নানা কারণেই কিন্তু মিনহাজ টের পায় যে সে বড় হয়ে যাইতেছে।
বড়াল নদীতে গোসল করার সময় মিনহাজ যখন খ্যাড় দিয়া নিজের হাত পা ডলে তখন কিন্তু সে টের পায় যে তার হাত-পা ঠিক শিশুদের মতো আর কোমল নাই। তার হাত পায়ের চামড়া খুব খসখসা আর তার ভেতরের মাংসপেশি খুব শক্ত হয়ে উঠতেছে। সে তার হাত আর পায়ের পেশিতে পেশিতে অমিত শক্তির খবর পায়। ওরা বুঝি তাকে ডেকে বলে যে আমরা তৈরি আছি।
যেদিন সন্ধ্যাবেলা রশিদ কন্টাক্টারের ধানের চাতাল থেকে ফেরার সময় বিলবকরীর মাথায় ধনুকের মতো ব্যাঁকা জোড়া তালগাছের কাছে এসে তার মা মাথা ঘুরে পড়ে যায় আর লোকজনের ডাকাডাকিতে মিনহাজ যখন সেখানে পৌঁছয়, আর যখন বিলবকরীর ছয়টা ব্যাঁকা তালগাছওয়ালা বাড়ির দাওয়ায় বসে থাকা নারাণ কাকা তাকে ডাক দিয়ে বলে যে, ‘মিনহাজ, তুমার মা তো মাথা ঘুরে পড়ে গ্যাছে, আমরা পানি পুনি দিছি, এখন সে ইট্টু সুস্থ, তাও তুমি বরং কোলে করেই তুমার মাক লিয়ে যাও বাপু’, তখন কিন্তু সে চিন্তাও করেনাই যে সে তার মাকে কোলে নিয়ে এতোখানি পথ হেঁটে যাইতে পারবে। কিন্তু নারাণ কাকা যে কোলে করে নিয়ে যাইতে বলল, তাইলে নারাণ কাকা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে যে সে তার মাকে কোলে করে নিয়ে যাবার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হইছে, বড় হইছে।
যতদূর মনে পড়ে, আসলে এতোখানি পথ মাকে সে কোলে করে নিয়ে যাইতে পারবে কি না তা পরীক্ষা করার আকাক্সক্ষায়ই সে তার মাকে কোলে করে বিলবকরীর ব্যাঁকা তালগাছ থেকে বাড়ি পর্যন্ত বয়ে আনে। আর বাড়িতে এনে চকির উপর শোয়ানোর সময় সে পিদিমের আলোয় দেখে তার মা তার দিকে ভীষণ অবাক আর প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকায়। মা’র চোখে এরকম দৃষ্টি সে কোনওদিন দেখেনাই। হয়ত তার মাও প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে, যে ব্যাটা তাকে কোলে করে এতো রাস্তা নিয়া আসল, সেই ব্যাটার উপর নির্ভর করার দিন এসে গেছে।
মা’র সেই দৃষ্টি দেখে অথবা বিলবকরীর ব্যাঁকা তালগাছ থেকে বাড়ি পর্যন্ত মাকে সে অবলীলায় বয়ে আনতে পারছে, এইটা বুঝতে পেরে অথবা চকির উপর ভাঁজ করে ও বিছায়ে রাখা ছেঁড়া কাঁথাগুলা দেখে প্রথমবারের মতো ‘তারা হয়ত গরিব হয়ে যাচ্ছে’ এই বুঝ আসার কারণে সে প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে যে সে বড় হয়ে যাচ্ছে।
তবে ঠিক কোনটার কারণে বড় হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তার নিজের কাছে পরিষ্কার হয় তা সে কিছুতেই নির্ণয় করতে পারেনা। কারণ এরই মধ্যে আরও কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ভাবনা তার এই নির্ণয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভাবনাগুলা হচ্ছে, সেইদিনই সে প্রথম খেয়াল করে যে তার মায়ের শরীরটা ভীষণই পলকা। বলতে গেলে কোনও ওজনই নাই। আর তার সুন্দর মায়ের মুখের চামড়াটা কেমন কুঁচকায় গেছে, খসখসা হয়ে গেছে। আর সেইদিনই তার প্রথম মনে হয়, সে তার মা’র মুখের দিকে কোনওসময় তাকায়ে দেখেনা। তার হয়ত ছেলে হিসাবে মা’র দিকে আরও বেশি তাকানো উচিত ছিল, কিন্তু সে তা করতেছেনা। আর সে তার ক্ষুদ্র জীবনে প্রথমবারের মতো ভাবে, তার মা কি তবে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেনা?
বয়সে ছোট হলেও একটা কথা অবশ্য মিনহাজ বেশ কয়েক বছর ধরেই খুব স্পষ্ট করে জানে যে আগে গ্রামের মধ্যে তাদের প্রতিপত্তি ছিল, আর তার মা ভালো ভালো রঙিন আর দামী কাপড় পরত আর তাদের বাড়িতে অনেক লোকজন আসত, থাকত, খাইত-পরত। কারণ তার আব্বা সৌদি আরব থেকে টাকা পাঠাইত। আর মিনহাজকে সাথে নিয়ে মিনহাজের মা প্রতিমাসে মোশাই কাকার ভ্যানে চড়ে সদরে গিয়া পোস্ট অফিস থেকে টাকা তুলে নিয়া আসত। কিন্তু তার আব্বা সৌদি আরব থেকে এখন আর টাকা পাঠায়না। ক্যান পাঠায়না, তা অবশ্য মিনহাজ কোনওদিন কাউকে জিজ্ঞাসা করেনাই। আর মাকে কোলে করে নিয়ে আসার দিনই মিনহাজ প্রথমবারের মতো মনে করতে পারে যে তার আব্বার টাকা পাঠানো বন্ধ হবার পর থেকেই তার মা’র হাসিও বন্ধ হয়া গেছে। আর তার দাদীর হাসিও বন্ধ হয়া গেছে। সত্যিই তো। তার দাদী শুধু পথের শেষে বিলবকরীর ব্যাঁকা তালগাছগুলার দিকে সারাদিন তাকায় থাকে আর মাঝে মধ্যে নিঃশ্বাস ফেলায়। মিনহাজ মনে করতে পারে যে তার মা আগে সবসময়ই হাসত। হয়ত আব্বার সাথে মা’র ঝগড়া হইছে। তাইলে দাদীর সাথেও কি আব্বার ঝগড়া হইছে? দাদীও তো আগে খুব হাসত। হয়ত আব্বা সবার উপর রাগ করে টাকা পাঠানো বন্ধ করছে। তার আব্বা কি তাইলে তার উপরেও রাগ করছে? বুবুর উপরও রাগ করছে? বুবুকে তো আব্বা খুবই ভালোবাসে।
আর তখন মিনহাজের মনে পড়ে, দুই বছর আগে তারা যখন তিনমাস পার হবার পরও দেখল যে তার আব্বা কোনও টাকা পাঠাইলনা কিংবা কোনও চিঠিও দিলনা, আর যেদিন তার ছোটকাকী তার মেজকাকীকে বলল যে, ‘দেখগা ভাইজান হয়ত কুনু আরোবী মেয়া শাদি করে বইসে আছে’, তখন মিনহাজের মা তাদের নিয়ে তার নামে মিনহাজের আব্বা অনেকদিন আগে খোনকার পাড়ার দক্ষিণ পাশে যে ভিটা কিনছিল, সেইখানে এসে ওঠে। সেইখানে একটা ঘরই কিছুটা ঠিকঠাক ছিল, আর বাকী ঘরগুলা ভাঙাচোরা ছিল। আর সেই কিছুটা ঠিকঠাক ঘর আরও কিছুটা ঠিকঠাক করে তারা সেইখানে সেইদিন থেকে থাকা শুরু করে। তার কয়দিন পর থেকে তার মা রশীদ কন্টাক্টারের ধানের চাতালে কাজ করতে যাইতে শুরু করে। আর তার কয়দিন পর তার মা মোশাই কাকার ভ্যানে করে মিনহাজদের আগের বাড়ি থেকে তাদের আলমারী আর একটা ট্রাঙ্ক আর কয়েকটা অন্যান্য জিনিস নিয়ে আসে। মিনহাজদের একটা সুন্দর খাট আর আরও কিছু জিনিস ছিল কিন্তু মিনহাজের দুই কাকা যখন বলে যে তাদের ভাইয়ের জিনিসে তাদেরও হক আছে তখন মিনহাজের মা আর কিছু আনেনা। আর তার পরের বছর মিনহাজের বোন ইয়াসমিন কুষ্টিয়ায় তাদের এক মামার বাড়িতে চলে যায়।
এই কথাটা মনে হলেই মিনহাজের খুব রাগ লাগে। বুবু ক্যান মামার বাড়ি চলে গেল? এই বাড়িতেই তো সে থাকতে পারত। জায়গা তো আছে। নাহয় আরেকটা ঘর ঠিকঠাক করে নেয়া যাইত। মিনহাজ নিজেই ঠিক করে দিতে পারত। চালের কয়েকটা টিন বদলায় দিলে আর ঘরের তিনটা খুঁটি নতুন করে বসায় দিলেই হইত। আর মামার বাড়ি বেড়াতে গেলে কি আর আসা যায় না? আর কুষ্টিয়ায় তাদের কোন মামা থাকে, সেই মামার নাম কী, তাও তো মিনহাজ জানেনা। মিনহাজ কোনওদিন সেই মামাকে দেখেনাই। মাকে জিজ্ঞাসা করলে মাও কিছু কয়না। হয়ত মার সাথে বুবুর ঝগড়া টগড়া হয়ে বুবু রাগ করে চলে গেছে, আর আসতেছে না। হয়ত মিনহাজ আনতে গেলে বুবু সব রাগ ভেঙে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসবে।
মার সাথে মিনহাজের আর তার দাদীর কোনওসময় ঝগড়া হয় না। মিনহাজ অবশ্য পাড়ার এক চাচীকে তার দাদীকে জিজ্ঞাসা করতে শুনছে যে তার দাদী ক্যান তার অন্য ব্যাটাদের সাথে না থেকে যে ব্যাটা তাদের সাথে এতো বড় বেঈমানী করল তার বউয়ের সাথে থাকে। মিনহাজ বুঝতে পারে, চাচী তার আব্বার কথা বলতেছে। মিনহাজের প্রথমে চাচীর উপর একটু রাগ হইলেও পরে তার মনে হয়, ঠিকই তো, তার বাপ তো একটা বেঈমানই। সে ক্যান আর টাকা পাঠায় না? তার কি টাকা শেষ হয়া গেছে? টাকা শেষ হয়া গেলে সে চলে আসলিই তো পারে। তার আর সৌদি থাকার দরকার কী? নাকি সত্যিই তার আব্বা আরোবী মেয়া শাদি করছে?
এসব কথা মনে আসার কারণেই হয়ত প্রথমবারের মতো মিনহাজের মনে হয়, সে বড় হয়া যাইতেছে। কারণ তার কাছে মনে হয়, এগুলা সব বড়দের কথা। আর এ কারণেই সে এসব কথা দাদীকে কিংবা মাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেনা। কারণ তারা তাকে এখনও ছোটই মনে করে। খুবই ছোট মনে করে। তবে বুবু থাকলে সে বুবুকে জিজ্ঞাসা করতে পারত। বুবু তো বড়, আর বুবু তখন দাদী কিংবা মা’র সাথে আলাপ করে মিনহাজকে পরে জানাইতে পারত, আসলে তার বাবার ব্যাপারটা কী?
অবশ্য প্রথম কখন তার মনে হয় যে সে বড় হয়ে যাইতেছে তা মিনহাজ কিছুতেই মনে করতে পারেনা। তার মনে পড়ে তার দাদী তাকে দুইতিন দিন আগে বলছিল যে, ‘ওই ছ্যামড়া, আর কতদিন মা’র কামাই খাবু? নিজির গা গতর দেখতি পাস না? বড় হসনাই? ডাঙর ব্যাটা থাকতি মা ক্যান কামাই করে, লজ্জার কথা না?’
সেইদিন মিনহাজ বড়াল নদীর ঘোলা পানিতে গোসল করতে গিয়া নিজেকে অনেকখানি আবিষ্কার করে ফেলে।
চৈত্রমাসে বড়াল নদীর পানি পুরাপুরি শুকায় যাবার আগেই অন্তত ভাঙ্গুরা থেকে বনওয়ারীনগর পর্যন্ত তিনশমণি নৌকা চলার মতো যথেষ্ট গভীরতা বজায় রাখার জন্য সোনাহারার কাছে বড়াল আর কালিগঙ্গা নদীর ত্রিমোহনীতে বাঁধ দিয়ে দেয়া হয়। তখন স্রোত হারানো বড়াল নদীর পানি উচ্চতায় কিছুটা বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে টলটলে সবুজ হয়ে আসে। তখন নদীতে গোসল করতে গিয়ে মিনহাজ দেখছে, নদীর তলা পর্যন্ত প্রায় স্পষ্ট দেখা যায়। আর তখন গোসল করতে নামলে পানিতে গা আড়াল হয় না, নিচে সব দেখা যায়। আবার বরষার আগে বাঁধ কেটে দিলে স্রোতস্বিনী বড়াল আবার ঘোলা হয়ে ওঠে। তখন পানির ছয় ইঞ্চি নিচে কী আছে তাই আর দেখা যায় না।
