রাস্তায় পেট ফেটে নবজাতকের জন্ম হওয়ার খবরে আৎকে উঠলেন আবুবর সাহেব। খবরটা আবার পড়লেন তিনি। ফেজবুকের লিঙ্ক থেকে ক্লিক করে খবরের মূল পোর্টালে চলে গেলেন। যদিও তিনি খবর-টবর তেমন পড়েন না, তবুও আজ পড়লেন খবরটি। পড়ার পর থেকেই যেন ঝিম ধরলেন। বসে আছেন চুপচাপ।
ট্রাকচাপায় দুর্ঘটনাস্থলেই মারা গেছে বাবা, মা ও আরেক সন্তান। স্পট ডেথ। অথচ মায়ের পেট চিড়ে ঘাতক ট্রাকটা যাওয়ার সময় জন্ম হয়েছে শিশুটি। কেউ ভাবেনি, মৃত্যুর সাথে জন্মও নিয়েছে শিশু। লোকেরা ছুটে এসে দেখছে, মায়ের বোরকার নিচে জ্যান্ত শিশু, কাঁদছে।
বারান্দায় চা নিয়ে বসেছিলেন আবুবর সাহেব। সেখানেই তিনি খবর পড়ে নিঃশ্চুপ হয়ে গেছেন। শিশুটির ভরাট আর গম্ভীর মখুখানা বেশ মায়াময়। এই মায়াময় মুখ তার হারানো সন্তানের মতো। সন্তান একটা পাথর তার বুকের ভেতর। এই পাথর তিনি নড়াচড়া করতে চান না। মনে করতে চান না পুরনো ব্যথা। বরং তিনি এই অনাথ শিশুটির কথা ভাবতে লাগলেন। মোবাইলটি বন্ধ করে মনে মনে বললেন, তাহলে এভাবেই জন্ম হলো শিশুটির, রাস্তায়, মা বাবার সারি সারি লাশের পাশে, হায়রে, জন্ম আর মৃত্যু।
শব্দগুলো মাথায় নিলেন তিনি থেকে থেকে। চায়ে চুমুক দিয়ে পা ছড়িয়ে বসলেন। চোখ বন্ধ করলে শিশুটির মুখখানা সামনে চলে আসছে। কিভাবে বাঁচল শিশুটি? বিজ্ঞানের কোন সম্পর্কে অলৌকিক ব্যাপারটা ঘটে গেছে? ধরা যাক আমি সেই শিশুটি, মায়ের পেটে শোয়া, মা আমাকে পেটে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আচমকা এলো ট্রাকটা। আহা কি নিদারুণ! ভাবতে পারছেন না।
এটা আবুবর সাহেবের বিশেষ অভ্যাস। তার মনে যেটা দাগ কাটে, তারই ভেতর ঢুকে যান। নিজেকে সম্পৃক্ত করে বিশেষভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এমনিতেই গবেষণা প্রিয় মানুষ তিনি। বিজ্ঞানের নানান গবেষণা করে তিনি পরদিন ক্লাসের ছাত্রদের মজা করে বলেন। আজকে ঢুকে গেছেন দুর্ঘটনার ভেতর। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে তিনি ঘটনাস্থালের শিশু হয়ে গেলেন। তিনি জন্ম নিয়েছেন সড়কে। শুয়ে আছেন বোরকার ভেতর। পাশেই মৃত পূর্বপুরুষেরা, সারি সারি লাশের সাথে, আর তিনি বোরকার ভেতর চেয়ে আছেন।
শিশু হতে ভালোই লাগছে তাঁর। ডান হাত দু’ জায়গায় ভাঙা মনে হচ্ছে। পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে। আর কপালে বসে আছে একটা মাকড়সা। চমকে উঠলেন তিনি।
এবার তিনি সত্যি সত্যিই মোবাইল নিয়ে আবারো খবরের ছবিটি ভালোভাবে দেখলেন। সত্যিই তিনি দেখতে পেলেন, নবজাতকের কপালেও একটা মাকড়সা বসা।
আবুবর সাহেবের মনে হলো, মাকড়সাটা তার কপালে বসা। নড়ছে। আস্তে আস্তে মাকড়সাটি কানের কাছে গেল। একটু খুটখুট করে চুলের ভেতরে ঠুকে গেল। তারপরেই ঢুকল যেন তার মাথায়, মগজে, তার চিন্তায়। তাকে কুটে কুটে খেতে লাগল। তিনি জোর করে চোখ বন্ধ করলেন। যেন চোখে না ঢুকে। তিনি মাথাটা ঝাঁকালেন যেন পড়ে যায়। কিন্তু মাকড়সাটি মাথা থেকে সরছে না। তিনি খবরের পাতা ঘাটতে লাগলেন। চোখের ভুল হয়ত, মাকড়সাটি নবজাতকের মাথায়। চোখ কচলে দেখলেন তিনি। মাকড়সা, অমেরুদন্ডী এই বিশেষ শিকারী কীট। আট পা ওয়ালা এই কীট সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটির মাথায় কি করছে? সেখান থেকে কিভাবে তারও মাথায় আসছে যাচ্ছে? না তার শিশু হতে চাওয়া ঠিক হয়নি। আর এই মাকড়সা, অন্তত মারা যাওয়া মা-বাবার শরীরের ওপরে থাকতে পারত এটা।
তিনি দেখলেন, মাকড়সাটির শরীর মাথা ও ধড় দুটি অংশে বিভক্ত, আটটি সন্ধিযুক্ত পা আছে, ডানা নেই। তিনি দেখলেন, এই সত্য শুধু অবিকৃত, শিশুটির কপালে শুধু মাকড়সাটি। যেন আঠা দিয়ে আটকানো। তিনি ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন, নিশ্চয়ই মাকড়সা সহ শিশুটি জন্ম নেয় নি। মায়ের পেটে অন্তত জাল বুনতে যায় নি এটা। অথবা,.. আহ কী সব হাজারো চিন্তা! কেন তিনি শিশু হতে গেলেন? কেন সেই দুর্ঘটনার চিন্তা মাথায় নিলেন? মূলত তিনি নিলেন সেই মাকড়সাটি। যে মাকড়সাটি শিশুটির মাথায় আর নিজের মাথায় ঘোরাফেরা করছে।
ইদানিং এই এক সমস্যা হচ্ছে আবুবর সাহেবের, প্রতিদিনের ঘটনাগুলো তাকে রেহাই দিচ্ছে না। কোনোমতেই এড়িয়ে থাকতে পারছেন না। বয়স বেড়ে গেলে এমন হয় হয়ত। যে কোন ঘটনা বা অন্যের চিন্তা, তার মাথায় ঢুকে যায়। যদিও এসব এড়িয়ে থাকতে চান, কিন্তু সারা জীবন সবকিছুকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এমনকি ক্ষুদ্র মাকড়সা পর্যন্ত। আফসোস হতে লাগল, এটা না দেখাই ভালো ছিল। অন্তত খবরটা উচিৎ ছিল না পড়া।
তিনি বাহিরে তাকালেন। উন্মুক্ত আকাশ। আরো এক কাপ চা দিতে বললেন স্ত্রী বিলকিস বেগমকে। চেয়ার থেকে উঠে ঘুরেফিরে আবারো চেয়ারে গিয়ে বসলেন হেলান দিয়ে। না সরছে না মাকড়সাটা। ঠিক মাথার ডান পাশটায় কিটকিট করছে। কানের পাশে। কানে? হাত দিয়ে চুল সরিয়ে দিলেন। তারো ভেতরে, মগজে, কীকরে মাকড়সাটা তার মাথায় ঢুকল বুঝতে পারছেন না।
অজান্তেই তিনি নেট সার্চ করতে লাগলেন, মাকড়সা! হাজারো ধরনের মাকড়সা। দেখতে অদ্ভুৎ ও বিষাক্ত। মাকড়সার একটি বিশেষ গুণ হল, এরা জাল তৈরি করে। অনেক রকম মাকড়সা হয়, কেউ জাল বোনে, কেউ লাফিয়ে শিকার ধরে। সব মাকড়সার একজোড়া বিষগ্রন্থি আছে। এদের অনেকের কামড় খুব বিষাক্ত। তবে সবাই প্রাণঘাতী নয়। এই মাকড়সাটি কি বিষাক্ত? না মনে হচ্ছে না। মাকড়সারা প্রথম স্থলচর প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। অপেক্ষাকৃত প্রাচীন মাকড়সারা নিঃসঙ্গ শিকারী অর্থাৎ এরা জাল বোনে না, লাফিয়ে শিকার ধরে। এদের চেনার উপায় হল..
– এই শুনছ? চা নিয়ে যাও।
স্ত্রীর ডাকে চা নিতে গেলেন। চা নিয়ে দুজনে বারান্দায় বসলেন।
– আচ্ছা বিলকিস বেগম, তোমার কি এমন হয়, যা দেখ, তা তোমার মাথার ভেতরে ঢুকে যায়?
– কেন? কি ঢুকেছে?
– না, কিছু না। যেমন গরু দেখলে। আর গরুটা মাথায় ঢুকে গেল। বা কোনো হাতি।
– আরে হাতি কেন মাথায় ঢুকবে? কি বলছ যা-তা? একটা ইমেজ তো মাথা ধরে। চিন্তায় রাখে। কেন হাতি ঢুকেছে নাকি মাথায়! হা হা হা!
– না সুখ নাই তোমার সাথে কথা বলে। আরে বাবা একটু ঠাট্টা থামাও। ব্যাপারটা ধরো, কোন মাকড়সা।
– এই-এই কই! কই মাকড়সা। বিলকিস বেগম যেন চমকে উঠলেন।
– ধূরো! এখানে নেই তো। শোনো, তুমি দেখলে একটা মাকড়সা, আর তা তোমার মাথায় ঢুকে গেল। কুটকুট করে কামড়াতে থাকছে- এই রকম?
– ওরে বাবা, না না তুমি মাকড়সা নিয়া কথা বলবে না। ও-বাবা, এখনই আমার গা কেমন করছে। মনে হচ্ছে কামড় দিচ্ছে।
– এই যে দেখ, এখানে, কানের পাশটায়, হ্যা, একটা ক্ষত হয়ে গেছে। কামড়িয়েছে মাকড়সাটা।
বিলকিস বেগম কানের পাশে দেখলেন, সামান্য রক্ত আর ক্ষত। তুমি কি চুলকিয়ে এমন করেছ? আহা কি অবস্থা করেছ। দেখি তোমার নখ। না সব তো পরিষ্কারই আছে। কিভাবে এমন হলো? কখন হলো?
– এই মাত্র। মাকড়সাটা এখান দিয়ে গর্ত করে মাথায় ঢুকে গেল।
– কি বলছ এসব যা-তা! এই তুমি কি কিছু খেয়েছ টেয়েছ নাকি? দেখি মুখ।
মুখ শুঁকে দেখলেন বিলকিস বেগম। না তো! সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলেন তবুও।
– শুধু হাত বুলিয়েছি আমি, ঘামের নোনতা গড়িয়ে এসে ক্ষতে দাহ তুলেছে। কামড়িয়েছে মনে হয়। না না, মনে হচ্ছে নখ দিয়ে চুলকিয়েছি। তিনি কথাটাকে ঘুড়িয়ে নিলেন। বোকার মতো কথা বলা থেকে চেপে যাওয়া উত্তম। এটাই বুঝতে পারছি না কিভাবে হল। কোন জীবন্ত মাকড়সা মাথার ভেতরে ঢুকে গেছে। বিশ্বাস করা কষ্টকর। বলাও যায় না, নবজাতকের কপালে বসা মাকড়সা তার কপালে বসে মগজে গেছে। শুধু বললেন, দেখেছ শিশুটিকে?
– কোন শিশু?
– মৃত মায়ের পেট ফেড়ে জন্ম নেয়া বাচ্চাটি। গতকাল অ্যাক্সিডেন্টে যা ঘটল।
– হুম। খুব মর্মান্তিক। এসব দেখিও না।
– হুম দেখি না। আজকে দেখলাম, আর মাথাটা ধরে গেল।
সবকিছু ভুলে থাকতে চাইছিলেন আবুবর সাহেব। চোখমুখ বন্ধ করে থেকেছিলেন। যা হয় হোক। ভুলে থাকো। ভালো থাকো। ঝঞ্ঝাটহীন। কিন্তু না, ব্যাপারগুলো কোন না কোন ভাবেই আঁচর কাটে। মাকড়সার মতো। নবজাতকের মাথায় থাকা মাকড়সা কেন ঢুকে যায় মাথার ভেতরে? একটা জ্যান্ত পোকা, আট পায়ে হেঁটে বেরাচ্ছে। কুটকুট কাটছে, ভাবতে পারা যায়? কাউকে বলা যায় না, অবিশ্বাস্য। যদি ধরা যায় চিন্তা এটা। মাথায় ঢুকেছে নবজাতকের ছবি থেকে, বিশ্বাসযোগ্য, অন্যের সাথে ব্যাপারটা আলোচনা করা যায়। তার মানে আবারো নানান ঘটনায় জড়িয়ে পড়া। না ভাববেন না তিনি। না সব চিন্তা বাদ দিতে চান। তাকাবেন না, শুনবেন না। বোবা-কালা হবেন। চোখ বন্ধ করে থাকবেন।
চোখ বন্ধ তার। চেয়ারে হেলান দিয়ে আছেন। বিলকিস বেগম কখন চলে গেছেন জানেন না। তিনি ভাবনায় ডুবে গেলেন। মাকড়সাটা মগজ থেকে বের হয়ে কপালে আসন নিচ্ছে। তার কপাল ফুলে উঠে মুকুলিত হচ্ছে। কি রে বাবা? মাকড়সাটা খুটখুট করে পায়ের পাতা নাড়িয়ে সামনে এগুচ্ছে। নাকের দিকে হেঁটে যাচ্ছে মাকড়সাটা। কী বাজে রকম সুরসুরি। অসহ্য অনুভূতি। অন্যরকম শিহরণ। দুটো পা দিয়ে তার নাকের ছিদ্রে আঙটা মতো ধরেছে মাকড়সাটা। ওরে বাবা, সে কি নাকে ঢুকবে? হাতের নখ দিয়ে খামছে টেনে ফেলবে নাকি? যদি কামড় দেয়? নিশ্বাস বন্ধ করে এবার তিনি নাকের গরম ভাপ ছাড়তে লাগলেন। কাজ হয়েছে, মাকড়সাটি আবারো নড়েচড়ে হেলেদুলে ডান চোখের ওপরে উঠল। এবার হাতপা নাড়িয়ে মাকড়সাটি তোর বন্ধ চোখের ওপরে জাল বুনছে।
ভ্রু থেকে চোখের পাতা, মোছে জাল বুনতে লাগল মাকড়সাটি। ডানচোখে জাল বোনা শেষ হলে বাম চোখে গেল এটা। ঠিক একইভাবে জাল বুনল বাম চোখে, একই নক্সা করা। কিভাবে পারে এরা? চোখের কোণে, ঠিক যেমনটা ডানে করেছে, শুরুতে একটু ফাঁকা রেখে বামেও তাই করেছে। বড় ইন্জিনিয়ার এই সব মাকড়সারা। কোণের জায়গা থেকে পাতার দিকে একটু মোটা দাগে সাদা-ঘন বিট। তাহলে কি মাকড়সাটি জালের মাধ্যমে অন্যান্য কীট-পতঙ্গ শিকার করবে চোখে? বোনা শেষ হলে আবারো কপালের দিকে গেল এটা। আবারো আসন নিয়ে বসল কপালের ওপর। আস্তে আস্তে কপালে মিশে গেল। সে ঢুকে গেল মাথার ভেতরে। মগজে।
তিনি চোখ খুললেন, চোখ তেরপাতে তেরপাতে একটু একটু করে খুলে দেখতে দেখতে বেশ শীতল ভাব আঁচ করলেন, জালের ঝাপসায় অস্পষ্ট দৃষ্টি, একটু শীতল অনুভূতি।
ধূরো! তিনি হাত মুছলেন। এসব কিছুই না, চিন্তা এসব। এই মাকড়সা চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে। যা শুরু হয়েছে নবজাতকের মাথা থেকে। এক্সিডেন্টের সেই ছবিটা। এক্সিডেনটের ট্রাকটা। অস্বাভাবিকভাবেই হয়েছে এক্সিডেনটা। পিতৃ পরিচয় মেরে ফেলতে? নাকি অনাথ করা নবজাতকের জন্ম দিতে? নাকি তার মাথায় ঢুকিয়ে দিতে এসেছিল একটা মাকড়সা?
তিনি চোখে হাত বুজলেন। যদিও আঙ্গুলে খানিকটা ভেজা ভেজা আঠা আঠা অনুভব করলেন, তবুও বললেন, এসব কিছুই না, শুধু চিন্তাগুলো এমন ভাবে ঢুকে যায়, যা অনুভূতিকে বিন্যাস করে। কিন্তু চিন্তা কি কামড় দিতে পারে? মাকড়সার মতো কুটকুট করে সবকিছু খেয়ে ফেলতে পারে? লোভী পেট বানাতে পারে তার চিকনগলা-কোমর নিয়ে? এমন কি হয়? চিন্তাবিদের চিন্তা খেয়ে ফেলছে চিন্তার মাকড়সা? হায় খোদা! বুদ্ধিজীবীর মাথায় যেন এমন মাকড়সা না থাকে। হয়তো তাদের মাথা ঠিকই থাকে। যত মাকড়সা তার মতো মানুষের মাথায়। তার মতো অনাথ, নবজাতকের কপালে, দুর্ঘটনাবশত যাদের জন্ম, রাস্তায়, চিন্তাগুলো মাকড়সা হয়ে যায়, আট হাতপায়ে নাকে কানে ওঠে, মগজ খায়। কেমন হতে পারে? এই যে বেগম সাহেবা, বিলকিস বেগম, কই তুমি? ভাবতে পারছি না। চিন্তাগুলো কীট হয়ে গেছে। একটা কাজ দাও তো! কি সব ঘটে শুধু শুধু ভাবনায় ফেলাতে।
তিনি উঠে গিয়ে বউয়ের কাজে সাহায্য করতে লাগলেন। এই যে বিছানার চাদর উপরে উঠে গেছে, টেনে নিচে নামিয়ে ঠিক করে দিলেন।
– কি ব্যাপার!
তিনি মাথা তুলে তাকালেন, না কিছু না।
– চা খাবে?
– না বিছানায় একটু হেলান দেব।
– এই না বললে কি নাকি কাজ করবে?
– পরে।
হেলান দিয়ে বিছানায় থাকতে থাকতে তিনি ঘুমিয়ে গেলেন। একটা অদ্ভূত স্বপ্নে ধরফড়িয়ে উঠলেন তিনি। স্বপ্নে দেখলেন, দুর্ঘটনাস্থলে তিনি। ট্রাকের মতো মাথাঅলা একটা মস্ত জন্তু পাকা সড়কের বুক চিড়ে এসে লোকদের গায়ের উপরে উঠে গেল। ফোসফোস করে দাপাতে দাপাতে ট্রাক থেকে ঝিটকে পড়ল সেই মাকড়সাটা। পেটের নাড়িভুঁড়ি ফেটে বের হয়ে আসা নবজাতকের মাথায় বসল মাকড়সাটা।
ঘুম ভেঙে গেছে। ঘামছেন তিনি। উঠে ঠান্ডা পানি খেলেন। বউয়ের কাছে গিয়ে আবার বসলেন। নড়ে উঠলেন বউ। কি ঘুম হলো?
– বুকটা ধড়ফর করছে।
– দেখি, ব্যথা হচ্ছে নাকি? কতবার বলেছি ডাক্তার দেখাও। এই বয়সটা খুব খারাপ। না তুমি তা করবা না।
– আরে না না ওসব না। বাজে স্বপ্ন।
– এখনো বাজে স্বপ্ন দেখ? এই অসময়ে!
