উনি হাটে গিয়ে গরু কেনা থেকে মাংস বানানো, ভাগ বাটোয়ারা বিলানো সব নিজ হাতে সুন্দরভাবে করেছিলেন। তাই বলে ভালোবাসাও যে কুরবানি দিয়ে সুন্দর মতো বিলি বণ্টন করতে পারেন তা কে জানতো!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত