বিছানায় ছটফট করছেন আবুবর সাহেব। সমানে ঘামছেন। বিলকিস বেগম ঘরে ঢুকেই দেখেন, বিছানার চাদর খামচে ধরে ওঠার চেষ্টা করছেন মানুষটা। আবুবর সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
– দেখো তো কেমন নখরা শুরু করেছে বাম পা।
বিলকিস বেগম বাম পা দেখতে লাগলেন। তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনসঙ্গী। টেবিল ধরে উঠতে গিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন বিছানা থেকে। তিনি দৌড়ে গিয়ে ধরলেন।
– দেখছ? কেমন আকাশমুখে খাড়া হইছে বুড়া আঙুল।
আবুবর সাহেব নিজে নিজেই পায়ের আঙুল নড়াতে চেষ্টা করলেন। বুড়ো আঙুল নড়ছে না। শুধু বুড়ো আঙুল নয়, গোটা পা-ই নড়ছে না।
শরীর এতোটা খারাপ হওয়ার কথা নয়। রাতের ঘুম ভালোই হয়েছিল তাঁর। তিনি বসার চেষ্টা করলেন। দু’হাতে ভর দিয়ে পাছাটা ছেঁচড়ে কিছুটা পিছিয়ে এলেন। শিথানের দিকে খাটের উঁচু ডাসায় বালিশ ঠেস দিয়ে পেছনে হেলান দিলেন। পা-টা বেশ ঠাণ্ডা হয়েছে। বিলকিস বেগম হাঁটুতে হাত বোলালেন, চিমটি কাটলেন। চিমটির ব্যথা টের পাচ্ছেন আবুবর সাহেব। তাহলে পা-টা একেবারে অবশ হয়ে যায়নি। একে একে পায়ের পাতা পর্যন্ত চিমটি কেটে দেখলেন, বোধশক্তি আছে পায়ের, শুধু বুড়ো আঙুল চেতনহীন। পা অবশ না হলেও এই বুড়ো মশাই অবশ হলেন কেন বুঝতে পারছেন না। কিছুটা ঘুরে কাত হলেন আবুবর সাহেব।
– আস্তে নড়ো। বিলকিস বেগম সাবধান করলেন।
ডানে-বামে হেলে নড়ার চেষ্টা করলেন আবুবর সাহেব। যেন আশি মণ ভারী বোঝা হয়েছে পা-টা। ইচ্ছাশক্তি লাগিয়ে আরেকটু জোর দিয়ে পা মোচড় দিলেন। হাঁটু মুড়ে ভাঁজ করার চেষ্টা করলেন। হলো না, বরং কোমরের কাছে কুট করে শব্দ হলো। এতে কোমরের কাছে জোড়াটা যেন কিছুটা ফাঁক হয়ে গেল।
– কই শুনছ? বিলকিস বেগম? শব্দটা শুনলে?
এরপর বিড়বিড় করতে থাকলেন, আশ্চর্য ব্যাপার, ভোট নিতে যাওয়ার কথা আজ, অথচ পা নড়ছে না।
স্বামীর এই অবস্থা দেখে বিলকিস বেগমের মুখ কালো হয়ে গেল। হাত দিয়ে টিপে টিপে আর আঙুলে ঠেসে ঠেসে কোমরের জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করলেন। জোড়াটার কাছে একটু গর্তমতোই মনে হচ্ছে। দু’পা সোজা করে ধরলেন। আবুবর সাহেব বললেন, দেখো তো, একটু লম্বা মনে হচ্ছে না বাম পা-টা?
– না না, ঠিক আছে।
তিনি পা-টা ধরে নিচে নামিয়ে দিলেন। কোনো গণ্ডগোল হইছিল ওঠার সময়? কামড় দিছে কিছু? নানা প্রশ্ন করে করে পা নাড়াচাড়া করতে থাকলেন বিলকিস বেগম।
– শুয়েই তো ছিলাম চিতপটাং। অথচ দেখো, কেমন ল্যাংড়া হইলাম।
– কী আজব মানুষ! এভাবে বলছ কেন? এটা কি খুশির কথা?
– খুশি হচ্ছি না তো।
– দুঃখও তো পাচ্ছ না। ভালো মানুষ একটা শুইলা, এমন কী হইল?