– গেলে আরেক দিকে।
তিনি উঠে গেলেন। দিন পার করলেন। সন্ধ্যা কাটালেন। এলো রাত।
ঘুমালেন। এবারও স্বপ্নটা এলো। মাকড়সাটি জাল বুনছে, লাফিয়ে যাচ্ছে সবচেয়ে বড় বিল্ডিংটার মাথা থেকে আরেক অট্টালিকার মাথায়। জন্তুটি পুত পুত করে শিশু মাকড়সা জন্ম দিচ্ছে আর জাল বুনে চলেছে। গোটা শহরটা জালে ঢেকে যাচ্ছে। তিনি স্বপ্নের ভেতর নিচে দেখলেন, তার নিচে, তারো নিচে, প্রতিনিয়ত রাস্তায় ধরফড়িয়ে পেট ফাটছে যাদের, তাদেরও মাথায় জাল। মৃত্যু ও জন্মের ভেতর ছড়িয়ে আছে জাল। আর তিনি জালের ভেতরের শিশু। তিনি ঘুম থেকে উঠলেন, মাকড়সারা জাল বুনছে। তিনি ঘুমালেন, মাকড়সারা জাল বুনছে। মেরুদণ্ড বাঁকা করে নির্বিকার চেয়ে থাকা হাসিহীন সেই নির্বাক শিশুটির দিকে তাকালেন, দেখলেন তিনি জালের ভেতর। খুব আফসোস হচ্ছে আবুবর সাহেবের। দেখলেন, ডাক্তারেরা ঘিরে আছে শিশুটিকে।
– হাসো তো মা। হাসো হাসো।
শিশুটি হাসে না। হাসি শেখাতে হবে তাকে। দেখেছ, কেমন গম্ভির ভাবে আছে? মা হাসো হাসো। ডাক্তার সাহেব বললেন।
একজন মোবাইলে চার্লি চাপলিন দেখছিলেন তখন, তিনি এগিয়ে এসে বললেন, এটা দেখালে হাসবে হয়ত শিশুটি। তিনি মোবাইলটি সামনে নিয়ে গেলেন।
-না কার্টুন দাও।
– এটাই চলুক স্যার, দেখবেন হাসবে।
আবুবর সাহেবও দেখতে লাগলেন। খুব সহজেই মেনে নেয়া দারিদ্রতা ও অভিজাতের বিদ্রুপ হাস্যরসে হাসছে সবাই। তাদের হাসি দেখে হেসে ওঠে শিশুটি।
– দারুণ দারুণ! হাসছে তো!
কেউ একজন একটা স্টান্ড এনে দেয় নবজাতকের বিছানার সামনে। সেখানেই মোবাইলটা হেলান দিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে। তারা গোল হয়ে ঘিরে দেখে শিশুটির তামাশা। শিশুটি এবার তাদের দিকে তাকায় আর মোবাইলে তাকায় আর হাত-পা নাড়া দিয়ে হাসে।
– ও-লে বাবা, ও-লে বাবা, এই তুই কি বুঝিস, হ্যা! দেখেছেন স্যার, কেমন করে হাসছে? মহিলা ডাক্তার বলে।
বড় ডাক্তার সহ সবাই দেখতে থাকে। সবাই হাসে। আবুবর সাহেবের খুব ভালো লাগে ব্যাপারটা। যদিও মাকড়সাটি তখনো তাদের মাথার ওপর দিয়ে জাল বুনে চলেছে নিয়ন্তর, তবুও তারা সেদিকে আর দৃষ্টি দেন না। এমনকি আবুবর সাহেবও দেখেন না। শুধু তিনি বড় একটা শ্বাস নিয়ে বুকে দম বন্ধ করে রাখেন। এরপর ধিরে ধিরে নিশ্বাস ছাড়েন আর চোখ বন্ধ করে ব্যাপারটা দেখতে থাকেন। দেখেন খুব মন দিয়ে, দেখেন যে, অনাথ নবজাতকটি মাকড়সার জালের ভেতর চার্লি দেখে হাঁসছে।
(ট্রাকচাপায় অন্তঃসত্ত্বা মায়ের মৃত্যু, জন্ম নিল নবজাতক সূত্রঃ ঢাকা পোস্ট, ১৬ জুলাই ২০২২, ০৬:২২ পিএম)
শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ
৬. অবৈধনামা
৫. দৃষ্টিহীনের নগ্নতা দর্শন
৪. রক্ত হিন্দু, রক্ত মুসলমান
৩. দুই নম্বর
২. শ্বশুর আমার ভিনদেশির মতো নজর নিছে
১. বেড়ালের স্পর্শ