উন্নয়ন ঘটানোর পেছনে মানুষের সবচেয়ে বড় ইন্ধন কি? এক বা দু’লাইনে ব্যাখ্যা কর।
-ধীরে ধীরে স্বভাব সুলভ সুস্থিরতায় কাফিলউদ্দিন স্যার ব্লাক বোর্ডে প্রশ্নটা লিখলেন। স্যারের লেখা একদম টাইপ করা বাংলা সুতনি ফন্টের মত-ঝকঝকে স্পষ্ট।
এই যে স্যার ধীরে ধীরে আমাদের দিকে পিছন ফিরে সময় নিয়ে লিখছিলেন তবুও আমাদের দশম শ্রেনীর ৫২ জন ছাত্রের একজনও কোন সাইট টক করছিলাম না। স্যারের ব্যক্তিত্বই ওমন যা আমাদের চুপ হতে ভেতর থেকেই তাগাদা দেয়। ঠিক ভয় নয়, তা একধরনের আবেগ। আমরা স্যারের ক্লাশ মিস করতে চাই না। স্যারের এখন অনেক বয়স হয়েছে। উনি আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সচারাচর উনি ক্লাশ নেন না আজকাল। দশম শ্রেনীর কেবল এই বাংলা ক্লাশটিই উনি নেন। আমরা তার চমকপ্রদ, গল্পময় এবং অভিজ্ঞতা লব্ধ পাঠদান মিস করতে চাই না। আমরা সপ্তাহে অন্তত তিনটি দিন ওনার ক্লাশে বসে মুগ্ধতায় ভরাতে চাই আমাদের মস্তিস্ক।
স্যার বললেন, তোমাদের হাতে থাকবে মাত্র তিন মিনিট সময় । বোর্ডে লেখা এই প্রশ্নের উত্তর তিন মিনিটের মধ্যে যে যে লিখে আনতে পারবে তাদের উত্তরগুলো আমি পড়ে শোনাবো এবং আলোচনা করবো।
এদিক ওদিক তাকিয়ে সেকেন্ড বয় সুধিরকে দেখলাম সে লেখা শুরু করে দিয়েছে । মুখস্ত বিদ্যা বিশারদ ফার্স্ট বয় অপু দেখলাম উঠে দাঁড়িয়ে স্যারকে প্রশ্ন করলো, স্যার এটা কোন প্রবন্ধের থেকে নেয়া একটু কি বলবেন তাহলে হয়তো অনেকের সুবিধা হতো ?
স্যার এক গাল হেসে বললেন – এটা বাস্তবতা থেকে নেয়া, বইয়ের কোন গল্প থেকে নয় । অপু ‘ধন্যবাদ স্যার’ বলে বসে দ্রুত লেখা শুরু করে দিলো। আসলে তিন মিনিটের মধ্যে ক্লাশের প্রথম তিনজনকে তো অবশ্যই লিখতে হবে । একটা প্রেসটিসের বিষয়।
এর মধ্যে আমি লিখে ফেলেছি। আমি ক্লাশের থার্ড বয় । হঠাৎ আফিফ উঠে দাঁড়ালো কিছু জিজ্ঞেস করতে। আফিফ হচ্ছে আমাদের ক্লাসের জোকস পিটারা মানে কৌতূকের ভান্ডার । বুদ্ধিমান এবং পড়ালেখায় মোটামুটি ভালোই, তার রোল নম্বর তেরো। আফিফ বললো- স্যার অয়ন মানে পথ বা সূর্যের গতিপথ এইরক কিছু আর উন মানে কম তারমানে উন্নয়ন কি কম পথ – এমন কিছু …
স্যার আফিফকে ভালো করেই চেনেন, সে স্কুলের পক্ষে আন্ত স্কুল সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতায় গতবছর থার্ড হয়েছিলো। স্যার বললেন তোমার লিখতে হবে না।
ক্লাসে একটা হাসির রোল পড়ল দুই সেকেন্ড তারপর সবাই চুপ।
আমি ওপাশের বেঞ্চে একসাথে বসে থাকা ক্লাশের সবচেয়ে পোংটা গ্রুপের একজনকেও কলম নাড়াতে দেখলাম না। ওদের লেখা স্যার সবার সামনে না পড়লেই তো তারা খুশি।
একটু সামনের বেঞ্চের বাম কিনারে বসে থাকা আতেল গ্রুপের লিডার রহমতের দিকে তাকালাম । সেও লিখছে ।রহমত ক্লাসের পঞ্চম বয় মানে রোল তার পাঁচ। আর ক্লাশের সবচেয়ে অমায়িক ছেলে মুরাদকে দেখলাম উঠে স্যারের কাছে গিয়ে কাগজ জমা দিচ্ছে । ওর রোল চার।
স্যার টেবিলের মৃদু টোকা দিয়ে বললেন – সময় শেষ । তার আগে অবশ্য স্যারের হাতে পাঁচটি কাগজ জমা পড়েছে । কোয়েন্সিডেন্টলি ক্লাশের প্রথম পাঁচ রোল নম্বরধারীই জমা দিয়েছে ।