– এতোটা সমস্যা মনে হচ্ছে না। শুধু পঙ্গু পঙ্গু লাগছে।
– হায় আল্লাহ, কী কয় মানুষটা!
– ভোট নিতে যাওয়ার কথা আজ, আর দেখো, পা নড়ছে না। মনে হচ্ছে ভালোই হলো।
– বুঝছি তো। ভাবছ কেন এমন হইল বুঝি না? সব বুঝি।
বিলকিস বেগম ভাবছিলেন, ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার বাহানায় এমন করছে মানুষটা। এমনই স্বভাব তাঁর। কোন কাজ পছন্দ না হলে সেটা না করার নানান বাহানা করেন। কিন্তু আজকে স্বামীর এমন আচরণ তাঁর ভালো ঠেকল না। তিনি বেজায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। উঠে রান্নাঘরে গেলেন। তাঁর ধারণা, সরিষার তেল গরম করে পায়ে মালিশ করলে পা ঠিক হতে পারে। এরপর ছোট বোনকে রান্নাঘর থেকেই তিনি ফোন দিলেন।
– এই শুনছিস? তোর দুলাভাই পঙ্গু হয়ে গেছে।
– কী বলিস সকাল সকাল!
– হ্যাঁ, বাম পা গেছে। একেবারেই বোধশক্তি নাই। এখন প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে আছে। আবার কয় ভোট নিতে যাবে। দেখ তো কী করি!
– ডাক্তারের কাছে নিয়া যা। নিউরোলজি। জলদি। আরে আমাদের যে নিউরোলজি হাসপাতাল আছে না, সেখানে ভর্তি করে দে। আর তুই চিন্তা করিস না। আচ্ছা, ঢং করছে না তো? ওটা দুলাভাইর ঢংও হতে পারে।
– কী? কী কইলি তুই? ঢং করছে তোর দুলাভাই?
– না, এমনি কইলাম।
– মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে, আর তুই বলছিস ঢং করছে! তুই কী রে? এমনি কি প্যাঁচামুখ হইছে? ব্যথায়। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর।
– আহা, কী দরদ! মোবাইলটা দাও তো দুলাভাইকে?
বিলকিস বেগম মোবাইল ফোনটা স্বামীকে দিয়ে পায়ে তেল মালিশ করতে লাগলেন।
– হ্যালো, কি দুলাভাই? বউয়ের সেবা খাওয়ার জন্য পা ফুলে বসে আছেন?
– না রে শালি। তোর জন্য বসে আছি।
– আহা, কত শখ! চিন্তা করিয়েন না, ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, প্যাঁচামুখ করে বসে থাকবেন না। প্যাঁচা অশনি। হাসি হাসি ভাব করে থাকেন। আমি দেখি কী করা যায়। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেছি।
– না, লাগবে না ডাক্তার।
– লাগবে না মানে? একশবার লাগবে। এক্ষুনি আসছি।
– আচ্ছা। বলে আবুবর সাহেব ফোন রেখে দিলেন।
তিনি বুঝতে পারলেন, পাকনা শালি শুধু বকবক করতেই থাকবে। শালি আসার আগেই বাসা থেকে বের হতে হবে। তিনি এবার পায়ের দিকে মন দিলেন। নিজে নিজে পা নড়াবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ব্যথা অনুভব হচ্ছে না। তিনি কনুই দুটোকে তোশকের ওপর ভর দিয়ে উঠবার চেষ্টা করলেন। এতে মেরুদণ্ডে হালকা ব্যথা বোধ হলো। কিন্তু তিনি দমে গেলেন না। সর্বশক্তি দিয়ে তিনি চেষ্টা করলেন এবং খেয়াল করলেন যাতে অতিরিক্ত জোর-জবরদস্তি করে পা মুচড়ে না যায়। অবশেষে পা নামিয়ে মেঝেতে রাখলেন তিনি। কিন্তু বাম পা-টা ঠিকমতো মেঝেতে বসছে না। ডানে-বামে সরে যাচ্ছে পায়ের মাথা। পায়ের আঙুলগুলো স্যান্ডেলের ফিতার ভেতরে ঢুকছে না। হয় কোনো আঙুল বের হয়ে থাকছে, নয়তো পায়ের মাথা বাঁকা হয়ে থাকছে। এবার সত্যি সত্যিই ভয় পেলেন তিনি। সমানে ঘামতে লাগলেন।
বিলকিস বেগম পা ধরে স্যান্ডেলের ফিতায় ঢুকিয়ে দিলেন পায়ের পাতা। আবুবর সাহেব বিছানার কিনারে এসে দাঁড়াবার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু দাঁড়ালেন না। মোবাইল নিয়ে প্রধান শিক্ষককে ফোন করলেন। দ্বিতীয়বার কল হতেই ফোন ধরলেন স্যার।
– স্যার, মনে হয় প্যারালাইসিস হইল আমার। বাম পা নড়ছে না।
– শুধু বাম পা?
– জ্বি স্যার। কোমরের কাছে ফাঁক হয়ে গেছে।
– তাই নাকি! পা ফাঁক হয়ে গেল!
– জ্বি স্যার। একেবারে পঙ্গুদশা।
– প্যারালাইসিস হলে কথা বলতে গেলেও তো সমস্যা হয়। বাম হাত ঠিক আছে তো?
– জ্বি। অন্য সব ঠিক আছে। ভালো করে দেখেছি স্যার। এ অবস্থায় ভোটকেন্দ্রে যেতে পারব না।
– ও আচ্ছা, তাই বলেন। কিন্তু আর তো কোনো উপায় নাই আবুবর সাহেব। সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে গেছেন। কী যে সমস্যা তৈরি করেন আপনি। না না আবুবর সাহেব, আপনার দায়িত্ব আপনি পালন করেন দয়া করে। তাছাড়া এটা আপনার প্যারালাইসিস না। এটা মনের রোগ। বুঝলেন? আপনি যে ভোট নিতে যেতে চান না, তাই এমন হয়েছে। কিছুক্ষণ হাঁটেন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। একটা রিকশা নিয়ে চলে যান সকাল সকাল। শুধু তো বসে থাকা কাজ। চলে যান।
কথাগুলো বলেই ফোন কেটে দিলেন প্রধান শিক্ষক। কথাটা বিশ্বাস করেননি তিনি। তবে তাঁর জানা থাকা উচিত, ব্যক্তি আবুবর মিথ্যা বলেন না। তবু তিনি ক্ষমতা দেখালেন। জেদ দেখালেন আর কি। দ্বিতীয়বার ফোন দিতে ইচ্ছে হলো না তাঁর।
তিনি মুখটা শক্ত করে মনের শক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে লাগলেন পা নড়াবার। এবার কিছুটা নড়ছে পা-টা। একটু নড়লেই যেতে পারবেন। যেতেই হবে ভোটকেন্দ্রে। অন্য সময় হলে ঘাপটি মেরে থেকে যেতেন। কোনো কিছু না বলে ছুটি কাটাতেন। কিন্তু আজকে এমনটা করলেন না। প্রধান শিক্ষকের ট্যারা কথা শুনতে ভালো লাগে না। এমনিতেই তাঁর হাজারো অভিযোগ, কথা শোনেন না।
– আপনি তো নিজের মনমর্জিমতো চলেন আবুবর সাহেব। অফিসের একটা ডেকোরাম আছে, আপনি মানেন না। কোনো বিশেষ দায়িত্ব দিলে এড়িয়ে যান। অনেকেই আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে।
– এসব ঠিক না স্যার। যেটা ন্যায় আমি সেটাই করি।
– আপনি শুধু ন্যায় বোঝেন, আর অন্যরা সব অন্যায় বোঝে। সাধু মানুষ আপনি!
আবুবর সাহেব আর কথা বলেন না। এ জন্য প্রধান শিক্ষক ক্ষোভ নিয়ে থাকেন। তিনি চান মানুষটাকে আঘাত করে ভেতরের গুমটটা ভেঙে ফেলতে। পারেন না। তর্ক করেন না আবুবর সাহেব। চুপ করে থাকেন।
অন্তঃমুখী এই নিমগ্ন মানুষটাকে ভোট নিতে যেতে হবে। তিনি বাধরুমে গেলেন বিলকিস বেগমের কাঁধে ভর করে। দু’হাত প্রসারিত করে কখনো দরজায়, কখনো দেয়ালে আর বেসিনে হাত রেখে বাম পা ছড়িয়ে আস্তে করে বসলেন কমোডের ওপর। বিলকিস বেগম দরজা লাগিয়ে দরজার ওপাশে বসে আছেন। মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গিয়ে চুলার অবস্থা দেখে আসছেন।
অনেকক্ষণ কেটে গেল। বিলকিস বেগম এসে দেখেন, বাথরুমের ভেতর থেকে কান্না আসছে। শিশুর মতো কাঁদছেন মানুষটা।
– এই কী হলো? কাঁদছ কেন?