সেদিন বাড়ি থেকে বের হয়ে বিলবকরীর জোলা বরাবর বড়াল নদী পর্যন্ত বিলম্বিত রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে মিনহাজ নারাণ কাকার বাড়িতে গরু খাওয়ানোর জন্য কেটে আনা কড়চার ডাঁটার স্তুপ থেকে কয়েকটা মোটা সোটা ডাঁটা তুলে নিয়ে চিবাতে চিবাতে হাঁটতে থাকে। কড়চাকে অনেকটা কুশাল বলে চালানো যায়। খালি তফাৎ হল, কড়চা খুব চিকণ। কিন্তু কুশালের মতোই গিঁট আছে আর কুশালের মতোই শক্ত চোঁচা ছুললে ভেতরে মিষ্টি শাঁস আছে। সেগুলাও কুশালের মতো চাবায়ে রস চুষে নিয়ে ফালায় দিতে হয়। তবে এগুলা খালি গাঁয়ের গরিব মাইনষের ছাওয়ালপালই কুশাল মনে করে খায়। বড়রা কিংবা ধনী মাইনষের ছাওয়ালপাল এগুলা খায় না। আর তখন মিনহাজের মনে পড়ে যে সে অনেকদিন কুশাল খায় না। আর তখন গরুর খাওয়ার জন্য কেটে রাখা সামান্য মিষ্টি মিষ্টি কড়চার ডাঁটা চাবানোর কারণে তার খুব লজ্জা লাগে।
আর তখন মিনহাজের মনে হয় যে তারা আসলে গরিব। তার মনে হয়, সে থাকতে তার মা রশীদ কন্টাক্টারের ধানের চাতালে সারাদিন পরিশ্রম করে। আর তার মা এতো পরিশ্রমের পর সামান্য কয়টা টাকা পায়। আর রশীদ কন্টাক্টার খুব ভালো মানুষ। সেইজন্য উনি মাঝে মধ্যে তার কামলাদের বিনা পয়সায় কিছু ধানের তুষ দেয়। আর তার দাদী সারাদিন ধরে সেই ধানের তুষ উড়াইলে তার মধ্যে থেকে এক পোয়া কিংবা আধ পোয়া চাল পাওয়া যায়। রশীদ কন্টাক্টার খুব ভালো মানুষ, তবু মিনহাজের ক্যান জানি রশীদ কন্টাক্টারের উপর খুব রাগ হয় আর সেই রাগে সে কড়চার ডাঁটাগুলা মটাৎ করে ভেঙে বিলবকরীর জোলায় ছুঁড়ে ফেলায় দেয়। কিংবা হয়ত এতক্ষণ ছোছার মতো এই কড়চার ডাঁটা সে চাবায় দেখে তার খুব রাগ লাগে।
আর তখন দাদীর বলা কথাটা নানাভাবে মনে মনে নাড়াচাড়া করে মিনহাজ। সে তবে বড় হইছে। তার মনে পড়ে, সে বেশ অনেকদিন, হয়ত অনেক বছর তার আব্বাকে দেখেনা। তার আরও মনে পড়ে, এর মাঝে অনেক রাতে ঘুম ভেঙে উঠে তার মাকে সে নিঃশব্দে কাঁদতে দেখছে। আর তার দাদীকে সে প্রকাশ্যেই কাঁদতে দেখছে। আর আজকে বিলবকরীর জোলা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বড়াল নদীতে পৌঁছানোর আগেই মিনহাজ বড় হয়ে যায়।
তার ক্ষুদ্র জীবনে প্রথমবারের মতো গড়ায়ে যাওয়া দুপুরে গোসল করতে আসলে মিনহাজ দেখতে পায় বড়াল নদীর দুইপাড়ের গ্রামগুলা থেকে কেবল মেয়েরা গোসল করতে আসছে। পুরুষরা দুপুরের আগেই গোসল শেষ করে চলে যায়। সে অনেক দেরিতে আসছে। গাঁয়ের মেয়েরা ভাত রেঁধে পুরুষদের খাওয়ায়ে দাওয়ায়ে তারপর গড়ায় যাওয়া দুপুরে গা ধুইতে আসে, কিংবা কেউ কেউ হয়ত সাবান মেখে গোসল করতে আসে। আর আজকে তারা মেয়েদের মাঝে ‘বড় ও পুরুষ মানুষ’ মিনহাজকে গোসল করতে আসতে দেখে লজ্জা পায়।
আর তখন মিনহাজ দেখে যে সাবেরা কাকী গা থেকে ব্লাউজ খুলে নদীর পানিতে ধুইতেছিল, আর নির্জন নদীর পারে আশে পাশে কোনও পুরুষ না থাকায় কাকী বেশি সাবধানীও ছিল না। আর তখন সাবেরা কাকী অসময়ে মিনহাজকে আসতে দেখেই চট করে ঘুরে দাঁড়ায়। আর বড়াল নদীর ঘোলা পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবায়ে দিয়ে সাবেরা কাকী লজ্জা ঢাকে আর তারপর মিনহাজের দিকে ঘাড় ঘুরায়ে তাকায়ে জিজ্ঞাসা করে সে গোসল করতে আসছে কি না। আর তখন সে বলে, হ কাকী।
মিনহাজ আশে পাশে আর কোনও পুরুষের খোঁজে তাকায়, কিন্তু আর কোনও পুরুষকে দেখতে না পেলেও সাবেরা কাকীর লজ্জা পাওয়া দেখেই সে বুঝতে পারে যে কাকী আসলে তাকে দেখেই লজ্জা পাইতেছে আর তখন সে বুঝতে পারে, সে আসলে বড় হয়া গেছে।
তখন সে লক্ষ করে, খালি সাবেরা কাকী না, এপারে আর ওপারের অন্য মেয়েগুলাও আর অন্য বৌঝিরাও তাকে দেখে খালি লজ্জাই পাইতেছে তা না, কেউ কেউ অসময়ে মেয়েদের গোসল করা দেখতে হাজির হওয়া বেলাহাজ পুরুষ মানুষকে দেখে বিরক্তও হইতেছে। আর তখন সে অন্যদিকে ঘুরে পানিতে নামতে নামতে সাবেরা কাকীর কথা ভাবে।
তাদের পাশের বাড়ির সিরাজ কাকা যখন বিয়ে করে বউ নিয়া আসল তখন গ্রামে রীতিমতো হৈ চৈ পড়ে গেল। কারণ সিরাজের বউয়ের মতো সুন্দরী মেয়ে এই গ্রামের মানুষ কোনওদিন দেখেনাই। আর তখন সিরাজ কাকার মা বলে যে সাবেরা মিনহাজের বোন ইয়াসমিনের চাইতেও বেশি সুন্দর। তখন অনেকে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে। তারা সিদ্ধান্তে আসতে পারে না যে সাবেরা কাকীই বেশি সুন্দর নাকি ইয়াসমিনই বেশি সুন্দর। তখন সিরাজ কাকার আব্বা হেসে বলে যে ইয়াসমিন তো একটা বাচ্চা মেয়া। এখনই তার সুন্দর কী? আগে বড় হৈক। তখন সবাই হাঁফ ছাড়ে এবং ইয়াসমিনের বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
আর মিনহাজ যখন সিরাজ কাকার বউ সাবেরা কাকীকে দেখতে এসে এতোসব তর্কের মধ্যেও পলকহীনভাবে নতুন কাকীর দিকে তাকায়ে থাকে তখন নতুন কাকী তাকে হেসে কোলে তুলে নেয়। আর নতুন কাকীর কোলে চড়া তার কাছে তারপর থেকে ডালভাত হয়ে যায়। যখন তখন এসে সে কাকীর কোলে বসে পড়ে। আর নতুন কাকী তাকে গাল টিপে আদর করে দেয় আর সাপটে ধরে। আর কাকী সাপটে ধরলে তার হাঁসফাস লাগলেও ভালো লাগে।
এখন যখন মিনহাজকে গোসল করতে আসতে দেখে কাকী নদীর ঘোলা পানির তলে তার শরীর লুকায় আর বিরক্তি গোপন করার চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞাসা করে যে সে গোসল করতে আসছে কি না আর সে বলে যে হ কাকী, তখন সে মনে করার চেষ্টা করে, কবে শেষবার সে সাবেরা কাকীর কোলে বসছে।
সেটা তার মনে পড়ে না, খালি মনে পড়ে যে সে একবার সাবেরা কাকীর ঘরে ঢুকে দেখে যে কাকী তার এক বছরের ছেলেকে দুধ খাওয়াইতেছে আর মিনহাজকে দেখেও সে খোলা বুক আড়াল করেনাই। আর তখন মিনহাজ কাকীর খুব কাছে গিয়ে বসে বসে দেখে যে কাকীর এক বছরের ছেলে চোখ বন্ধ করে চুষে চুষে একটা দুধ খায় আর একহাত দিয়ে আরেকটা দুধ ধরে রাখে। আর তখন সে বুঝতে পারে, সে আসলে কাকীর ছেলের দুধ খাওয়া দেখে না, কাকীর ভীষণ স্ফীত আর ফর্সা বুক দেখে। দেখতে তার ভালো লাগে। আর তখন কাকী হেসে জিজ্ঞাসা করে যে মিনহাজও খাবে কি না। আর তখন মিনহাজের লজ্জা পাওয়া দেখে কাকী দুলে দুলে হাসতে থাকে। আর তখন মিনহাজ দেখে যে কাকীর ভীষণ স্ফীত ও ফর্সা বুকও সেই সাথে দুলতেছে।
আর এখন মিনহাজ নদীর ঘোলা পানিতে দাঁড়ায়ে কল্পনায় সাবেরা কাকীর বুকের সেই কম্পন দেখতে পায় আর তার লজ্জা লাগে। আর তার ভালোও লাগে। ভালো লাগা ছাড়াও অন্য একটা কিছু সে তার শরীরের মধ্যে টের পায় কিন্তু ব্যাপারটা সে বুঝতে পারেনা। ব্যাপারটা তার অচেনা। আর তখন মিনহাজ টের পায় যে সে মুখ তুলে সাবেরা কাকীর দিকে তাকাইতে পারতেছে না। আর তখন সে বিব্রত হয়ে ভাবে যে তার হয়ত এখন চলে যাওয়া উচিত। সে সিদ্ধান্ত নেয়, কোনওদিকে না তাকায়ে খুব দ্রুত দুই তিনটা ডুব মেরে সে উঠে চলে যাবে। আর তখন তার মনে পড়ে, তারা নতুন বাড়িতে আসার পর আর সাবেরা কাকীর বাড়িতে যায়নাই।
তখন মিনহাজের মনে হয়, তারা নতুন বাড়িতে চলে আসার পর আর তার বোনের মামার বাড়িতে চলে যাবার পরই সে আসলে বড় হয়ে গেছে। আর তখন তার মনে একটা প্রশ্ন উদয় হয়, মানুষ কত দ্রুত বড় হয়? আর তখন সাবেরা কাকী মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার বোন কবে আসবে?’ কাকী আরও জিজ্ঞাসা করে যে তারা তার বোনের বিয়ে দিবে কি না। মিনহাজ কোনও জবাব দিতে পারেনা। সে কিছুটা হাসে আর কিছুটা আমতা আমতা করে। আর তখন সে দেখে যে কাকী গোসল শেষ করে চলে যাইতেছে। আর তখন সে আরেকটু দেরি করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তার মনে পড়ে, বিকালের দিকে সাবেরা কাকীর বাড়িতে গেলে সে দেখছে সাবেরা কাকী মাত্র গোসল করে এসে কাপড় বদলাইতেছে। আর তখন মিনহাজ আবারও তার শরীরের মধ্যে সেই অচেনা অনুভূতিটা টের পায়। সে বুঝতে পারে যে কাকীর কিছু কিছু বিষয় নিয়া ভাবলেই তার মধ্যে একটা ব্যাপার ঘটতেছে। তার কেন জানি মনে হয় ব্যাপারটা ছোটদের না, বড়দের। কারণ যখন সে ছোট ছিল তখন সে এই ব্যাপারগুলা টের পায়নাই। আর সেইদিন তার মনে হয়, তাহলে সে হয়ত বড় হয়ে যাইতেছে আর বড় হয়ে যাওয়া খুব খারাপ না। আর তখন তার মনে হয়, সাবেরা কাকী আসলেই খুব সুন্দর। আর তখন তার মনে হয়, তার বোন ইয়াসমিনকে এখন দেখলে সিরাজ কাকার আব্বা কিংবা গ্রামের অন্যান্যরা সিদ্ধান্ত নিতে পারত যে ইয়াসমিন বেশি সুন্দর নাকি সাবেরা কাকী বেশি সুন্দর।
তখন মিনহাজ নতুন করে নিজের হাত পা, বুকের ছাতি আর কোমরের দিকে তাকায়। প্রথমবারে মতো সে খেয়াল করে তার শরীর বেশ বাড়ন্ত। মোষের শক্তি সে টের পায় তার বাহুতে। সেদিনই প্রথম সে বড়াল নদীর ঘোলা পানির নিচে তার বাহুসন্ধি আর উরুসন্ধিতে নতুন গজানো চুল আবিষ্কার করে। সে বড় অবাক হয়। আর সে বড়াল নদীর দুইপাড়ে গোসল করতে বা কাপড় ধুইতে বা পানি নিতে আসা পরিচিত, মুখচেনা আর অপরিচিত নানা বয়সের মেয়েদের চোখের সামনে একলা বড় লজ্জা বোধ করে। আর আলগোছে নদীর ঘোলা পানির নিচে আরও হাতখানিক তলায়ে গিয়া সে তার পৌরুষ আড়াল করে।
বিকালবেলা ঘরের বারান্দায় বসে সে ব্যাপারটা আবার ভালো করে ভাবে। তার ভাবতে ভালো লাগে যে তার বড় হয়ে যাওয়ার সাথে সাবেরা কাকীর সৌন্দর্যের হয়ত একটা সম্পর্ক আছে। তবে সম্পর্কটা গোপন। কেন গোপন তা সে বুঝতে পারেনা, তবে তার মনে হয় সে এই কথাটা, তার বড় হয়ে যাবার কথাটা সে আসলে কাউকে বুঝায় বলতে পারবেনা। আর তখন সে ভাবে যে তাহলে মানুষ বড় হয় ক্যান? আর যারা বড় হয় তাদের তাহলে লজ্জা লাগেনা ক্যান?
আর তখন তার মা ঘর থেকে তাকে ‘মিনহাজ’ বলে ডাক দেয়। আর সে ‘কী’ বলে সাড়া দিলে তার মা ঘরের ভেতর থেকে বলে, রশীদ কন্টাক্টার আজকে সপ্তাহের বেতন দিবে, মিনহাজ জানি দেরি না করে যায় আর চাতালে ম্যানেজার স্যারের সাথে দেখা করে বলে যে তার মা’র খুব অসুখ। আর বেতনডা নিয়া জানি সে বাজার কইরা আসে। আর বেশি টাকা জানি মিনহাজ খরচ না করে। আর বাকী টাকাডা জানি সে মায়ের হাতে দেয়। আর তখন মিনহাজ মা’র ঘরে আসে। আর তখন মা’র জন্য তার খুব কষ্ট লাগে। সে তখন দেখে যে তার মা খুব শুকায়ে গেছে।
মিনহাজ তার মাকে বলে, তার আর কষ্ট করে রশীদ কন্টাক্টারের চাতালে কাজ করতে যাওয়া লাগবেনা, মিনহাজ এখন থেকে টাকা উপার্জন করবে। তখন তার মা হাসে। তখন মা’র সেই হাসি দেখে তার মনে হয়, মা হয়ত এতোদিনে বুকে কিছুটা বল পায়। তার মা’র হাসির মধ্যে একটা ভরসার চিহ্ন দেখে সে। তখন তার এক ধরনের গর্ব হয়। আর তখন সে টের পায় এই অনুভূতিটাও তার কাছে নতুন। সে বুঝতে পারে, সে সম্ভবত কয়েকদনি ধরেই প্রতিদিন একটু একটু করে বড় হয়ে যাইতেছে।
তার আরও আগেই বড় হওয়া উচিত ছিল, তাইলে তার মা আর দাদীকে এতোটা কষ্ট করতে হইতনা, আর তার বোনকেও মামার বাড়ি গিয়া থাকতে হইতনা। তার মনে হয়, বুবু তাইলে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যায়নাই। হয়ত চারজন মানুষের খাওয়াপরার মতো যথেষ্ট আয় তার মা করতে পারেনা বলে তার মা হয়ত কায়দা করে বুবুকে মামার বাড়ি পাঠায়ে দিছে। আর তখন সহজ সরল আর খুব সুন্দর বুবুটার জন্য মিনহাজের বুকের মধ্যে কেমন জানি করে। আর সে প্রথমবারের মতো টের পায়, সে তার বুবুর জন্য কেমন একটা দায়িত্ব বোধ করতেছে। আর তখন সে ভাবে, সে তাহলে বড় হয়ে গেছে।
আর তখন তার মা জিজ্ঞাসা করে, মিনহাজ কী করবে। মা’র প্রশ্ন সে প্রথমে বুঝতে পারেনা। তখন মা বলে সে যে এইমাত্র বলল সে আয় করে তার মা ও দাদীকে খাওয়াবে, সে কী কাজ করবে? আর তখন সে কোনও জবাব দিতে পারেনা। আর জবাব দিতে পারেনা বলে তার খুব কষ্ট হয়। এইমাত্র বড় হয়ে যাবার অনুভূতির গর্ব আর সুখ তার ধূলায় লুটায় পড়ে।
সেইদিন রশীদ কন্টাক্টারের চাতালে তার মা’র টাকা তোলার সময় ম্যানেজার স্যারকে মিনহাজ জিজ্ঞাসা করে যে, সে তার মা’র বদলে কাজ করতে পারবে কি না। তার পক্ষে সাফাই হিসাবে মিনহাজ বলে যে মা তো অসুস্থ, মা’র গায়ে বল নাই, কিন্তু তার গায়ে অনেক বল আছে, সে মা’র ডাবল কাজ করতে পারবে। তখন ম্যানেজার স্যার সম্মতি দিয়ে বলে যে, ‘হয়, তোর মাও সত্যই খুবই রোগা। আরো আগেই বেটিরে বাদ দেয়া হইত।’ ম্যানেজার স্যার আরও বলে, তাদের পরিবারে আয় করার মতো কেউই নাই, এইসব বলে কান্নাকাটি করার কারণে রশীদ কন্টাক্টার তারে রাখছিল। কিন্তু তারে যে টাকা দেয়া হইতেছে তার পুরাটাই লস। কারণ তার মা কোনও কাজই করতে পারেনা। আর মিনহাজের চাকরি সম্পর্কে ম্যানেজার স্যার বলে যে মিনহাজ এখনও অনেক ছোট, তার গায়ে বল যতই থাকুক সরকারী নিয়ম অনুযায়ী কোনও শিশুকে তারা কাজ দিতে পারবেনা। এতে পুলিশ এসে ম্যানেজারকে ধরে নিয়ে যাবে।
এই কথা শোনার পর মিনহাজের একসাথে অনেক কথা মনে হয়। তার মা যে আরও অনেকদিন ধরেই অসুস্থ্য সেই কথাটা আজই প্রথম জানতে পারে সে। সে ক্যান তাইলে এতোদিন মা’র দিকে একবারও তাকায়ে দেখেনাই? এখানে যদি সে কাজ করতে না পারে, তাইলে কী কাজ সে করতে পারে যা দিয়ে সে, মা, দাদী আর তার বোন ইয়াসমিন তিন বেলা খাইতে, পরতে পারবে? সে দেখছে, বড়াল নদীর ওপারে মানুষ কাবিখা-র মাটি কাটে, আর দিনশেষে একশ বা একশ বিশ টাকা পায় আর কয়কেজি জানি গম পায়। সে তাইলে মাটি কাটা শিখবে।
আর তখন সরকার আর পুলিশের উপর তার চরম রাগ হয়। তারা যে মিনহাজকে কাজ করতে দিবে না, তাইলে কি তারা তাদের বাড়ি আইসে খাবার দিয়া যাবে? তখন সে সরকার আর পুলিশকে খারাপ একটা গালি দেয়। গালি দেবার পর তার কিছুটা ভালো লাগে আর তারপর গালি দেবার জন্য তার কিছুটা খারাপ লাগে।
এক ধরা চাল আর একটা মিষ্টি কুমড়া কিনে বাড়ি আসলে মিনহাজ ভীষণ অবাক হয়ে দেখে যে তার বুবু আসছে। সে খুবই খুশী হইতে চায় কিন্তু এক অজানা অভিমানে তার বুক ভার হয়ে আসে। সে আর খুশী হইতে পারেনা। সন্ধ্যা গড়ানোর পর মিনহাজ টের পায় দাদীও খুশী হয়নাই, মাও না। বুবু টাকা নিয়া আসছে। অনেক টাকা। টাকাটা বুবু মা’র হাতে দিছে তবে দাদীকে গোপন করে। তখন মিনহাজ ভাবে, তার মতো তার দাদীরও হয়ত অভিমান হইছে, কিন্তু সে জানে, তার মতোই দাদীও মনে মনে অনেক খুশী হইছে।
কিন্তু সন্ধ্যাটা রাতে পরিণত হওয়ার আগেই সে টের পায় ব্যাপারটা তা না। তার দাদী তার এতো সুন্দর বুবুকে তার শরীর স্পর্শও করতে দেয়নাই। তখন মিনহাজের খুব কষ্ট লাগে। কারণ মিনহাজ দেখছে, দাদী বুবুকে আগেও বকত, উঠতে বসতে বকত। আর বুবু খুব হাসত। দাদীর বকা তার গায়ে লাগতনা। দাদী বকত আর বুবু দাদীকে পেছন থেকে গিয়া জড়ায়ে ধরত। দাদী তখন ধমক দিয়ে ‘ছাড়, মুখপুড়ী ছাড়!’ বললেও কিছুক্ষণ পর হেসে ফেলত। মিনহাজ প্রথম ভাবে, বুবু হয়ত এক্ষুণি দাদীকে পেছন থেকে জড়ায়ে ধরবে। তখন তার দাদী কী বলে কিংবা কী করে সেটা দেখার জন্য মিনহাজ দরজার বাইরে দাঁড়ায়ে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বুবু যখন মন খারাপ করে ঘুরে বের হয়ে আসে তখন মিনহাজের বুক ভেঙে যায়। সে বুঝতে পারেনা, বুবু ক্যান তার দাদীকে পেছন থেকে জড়ায়ে ধরলনা, জড়ায়ে ধরলেই তো দাদীর আর রাগ থাকত না, এই সহজ কথাটা কি বুবু ভুলে গেল?
আর তখন মিনহাজ লক্ষ করে বুবুর হাতে চায়ের কাপ। তাদের বাড়িতে কতদিন চা বানানো হয়নাই। তারা এই বাড়িতে আসার পর সম্ভবত একদিন বুবু আল্লাদ করে চা বানাইছিল আর দাদী খুব বকছিল। তখন মিনহাজ বুঝতে পারেনাই বুবুর চা বানানোতে কী অপরাধ হইছে। আর আজ সন্ধ্যায় সে বুঝতে পারে তারা গরিব হয়ে যাওয়ার কারণে চা খাওয়া দাদীর কাছে সেদিন বিলাসিতা মনে হইছিল।
কিন্তু আজকে তো বুবুই চাপাতা কিনে আনছে। তাইলে দাদীর চা খাইতে আপত্তি কোথায় ছিল? আর সে কিছুতেই বুঝতে পারেনা, দাদী বুবুর হাতের চাটা ধরেও দেখলনা ক্যান। বুবু অনেকদিন পর আসছে দেখে দাদীর অভিমান হইছে- ব্যাপারটা যে এত সরল না, এই কথা তাকে কারও বুঝায় বলার দরকার পড়লনা। পুরো ব্যাপারটা সে বুঝতে পারল না বলে তার একবার শুধু মনে হলো, সে যথেষ্ট বড় হয়নি।
আর বুবু দাদীর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অপমানে জর্জরিত চেহারা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়েই দেখতে পায় যে মিনহাজ সোজা তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়ে আছে। আর তখন সে দেখতে পায় বুবুর চেহারা দ্রুত বদলায়ে যায়। তখন বুবু তাকে দেখে হাসে আর জিজ্ঞাসা করে, সে চা খাবে কি না। আর তখন সে কিছু বলার আগেই ইয়াসমিন হেসে বলে, তুই চা খাবি কি, তুই তো ছোট। আর তখন সে বুবুকে খুলে বলতে পারেনা যে গত দুইতিন দিনে সে কিভাবে বড় হয়া গেছে। আর তখন এই কথা বলতে না পারার কারণে তার গলা প্রচণ্ড ভার হয়ে আসে। আর তখন বুবু তার হাত ধরে উঠানের কোণায় ডালিম গাছটার কাছে নিয়া যায়।
মিনহাজ বুঝতে পারে বুবু তাকে কিছু বলবে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু। আর তখন তার ভাবতে ভালো লাগে যে তাহলে বুবু বুঝতে পারতেছে যে সে বড় হইছে, তাকে সে কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে। আর ডালিম গাছের কাছে পৌঁছানোর আগেই ইয়াসমিন যখন ভাঙ্গা গলায় বলে যে, ভাই, আমারে বড়াল ব্রিজ স্টেশনে দিয়া আসতে পারবি? তখন মিনহাজ এই কথার উত্তরে কোনও কথা বলতে পারেনা। আর বুবু তার হাতের যে জায়গায় ধরে রাখছে সেইখানে তার পুড়ে যাইতে থাকে। আর তখন মিনহাজের মনে হয় সাবেরা কাকীও তার সাথে কথা বলার সময় এইভাবে তার হাত ধরে রাখত আর কাকীর কথার চেয়ে হাতে তার স্পর্শই তখন প্রধান হয়ে পড়ত। আর তখন সেই সন্ধ্যাবেলা ডালিম গাছের কাছে দাঁড়ায়ে মিনহাজের মনে হয় যে তার বুবু সাবেরা কাকীর চেয়ে হাজার গুণ সুন্দর। তখন সে বুঝতে পারে, সে সত্যিই বড় হয়ে যাইতেছে, কারণ বুবুর এই সৌন্দর্য্য কোনওদিন তার চোখে পড়েনাই। কারণ তখন সে ছোট ছিল।
একটু পরেই অবশ্য ইয়াসমিন হেসে ফেলে বলে যে, সে ঠাট্টা করতেছে। কিন্তু মিনহাজ তার বুবুর মুখে একটু আগে এক মুহূর্তের জন্য ভেসে ওঠা তীব্র একটা বেদনার ছাপ ভুলতে পারেনা। আর তখন সে বুঝতে পারে, বুবুর ওই মুখ সে সারাজীবনেও ভুলতে পারবেনা। আর তখন বুবু মিনহাজকে ভর সন্ধ্যাবেলা ডালিম গাছের কাছে একলা দাঁড় করায় রেখে মা’র ঘরে চলে যায়।
বাড়িতে এতোসব ঘটনা ঘটে গেলেও কেন জানি মিনহাজ এইসব বিষয় নিয়ে কারও সাথে কোনও কথা বলেনা। সে শুধু টের পায় তার মধ্যে শিশুসুলভ প্রগলভতা আর নাই, বরং সে অনেক গম্ভীর। আর তখন সে টের পায়, সে আসলে বড় হয়ে যাইতেছে। আসলে গত দুই তিন দিনের ব্যবধানে মিনহাজকে ছেড়ে গেছে তার রঙিন শৈশব।
আর বুবু তাকে ভুল বোঝে। বুবু ভাবে মা আর দাদীর মতো মিনহাজও বোধহয় তার উপর রাগ করছে। বুবু তাকে রাতে খেতে বসে জিজ্ঞাসা করে, তুইও আমার উপর রাগ করছিস, না? তখন সে হাসির মতো মুখ করে বলে যে, ‘আরে না।’ কিন্তু তার মুখের মধ্যে ভাত থাকায় ‘আরে না’ কথাটা একটা গরগর শব্দের মতো শোনায়। আর সে স্পষ্টই বুঝতে পারে তার মুখে হাসিটাও ঠিকমতো ফোটেনাই। বুবু তার দিকে সোজা চোখে তাকায়ে থাকে। ভাইয়ের চোখে মুখে হয়ত সে কিছু খোঁজে। কে জানে সে তা পায় কি না, তবে মিনহাজ আর তার বুবুর চোখের দিকে তাকায় থাকতে পারেনা। সে ঘাড় নিচু করে ভাতের দিকে তাকায়। আর দেখে তার প্লেটের ভাতগুলা ঝাপসা হয়ে আসতেছে। আর তার গলাও বুজে আসতে থাকে। ভাত গিলতে তার বড় কষ্ট হইতে থাকে। কিন্তু সবকিছু ছাপায়ে মিনহাজের মনে হয় বুবুকে এইসব বুঝতে দেওয়া তার উচিত হইতেছেনা। বুবুর উপর যে সে রাগ করেনাই তা প্রমাণ করার জন্য তার এখন খুবই হাসিখুশী থাকা উচিত, হয়ত বুবুর সাথে কিছু ঠাট্টা মশকরাও করা উচিত। আর তখন সে বুঝতে পারে না, কেন মানুষ সবসময় তার মনের কথা সরাসরি প্রকাশ করতে পারে না। কেন তাকে মনের বিপরীত অনুভূতি সবসময় প্রকাশ করতে হয়। এটা তো সহজ না। খুবই কঠিন। বুবু কি জানে, কতটা কঠিন?
