ভর দুপুরে পার্কে মানুষজন একটু কম থাকে। আসিফের মনে পড়ছে নাবিলার সাথে কুসুম কুসুম প্রেমের সময়টাতে তারা এরকম নির্জনতাই খুঁজত। শুধু একটু হাত ধরে বসে থাকাটাতেই যে কত প্রশান্তি! কি সব দিন ছিল! যদিও আসিফ এই ভর দুপুরে একা বসে। গত এক সপ্তাহ যাবৎ সে দিনগুলো এখানেই কাটাচ্ছে। অফিসে যাচ্ছে না। কারণ তার চাকরি চলে গেছে। বেসরকারি একটি ব্যাংকে এভিপি হিসেবে কাজ করছিল। বিএফটিএন রাউটিং কোডে কী গণ্ডগোল। একজনের টাকা আরেকজনের একাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। এটা নিয়ে মহা কেলেঙ্কারি। নিরীহ আসিফের উপর দিয়ে কেলেঙ্কারির স্টিম রোলার চলে গেছে। এখন আসিফ প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার ভান করে পার্কে বসে বাদাম চিবায়। তিথিকে এখনো বলা হয়নি। কী দরকার শুধু শুধু পেরেশানিতে রাখার।
আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি!
আসিফ চমকে উঠল। ভর দুপুরে পার্কে যেমন আসিফের বসে থাকাটা বেমানান। তদ্রূপ এরকম সুনশান দুপুরে একজন রূপবতীর এভাবে একটু কথা বলতে চাওয়াটাও বেমানান।
নিজেকে সামলে নিয়ে আসিফ বলল কী ব্যাপার বলুন তো? কোন কোম্পানির সার্ভে নাকি মার্কেটিং?
না না সেরকম কিছু না। একটু আলাপ করতে চাচ্ছিলাম।
কে আপনি? কী আলাপ! আসিফ ভ্রু কুঞ্চিত করে আছে।
কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা মেয়েটি হাসনাহেনার গন্ধ ছড়িয়ে আসিফের পাশে বসতে বসতে বলল। নাম জানা কি খুব জরুরী! মনে করুন আমি সাবিলা। আর আমার কিছু গল্প আপনাকে শোনাতে চাই।
সাবিলা! আসিফ অস্ফুট বলে উঠল। এক নাবিলা লোকান্তরে আরেক সাবিলা পার্কে ঘুরে!! আমাকে কেন জানতে পারি? আসিফ শংকার সাথে জিজ্ঞাসা করল।
র্যান্ডম চয়েজ বলতে পারেন।
আচ্ছা বলুন কী বলতে চান?
ইজি হয়ে বসুন। ওরকম চোখ বড় করে রাখলে গল্প কিভাবে শোনাবো। গল্প শুনে চোখ বড় করার ব্যাপার থাকলে তখন নাহয় চোখ গোল্লা করবেন।
আসিফ একটু স্বাভাবিক হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল।
সাবিলা বলতে শুরু করল। জানেন আমি ছোটবেলা থেকেই ঘর সংসার খুব পছন্দ করতাম।
আসিফ তড়িৎ জবাব দিল নাতো জানিনাতো!
সাবিলা খিলখিল করে হেসে উঠলো। বলল আপনিতো বেশ মজার মানুষ।
মানুষের হাসি এত সুন্দর হয়! কিন্তু এরকম ভর দুপুরে সাবিলার মন কেমন করা হাসিতে আসিফের প্রেম পাওয়ার কথা কিন্তু তার গা ছমছম করছে।
আচ্ছা শুনুন বলছি – সবাই পড়াশুনা শেষ করে বিসিএস দিবে, ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে এরকম এম্বিশানের কথা বলত। আর আমি বলতাম পড়াশুনা শেষ করে আমি বিয়ে করবো। বাসায় রান্না-বান্না করবো। বরকে অনেক ভালবাসবো। একটা বেবি হবে। ছোট সংসার। ভালোবাসায় পূর্ণ থাকবে সে সংসার।
হুম তারপর! আসিফ মনোযোগী হচ্ছে।
মাস্টার্স শেষ করার পরপরই কানাডা প্রবাসী এক ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। ছেলেতো নয় যেন রাজপুত্র। আমি কল্পনায় যেমন ভাবতাম তারচেয়েও অনেক সুন্দর।
আমি সহ পরিবারের সবাই খুব খুশি। দুই পরিবারই দারুণ উচ্ছ্বসিত কারণ আমিও কম সুন্দরী নই। বুঝতে পারছেনতো!