– না, কাঁদছি না।
– কাঁদছ না তো গুনগুন করছ কেন?
– আমি গুনগুন করছি না।
– তাহলে কে গুনগুন করছে?
– শিশুটা। মায়ের পেট ফেটে বের হওয়া শিশুটা।
– আবার তুমি সেই শিশুটা হয়ে গেলে? হায় আল্লাহ, পারি না মানুষটাক নিয়ে। তাড়াতাড়ি বের হও দয়া করে। সাবধানে পা ফেলবা। পারলে পা-টা এক হাতে ধরে বের হও, যাতে ঝুলে না যায়।
– কী বলছ তুমি? পা রেখে আসব নাকি? পা ধরেই আসতেছি?
পা ধরেই বের হলেন তিনি। কিন্তু তার দরকার ছিল না। কমোড থেকে ওঠার পরই বুঝতে পারলেন, পায়ে শক্তি এসেছে কিছুটা। পা কাজ করছে। তবে মনে হচ্ছে, যা ভেবেছিলেন তা-ই, ডান পায়ের চেয়ে বাম পা-টা একটু লম্বা হয়ে গেছে। তিনি আয়নার সামনে বেসিন ধরে সোজা দাঁড়ালেন। সত্যি, ডানে বাঁকা হয়ে হেলে দাঁড়াতে হচ্ছে। এতে পাছার বাম পাশ বাতাসে উঁচু করে রাখতে হচ্ছে। তিনি এ অবস্থায় হাত-মুখ ধুলেন। গোসল সারলেন। বেরিয়ে এসেই মনে হচ্ছে, মাথার চুলগুলো আকাশে হা-হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন মাকড়সার জালে আটকে আছে। তিনি বারে বারে মাথায় হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে চুলগুলো সোজা করার চেষ্টা করছেন।
– কী হলো?
– দেখো তো মাকড়সার জাল মাথায় আছে কি না।
– কেবল গোসল সেরে আসলে। মাথায় আবার মাকড়সার জাল থাকবে কেন? যাও খেতে বস।
অগ্যতা যেতেই হলো ভোটকেন্দ্রে। তবে বিলকিস বেগম তাঁকে যেতে না দেওয়ার হাজারো চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত যেতে দিলেন এই শর্তে যে, শুধুমাত্র হাজিরা দিয়ে তিনি ডাক্তারের কাছে যাবেন। তবে তিনি একা ছাড়লেন না। সহযোগী হিসেবে নাতি সম্পর্কের প্রতিবেশী মান্নানকে সঙ্গে দিলেন।
রিকশায় পা মুড়ে বসার পর তেমন সমস্যা মনে হলো না আবুবর সাহেবের। সহযোগী মান্নান তাঁকে রিকশা থেকে ওঠানামায় সাহায্য করছে। আবুবর সাহেব রিকশা থেকে নামার পর মাটিতে বাম পা-টা আলতো রেখে আরেক হাত মান্নানের কাঁধে রেখে কিছুটা লাফমতো দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলেন। যেন লাফাচ্ছে মানুষটা ব্যাঙের মতো। বাঁকা হয়ে লাফিয়ে হাঁটা মানুষ ছোট-বড় পায়ের তালে লাফিয়ে হেঁটে হেঁটে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ঢুকলেন।
– আরে কী হয়েছে আপনার? এই অবস্থায় এসেছেন কেন?
– দায়িত্ব বলে কথা। আসতেই হলো।
– আপনি ওদিকে গিয়ে বসেন স্যার। অসুস্থ মানুষ! সব ব্যবস্থা আমরা করছি। রেস্ট নেন আপনি।
আবুবর সাহেব তবু নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন।
একসময় হুড়মুড়িয়ে কিছু ছেলে ভোটকেন্দ্রে ঢুকল। বাধা দিলেন তিনি, না বাবারা, এভাবে ভোট দিয়ো না।
– চুপ! ল্যাংড়া খাটাশ আবার ফাল পাড়িস কেন?