আরও চারজন হাত তুলে বললো, স্যার শেষ – জমা দিতে পারবো।
স্যার সে গুলো জমা নিলেন। কিন্তু সেগুলো ক্লাশে পঠিত হবে কিনা তা পরে নির্ধারণ করবেন জানালেন।
স্যার টেবিল থেকে হাতে নিলেন তার ডায়েরীটা। সেখানে পেছনের পাতায় একটা কিছু লিখলেন । তারপর বললেন – এইখানে আমি আমার নিজের উত্তরটি লিখে রাখলাম। তোমাদের মধ্যে তিন মিনিটে যে পাঁচজন উত্তর জমা দিয়েছো তার মধ্যে যার উত্তর আমার সাথে মিলবে তার জন্যে আজ আমার বিশেষ একটা উপহার থাকবে। উপহার হলো এই যে আমার এই হাতের ঘড়িটি। কেনো দেবো সেইটা বলবো দেয়ার সময় ।
স্যার এবার পাঁচটি উত্তর হাতে নিলেন। প্রথমে খুললেন মুরাদের উত্তর এবং পড়লেন-
‘ মানুষের উন্নয়ন ঘটানোর পেছনে সবচেয়ে বড় ইন্ধন ক্ষুধা। ক্ষুধা মেটানোর জন্য মানুষ কাজ করে । কাজে উন্নতি করে , সমাজ রাষ্ট্রে উন্নয়ন ঘটায় যাতে কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দর করে করা যায় এবং ভালোভাবে ক্ষুধা মেটানো যায়’
দ্বিতীয় উত্তর তিনি পড়লেন যা সুধিরের লেখা –
‘ মানুষ উন্নয়ন ঘটায় কারণ মানুষ সুখ শান্তি চায় । সুখ শান্তির জন্যে মানুষ সব রকমের উন্নয়ন কান্ড করে । উন্নত পরিবেশ সৃষ্টি করে সেখানে মনকে বিনোদিত ও প্রশান্ত করতে চায়।’
তৃতীয় উত্তরটি পড়লেন রহমতের-
‘ মানুষের মধ্যে অর্থের লোভ মানুষকে উন্নয়ন ঘটাতে ইন্ধন যোগায়। উন্নয়ন ঘটলে বেশি অর্থ আয়ের উপযোগিতা ঘটবে। অর্থই সকল অনর্থের মূল এরকম পুস্তকে লেখা থাকিলেও বাস্তবে অর্থই হয়ে ওঠে উন্নয়ন কর্মকান্ডের নিয়ামক তথা ইন্ধন।’
এখনও আমারটা স্যার হাতে নিলেন না। অপুরটা এখন স্যারের হাতে । তিনি পড়লেন-‘ মানুষ সামাজিক জীব, সমাজবদ্ধ হয়ে মানুষ ধীরে ধীরে সমাজকে বড় করেছে, সমাজ থেকে রাষ্ট্র বানিয়েছে । সমাজ গঠনের তাগাদায় মানুষ সমাজকে সমৃদ্ধ করেছে – উন্নয়ন ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ হয়েছে। উন্নত রাষ্ট্র সহজে জয় পেয়েছে। উন্নত রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি মানুষের আকর্ষন বেড়েছে। সেদিকে মেধা ধাবিত হয়েছে। উন্নয়ন ও প্রযুক্তি তরান্বিত হয়েছে। আসলে মানুষের এই সমাজবদ্ধতা ও জয়ের আকাঙ্খা মানুষকে ক্রমাগত উন্নয়ন ঘটাতে ইন্ধন জুগিয়েছে।’
এবার স্যার আমার লেখা হাতে নিলেন । ঠিক সে সময় জুনায়েদ উঠে বললো স্যার আমি কিন্তু সাড়ে তিন মিনিটে জমা দিয়েছি। আমাদেরগুলোও পড়েন। আমার মনে হয় আমারটাই আপনার লেখা উত্তরের সাথে মিলবে – আমি কিন্তু লিখেছি মানুষ উন্নয়ন ঘটায় কারণ মানুষকে সৃষ্টিকর্তা উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষমতা ও ইচ্ছা দিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তাও চান মানুষ উন্নয়ন ঘটাক …
স্যার শুনেলন তার কথা তারপর বললেন কিন্তু তুমিতো তিন মিনিটের মধ্যে জমা দাও নি। হয়তো সৃষ্টিকর্তা চান না তোমারটা পড়া হোক।
স্যার এখন আমার লেখার দিকে তাকিয়ে দেখলেন তারপর বললেন, আমি আমার উত্তরের হুবহু লেখা পেয়ে গেছি । তিন মিনিটের পরে জমা দেয়াগুলো আর পড়ার দরকার হবে না।