রাতে দাদীর ঘর থেকেই মিনহাজ তার মা’র প্রায় নিঃশব্দ কান্না শুনতে পায়। সে একটু বোঝার চেষ্টা করে যে তার দাদী তা শুনতে পারতেছে কি না। তার মনে হয় যে তার দাদীও শুনতেছে। কিন্তু দাদীর মধ্যে কোনও নড়াচড়া সে দেখতে পায়না। নড়াচড়া না দেখলেও তার দাদী ঘুমায় গেছে তা তার মনে হয়না। সে বুঝতে পারে, আজ রাতে তাদের বাড়ির প্রতিটা প্রাণী জাগনা। কেউ ঘুমাইতে পারতেছে না। কিন্তু সবাই সবাইরে বুঝাইতেছে সে ঘুমায়ে আছে। মিনহাজ বুঝতে পারে, এইটাই বড়দের স্বভাব।
সকালবেলা বড়াল ব্রিজ স্টেশনে এসে মিনহাজ আর ইয়াসমিন জানতে পারে যে আজকে ট্রেন লেট। মিনহাজ একবারও ইয়াসমিনকে জিজ্ঞাসা করতে পারেনা যে, তার কুষ্টিয়া না গেলে চলে কি না। এখন থেকে ইয়াসমিন তাদের সাথে থেকে যায়না ক্যান? এখন তো মিনহাজ মনস্থির করেই ফেলাইছে যে, সে কাজ করবে আর তার মাকে কোনও কাজ করতে দিবেনা। কিন্তু এসব কথার বদলে মিনহাজ জিজ্ঞাসা করে, কুষ্টিয়া কেমন করে যাইতে হয়। ইয়াসমিন বলে, আগে ঈশ্বরদী যাইতে হয়। সেইখান থেকে খুলনার ট্রেনে কুষ্টিয়া। তখন মিনহাজ বলে, সেও যাবে তার সাথে। তখন ইয়াসমিন একটু রেগে বলে, মিনহাজ কি আর বড় হবেনা? সে মা আর দাদীকে একলা ফেলে কিভাবে যাইতে চায়? মা আর দাদী তো তার মুখের দিকেই তাকায়ে আছে। তখন বুবুকেও অনেক পাল্টা অভিযোগ করতে ইচ্ছা করে মিনহাজের, কিন্তু সে কিছুই বলতে পারেনা।
আর তখন ইয়াসমিন আগায়ে এসে মিনহাজের হাত ধরে। আর প্রথমবারের মতো সে বুঝতে পারে, তার বুবুর হাত বড় নরম। সে এও বুঝতে পারে, তার বোনটা বড়ই সহজ সরল আর বড়ই দুঃখী। সে বুঝতে পারে, বোনের দুঃখও তাকেই দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে। তখন সে বুবুকে জিজ্ঞাসা করে, কুষ্টিয়ায় সে যে মামার বাড়িতে থাকে সেই মামার নাম কী? তারা কেমন? তারা বুবুকে ভালোবাসে কি না। আদর করে কি না। হেসে কথা বলে কি না। খাবার সময় হইলে খাইতে ডাকে কি না। আর তখন ইয়াসমিন খুবই অবাক হয়ে মিনহাজকে বলে, তুই তো বড় হয়ে গেছিস রে ভাই! এতো কথা কি তুই নিজের থেকে বলতেছিস? তখন মিনহাজ বলে, সে সবসময়ই এইসব চিন্তা করে, কারণ মাকে জিজ্ঞাসা করলে মা কোনওসময় বলেনা, তুই কোন মামার বাড়িতে থাকিস। মা কোনও কথাই বলে না এই বিষয়ে।
আর তখন ক্যান জানি ইয়াসমিন হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে যায়। সে অনেক চিন্তিত হয়ে পড়ে। তখন মিনহাজ বুঝতে পারে, তার বুবু কুষ্টিয়াতে বড় কষ্টে আছে। তখন সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে বুবুর সাথে গিয়া বুবুকে রেখে আসবে। আর তাদের মামাকে বলে আসবে, খুব অল্প দিনের মধ্যেই সে তার বুবুকে নিয়া যাবে। কারণ বুবুর বিয়ে ঠিক হইছে। সে তখন বুবুকে জানায়, সে তার সাথে যাবে। ইয়াসমিন মিনহাজের দিকে অনেক্ষণ তাকায়ে থাকে। কিন্তু সে তার বুবুর দিকে তাকায়ে থাকতে পারেনা। সে চোখ ফিরায়ে দেখে যে বড়াল ব্রিজ স্টেশনের চাপকলটা বাইরে থেকে দেখতে ঠিকঠাক মনে হইলেও পানি ওঠে না। নষ্ট।
ইয়াসমিন আর মিনহাজ গোয়ালন্দ স্টেশনে এসে নামে গভীর রাতে। আর বুবু যখন তাকে নিয়ে যখন পল্লীতে ঢোকে তখন তার জাঁকজমক দেখে মিনহাজ সাংঘাতিক অবাক হয়। অনেক উঁচু ভলিউমের গান, লোকের সরগরম, রাস্তার দুইপাশে সারি সারি দাঁড়ায়ে থাকা ভারী সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখে সে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে দেখে, মেয়েগুলা সবাই সাবেরা কাকীর চাইতেও সুন্দর। তাদের বুকও সাবের কাকীর চাইতে বেশি স্ফীত। তখন তার সামান্য সন্দেহ হয়, মেয়েগুলা হয়ত ইচ্ছা করেই এমনভাবে দাঁড়াইতেছে যাতে তাদের বুক বেশি উঁচু মনে হয়। কিন্তু সে তার এই সন্দেহের কোনও কারণ খুঁজে পায়না। তাই কি কোনওদিন হইতে পারে?
আর গলিগুলা এতো সরু যে হাঁটার সময় সেইসব মেয়েগুলাকে প্রায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাইতে হয়। সরু গলিতে স্পর্শ এড়ানোর কোনও জায়গা পায় না মিনহাজ। আর তার কেন জানি মনে হয়, মেয়েগুলা ইচ্ছা করেই তার গায়ে স্পর্শ করতেছে। কিন্তু এই কথা মিনহাজের বিশ্বাস হতে চায়না। তাই কি কোনওদিন হইতে পারে?
গলি দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ইয়াসমিন একটু পর পর মিনহাজকে দেখে। মিনহাজকে নিয়ে একটা বাড়িতে ঢোকার পর ইয়াসমিন এক মোটা আর জঘন্য চেহারার মহিলাকে দেখায়ে মিনহাজকে বলে যে, ‘আমার মা’। আর মিনহাজ চমকায়ে যায়। সে অবাক হয়ে বুবুর দিকে তাকায়। তার শুধু মনে পড়ে, তাদের মা বড় শীর্ণ। রোগা। ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে এখন সে শুয়ে আছে।
আর যখন বুবুর মা অনেক উঁচু আর কর্কশ গলায় জিজ্ঞাসা করে যে, যমুনা আবার কোন নাং ধইরা আনল। নাং তো এইটা দেহি এক্কেরে কচি। তখন বুবুও তার মা’র মতোই কর্কশ গলায় উত্তর দেয় যে, নাং না, তার ভাই। আপন ভাই। মায়ের পেটের ভাই। ভাইরে দেখাইতে আনছি, তার বইন কই থাকে। তখন মিনহাজ বুঝতে পারে না যে, যমুনা কে। তার বোনের নাম কি যমুনা নাকি?
তারপর ঘরের তালা খুলে ইয়াসমিন মিনহাজকে নিয়ে ঘরে ঢোকে। ইয়াসমিনের পেছন পেছন তার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তার মনে হয়, তার বুবুর গলা এতো কর্কশ কিভাবে হইল। তার বুবুর গলার স্বর তো খুবই নরম আর আদরমাখা। তাকে যখন বুবু ভাই বলে ডাকে, তখন কতই না ভালো লাগে তার। ভেতরে ভেতরে সে কোঁকড়ায়ে যেতে থাকে। সবকিছু তার কাছে অশুভ লাগে। তার মনে হয়, এসবই নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন। একটু পরেই তার ঘুম ভাঙলে খোঁজ নিতে যাইতে হবে কাবিখার মাটি কাটার কাজ কিভাবে পাওয়া যায়। তার বুবু কি তাকে মাটি কাটার কাজ করতে দিবে? বুবু হয়ত দিতে চাইবেনা, কিন্তু বুবুকে বুঝায় বলতে হবে যে, কাজ না করলে সে মা, দাদী আর বোনকে খাওয়াবে কেমন করে?