আসিফ বলল জ্বী আপনি সুন্দর।
অমন মুখ শুকনা করে বলছেন কেন! কখনো প্রেম করেননি বুঝি! সাবিলা হাসছে।
আসিফ বিব্রত হয়ে বলল দেখুন যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন আমার একটু তাড়া আছে।
তারপর আমার সেই রাজপুত্রের মতো বর বিয়ের পরদিন কানাডা চলে গেল। আমি শ্বশুর বাড়িতে পড়ে রইলাম। কাগজপত্র হলে আমাকে নিয়ে যাবে। এভাবে তিনবছর চলে গেল কাগজপত্র হয়না আমাকেও নেয় না। চিঠি লিখলে চিঠির উত্তর আসেনা। একপ্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমার স্বপ্নময় সংসার শুরু হতে হতেই যেন কেমন গুটিয়ে গেল।
একদিন টেলিফোনে আমার স্বপ্নের রাজপুত্রকে পেলাম। আমি তার কাছে কবে যাবো জিজ্ঞাসা করাতে সে এমন দুর্ব্যবহার করলো যে আমার বুঝতে বাকি রইল না আমার এই অপেক্ষায় থাকাটাই সার। আমি সেদিনই শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এলাম।
তারপর! আসিফ যেন গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
পরে শুনলাম রাজপুত্রের ওখানেই একটা বিদেশি বউ আছে যা তার বাবা মাও জানতেন না। যাইহোক তারপর এভাবে এক বিভীষিকাময় জীবন পার করলাম। ছেলে মানুষের প্রতি আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে এলো। জীবন থেমে থাকে না। আমার বাবা-মা কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে আরেকটি ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন। ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সাহবের বিরাট জমিদারি রক্ষার জন্য পুত্র সন্তান চাই। পুত্র সন্তান দূরের কথা কোন সন্তানই হলো না। ছয় বছরের সংসারে রান্নাবান্না করাই সার হলো। বরের ভালোবাসার বাতি ঝাড়বাতি থেকে আগরবাতি হয়ে নিভু নিভু করে শেষে নিভেই গেল।
তারপর!
তারপর আমি সংসার সংসার খেলার রণে ভঙ্গ দিলাম। একটা স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানোর চাকরি নিলাম। আর বাবা-মায়ের কাছে নয় নিজে একা থাকা শুরু করলাম।
এটা বেশ। তারপর কি হলো? আসিফের কৌতূহলী প্রশ্ন।
মানুষ আসলে একা থাকতে পারে না। তার কাউকে লাগেই। কথা বলার হোক, ভালোবাসার হোক, মনের হোক, শরীরের হোক।
আচ্ছা! হুম হবে হয়তো।
হবে হয়তো কেন বলছেন? জানেন না বুঝি। এগুলো কি এই প্রথম শুনলেন? ঢং করছেন কেন? রাগ লাগছে কিন্তু আপনার উপর।
আসিফ বিব্রত হলো। অবাকও হলো। সাবিলা মেয়েটি এমন করে বলছে যেন তার সাথে কতকালের প্রেম।
আচ্ছা আপনার রাগ লাগলে গল্পে ইস্তফা দেন। আমি যাই। কাজ আছে।
যাই মানে! বসুন বলছি।
আসিফ উঠে দাঁড়িয়েছিল। অস্বস্তি নিয়ে আবার বসল। মেয়েটির সম্ভবত মাথায় গণ্ডগোল আছে। বলাতো যায় না চিৎকার চেচামচি করে ঝামেলায় ফেলে দিতে পারে। আজকাল গণপিটুনির সিজন চলছে। মানুষ বেঘোরে জনরোষে মারা পড়ছে।
তারপর শুনুন। আমি একা থাকি। ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল। অবসরে ছবি আঁকায় মন দিলাম। একটা প্রদর্শনীতে একজনের সাথে পরিচয় হলো। আমরা বন্ধু হলাম। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন সেই বন্ধু আমার প্রেমে পড়ে গেল কিনা। আসলে না, প্রেমে পড়ল না। প্রেমে পড়ার মতো সে ভালনারেবল ছিল না। অবশ্য সে প্রেম ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিল না। তার ধারণা ছিল এসব মন ভুলানো কথাবার্তা। আর্ট নিয়ে অনেক স্তাবকতা করতো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনতাম। এক সময় মনে হলো সেই বন্ধুটিকে আমি চাচ্ছি। মনে না হোক শরীরে।
একদিন সন্ধ্যায় ভীষণ ঝড় শুরু হল। সে আমার বাসায় আটকা পড়ল। অথবা ঝড় আর আমি মিলে তাকে আটকে রাখলাম।
তারপর?