স্যার আমার লেখা পড়লেন- ‘ উন্নয়ন ঘটানোর পেছনে মানুষের মূল ইন্ধন পারস্পারিক প্রতিযোগিতা। তা সে উন্নয়ন ব্যক্তিগত হোক কিংবা সামাজিক। কারণ প্রতিযোগিতা নেই এমন এক গ্রহে যদি একদল মানুষকে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে আসলে মানুষ ক্রমাগত উন্নয়ন করার কোন ইন্ধনই পাবে না। ‘
স্যার তারপর তার ডায়েরী খুলে সকলকে দেখালেন। সেখানে স্পষ্ট করে লেখা সুতনি ফন্টের মত টাইপ করা গোটাগোটা অক্ষরে –
‘ উন্নয়ন ঘটানোর পেছনে মানুষের মূল ইন্ধন প্রতিযোগিতা।’
ক্লাশের সবাই অবাক বয়ে তাকিয়ে আছে কিভাবে সম্ভব!স্যার বললেন আমি পলাশকে দেখেছি লাইব্রেরীতে বসে আমার লেখা ‘প্রতিযোগিতা’ বইটি পড়তে। তাই অন্তত সে আমার ভাবনানুযায়ী উত্তর লিখতে পারবে এটা জানতাম।
কয়েকজন একসাথে বলে উঠলো, তাইলে স্যার আপনি জেনে শুনে পরীক্ষা নিচ্ছেন কেনো । আপনার তো ফলাফল আগে থেকে জানাই ।
স্যার বললেন, আমি তো সবজান্তা না , কেবল জানতাম একজন পড়েছে। বাকী ৫১ জন যে পড়েনি সেইটা জানলাম এখন এই পরীক্ষা নিয়ে। আসলে এই ঘড়িটা আমি আমার এক প্রিয় শিক্ষকের কাছ থেকে পেয়েছিলাম । তিনি আমার বইটি পড়ে খুব খুশি হয়ে আমাকে এই ঘড়িটি হাত থেকে খুলে দিয়েছিলেন আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে। উনি আজ বেঁচে নেই। কিন্তু উনি আমাকে বলেছিলেন আমার বইটি অন্তত কিছু ছাত্রকে পড়তে উদ্ভুদ্ধ করতে। আমি কাউকেই কখনও আমার বইটি পড়তে বলি না- আমি লজ্জাবোধ করি। এই ক্লাশ টেনই আমার শেষ বছর । আগামী বছর আর আমি কোন ব্যাচ পড়াতে পারবো না। তাই এই ক্লাশের কাউকে আমি ঘড়টি দিতে চেয়েছি। সেই সাথে বাকী চারজনের উত্তরও যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত, কখনও বইটি আবার পুন প্রকাশ করলে তোমাদের লেখাগুলো নিয়ে তাতে আলোকপাত করবো অবশ্যই ।
আমি উঠে প্রায় কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম, কিন্তু স্যার আমি তো এই পুরষ্কার নিতে চাই না। আপনি তো আগেই ডিসাইড করে রেখেছেন কাকে দেবেন । এটা তো আমার অর্জন নয়!
স্যার বললেন – তাতো ঠিক করে রেখেছিই বোকা। পরীক্ষা না নিয়েও তো তোকে দিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি তো জানি না আর কেউ সমান হকদার কি না , আর কেউ পড়েছে কিনা – সেটা যাচাই করলাম পরীক্ষাটা নিয়ে । এখন তোরই প্রাপ্য।
ঘড়ি নিতে নিতে আমি কেঁদে ফেললাম। অপু এসে আমার কাঁধে হাত রাখলো ।
আফিফ হাত তুলে বললো – স্যার একটা জোকস বলি – একবার পাপ্পু চোরা এক সন্ধ্যায় দৌড়াইতে দৌড়াইতে তার ওয়াইফের কাছে আইসা বললো, দেখছো আমি দৌড় প্রতিযোগিতায় এই স্যামসং মোবাইলটা জিতছি। রাইতে রাইতে যে আমি দৌড়ায় সেইটা আজ কাজে লাগছে।
ওয়াইফ বললো- প্রতিযোগিতায় ক’জন দৌড়াইছিলো –
পাপ্পু বলল- আমি , একজন মোবাইল দোকানদার, মার্কেটের দারোয়ান আর দুইজন পুলিশ ।
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আমিও । আমার হাতে তখন স্যারের সেই অভাবনীয় ঘড়িটি আঁকড়ে ধরে আছি।