পাশেই একজন থামিয়ে দিল। বলল, স্যার, আপনি মাস্টার মানুষ, নিজের সম্মান নিয়ে চুপচাপ থাকেন।
– বোঝেন তো, বাধা দিলে যা হবে, না দিলেও তা-ই হবে। অযথা হাঙ্গামা না করে ওদিকে বসে থাকেন।
তিনি তবু বাধা দিতে গেলেন। কিন্তু তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হলো। দুটো পা ভেঙে দেব শালা। চুপ থাক!
যেখানে পড়ে গেলেন, ঠিক সেখানেই যেন হেলান অবস্থায় থেকে গেলেন তিনি। চুপ হয়ে মাটিতে হেলান দিয়ে থাকলেন। যা তাঁর করার কথা নয় তা-ই করলেন। তিনি পানি খাওয়ার কথা বলে বাইরে চলে গেলেন। কিন্তু পানি খেলেন না। বরং খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বারান্দায় হাঁটতে লাগলেন। দেয়াল ধরে হাঁটছেন এমাথা-ওমাথা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হেসে ফেললেন তিনি। আজকে তাঁকে একটা খোঁড়া ঘোড়ার মতো লাগছে। যৌবনের তেজি ঘোড়া খুঁড়িয়ে হাঁটছে। কী দাপট ছিল তাঁর একসময়! ছেলেমেয়েরা সম্মান করত। অভিভাবকেরা প্রশংসা করত। এখন আর শিক্ষকের সম্মান আর দাপটের দিন নেই। এখন শিক্ষক খোঁড়া ঘোড়া। এই যে এরকম- বলেই তিনি লাফিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলেন। আচ্ছা, একজন শিক্ষকের ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটার দৃশ্য দূর থেকে দেখতে কেমন লাগে? নিশ্চয়ই দারুণ। না-হলে সবাই দূর থেকে মজা করে তাকিয়ে দেখে কেনো? কেউ তো কিছু বলে না। এগিয়ে আসে না। হয়ত তারা অপেক্ষা করে, আবুবর সাহেব একদিন কেঁচো হবেন আর এঁকেবেঁকে স্কুলের মাঠ দিয়ে ঘাসের ভেতর যেতে যেতে তলিয়ে যাবেন। তিনি স্কুলের একটা পিলার ধরে চোখ বুজে ভাবতে লাগলেন।
হই হট্টগোল শুনে একসময় তিনি ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন, ব্যালটে সীল মারার হুড়মুড়ি চলছে।
– পানি খেলেন? একজন জানতে চাইল।
তিনি কিছু বললেন না।
– ওই দিকে বসেন।
– না না বাবা, বসা লাগবে না।
একজন একটা কাগজ এগিয়ে দিল।
– অসুস্থ মানুষ, কতক্ষণ থাকবেন। এখানে একটা সিগনেচার করে চলে যান। বাকিটা আমরা করে নিচ্ছি।
– কিসের সিগনেচার? না না বাবা, এটা তোমরাই করে নাও।
– জানতাম, আপনি ট্যারা মানুষ। করবেন না। তাই আমরা করে নিয়েছি। এই যে দেখেন আপনার সিগনেচার করা রেজাল্ট শিট। কিন্তু আপনি এখন যেতে পারবেন না। যাবেন ছয়টার পরে। ভোট শেষ করে যাবেন।
– কেন?
– কেন মানে? সবকিছুর নিয়ম আছে না একটা!