তারপর সে সুবোধ বালকের ন্যায় সারারাত আমার সাথে গল্প করে কাটালো। কিন্তু একটুও প্রেমবোধ জাগল না। আমার মতো এমন আগুন রঙ্গা রূপবতী মেয়ে তার কাছে হয়ে রইলাম কাঠের পুতুল। আমি নিজের সউন্দর্যে আস্থা হারালাম। পরিশেষে বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলাম সে আসলে অক্ষম নির্জীব পুরুষ। আমার নিজের উপর খুব রাগ হলো। নিজেকে অভিশপ্ত মনে হলো।
তারপর কি হলো?
আমি সেই সুবোধ বালককে যে পার্সোনালিটির জন্য পছন্দ করেছিলাম, সেটা হয়তো তার অক্ষমতা থেকে উৎসারিত ছিল। তাইতো বলি এমন পুরুষও আছে!
তারপর চিত্র কলা, ছলা-কলায় জীবন ভালোই চলে যাচ্ছিল। আচ্ছা আপনি কি গান জানেন?
প্রশ্ন শুনে আসিফ চমকে উঠলো। মাথা দুই দিকে নেড়ে বলল না না আমি গান জানি না।
তবে কী জানেন? গল্প-কবিতা?
তেমন কিছু জানিনা।
কিছু একটাতো জানেন। নাহলে এমন উদাস দুপুরে একা কেন?
আচ্ছা তারপর শুনুন, সেই সময়ে আর্টের পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষা শেখার চরম আগ্রহ জন্মালো। ফ্রেঞ্চ এবং স্প্যানিশ ভাষা শিখে ফেললাম। আলিয়াস ফ্রসেতে এক ফরাসী ছেলের সাথে পরিচয় হলো। একটা পর্যায়ে ছেলেটি আমাকে বলল “য়ুজেত ব্যাল” মানে তুমি সুন্দর। একটা এক্সিবিশনে ছেলেটির সাথে প্যারিস গেলাম। ছেলেটি তার বাসায় নিয়ে গেল। সেখানে তাদের পারফিউম তৈরির কারখানা। আমার গায়ের গন্ধ নাকি খুব সুন্দর। হাসনাহেনার মতো। সে আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে বড়সড় একটা বোতলে চুবিয়ে রাখলো।
আসিফ চোখ বড় বড় করে বলল আপনি আমার সাথে রসিকতা করছেন তাই না?
বাড়ে! রসিকতা কেন হবে! এই যে দেখুন আমার গায়ের গন্ধ। সুন্দর না! সাবিলা খিলখিল করে হাসছে।
আসিফের মাথা ঝিম ঝিম করছে। হাসনাহেনার গন্ধ তীব্র হচ্ছে। সে কি জ্ঞান হারাচ্ছে!
সুনশান দুপুরে কিছু লোক ভীড় করছে পার্কে। একটা লোক পড়ে আছে। ভালো করে খেয়াল করলে শোনা যায় সে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। নাবিলা! সাবিলা!!!