ইয়াসমিন যখন বলে যে, সে তার শরীর বিক্রি করে, তখন মিনহাজ তার অর্থ বুঝতে পারে না। তখন ইয়াসমিন তাকে বুঝাইতে বসে। আর তখন মিনহাজ দেখে, তার বোনের চোখে সাংঘাতিক একটা রাগ। কিন্তু সে খুবই নরম গলায় কথা বলে। হয়ত একটু বেশি নরম গলায় কথা বলে। চোখে রাগ নিয়ে কেমন করে নরম গলায় কথা বলা যায়, তা সে বুঝতে পারে না। তখন ইয়াসমিন জিজ্ঞাসা করে, গাঁয়ে তার কোনও মেয়েকে ভালো লাগে কি না। তখন সে লজ্জা পেয়ে বলে, মাষ্টারপাড়ার মন্টু মাষ্টারের মেয়ে সেতুকে তার ভালো লাগে। তখন ইয়াসমিন জিজ্ঞাসা করে, সেতুর হাত ধরতে তার ইচ্ছা করে কি না। তখন মিনহাজ মাথা আরেকটু নিচু করে বলে, করে। তখন ইয়াসমিন জিজ্ঞাসা করে যে, সেতুর সাথে আর কিছু করতে ইচ্ছা করে কি না? তখন মিনহাজ চোখ তুলে ইয়াসমিনের দিকে তাকায়, তার চোখে হয়ত প্রশ্ন ফুটে ওঠে। তখন ইয়াসমিন আরেকটু রেগে যায়, তবু কণ্ঠস্বর নরম রেখেই জিজ্ঞাসা করে যে, সেতুর সাথে তার শুইতে ইচ্ছা করে কি না, সেতুর বুক আছে কি না, সেতুর বুকে তার হাত রাখতে ইচ্ছা করে কি না। তখন মিনহাজ তার ভেতরে কোথাও নিয়ন্ত্রণ হারায়ে ফেলে। সে তখন বুবুকে গড় গড় করে বলে ফেলে, সেতুর বুক নাই, কিন্তু সাবেরা কাকীর বুক খুব সুন্দর। সাবেরা কাকীর বুক দেখতে তার ভালো লাগে। কিন্তু কোনওদিন ধরে দেখার কথা তার মনে হয়নাই। এইটুকু বলতে মিনহাজের দম ফেটে যায়। লজ্জায় সে নিচু হয়ে যায়। বুবুর সামনে সে এই খারাপ কথা কিভাবে বলল? মিনহাজ বড় অবাক হয়।
অনেক্ষণ পর ইয়াসমিন বলে, সে দুনিয়ার লোককে তার বুক ধরতে দেয়, লোকগুলাকে তার ঘরে এসে তার বিছানায় তার সাথে শুইতে দেয়, তার শরীর নিয়ে সবকিছু করতে দেয়। তার বিনিময়ে লোকগুলা তাকে টাকা দেয়। আর মিনহাজ আসার সময় যে গলিতে হাজার হাজার মেয়ে দাঁড়ায়ে থাকতে দেখছে তারা সবাই তার মতো এই কাজ করে। লোকেরা বাইরে থেকে এসে মেয়ে পছন্দ করে তার ঘরে যায়। কাজ শেষ হইলে তারা টাকা দেয়।
ইয়াসমিন অনেক্ষণ চুপ করে থাকে। মিনহাজও চুপ করে থাকে। আরও অনেক্ষণ পর ইয়াসমিন বলে, এই টাকাই সে বাড়িতে পাঠায়। সে এইসব কাজ করে বলে দাদী তাকে ঘেন্না করে। কিন্তু মা তার টাকা নেয়। মা তাকে ঘেন্না করে কি না তা সে জানেনা। কিন্তু মা তাকে আর আগের মতো জড়ায়ে ধরেনা। ইয়াসমিনের খুব ইচ্ছা করে যে মা তাকে একবার জড়ায়ে ধরুক, আর দাদী তাকে জড়ায়ে না ধরুক, একবার তাকে জড়ায়ে ধরতে দিক। এখন মিনহাজ বলুক যে, সবকিছু জানার পর মিনহাজ তার বুবুকে ঘেন্না করতেছে কি না।
মিনহাজের প্রথমে কান্না আসলেও ধীরে ধীরে সেই কান্না চলে যায়। তার খুব রাগ হয়। কিন্তু কার উপর রাগ তা সে বুঝতে পারেনা। বুবুর খাটের উপর বসে সে ভেবে বের করতে চেষ্টা করে যে কার উপরে তার রাগ হওয়া উচিত। একটা প্রতিপক্ষকে সে সামনা সামনি দাঁড়া করাতে চায়, হয়ত সেই প্রতিপক্ষের উপর সে ঝাঁপায়ে পড়তে চায়। আর তার বুবু কোনওভাবেই সেই প্রতিপক্ষ না। তার বুবু বড় সহজ সরল। তার আব্বার উপর তার রাগ হয়, রশীদ কন্টাক্টারের চাতালের ম্যানেজার স্যারের উপর তার রাগ হয় আর রাগ হয় পুলিশ ও সরকারের উপর।
পুলিশ ও সরকার মানে কী মিনহাজ তা জানেনা কিন্তু তাদের উপর তার খুব রাগ হইতে থাকে। তারা ক্যান মিনহাজকে কাজ দিতে চাতালের ম্যানেজারকে নিষেধ করছে? তারা কি বোঝেনা যে তার মা অসুস্থ, দাদীটা বুড়া আর বোনটা খুব সুন্দর আর খুব নরম স্বভাবের। তাইলে তাদের খাওয়া পরার জন্য মিনহাজকে তো কাজ করতেই হবে। এই সরল কথাটা ক্যান পুলিশ বুঝতে পারেনা? তার মনে হয়, পুলিশ মানে কি সে তা জানে না। হয়ত বড় হইলে সে জানতে পারবে। তাইলে কি সে বড় হয়নাই? ম্যানেজার স্যারও বলছলি, সে বড় হলে তাকে তারা কাজ দিতে পারত। তাইলে সে কি যথেষ্ট বড় হয়নাই?
বুবুর প্রশ্নের উত্তর আর দেওয়া হয়না। বরং তার বুকের মধ্যে ক্রোধের আগুন পাকায়ে উঠতে থাকে। এক অজানা আক্রোশে তার দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে। আর সে তার হাতে পায়ের পেশিতে অমিত শক্তি অনুভব করে। তার মনে হয় সে পারবে।
তার আসলে আরও আগেই বড় হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। তাহলে অনেক কিছুই ঘটত না। সে ঘটতে দিত না। আর ঠিক তখন বুবু আরও ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, তাহলে মিনহাজ এখন বলুক, সে তাকে ঘেন্না করে কি না।
আর তখন মিনহাজ দেশ কাল অতিক্রম করে বুবুর সামনে ফিরে আসে। সামান্য হাসার চেষ্টা করতে করতে সে কোনওরকমে বলে যে ‘আরে না’। কিন্তু ঠিক তখনই তার গলায় কী জানি হয়। সামান্য ‘আরে না’ কথাটাও অর্ধেক বের হয় আর অর্ধেক ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে চাপা পড়ে যায়। তার কথার অর্থ কিছুই বুঝা যায় না। সে নিজেও তা বুঝতে পারে। আর তখন সে দেখে, বুবু তার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে জবাবের অপেক্ষায় তাকায়ে আছে। আর তখন বুবুর জন্য তার খুব মায়া লাগে। মনে হয়, সে আসলে যথেষ্ট বড় হয়নাই, যতখানি বড় হলে সে একজন প্রতিপক্ষকে সামনে দাঁড় করাইতে পারত আর সবকিছুর জন্য তাকে দায়ী করে তার জবাব চাইতে পারত, আর বুবুকে এখান থেকে নিয়ে যাইতে পারত। আর এই কথা মনে হওয়ার সাথে সাথে মিনহাজের সব রাগ পানি হয়ে যায়। আর তখন সে কাঁদতে থাকে।