– নিয়ম! নিয়মের গুষ্টি মারি। সব নিয়ম আমার ক্ষেত্রে? তিনি যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।
– চোপ! একজন হাত উঠিয়ে গালে প্রায় থাপ্পর বসিয়ে দিচ্ছিল। আরেকজন পাশ থেকে এসে সরিয়ে দিয়ে বলল, যান, অফিসে গিয়ে বসেন।
অগত্যা তিনি অফিস রুমে গিয়ে বসে থাকলেন। অফিস না, সেটা ছিল কমনরুম। লম্বা টেবিল বেঞ্চ বসা চিকণ রুম। নিজেকে বন্দি বন্দি মনে হচ্ছে তাঁর এখানে। পাশেই আরো কয়েকজন বসে বেহেস্তি হুর নিয়ে গল্প করছে। যারা গল্প করছে তারাও কি তাঁরই মতো চটকোনা খেয়ে এখানে এসেছে? নাকি সবকিছু জাহান্নামে ছেড়ে দিয়ে এখানে এসে হুর নিয়ে গল্প করছে? ইচ্ছে করছে না জানতে। অপমান নিয়ে ঘাটাঘাটির কী প্রয়োজন? বরং তিনি চুপ থেকে নিজের চিন্তার জগতে চলে গেলেন। মাইন্ড ডাইভার্ট! বাচ্চা মানুষ তারা ভুল করতেই পারে। তাদের ওপর রাগ-ক্ষোভ করা যাবে না। শিক্ষক মানুষ নম্র-ভদ্র থাকতে হয়। তিনি চোখ বুজে মাথা ঝিমিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। কিন্তু তাঁর রাগ দমন হচ্ছে না। রাগটা ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। সবকিছুই কি উচ্ছন্নে যাবে? বাঁধাও দেয়া যাবে না?
একসময় তিনি পেটমোটা মাকড়সার কথা ভাবতে লাগলেন। মাথা উঁচু করে অফিস ঘরের ছাদের দিকে মুখ করে তাকালেন। দেখলেন, চুন-সুরকির দুধফাটা হলদেটে দেয়ালের কোণে মাকড়সারা জাল বুনছে। অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, ছোট বড় অসংখ্য মাকড়সা। চারদিকে জাল বুনছে। একটা পেটমোটা বড় মাকড়সা ছোট একটা মাকড়সাকে ছুটে গিয়ে ধরল। সম্ভবত পুরুষ মাকড়সা ছিল ছোটটা। খেয়ে ফেলছে। তাঁর মনে হলো, সেই ছোট পুরুষ মাকড়সাটি যেন তিনি। হঠাৎ তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কেনো তিনি পেট মোটা মাকড়সার আহার হতে বসে আছেন? নো! এক মুহুর্ত আর বসে থাকা যাবে না। সহ্যের একটা সীমা আছে। এবার কেউ বাধা দিলে কষে একটা থাপ্পড় দিয়ে চলে যাবেন। মনের খেদে দাঁতে দাঁত কিড়মিড়িয়ে তিনি ভোটকেন্দ্রের উঠানটায় বেড়িয়ে এলেন। তারপরেই সশব্দে লাথি মারলেন, এতোটা পঙ্গু হয়ে যাইনি!
তিনি বাম পা দিয়েই মারলেন লাথিটা। লাথিটা ভোটবাক্সের গায়েও লেগে গেল এবং পালা করে রাখা বাক্সগুলো পা লেগে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। কিন্তু তিনি সেদিকে ফিরেও তাকালেন না। বরং অবাক হলেন, বাম পা সত্যি সত্যিই কাজ করছে এখন।
দেখলেন, মান্নান ছুটে এসেছে। ধমক দিয়ে থামালেন তাকে। তিনি মান্নানের কাঁধে হাত না দিয়ে একা নামলেন। হাঁটতে তেমন আর অসুবিধে হচ্ছে না। মনে হলো, লাথির উল্টো ধাক্কায় হয়তো খট করে বসে গেছে বাম পা। সত্যিই পা যেন ঠিক হয়ে গেছে। এবার হনহন করে তিনি হাঁটতে লাগলেন।
সবাই হেসে উঠল তাঁর কাণ্ড দেখে, বলল, শালা ভালোই অভিনয় জানে।
কে কী বলে বলুক, তিনি কান দিলেন না। তিনি হাঁটছেন আপন মনে। বুক চিতিয়ে রাস্তার মাঝ বরাবর হেঁটে যেতে যেতে একসময় থমকে দাঁড়ালেন। পেছন ফিরে মুখে একগাদা কফথুতু টেনে জড়ো করে থুঃ! মেরে ছুড়ে দিলেন। তারপরেই তিনি রাস্তার ডান পাশ ধরে হাঁটতে থাকলেন। হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে তাঁর। ফুরফুরে মেজাজে আপন মনে গুনগুন করে হাঁটছেন এখন।
শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ
৭. মাকড়সার জালে অনাথের হাসি
৬. অবৈধনামা
৫. দৃষ্টিহীনের নগ্নতা দর্শন